৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
রাজনৈতিক দল!
এটা লুটেপুটে খাওয়ার চোরেদের দল
বিশেষ পর্যবেক্ষক
বাংলায় একটি বহুল প্রচলিত প্রবাদ হলো ‘ঠক বাছতে গাঁ উজাড়’। যার আক্ষরিক অর্থ: সম্পূর্ণটাই খারাপ লোকে ভরে গেছে। যেখানে সৎ, ভালো লোক পাওয়া সত্যই দুষ্কর। বর্তমান সময়ের তৃণমূল দলটার প্রতি এই প্রবাদটি ব্যবহৃত হলে কেউই এটাকে খুব একটা অন্যায় বলতে পারবেন না।
এই ঠকে ভরতি তৃণমূল দলের ব্যাখ্যান কোনো প্রবন্ধে বিবৃত করা সত্যই শক্ত। কেননা এটা দৈর্ঘ্য প্রস্থে এতটাই চওড়া হবে যে, এর জন্য হয় তো দরকার পড়বে গ্রন্থ রচনার। হিমশৈলের সামান্য যে চূড়াটুকু আমরা খালি চোখে দেখতে পাচ্ছি তা চিত্রিত করতে গেলেও কালি-কাগজে টান পড়তে পারে।
ত্রাণ-দুর্নীতি কিংবা রেশন দুর্নীতি একেবারেই হালের ব্যাপার। করোনা পরিস্থিতি এবং আমফান ঘূর্ণিঝড়-উত্তর সময়ে এটা তৃণমূলের অঙ্গে নতুন ভূষণ সংযোজিত করেছে। রেশনের চাল কিংবা ত্রাণের টাকা সাধারণ গরিব-পীড়িত মানুষের হাতে পৌঁছনোর কথা ছিল। কিন্তু সেখানে না পৌঁছে এসব তৃণমূল নেতা-কর্মীদের ভাণ্ডার ভরতি করেছে, ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টকে স্ফীত করেছে।
এখন কথা হচ্ছে ২০১১-উত্তর সময়ে তৃণমূল শাসনে পশ্চিমবঙ্গে এসব কোন্দিন হয়নি। প্রধানমন্ত্রীর আবাস যোজনায় বাড়ি পেতে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের কাটমানি দিতে হয়েছে; রেগার মজুরি পেতে কাটমানি দিতে হয়েছে; এমনকি বিধবা ভাতা বার্ধক্য ভাতার টাকা পেতেও কাটমানি খেয়েছে তৃণমূল নেতা-কর্মীরা। এসব আমরা বলছি না। গত বছর কাটমানি কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসতেই বঙ্গবাসী এসবই প্রত্যক্ষ করেছে। তবে যেটা তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় তা হলো, ঠাকুরঘরে কলা খেয়ে বাবাজীবনরা এবারে আর পালাতে পারেনি। জনগণই ঘিরে ধরেছে ওই দুর্নীতিপরায়ণ তৃণমূল নেতা-কর্মীদের। ক্ষোভে-ঘৃণায় জনগণের কণ্ঠস্বরটাও এবারে একটু চড়া। তাই বিপদে পড়ে গেছে মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি সহ সমগ্র তৃণমূল দলটাই। ফলত লুটের টাকা ফেরত দিতে হচ্ছে অনেক জায়গায় শুধু নয়, এর সঙ্গে উপরি হিসাবে জুটছে কান ধরে ওঠবোস, জনগণের তাড়া, কোনো কোনো স্থানে একটু উত্তম-মধ্যমও।
একটা কথা পশ্চিমবঙ্গে খুবই প্রচলিত তা হলো, তৃণমূলের একটাই পোস্ট, বাকি সব ল্যাম্পপোস্ট। এই মহাবিপদে দলকে উদ্ধার করতে সেই পোস্টকেই আবার খাড়া হতে হয়েছে। যথারীতি আগের মতোই দলের ভাই-বোনেদের অপকর্মের সাফাই দিতে আসরে অবতীর্ণ হয়েছেন মমতা ব্যানার্জি। তবে এটা তাঁর গুণ, দোষ না রোগ, না শুধুই শঠতা তা রাজ্যের জনগণ ঠিক ঠাওর করতে পারে না যে, তিনি সব অপকর্মকেই ছোটো কম করে দেখতে ভালোবাসেন। এবারে তিনি ত্রাণ বিলির দুর্নীতিকে বলেছেন ‘একটু একটু ভুল’। ঠিক যেমন বলেছিলেন, ধর্ষণের ঘটনাকে ‘সামান্য’ ঘটনা, অধ্যাপক নিগ্রহকে ‘ছোটো ছোটো ছেলেদের কাজ’ প্রভৃতি। তবে এইসব বলে, পুলিশ প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে, সংবাদপত্রগুলিকে হাতে রেখেও পূতিগন্ধময় রক্ত পুঁজকে আটকে রাখতে পারছেন না। দলের বিষফোঁড়াগুলো সব ফুলে উঠেছে। এখনো ফাটেনি, রক্ত-পুঁজ চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে। এই চুঁইয়ে পড়ার খবরই প্রকাশ পাচ্ছে বাজারি সংবাদপত্রের পাতাতে।
