E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭

বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে দেশব্যাপী কয়লা শিল্পে তিনদিনের সফল ধর্মঘট

শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ হুঁশিয়ারি কেন্দ্রীয় সরকারকে


ছত্তিশগড়ে বন্ধ কোলিয়ারি।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দেশের অমূল্য খনিজ সম্পদ কয়লা শিল্পে বেসরকারিকরণের প্রতিবাদে দেশব্যাপী ৭২ ঘণ্টা ধর্মঘট সফল করে কেন্দ্রের মোদী সরকারকে যোগ্য জবাব দিলেন কয়লা শ্রমিকরা। ২ জুলাই থেকে ৪ জুলাই টানা ৩দিনের ধর্মঘটের মধ্য দিয়ে কয়লা শ্রমিকরা বুঝিয়ে দিলেন তাঁরা কিছুতেই দেশের কয়লা সম্পদকে কর্পোরেট মুনাফার জন্য বিকিয়ে দেবেন না। দ্বিতীয়বারের জন্য দেশের ক্ষমতা দখল করে দেশি-বিদে‍‌শি বৃহৎ পুঁজির মালিকদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কেন্দ্রের মোদী সরকার আরও আগ্রাসীভাবে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র বেসরকারিকরণের উদ্যোগ নেয়। বর্তমানে চলা করোনা বিপর্যয়ের সময়কে কা‍জে লাগিয়ে আরও অন্যান্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রের মতো অমূল্য জাতীয় সম্পদ ক‌য়লা ক্ষেত্রকেও কমার্শিয়াল মাইনিং বা বাণিজ্যিক খননের নামে বেসরকারি মালিকদের হাতে তুলে দেবার চক্রান্ত করে কেন্দ্রের সরকার। লকডাউনের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দেশে আত্মনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার নামে দেশের কয়লা খনির ঢালাও বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে ৪১টি কয়লা ব্লকের নিলাম ঘোষণা করেন। তাতে মজুত রয়েছে ২২৭৩ কোটি টন কয়লা। এর ফলে দেশ আত্মনির্ভর হবার বদলে মোদী তথা বিজেপি ঘনিষ্ঠ বেসরকারি মুনাফার কারবার প্রশস্ত হবে। তার বিরুদ্ধেই টানা ধর্মঘট করে প্রতিবাদ জানালেন কয়লা শ্রমিকরা।

তিন‍‌দিনের এই ধর্মঘটে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে ছড়িয়ে থাকা কয়লা খনিতে যুক্ত ৫.৩ লক্ষ শ্রমিক শামিল হন। দিনে গড়ে ১৫ লক্ষ টন কয়লা উত্তোলন হয়। কিন্তু টানা তিনদিনের সফল ধর্মঘটের জেরে ১ টনও কয়লা উত্তোলন হয়নি। কোল ইন্ডিয়ার অধীন ইস্টার্ন কোলফিল্ড, ভারত কোকিং কোল, সেন্ট্রাল কোল ফিল্ড, ওয়েস্টার্ন কোল ফিল্ড, সাউথ ইস্টার্ন কোল ফিল্ড, নর্দার্ন কোল‍‌ ফিল্ড, মহানদী কোল ফিল্ড, নর্থ ইস্টার্ন কোল ফিল্ড, সিঙ্গারেনি কোল ফিল্ড প্রভৃতি সমস্ত অনুসারি শিল্পেই সফল ধর্মঘট হয়েছে। কিন্তু লক্ষণীয় ঘটনা হলো, দেশের প্রতিটি কোলিয়ারি খাদানে ঝান্ডা নির্বিশেষে মজুররা ধর্মঘটে অংশ নিলেও একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল তৃণমূল শাসিত পশ্চিমবঙ্গ। বাইরে যতই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার-বিরোধী ভূমিকা দেখাক না কেন, এই দলের শ্রমিক সংগঠন আইএনটিটিইউসি ছিল ধর্মঘটের বাইরে। এরা দেশের সম্পদ, শ্রমিক স্বার্থ দেখার পরিবর্তে ইস্টার্ন কোল ফিল্ডের একের পর এক কোলিয়ারিতে পুলিশ নিয়ে ধর্মঘট ভাঙতে আসরে নামে। কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিবাদী মনোভাবের ফলে সুবিধা করতে পারেনি। সর্বত্রই ধর্মঘট সফল হয়েছে।

