৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
বিএসএনএল-কে রুগ্ণ সংস্থায় পরিণত করতে চাইছে কেন্দ্রীয় সরকার
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ প্রচুর ঢক্কানিনাদ সহযোগে নরেন্দ্র মোদী বিএসএনএল-এর জন্য যখন পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন তারপর প্রায় আট মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে একমাত্র স্বেচ্ছা অবসর প্রকল্পের মাধ্যমে ৭৯ হাজার কর্মীকে ছাঁটাই করা ছাড়া আর কোনো বলবার মতো পদক্ষেপ সরকারের পক্ষ থেকে করা হয়নি। উল্টে সরকারের পক্ষ থেকে বিএসএনএল’কে দুর্বল করার জন্য চোরাগোপ্তা পদক্ষেপ করে সংস্থাটিকে রুগ্ণ করে ফেলার চেষ্টা হয়েছে।
ফোর-জি পরিষেবার জন্য যন্ত্রপাতি কেনার যে টেন্ডার বিএসএনএল প্রকাশ করেছিল, তা সরকারের পক্ষ থেকে রদ করা হয়। বিএসএনএল-এর ফোর-জি পরিষেবা চালুর প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করতে সরকারের এই অসাধু ছলের বিরুদ্ধে ২৬ জুন দেশজুড়ে ধরনা সংগঠিত করে বিএসএনএল এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন।
বিএসএনএল ফোর-জি নেটওয়ার্ক-এর জন্য যন্ত্রপাতি জোগাড় করতে টেন্ডার ছাড়ে। তারপর টেলিকম ইকুইপমেন্টস অ্যান্ড সার্ভিসেস প্রমোশন কাউন্সিল (টিইপিসি)-এর করা একটি অভিযোগের জেরে কেন্দ্রীয় সরকার বিএসএনএল-এর সেই টেন্ডার স্থগিত করে দেয়।
টিইপিসি নির্দিষ্টভাবে বিএসএনএল-এর টেন্ডারের দু’টি শর্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানায়। ওই টেন্ডারে উল্লিখিত ছিল যে টেন্ডারে অংশগ্রহণকারী কোম্পানিগুলিকে বিগত দু’টি আর্থিক বর্ষে ৮ হাজার কোটি টাকার ব্যবসা করতে হবে। আপত্তির অপর শর্তটি হলো, উক্ত অংশগ্রহণকারী সংস্থাকে অন্তত কুড়ি মিলিয়ন ফোর-জি লাইনের সংযুক্তি সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা থাকতে হবে। টিইপিসি এর পাশাপাশি আরও দাবি করেছিল যে, বিএসএনএল-এর টেন্ডারে ফোর-জি বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত করতে হবে।
বিএসএনএল-এর পক্ষ থেকে যে সমস্ত শর্ত আরোপ করা হয়েছিল টেন্ডারে সেগুলি যথেষ্ট যুক্তিসংগত। যে সমস্ত সংস্থাগুলি টেন্ডারে অংশগ্রহণ করবে সেগুলো যাতে আর্থিকভাবে সবল এবং ফোর-জি যন্ত্রাংশ উৎপাদন এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় প্রযুক্তিগত দক্ষতা সম্পন্ন হয় তা নিশ্চিত করার জন্যই শর্তগুলি আরোপ করা হয়েছিল। এছাড়াও এই শর্তগুলি আরোপ করার অন্যতম লক্ষ্য ছিল, যে সংস্থাগুলি অংশ নেবে তাদের একটি ফোর-জি নেটওয়ার্ক পরিচালনা করার অভিজ্ঞতা সম্পন্ন হতে হবে সেটা নিশ্চিত করা।
বেসরকারি সংস্থাসমুহের মতো একই মাপকাঠি প্রযোজ্য নয় বি এস এন এল-এর জন্য