যে সংবাদপত্রগুলি সারা বছর মুখ্যমন্ত্রীর জনদরদী ইতিবাচক ভাবমূর্তি নির্মাণে সদাব্যস্ত থাকত, সেই সব সংবাদপত্রের প্রথম পাতাতেই এসব খবর এখন শোভা পাচ্ছে। ওইসব খবরের নির্যাস করলে যা পাওয়া যায় তা হলো: সারা রাজ্যে একপ্রকার মগের মুলুক চলছে। গ্রাম থেকে শহর - সর্বত্র তৃণমূল নেতা-কর্মী, দাদা-ভাইয়াদের চলছে অঘোষিত রাজ। তাদের প্রতাপ এতোটাই যে, তারা যত্রতত্র জমি লুঠ করছে, চাষ জমি দখল করে ভেড়ি বানিয়ে নিচ্ছে; নিজেদের বাড়িতে লক্ষ লক্ষ টাকার বিদ্যুৎ বিল বাকি রাখছে, প্রশাসন কাঠপুতুলের মতো শুধু দেখা ছাড়া আর কিছুই করতে পারছে না; নিজেদের ইচ্ছে মতো মূল্যবান গাছ কেটে বিক্রি করে দিচ্ছে - এরকম কতো কি ঘটছে সবটা আবার জানাও যাচ্ছে না। আর শহরে কোন্ এলাকায় ক’তলা আবাসন হবে, তার জন্য কি পরিবর্তন করতে হবে; কোন্ রুটে অটো চলবে, তার ভাড়া কত হবে; ফুটপাতে কে হকারি করতে বসতে পারবে, তার জন্য এককালীন ও সপ্তাহে কত টাকা করে দিতে হবে - সব ঠিক করে দিচ্ছে তৃণমূলের নেতা-কর্মী গুন্ডারা। তারাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা হয়ে গেছে।
চিট ফান্ডে সাধারণ মানুষের টাকা লুঠ, শিল্পপতি-ব্যবসাদারদের কাছে তোলাবাজি তৃণমূলের শাসনের প্রথম থেকেই ছিল। তার পরিণতিতে কোটি কোটি সাধারণ মানুষ সব হারিয়ে রাস্তায় বসেছে, হলদিয়ায় এবিজে’র মতো অনেক সংস্থাকে রাজ্য থেকে ব্যবসা গুটিয়ে পালাতে হয়েছে। এখন এই তোলাবাজি, দাদাগিরি রাজ্যের সর্বত্র ক্ষয়রোগের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। পুলিশ-প্রশাসন কোথাও নেই। মানুষ অসহায়। রাজ্যের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে এই যে গভীর ক্ষত আমাদের যে কতদিন বয়ে চলতে হবে তা সময়ই বলবে। কিন্তু বর্তমান অবস্থা খুবই ভয়ঙ্কর।
মুখ্যমন্ত্রী হবার কিছুদিনের মধ্যেই মমতা ব্যানার্জি নিজের এলাকা ভবানীপুর থানা থেকে প্রায় হলিউডি সিনেমার কায়দায় দুষ্কৃতীদের ছাড়িয়ে এনেছিলেন। সেই ছিল প্রভাত, যা বুঝিয়ে দিয়েছিল বাকি দিনটা কেমন যাবে। রাজ্যবাসী দেখতে পাচ্ছে দিনটা কেমন যাচ্ছে। চুরি, ধর্ষণ, তোলাবাজি, কালোবাজারি এমন কোনো অপকর্ম নেই যাতে কৃতিত্ব দেখায়নি তৃণমূল দল। রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য তৃণমূল দল সম্পর্কে একটা মূল্যবান কথা বলেছিলেন। তাঁর মন্তব্যের সারমর্ম ছিল: খুনি বদমাশ, গুন্ডারা এখন তৃণমূলকে তাদের নিজেদের দল মনে করছে। কথাটা যে কত খাঁটি ছিল তা গত ৯ বছরের তৃণমূল শাসনই প্রমাণ করে দিয়েছে।
শেষে আরেকটি প্রবাদ প্রবচনের কথা স্মরণ করা যায়: ‘সাত খুন মাপ’। উনিশ শতকের মধ্যভাগে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের প্রতীক হিসেবে আজও বাংলা ভাষায় এই প্রবচনটি রয়ে গেছে। এর আক্ষরিক অর্থ সাতটা খুন করেও হাকিমের শাস্তি থেকে পার পাওয়া যেত। এতটাই নীলকর সাহেবদের প্রতিপত্তি ছিল। কথাটা ১০০ শতাংশ সত্যি। আজও পশ্চিমবঙ্গে সমস্তরকম অপকর্ম করে পার পেয়ে যায় তৃণমূল কর্মীরা। পুলিশ প্রশাসন কারুরই ক্ষমতা নেই একবিংশ শতাব্দীর রাজনীতির এই নয়া ঠকেদের কেশাগ্র স্পর্শ করে।
তবে, ভরসার কথা এই যে, জনগণ চোখ খুলে রেখে সবই দেখছে বুঝছে। তাদেরও সহ্যের সীমা আছে। আমরা কমিউনিস্ট কর্মীরা জনগণের অন্যতম অগ্রণী অংশ। জনগণের ঘৃণা-ক্রোধকে উপলব্ধি করে গণতান্ত্রিক-সুস্থচিন্তার সমস্ত অংশের মানুষকে একজোট করে এই অরাজক অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।