৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সরব নন্দীগ্রাম-খেজুরি
কোণঠাসা তৃণমূল ফের খুন-সন্ত্রাসের পথে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ দীর্ঘদিনের সন্ত্রাসকবলিত নন্দীগ্রাম-খেজুরিতে শাসকদলের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-ধিক্কারে সরব হচ্ছেন সাধারণ মানুষ। এই সমস্ত অঞ্চলে আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত-বিপন্ন হাজারো মানুষ ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণের অর্থ না পেয়ে পথে নেমে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ জানাচ্ছেন। তাঁদের ক্ষোভের কারণ হলো, অসহায় মানুষেরা কোনো ত্রাণ এবং অর্থসাহায্য পাননি। অথচ এই সমস্ত এলাকায় শাসকদলের নেতা-মাতব্বর ও পঞ্চায়েতের কর্তাব্যক্তিরা নিজেদের ও আত্মীয়-পরিজনসহ দলীয় কর্মীদের অন্যায়ভাবে সে সমস্ত সরকারি সাহায্য পাইয়ে দিয়েছে। এসবের বিরুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষেরা শাসকদলের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করেই নানা জায়গায় তৃণমূলের দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-কর্মী ও পঞ্চায়েতের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে এবং পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিস ঘেরাও করে তাঁদের বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত করছেন।
খেজুরিতে দীর্ঘদিন ধরেই সাধারণ মানুষের দাবি-দাওয়ার আন্দোলন, তৃণমূল কংগ্রেসের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়ে আসছিলেন বারাতলার সিপিআই(এম) সদস্য কমরেড দেবকুমার ভুঁঞা। মানুষের এই প্রতিবাদ-আন্দোলনে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে শাসকদলের দুষ্কৃতীরা তাঁকে নৃশংসভাবে খুন করে। এভাবে খুন করে ওই এলাকায় সাধারণ মানুষের মধ্যে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করতে চেয়েছিল শাসকদল। কিন্তু আমফানে ক্ষতিগ্রস্ত বঞ্চিত মানুষের মধ্যে এই খুনের প্রতিক্রিয়ায় আরও ব্যাপক মাত্রায় ক্ষোভের সঞ্চার হয়। এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে এবং অপরাধীদের গ্রেপ্তার ও কঠোর শাস্তির দাবিতে ৫ জুলাই অসংখ্য মানুষ লালঝান্ডার প্রতিবাদ মিছিলে অংশ নেন। সিপিআই(এম) পূর্ব মেদিনীপুর জেলা কমিটির সম্পাদক নিরঞ্জন সিহি এই হত্যাকাণ্ডের তীব্র নিন্দা করে অবিলম্বে দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার ও শাস্তির দাবি জানিয়েছেন।