এটা খুবই অদ্ভুত যে কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে একটি গুরুত্বহীন সংগঠনের তোলা অভিযোগের প্রতি অপ্রয়োজনীয় আস্থা প্রকাশ করে বিএসএনএল-এর টেন্ডার রদ করা হলো। একটি নতুন টেন্ডার ছাড়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সম্প্রতি একটি কমিটি গঠন করা হয়েছে বিএসএনএল-কে পরামর্শ দিয়ে টেন্ডার সংক্রান্ত নির্দেশিকা তৈরি করার জন্য। আবার একটি নতুন টেন্ডার ইস্যু করার জন্য বিএসএনএল-কে বাধ্য করার পেছনে সরকারের একটাই উদ্দেশ্য, তা হলো বিএসএনএল-কে ফোর-জি নেটওয়ার্ক-এ অংশ নেওয়া থেকে বিরত করা।
বহুজাতিক সংস্থাগুলিকে বিএসএনএল-এর ডাকা ফোর-জি টেন্ডার-এ অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত করবার যে দাবি টিইপিসি-এর পক্ষ থেকে রাখা হয়েছে, তাকে খুব কম কথায় দুরভিসন্ধিমূলক বলা যেতে পারে। যখন সমস্ত প্রাইভেট অপারেটররা বিশ্বমানের যন্ত্রাংশ নোকিয়া, জেডটিই, এরিকসন, হুয়েই-এর মতো বহুজাতিক সংস্থার থেকে সংগ্রহ করতে পারে সেখানে বিএসএনএল একা কেন অনভিজ্ঞ স্থানীয় ভেন্ডারদের কাছ থেকে নিম্নমানের ফোর-জি যন্ত্রাংশ এবং পরীক্ষিত নয় এমন প্রযুক্তি কিনবে? এটা করা হচ্ছে বিএসএনএল-কে প্রতিযোগিতায় সমসুযোগ না দেওয়া জন্য। এখনো পর্যন্ত যা জানা গেছে তা হলো কোনো ভারতীয় কোম্পানি এ পর্যন্ত ফোর-জি প্রযুক্তি তৈরি-উদ্ভাবন করতে পারেনি। অর্থাৎ এইভাবে বিএসএনএল-কে ফোর-জি যন্ত্রাংশ স্থানীয় ভেন্ডারদের থেকে ক্রয় করতে বাধ্য করার মধ্য দিয়ে কার্যত ফোর-জি নেটওয়ার্ক থেকে বিএসএনএল-কে সরিয়ে রাখতে এটা করা হচ্ছে।
টিইপিসি একটি যন্ত্র মাত্র
এটা এখন খুব পরিষ্কার যে টিইপিসি একটি কলকাঠি ছাড়া আর কিছু নয়, যা ব্যবহার করা হচ্ছে কায়েমি স্বার্থের জন্য বিএসএনএল-কে ফোর জি নেটওয়ার্ক-এ অংশগ্রহণ করা থেকে বাইরে রাখতে। এটা বোঝাটা শক্ত নয় যে, বিএসএনএল-কে যদি ফোর-জি নেটওয়ার্ক-এ অংশ নেওয়া থেকে বিলম্ব করানো যায় তাহলে সুবিধা পাবে কে। ২০০৬ সালেও বেসরকারি টেলিকম সংস্থাগুলি একই ধরনের ষড়যন্ত্র করেছিল। বিএসএনএল-এর মোবাইল নেটওয়ার্ক বিস্তার রদ করার জন্য। ৪৫ মিলিয়ন লাইন চালু করার জন্য বিএসএনএল টু-জি যন্ত্রাংশ কেনার যে টেন্ডার ইস্যু করেছিল তার বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন হাইকোর্টে বহু মামলা দায়ের করা হয়েছিল।
যদিও বিএসএনএল সেই সবক’টি মামলায় জয়লাভ করে। তৎকালীন টেলিকম মন্ত্রী এ রাজা বেসরকারি সংস্থা গুলির দ্বারা ব্যবহার্য ৪৫ মিলিয়ন লাইন-এর টেন্ডার বাতিল করেছিলেন। সেই ধরনের ষড়যন্ত্র যে এখন আবার শুরু হয়েছে তা বিশ্বাস করার জন্য বিএসএনএলইইউ-এর কাছে বহু কারণ রয়েছে। একটি শক্তিশালী রাষ্ট্রায়ত্ত টেলিকম সংস্থা হিসেবে বিএসএনএল-এর পুনরুত্থান অবশ্যই মুকেশ আম্বানির গোটা টেলিকম ব্যবসা কুক্ষিগত করার যে প্ল্যান তাকে আঘাত করবে। বিএসএনএল-এর ফোর-জি টেন্ডার তড়িঘড়ি স্থগিত করবার মোদী সরকারের যে সিদ্ধান্ত সেটা একথাই প্রমাণ করে যে, সরকার বিনা প্রশ্নে মুকেশ আম্বানির উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণ করতে রাজি।
