E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭

বর্ণহিন্দুর স্বার্থেই দেশভাগ চেয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ

গৌতম রায়


ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়, যাঁর সঙ্গে স্যার আশুতোষের পরিবারের ব্যক্তিগতস্তরের ঘনিষ্ঠতা ছিল, তিনি তাঁর দীর্ঘ মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে একটিবারও শ্যামাপ্রসালের জন্ম বা মৃত্যুদিন পালন করেননি। প্রফুল্লচন্দ্র সেন থেকে অজয় মুখার্জি, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য - ভিন্ন রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী একজন মুখ্যমন্ত্রীও শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন পালন তো দূরের কথা, এমন একটা কথাও বলেননি, যাতে বর্ণহিন্দুর স্বার্থরক্ষাকে ‘হিন্দু’স্বার্থ বলে গুলিয়ে দিয়ে বাংলাভাগের অন্যতম খলনায়ক শ্যামাপ্রসাদের রাজনৈতিক ইমেজ পুনরুদ্ধার হয়।

সেই শ্যামাপ্রসাদ, যিনি উচ্চবর্ণের হিন্দুর অর্থনৈতিক স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বাংলাভাগে বলি দিয়েছিলেন লক্ষ লক্ষ তপশিলি জাতি-উপজাতি সহ নিম্নবর্গের হিন্দুদের, ক্ষমতায় এসেই, সেই শ্যামাপ্রসাদকে ঘিরে প্রশাসনিকস্তরে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের প্রথম উদ্যোগ দেখান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যে শ্যামাপ্রসাদ, মুসলিম সাম্প্রদায়িক স্বার্থের পরিপূর্ণতা দেওয়ার বিনিময়ে সুরক্ষিত করতে চেয়েছিলেন ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃতির ‘হিন্দু’ধারা, যেখানে ‘শম্বুক’দের কোনো ঠাঁই হবে না, সেই শ্যামাপ্রসাদকে ঘিরে ‘হাজিবিবি’র ভেকধরা মমতার উচ্ছ্বাস নিম্নবর্গের হিন্দু সহ গোটা মুসলমান সমাজের সাথে সম্পূর্ণ বিশ্বাঘাতকতার শামিল।

যে উচ্চবর্ণের হিন্দু স্বার্থরক্ষার তাগিদে মুসলিম লিগের সহায়ক শক্তি হয়ে বাংলা তথা ভারতকে ভেঙেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ, সেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ্যবাদীদের প্রতিনিধিত্ব করে নাগপুরের রেশমবাগের কেশব ভবনের কর্তাদের খুশি করতেই মমতার এই শ্যামাপ্রসাদ বন্দনা। মুসলমানেরা যাতে পড়াশুনার সুযোগ না পায়, শিক্ষাক্ষেত্রে তাঁদের কার্যত হিন্দু দেবদেবীর অর্চনাকেই পাঠক্রম হিসেবে মেনে নিতে হয়, বৈদিক দেবতার বাইরে কোনো লোকায়ত চর্চা যাতে নিম্নবর্গের হিন্দু না করতে পারে - সেভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রম সাজিয়েছিলেন শ্যামাপ্রসাদ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে।

সেই শ্যামাপ্রসাদকে ঘিরে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কেন এতো আবেগ উথলে উঠছে মমতার? নেতাজি সুভাষচন্দ্রের নাম মুছে কলকাতা বন্দরের নাম দেশভাগের নায়ক, মুসলিম হত্যার অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্রী শ্যামাপ্রসাদের নামে করেছে। তার বিরোধিতা তো দূরের কথা, সেই শ্যামাপ্রসাদের জন্মদিন ঘিরে প্রশাসনিক স্তরে মমতার উচ্ছ্বাস ঘিরে এই আশঙ্কাও প্রবল হয়ে উঠছে যে, দ্বৈত সদস্যপদ ঘিরে ভারতীয় রাজনীতিতে মোরারজি দেশাইয়ের প্রধানমন্ত্রিত্বকালে যে বিতর্ক উঠেছিল, নাগপুরের রেশমবাগ থেকে অচিরে তেমন বিতর্ক পশ্চিমবঙ্গ ঘিরে আবার উঠবে না তো?

আসুন বন্ধু, ইতিহাসের নিরিখে আমরা দেখি শ্যামাপ্রসাদকে। অন্ধ আবেগ বা অন্ধ বিরোধিতাতে নয়। ফলিতবিজ্ঞানে যেমন যৌগের সংযুক্তি-বিযুক্তিতে উঠে আসে চরম সত্য গবেষণাগারে, তেমনিই তথ্য আর বিশ্লেষণের সম্মিলিত ধারায় মানবিকীচর্চার গবেষণাগারে উঠে আসুক। ইতিহাসের শ্যামাপ্রসাদ-অখণ্ড বাংলায় হিন্দু মহাসভার প্রতিষ্ঠা ১৯২৩ সালে। জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে অ্যালেন অক্টোভিয়ান হিউম যেমন ‘সেফ্‌টি ভালভ’ তত্ত্বের অবতারণা করেছিলেন, সেভাবেই বাংলাতে বর্ণহিন্দু অভিজাতের স্বার্থ সংরক্ষণে বাংলাভাগ তথা দেশভাগকেই একমাত্র সমাধানসূত্র হিসেবে ধরেছিল হিন্দু সাম্প্রদায়িকরা। তাই হিন্দু মহাসভা বাংলায় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ক্ষেত্র তৈরি করতে সামাজিক বিভাজনকেই আশ্রয় করে একাংশের হিন্দু বুদ্ধিজীবীরা।

তারা মুসলমানদের এবং নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের বেশিমাত্রায় সুযোগ পাওয়ার জিগির তোলে। ফলে বর্ণহিন্দুদের ভিতরে যাঁরা সাম্প্রদায়িক ছিলেন না, পরধর্মের প্রতি একটা সম্ভ্রম নিয়ে চলতেন, বর্ণবাদী সমাজেও যাঁরা নিম্নবর্গের প্রতি প্রবল ঘৃণার মানসিকতা নিয়ে চলতেন না, অর্থনৈতিক বঞ্চনার এই সুড়সুড়িতে তাঁরা খুব সহজেই হয়ে উঠতে থাকেন সাম্প্রদায়িক। হয়ে উঠতে থাকেন পরধর্ম-বিদ্বেষী। নিম্নবর্গ সম্পর্কে ঘৃণা তাঁদের সীমাহীন হয়ে ওঠে। বর্ণহিন্দুদের ভিতর শ্রেণি-ঐক্যকে জোরদার করবার তাগিদেই উচ্চবর্ণের ব্রাহ্মণ, কায়স্থরা হিন্দু মহাসভা বাংলাতে তৈরি করেছিল।

এই উচ্চবর্ণের, উচ্চবিত্তের হিন্দুরা তিনের দশক থেকেই তাদের কর্মসূচি পূরণের আদর্শপুরুষ হিসেবে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়কে চিহ্নিত করে। আধুনিক মেট্রোপলিটন অভিজাত হিন্দু মনন শ্যামাপ্রসাদের বংশকৌলিন্যের জেরে তাই বুঝে উঠতে পারেনি ঠিক মতো, তাঁর চরম ব্যক্তি আকাঙ্ক্ষা চরিতার্থকারী রাজনৈতিক চরিত্রটিকে। মুসলমানেরা অর্থনীতিকে পুরোপুরি দখল করে নিচ্ছে, মুসলমানদের জন্যে বাঙালি হিন্দু মধ্যবিত্তরা চাকরি পাবে না, জনগণনাতে পর্যন্ত মুসলমানেরা এমন কারচুপি করছে যে, বাঙালি হিন্দুকে আবার মুসলমানের অধীন হয়ে থাকতে হবে ব্রিটিশ চলে গেলে - আরএসএস-হিন্দু মহাসভার এই ভয়ঙ্কর প্রচারকে উচ্চবর্ণের বাঙালি হিন্দু মননে বিশ্বাস করাবার ক্ষেত্রে শ্যামাপ্রসাদ হয়ে ওঠেন কায়েমিস্বার্থান্বেষীদের সবথেকে বিশ্বস্ত সঙ্গী।

গত শতকের তিনের দশকের সূচনাপর্ব থেকে মুসলমান সমাজের ভিতর যে আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সচেতনতা তীব্র হতে থাকে তার জেরে প্রাদেশিক আইনসভা থেকে একদম ভূমিস্তরে কলেজ, স্কুলবোর্ডগুলির পরিচালনার ক্ষেত্রেও মুসলমানদের অংশগ্রহণ বাড়তে থাকে। বর্ণহিন্দুদের নিয়ন্ত্রণে থাকা স্কুল-কলেজের পরিচালনাতে মুসলমানদের প্রবেশাধিকারে প্রতিবন্ধকতা তৈরিতে স্যার আশুতোষের পুত্র তথা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য শ্যামাপ্রসাদের ক্যারিশমাকে কাজে লাগায় হিন্দু মহাসভা। আর শ্যামাপ্রসাদও বর্ণহিন্দুদের সামাজিক প্রতিপত্তি বজায় রাখতে ফজলুল হকের মন্ত্রী হয়েও তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণের বাইরে স্কুলশিক্ষাকে আনার বিরোধিতায় আদাজল খেয়ে নেমে পড়েন।

উপাচার্য থাকাকালীন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়কে কার্যত মুসলমানশূন্য করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। সে যুগের আইনে স্কুলগুলি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে থাকার ফলে, সেখানকার পরিচালনা সমিতির সদস্য নিয়োগে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা বড়ো ভূমিকা থাকত। সেই সুযোগে স্কুলগুলিতে মুসলমানদের বঞ্চিত করে বর্ণহিন্দুদের আধিপত্য কায়েম করা হতো। এরফলে গোটা বাংলার অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণের অনেকটাই চলে আসে বর্ণহিন্দুদের হাতে।

ফজলুল হক ম্যাট্রিক শিক্ষার জন্যে পৃথক বোর্ড তৈরি করলে বর্ণহিন্দুদের সেই একাধিপত্য খর্ব হতো। মুসলমান এবং তপশিলি জাতি-উপজাতির মানুষেরা ধীরে ধীরে স্কুল-কলেজগুলির পরিচালনা সমিতির সদস্য হবেন গণতান্ত্রিক কাঠামোতেই। আর তার ফলে স্থানীয় অর্থনীতিতে এইসব মানুষ ধীরে ধীরে প্রভাবশালী হয়ে উঠবেন। নিয়ন্ত্রকও হয়ে উঠবেন অর্থনীতির। বর্ণহিন্দুর শ্রেণিস্বার্থ বিঘ্নিত হবে মারাত্মকভাবে। বর্ণহিন্দুদের সামাজিক দাপট কমতে থাকবে। তাই কেবলমাত্র বর্ণহিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় ফজলুল হকের মাধ্যমিক শিক্ষাবিলের বিরুদ্ধতায় মেতে উঠলেন শ্যামাপ্রসাদ।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্র থেকে শ্যামাপ্রসাদ প্রথম আইনসভাতে যান। জাতীয় কংগ্রেস আইনসভা বর্জন করলে সংসদীয় রাজনীতির সুযোগসুবিধা ছাড়তে রাজি ছিলেন না শ্যামাপ্রসাদ। তাই নির্দল প্রার্থী হিসেবে আবার ভোটে লড়েন। কংগ্রেস তো তখন আইনসভা বয়কট করেছে। ফলে কার্যত প্রতিদ্বন্দ্বিতার কঠিন পরিবেশের বাইরেই শ্যামাপ্রসাদ জিতে যান।

এই শ্যামাপ্রসাদকে কিন্তু আরএসএস’র তৎকালীন রাজনৈতিক সংগঠন হিন্দু মহাসভা তখনই তাদের দলভুক্ত করেনি। কারণ, মেট্রোপলিটন হিন্দু বাঙালি উচ্চবর্ণের মন জয় করতে তখনও প্রত্যক্ষ সাম্প্রদায়িক পরিমণ্ডলের বাইরে রেখে, তাঁকে দিয়ে হিন্দু সাম্প্রদায়িক আবেগকে জোরদার করার কৌশলটাই হিন্দু মহাসভার কাছে সবথেকে জরুরি ছিল। তা না হলে, ফজলুল হকের সঙ্গে শ্যামাপ্রসাদের পরিবারের যতোই ব্যক্তিগতস্তরের সম্পর্ক থাকুক না কেন, শ্যামাপ্রসাদ যদি তখন সরাসরি হিন্দু মহাসভা করতেন, তাহলে তাঁকে কোনো অবস্থাতেই মন্ত্রীসভাতে নিতেন না ফজলুল হক। তাই হক মন্ত্রীসভাতে যোগদানের পর আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দু মহাসভার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরি হলো শ্যামাপ্রসাদের।

দ্বিতীয়বার মন্ত্রীসভা গঠনের আগে (’৪১) কার্যত বাধ্য হয়ে ফজলুল হক কট্টর সাম্প্রদায়িক হিন্দু শ্যামাপ্রসাদকে নিয়েছিলেন। কারণ, শরