৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
অবরোধের অন্তরালে অপরাধ
অমিতাভ রায়
মানুষের মুখে মুখোশ। চোখে সন্ত্রস্ত দৃষ্টি। মনে সন্দেহ - সামনে পিছনে বা আশপাশের কেউ করোনা আক্রান্ত নয় তো! মাথায় চিন্তা - আজ কাজ আছে, কাল থাকবে তো; আজ ভাত আছে, কাল জুটবে তো! পরিস্থিতির এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই কোনোরকমে দমবন্ধ আবহে দিন কাটাচ্ছে ভারতীয় সমাজ। আর এই সুযোগে রাষ্ট্র ধারাবাহিকভাবে চালিয়ে যাচ্ছে অবাধ লুটপাট।
রেল তেল টেলিফোন বিমান বিমানবন্দর থেকে শুরু করে কয়লাখনি মহাকাশের উপগ্রহ, এককথায় মাটির গহ্বর থেকে ভূপৃষ্ঠ হয়ে অন্তরীক্ষ পর্যন্ত যেখানে যা কিছু রাষ্ট্রীয় সম্পদ রয়েছে তার বিরাষ্ট্রীয়করণ হয়েই চলেছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদ বিক্রির সুদীর্ঘ তালিকায় সম্প্রতি এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছে। অসম সরকার অধ্যাদেশ জারি করে জানিয়ে দিয়েছে যে, এখন থেকে অসমের যে কোনো জমিতে ক্ষুদ্র, ছোটো এবং মাঝারি শিল্প স্থাপনের জন্য কোনোরকম সরকারি অনুমতির দরকার নেই। জমি কিনে নিয়ে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে জমি জোগাড় করে প্রস্তাবিত শিল্পের বিষয়ে একটা স্বঘোষিত বিবৃতি দিলেই হবে। এমনকি জমির চরিত্রের পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদন করারও দরকার নেই। পরিবেশ বিভাগের ছাড়পত্র নিতে হবে না। দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী শিল্পসংস্থা স্থাপিত হয়েছে কিনা তার জন্য কেউ নজরদারি করতে আসবে না। বিদ্যুৎ সংযোগের আবেদন করার জন্য অন্য কোনো কাগজপত্র দাখিল করতে হবে না। সবমিলিয়ে ঢালাও লুটের বন্দোবস্ত। ভারত সরকারের সাম্প্রতিক সিদ্ধান্ত অনুসারে এক কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম নিয়ে কোনো নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ নেওয়া হলে তা ক্ষুদ্র শিল্প বলে গণ্য হবে। ক্ষুদ্র শিল্পের বাণিজ্যিক লেনদেন বছরে পাঁচ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। দশ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জাম নিয়ে কোনো নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হলে তার পরিচয় হবে ছোটো শিল্প। এক্ষেত্রে বাণিজ্যিক লেনদেন বছরে পঞ্চাশ কোটি টাকার বেশি হওয়া চলবে না। যন্ত্রপাতি সাজসরঞ্জামের জন্য পঞ্চাশ কোটি টাকার বিনিয়োগে যে শিল্প কারখানা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হবে তাকে মাঝারি শিল্প বলতে হবে। মাঝারি শিল্পের বার্ষিক বাণিজ্যিক লেনদেন আড়াইশো কোটি টাকা পর্যন্ত ধার্য করা হয়েছে। ক্ষুদ্র, ছোটো এবং মাঝারি কোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার জন্য জমি কিনতে, বিদ্যুৎ সংযোগ করতে বা জল জোগাড় এমনকি প্রয়োজনে সড়ক নির্মাণের জন্য যা খরচাপাতি হবে তা কিন্তু এই হিসেবের মধ্যে ধরা হয়নি।
ভারতের শিল্প বিকাশের ধারাবাহিকতায় এমন লাগামহীন জমি দখলের সুযোগ সেই ব্রিটিশ সরকারের সময় থেকে শুরু করে ২০২০-র জুন পর্যন্ত দেশের কোনো প্রান্তে কোনোদিন দেওয়া হয়নি। কৃষিজমি, স্থানীয় জনজাতির জন্য সংরক্ষিত জমি থেকে শুরু করে বাগিচা অরণ্য যে জমিই হোক না কেন শিল্প-উদ্যোগীর পছন্দই শেষ কথা। যেনতেন প্রকারে জমি হাতিয়ে সরকারের অনুমোদন ছাড়াই রাজ্যের যে কোনো এলাকায় নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান করার এমন নিয়ন্ত্রণবিহীন সুযোগ দেশের অন্য কোথাও নেই। নতুন শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থানীয় জনবসতির উপর কী প্রভাব ফেলতে পারে, পরিবেশ কতখানি দূষিত করতে পারে, তা নিয়ন্ত্রণের জন্য কী কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে সেসব দেখার প্রয়োজনীয়তা থাকবে না। নতুন সংস্থার জন্য বিশেষ দক্ষতাসম্পন্ন শ্রমিক-কর্মচারী-প্রযুক্তিবিদ প্রয়োজন হলে তাদের অন্য জায়গা থেকে অনায়াসে নিয়ে আসা যাবে। স্বাভাবিকভাবেই বহিরাগতদের জন্য শিল্প প্রতিষ্ঠানের কাছাকাছি কোনো জায়গায় তাদের বসবাসের বন্দোবস্ত হবে। স্থানীয় জনজীবনে আসবে বিরাট পরিবর্তন। জনবিন্যাস বদলে যাবে। স্থানীয় কৃষ্টি সংস্কৃতি হারিয়ে যাবে। তবে সবার আগে স্থানীয় মানুষের কৃষিজমি ও বাস্তুজমি বেদখল হয়ে যাওয়ায় তৈরি হবে একদল বাস্তুহারা এবং কাজছাড়া মানুষ। নীল আকাশের নিচে এই পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য একদল নিরন্ন মানুষের জীবন সংগ্রাম শুরু হবে যাঁরা সদ্য স্থাপিত শিল্প প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকিয়ে প্রতি মুহূর্তে ভাববেন ওইখানে ছিল তাঁদের বাড়িঘর চাষের জমি।
অসম সরকারের তরফে ৩ জুলাই, ২০২০ জারি করা বিবৃতিতে জানানো হয়েছে যে, ৩০ জুন, ২০২০-তে অনুষ্ঠিত রাজ্য মন্ত্রীসভার বৈঠকে এই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
অসম সরকারের আমলাতন্ত্রের নজরে এল না যে ১৯৮০-র অরণ্য সংরক্ষণ আইন (Forest Conservation Act 1980) এবং ২০০৪-এর স্থানীয় জনজাতির অরণ্য সুরক্ষা আইন (Tribal Forest Protection Act 2004) লঙ্ঘন করে মন্ত্রীসভার বৈঠকে এই জনবিরোধী সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। জাতীয় অবরোধের কারণে আদালতের দ্বারস্থ হওয়ার সুযোগ সঙ্কুচিত হয়ে গেছে। এই অবসরে নির্দ্বিধায় এবং নিশ্চিন্তে রাজ্য মন্ত্রীসভার সম্পূর্ণ বেআইনি সিদ্ধান্তে সরকারি মোহর লাগিয়ে দেওয়া হলো। আগামীদিনে অন্যান্য রাজ্য সরকার এই সিদ্ধান্তকে অনুসরণ করলে আশ্চর্য হওয়ার অবকাশ থাকবে না। সেইসব বেআইনি সিদ্ধান্ত নিয়ে আইন আদালত হলে অসমের দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হবে। সবমিলিয়ে অসম সরকারের এই সর্বগ্রাসী জনবিরোধী সিদ্ধান্তের ফল সুদূরপ্রসারী। অবরোধের দাপটে মানুষ দিশেহারা। দেশের কর্মক্ষম মানুষের অনেকেই কাজছাড়া ছিলেন। তার সঙ্গে জুড়ে গেছে সদ্য কাজহারা হয়ে ঘুরে বেড়ানো অসংখ্য মানুষ। অবরোধের আবহে অসম সরকার তৈরি করতে চলেছে আরও একদল বাস্তুহারা ভূমিহীন কাজছাড়া মানুষ। অবরোধের আড়ালে অবাধ লুটপাটের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানো ছাড়া অন্য কোনো পথ খোলা নেই।
অসম সরকার অধ্যাদেশ জারি করে জানিয়ে দিয়েছে যে, এখন থেকে অসমের যে কোনো জমিতে ক্ষুদ্র, ছোটো এবং মাঝারি শিল্প স্থাপনের জন্য কোনোরকম সরকারি অনুমতির দরকার নেই। জমি কিনে নিয়ে বা অন্য কোনো পদ্ধতিতে জমি জোগাড় করে প্রস্তাবিত শিল্পের বিষয়ে একটা স্বঘোষিত বিবৃতি দিলেই হবে। এমনকি জমির চরিত্রের পরিবর্তনের জন্য কোনো আবেদন করারও দরকার নেই। পরিবেশ বিভাগের ছাড়পত্র নিতে হবে না। দূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধি অনুযায়ী শিল্পসংস্থা স্থাপিত হয়েছে কিনা তার জন্য কেউ নজরদারি করতে আসবে না।