৪ জুলাই তিনদিনের টানা কয়লা শিল্পে ধর্মঘট সফল হবার পর কয়লা শিল্পের সমস্ত শ্রমিক সংগঠন ও ফেডারেশনগুলি বৈঠক করে প্রাথমিকভাবে স্থির করেছে, কেন্দ্র কয়লা শিল্প বেসরকারিকরণের ব্লক নিলাম বাতিল না করলে ১৮ আগস্ট ফের কয়লা শিল্পে ধর্মঘট হবে। এদিন কয়লা শি‍‌ল্পে ধর্মঘট সফল হওয়ায় অভিনন্দন জানিয়ে সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক তপন সেন বলেছেন, শ্রমিক ইউনিয়ন ও ফেডারেশনের যৌথ মঞ্চের ডাকে তিনদিনের ধর্মঘট ছিল সর্বাত্মক। সমস্ত খনিতে কয়লা উত্তোলন ও তা সরবরাহের কাজ পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে যায়। যদিও ধর্মঘট বানচালে তৎপর ছিল কেন্দ্রীয় সরকার ও তার দালাল বাহিনী। তবে সব ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে সফল হয়েছে ধর্মঘট। এই সময়ে বেশিরভাগ যানচলাচল বন্ধ হওয়ায় যাতায়াতে প্রতিবন্ধকতা থাকলেও ধর্মঘটে শ্রমিকদের অংশগ্রহণে কোনো বাধা পড়েনি। ধর্মঘটকে কেন্দ্র করে মিছিল সমাবেশে ব্যাপক অংশের শ্রমিক যোগ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, করোনা সংক্রমণ ও লকডাউনের পর বিপর্যস্ত অবস্থা শ্রমিকদের। তাঁদের আয়ের সংস্থান নেই, কাজ নেই। কয়লা শিল্পে ঠিকা শ্রমিকরা একই সঙ্কটে। এই চরম সঙ্কটের মধ্যে কয়লা শিল্পে বেসরকারিকরণে নিলামের প্রক্রিয়া চালু করে দিয়েছে মোদী সরকার। লকডাউনের বিধিনিষেধের সুযোগ নিয়েই গত ১৮ জুন নিলাম ডেকে বেসরকারিকরণের প্রক্রিয়া মোদী সরকার চালু করতেই সে রাতেই ধর্মঘটের নোটিশ দেয় শ্রমিক সংগঠন। তিনি জানান, এই ধর্মঘটে বিভিন্ন শিল্প শ্রমিকদের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন মিলেছে। খেতমজুর ও কৃষক সংগঠন এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছে। ‍‌তিনি আরও জানান, শ্রমিক ইউনিয়ন ও ফেডারেশন মঞ্চ কয়লা বেসরকারিকরণ রোধে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। নিলাম ও বাণিজ্যিকিকরণ রুখতে সরাসরি প্রতিরোধে নামার পরিকল্পনা নিয়েছে মঞ্চ। আরও জোরদার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কথা ভাবা হচ্ছে। প্রয়োজনে ফের ধর্মঘটের কথা আলোচনা হয়েছে বৈঠকে।

৪ জুলাই কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ যৌথ বিবৃতিতে কয়লা শিল্প শ্রমিকদের ধর্মঘট সফল করার জন্য অভিনন্দন জানিয়েছেন। কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলির মধ্যে রয়েছে সিআইটিইউ, আইএনটিইউসি, এআইটিইউসি, এইচএমএস, এআইইউটিইউসি, টিইউসিসি, এসইডব্লিউএ, এআইসিসিটিইউ, এলপিএফ এবং ইউটিইউসি। এই সংগঠনগুলির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কেন্দ্রের মোদী সরকার লকডাউনের মধ্যেই সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা বেসরকারিকরণে বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। কয়লা, প্রতিরক্ষা, রেল সব ঢালাও বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। রেলে যে রুটে সব থেকে বেশি মুনাফা হয়ে থাকে প্রথমে বেছে বেছে সেই ১৫১টি ট্রেন বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে। প্রতিরক্ষা ক্ষেত্রে ৪১টি অর্ডন্যান্স কারখানা কর্পোরেট করার নামে বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। দেশি-বিদেশি কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে রেল, প্রতিরক্ষা সহ বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা। কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগঠনগুলি জানিয়েছে, এই বেপরোয়া বেসরকারিকরণ রুখতে যৌথ আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করতে চলেছে কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলি। এখন থেকে চলবে বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে মঞ্চের যৌথ গেট সভা। প্রতিদিনই চলবে প্রচার।

লক্ষণীয় বিষ‌য় হলো, দেশজুড়ে কয়লা শিল্প শ্রমিকদের ধর্মঘটে প্রায় সমস্ত রাজ্য সরকারগুলো হয় নিরপেক্ষ ভূমিকা নিয়েছে, নতুবা প্রকাশ্যে কমার্শিয়াল মাইনিং-এর বিরোধিতা করে বিবৃতি দিয়েছে। ঝাড়খণ্ড সরকার কয়লা ব্লক নিলামের বিরোধিতা করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা দায়ের করেছে। ছত্তিশগড় সরকারও কয়লা ব্লক নিলামের বিরোধিতা করে। কিন্তু ব্যতিক্রম শুধু পশ্চিমবঙ্গ। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এবং তাঁর দলের শ্রমিক সংগঠন এই শিল্পে ধর্মঘটের বিরোধিতা করে। এদের নানা হুমকি, প্রলোভন, ভয়ভীতির বিরুদ্ধে কয়লা শ্রমিকদের একতা ও দৃঢ়তার ধর্মঘট প্রত্যক্ষ করে রানিগঞ্জ কয়লাঞ্চল। লাগাতার তিনদিনের সফল সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়েছে। এই অঞ্চলে ধর্মঘটের আগেরদিন থেকেই রাজ্যের শাসকদলের বাহিনী ধর্মঘট ব্যর্থ করার জন্য নেমে পড়ে। গায়ের জোরে ধর্মঘট ভাঙার জন্য রানিগঞ্জ কয়লাঞ্চলে বহিরাগতদের জড়ো করে। তা সত্ত্বেও ধর্মঘটকে স্তব্ধ করা যায়নি। ঝাঁঝরা কোলিয়ারিতে কর্তৃপক্ষ শাসকদলের বাহিনীর সাহায্যে কিছু ঠিকাশ্রমিক নামিয়ে বেআইনিভাবে কনভেয়ার বেল্ট চালু করে। ধর্মঘটী‍‌ শ্রমিকরা কর্তৃপক্ষের নিয়মবিরুদ্ধ কাজের তীব্র প্রতিবাদ করেন। এতে প্রতি‍হিংসাপরায়ণ হয়ে কর্তৃপক্ষ দু’জন ধর্মঘটীকে চাকরি থেকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে। পরে তীব্র শ্রমিক বিক্ষোভের জেরে কর্তৃপক্ষ বেআইনি সাময়িক বরখাস্তের নির্দেশ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। শ্রমিকরা খনিমুখো না হওয়ায় ধেমোমেন, চিনাকুড়ি ৩ নম্বর, মিঠানী, নবসমুদা কোলিয়ারিতে কোনো উৎপাদন হয়নি। শ্রীপুর, কুনুস্তোরিয়া, বাকোলা, কাকোড়া, ঝাঁঝরা, পাণ্ডবেশ্বর, সোদপুর, সালানপুর এলাকায় সর্বাত্মক ধর্মঘট হয়েছে। সালান‍‍‌পুরের কয়েকটা খনি, সোদপুরের দুবেশ্বরী পারবেলিয়া খনি, পাণ্ডবেশ্বরের শোনপুরবাজারি, খোট্টাডি, সাতগ্রামের নিমচা, আমকুলা প্রভৃতি খনিতে শাসক দলের বাহিনী জোর জবরদস্তি করতে আসে। কিন্তু শ্রমিকদের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধে ওরা ব্যর্থ হয়। সমস্ত জায়গাতেই উৎপাদন ও পরিবহণ ব্যাহত হয়েছে। এদিন পশ্চিমবঙ্গ সহ বিভিন্ন রাজ্যে ধর্মঘটী শ্রমিকরা আওয়াজ তুলেছেন, ‘কমার্শিয়াল মাইনিং ও‌য়াপস লো’। ধর্মঘট ভাঙার দালাল বাহিনীর বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রকাশ করে শ্রমিকরা স্লোগান দেন - ‘অ্যায় দালালো ডুব মরো’। এরাজ্যে শ্রমিকরা দৃঢ়তার সঙ্গে জানিয়ে দিয়েছেন, ‘নীতিবদলের লড়াই ছাড়বো না’। সিআইটিইউ পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে সুভাষ মুখার্জি এবং অনাদি সাহু দেশব্যাপী কয়লা শিল্পে তিনদিনের সাধারণ ধর্মঘটকে সফল করার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের অভিনন্দন জানান। অভিনন্দন জানি‌য়েছেন ইউটিইউসি-র সাধারণ সম্পাদক অশোক ঘোষ।

তিনদিনের কয়লা শিল্পের সফল ধর্মঘটের শেষদিনে দুর্গাপুর ইস্পাত নগরীতে অ্যালয় স্টিলের শ্রমিকদের সংহতি মিছিল এবং সিআইটিইউ’র উদ্যোগে সংহতি সভা হয়।