ফোর-জি নেটওয়ার্ক চালু করার বিষয়টি ছাড়াও সরকারের পক্ষ থেকে বিএসএনএল-এর পুনরুজ্জীবন প্যাকেজ হিসেবে যা ঘোষণা করা হয়েছিল তা এখনও অবধি দিনের আলো দেখলো না। বিশেষত সার্বভৌম গ্যারান্টি দেওয়ার প্রশ্নে বাজার থেকে বন্ড ইস্যু করে টাকা তোলার ক্ষেত্রে যে নিশ্চয়তা সরকার দিয়েছিল তার এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। সরকারি সংস্থা ডিওটি, বিএসএনএল-এর ব্যাঙ্ক থেকে ঋণ নেওয়ার প্রস্তাবে এখনো অবধি সম্মতি দেয়নি। এই পরিস্থিতিতে বিএসএনএল নগদের অপ্রতুলতার সমস্যায় ভুগছে।
জাতীয় নিরাপত্তা এবং বিএসএনএল
ভারত এবং চীনের সেনাদের মধ্যে সহিংস সংঘর্ষ ঘটার পর ডিওটি-এর পক্ষ থেকে বিএসএনএল এবং এমটিএনএল-কে চীনের কোম্পানিগুলি থেকে যন্ত্রাংশ কেনার ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে। এটা মনে রাখতে হবে যে, এই নিষেধাজ্ঞা বেসরকারি টেলিকম সংস্থা সমূহের ক্ষেত্রে বলবৎ হয়নি। ডিওটি-এর পক্ষ থেকে এই বিষয়টিকে মান্যতা দেওয়ার ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তার কথা উল্লেখ করা হয়।গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি বিষয় মনে রাখা দরকার, সেটা হলো গুণগত মানের দিক থেকে এবং দামের দিক থেকে চীনের টেলিকম যন্ত্রপাতি গোটা পৃথিবীতেই যথেষ্ট কার্যকর হিসেবে পরিগণিত হয়। এক্ষেত্রে চীন পশ্চিমের বহুজাতিক সংস্থাগুলির সরবরাহ করা যন্ত্রাংশের তুলনায় অনেক বেশি উপযুক্ত।
এটা বেশ মজার যে, বিএসএনএল যখন চীনের টেলিকম সংস্থাগুলি থেকে যন্ত্রাংশ কেনে, মোদি সরকারের ঠিক তখনই জাতীয় নিরাপত্তার কথা মনে পড়ে যায়। কিন্তু যখন লাদাখে সীমান্ত বরাবর ৫৪টি মোবাইল টাওয়ার বসানো হয় সরকারের টাকা ব্যবহার করে, তখন সরকারের কিন্তু এই ধরনের বিষয়গুলির কথা মনে থাকেনা। এটা উল্লেখ করাও অপ্রাসঙ্গিক হবে না যে, জিও সংস্থাকে ইতিমধ্যেই যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য দেশের সমস্ত বিমানবন্দরগুলোতে বরাত দেওয়া হয়েছে। আবার জিও-কে ভারতীয় রেলের পক্ষ থেকেও টেলিকম পরিষেবা দেওয়ার জন্য নির্বাচিত করা হয়েছে।
ধীরে ধীরে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে রিলায়েন্স জিও দেশের মধ্যে কার্যত মূল্য সরকারি সার্ভিস প্রোভাইডার বা টেলিকম পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসেবে বিএসএনএল-কে সরিয়ে উঠে আসছে।সরকারের পক্ষ থেকে এই সমস্ত পদক্ষেপের জন্য নানা ধরনের আষাঢ়ে যুক্তি দেওয়া হতে পারে, কিন্তু এটা স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ যে টেলিকম ইন্ডাস্ট্রিতে মুকেশ আম্বানি নরেন্দ্র মোদী সরকারের সবচেয়ে পছন্দের চরিত্র।
তবে সংস্থার কর্মীদের সম্পর্কে বলা যেতে পারে যে, তারা বিএসএনএল-কে রক্ষা করার প্রশ্নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তারা আন্দোলন-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে মোদী সরকারের জিও সংস্থার প্রতি পক্ষপাতিত্বমূলক এবং বিএসএনএল বিরোধী বিভিন্ন পদক্ষেপের মুখোশ খুলে দিতে বদ্ধপরিকর।