কমরেড দেবকুমার ভুঁঞা এলাকার একনিষ্ঠ, সক্রিয় পার্টিকর্মী ছিলেন। ২০০৯ সাল থেকে তৃণমূলের সন্ত্রাসে ঘরছাড়া ছিলেন। অনেকগুলো সাজানো মামলায় তাঁকে ফাঁসানো হয়। ২০১৮ সালে তিনি ঘরে ফিরেছিলেন। আবার ২০১৯ সালে লোকসভা ভোটের পর তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা তাঁর উপর হামলা চালায় এবং আবারও মিথ্যা মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়। ৪ জুলাই কাঁথি থেকে সেই মামলায় হাজিরা দিয়ে তিনি বাড়ি ফিরছিলেন। দুষ্কৃতীরা পিছু নিয়ে তাঁর বাড়ি পর্যন্ত যায়। তারপর বাড়ি থেকে তুলে এনে ফাঁকা মাঠে ইটভাটায় তাঁকে খুন করে বামুনচকে রাস্তার কাছে ফেলে যায়। তাঁর একটি হাত ও একটি পা ভেঙে দেওয়া হয় বলে চিকিৎসকদের ধারণা। এছাড়া শরীরে অনেকগুলো আঘাতের চিহ্ন ছিল।
এই জঘন্য ঘটনার প্রতিবাদে ৫ জুলাই হেঁড়িয়াতে বিশাল মিছিল সংগঠিত হয়। মিছিল থেকে দুষ্কৃতীদের গ্রেপ্তার ও উপযুক্ত শাস্তির দাবি জানানো হয়। মিছিলে অংশ নেন পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য হিমাংশু দাস, জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য পরিতোষ পট্টনায়কসহ যাদবেন্দ্র সাহু, গোকুল ঘোড়াই, মৃন্ময় মাইতি প্রমুখ। পার্টির পক্ষ থেকে খেজুরি থানায় খুনিদের শাস্তির দাবি জানানো হয়। শহিদ কমরেডের স্ত্রীও থানায় অভিযোগ জানিয়েছেন। এভাবে খুন-সন্ত্রাসের মাধ্যমে ভীতি সঞ্চার করে শাসকদল প্রতিবাদ-বিক্ষোভের পথ থেকে সাধারণ মানুষকে দূরে সরিয়ে দিতে চাইছে। কিন্তু খেজুরিতে গ্রামবাসীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের মধ্য দিয়ে এটা স্পষ্ট হয়েছে যে, ভয় দেখিয়ে সন্ত্রাস করে মানুষের প্রতিবাদকে স্তব্ধ করা যাবে না।
এদিকে শাসকদলের চাপে কমরেড দেবকুমার ভুঁঞার খুনের ঘটনাকে স্বাভাবিক মৃত্যু বলে প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে পুলিশ। খেজুরিসহ জেলাজুড়ে এই হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ ও প্রতিবাদের চেহারা দেখে পুলিশ গোপনে তৃণমূলের সন্ত্রাসকবলিত ভগবানপুর ২ ব্লকের বরোজ অঞ্চলের পাঁউশিতে নিয়ে গিয়ে কমরেড দেবকুমার ভুঁঞার শেষকৃত্য করে দেয়।
এই হত্যাকাণ্ডের পর থেকেই শহিদ কমরেডের স্ত্রী ও জামাইকে নজরবন্দি করে রাখে তৃণমূল কংগ্রেস। তাঁদের পুলিশ ও শাসকদলের নেতারা ভয় দেখায়। এই খুনের ঘটনার পর একজন টোটো চালককে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূলের চাপে সেই টোটো চালককে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। সেই টোটোতেই নাকি খুনের জায়গা থেকে দেবকুমার ভুঁঞার দেহ বামুনচক পর্যন্ত বহন করা হয়েছিল। পুলিশেরই একটি অংশ এই সমস্ত খবর গ্রামবাসীকে জানায়। কাঁথির এস ডি পি ও জানিয়েছেন, দেবকুমার ভুঁঞাকে নাকি কেউ খুন করেনি। স্বাভাবিক অবস্থায় তাঁর বাড়িতে নাকি মারা গেছেন! অথচ শহিদ কমরেডের দেহ পাওয়া গিয়েছিল বামুনচকের রাস্তার ধারে। পুলিশ কর্তার এই বক্তব্যে এলাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।
এই ঘটনার সঠিক তদন্ত ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে ৯ জুলাই জেলার বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ ও ডেপুটেশন দেওয়া হয়। কমরেড দেবকুমার ভুঁঞার খুনের প্রতিবাদে ও দোষীদের শাস্তির দাবিতে ৬ জুলাই তমলুকের মানিকতলা, কোলাঘাট, পাঁশকুড়ার রাতুলিয়া বাজার, কাঁথি, দেশপ্রাণ, মারিশদা, নন্দকুমার, হলদিয়া, বামনগর, মহিষাদল, সুতাহাটা, মুগবেড়িয়া ১, ২, বালিঘাই, ভগবানসহ ২৫টি ব্লকে বিক্ষোভ মিছিল হয়।
এদিন খেজুরি থানার কুঞ্জপুর, কশতলা, কশাড়িয়া, খেজুরি, কলাগেছিয়া, কামারদা, টিকাশী, হেঁড়িয়া, লাখি অঞ্চলের পার্টি নেতা ও কর্মীরা সাধারণ মানুষকে সমবেত করে ধিক্কার মিছিল সংগঠিত করেন।
আজ অবস্থা এমনই দাঁড়িয়েছে যে, খেজুরি, নন্দীগ্রামসহ জেলায় শাসকদলের সন্ত্রাসে আক্রান্ত সমস্ত এলাকায় সাধারণ মানুষ শাসকদলের চোখরাঙানি-হুমকিকে আর পরোয়া করছে না। তারা উল্টে শাসকদলের দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অঞ্চলে পথ অবরোধ করছেন, তৃণমূলের স্থানীয় নেতাদের দুর্নীতির প্রতিবাদে ঘেরাও করছেন। দলে দলে মানুষ তাঁদের ন্যায্য দাবি জানাতে স্থানীয় পঞ্চায়েত ও বিডিও অফিসে জড়ো হচ্ছেন। প্রকাশ্যে ধ্বনি তুলছেন, ‘তৃণমূল চোর’।
নন্দীগ্রামের অন্তর্গত সোনাচুরা, ভেকুটিয়া, দাউদপুর, সামসাবাদ, কালীচরণপুর, মহম্মদপুর সহ নন্দীগ্রাম-১ ব্লকের দশটি পঞ্চায়েতেই আজ মানুষ প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সরব হয়েছেন। ভাঙাবেড়ায় শাসকদালের প্রতাপশালী দুই নেতা অশ্বিনী পাত্র এবং দুলাল গিরিকে দুর্নীতির জন্য ঘাড় ধাক্কাও খেতে হয়। সোনাচুরায় পঞ্চায়েত প্রধান, উপপ্রধানসহ পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য তথা তৃণমূল-মাওবাদীদের ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির অন্যতম খোকন শীটদের মতো তৃণমূলের নেতা-মাতব্বরদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হয়েছেন গরিব সাধারণ মানুষ। তাঁদের অভিযোগ, শাসকদলের এই সমস্ত নেতা আমফান ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের সাহায্যের জন্য টাকা নিজেদের ছেলে, ভাইসহ ঘরের লোক, আত্মীয়স্বজনদের অ্যাকাউন্টে নিয়ে নিয়েছেন। সোনাচূড়া গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় প্রায় ১ হাজার ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। যেখানে প্রচুর জালিয়াতির অভিযোগ ওঠে তৃণমূল কংগ্রেসের বিরুদ্ধে। অভিযোগ ওঠে যে, পঞ্চায়েতের যে কোনও কাজে তোলাবাজি, জরিমানা, চাষআবাদ বন্ধের ফতোয়া ছিলই। তার সঙ্গে এবারে নতুন করে যুক্ত হয়েছে আমফানে ক্ষতিপূরণের টাকা নিয়ে বিপুল দুর্নীতি ও স্বজনপোষণের অভিযোগ।
সোনাচূড়ায় এই সমস্ত অভিযোগে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদ-বিক্ষোভ ওঠায় তৃণমূল নেতা অশ্বিনী পাত্র গা ঢাকা দিয়ে ছিলেন। এরপর তিনি বাড়িতে ফিরলে এলাকার মানুষ তাকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখান। গ্রামবাসীরা অভিযোগ করেন, এই তৃণমূল নেতার দুই পুত্র উৎপল, উজ্জ্বলসহ তার ভাইয়ের ছেলেদের নামে আমফানের ২০ হাজার টাকা করে ঢুকেছে। তাছাড়া দলের অপর নেতা রাধাকৃষ্ণ মণ্ডলের তিন ছেলে রঞ্জন, কিশোর ও প্রদীপের নামেও টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এছাড়া তৃণমূল কংগ্রেস নেতা দুলাল মণ্ডল, তার দুই ভাই দিলীপ, দীপক, সুধাংশু প্রামাণিকের ছেলে কৃষ্ণগোপাল, মেয়ে পার্বতী, পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য খোকন শীটের ভাই মণি শীট, বকুলদেব দাসের মেয়ের বাড়ির তিনজন, পঞ্চায়েতের প্রধান গীতারানি মণ্ডলের দুই ছেলে, উপপ্রধান কালীকৃষ্ণ প্রধানের এক অনুগতর বাড়ির চারজন এবং নিজের পরিবারের দু’জন - এমন অনেকেই বাড়ি তৈরির টাকা পেয়েছেন।
সোনাচূড়ার গ্রামবাসীদের অভিযোগ, সবার পাকাবাড়ি থাকা সত্ত্বেও তারা ক্ষতিপূরণের টাকা পেয়েছেন। কিন্তু যাদের মাটির ঘর ভেঙেছে, তারা টাকা পায়নি। এছাড়া ঘর পাইয়ে দেবার নাম করে তোলা বাবদ টাকাও পেয়েছে। গ্রামবাসীরা অভিযোগ জানিয়েছেন, অশ্বিনী পাত্র, রঞ্জন মণ্ডল, দুলাল মণ্ডল, অশোক ভুঁঞা, রতন দোলুইয়ের মতো শাসকদলের নেতার মোবাইল নম্বরের সঙ্গে ৩০-৪০টি করে নাম যুক্ত করা হয়েছে। এমন অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে।
এদিকে অবস্থা বেগতিক বুঝে তৃণমূল কংগ্রেস দলের প্রবীণ নেতা শিশির অধিকারীকে সামনে এনে অবস্থা সামাল দিতে চেয়েছে। তিনি জানিয়েছেন, নন্দীগ্রামের ২৯জন দলীয় নেতাসহ দলের ২০০ জন পঞ্চায়েত সদস্যকে শোকজ করা হয়েছে দুর্নীতির অভিযোগে। কিন্তু সাধারণ মানুষের এটা অজানা নয়, তৃণমূল দলে শোকজ, বহিষ্কার অর্থহীন। নন্দীগ্রামের বিধায়ক তথা পরিবহণমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী আমফানের দুর্নীতি নিয়ে সাধারণ মানুষের বিক্ষোভ সম্পর্কে কোনো মন্তব্য করেননি। এ রাজ্যে ক্ষমতায় আসার আগে জেলিঙহ্যামের চরে কারখানা সহ নানা প্রতিশ্রুতি বিলিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। কিন্তু তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্বের ৯ বছর অতিক্রান্ত হলেও মানুষ একটা প্রতিশ্রুতিরও বাস্তবায়ন দেখেননি। উল্টে দুর্নীতি-স্বজনপোষণ ইত্যাদিতে নানাভাবে বঞ্চিত হয়েছেন।
সাম্প্রতিককালে লকডাউনের ফলে এখানকার মানুষও রুটি-রুজি হারিয়েছেন। তার উপর আমফান ঝড়ের তাণ্ডব তাদের একেবারে বিপন্ন করে তুলেছে। এই মানুষেরাই আজ জীবনের তাগিদে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে সরব হয়েছেন। জেলার যে সমস্ত অঞ্চলে এক সময়ে তৃণমূলের দাপটে মানুষের উচ্চবাচ্য করার ক্ষমতা ছিল না, সেই সমস্ত অঞ্চলেই মানুষ আজ প্রকাশ্যে তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে প্রতিবাদ-বিক্ষোভে জোট বেঁধে পথে নামছেন। মানুষের এই সংগঠিত প্রতিবাদকে স্তব্ধ করতে শাসকদল সন্ত্রাস-খুনের পথ নিলেও অকুতোভয় মানুষকে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না। খেজুরি, নন্দীগ্রামে এই বাস্তবতাই ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে।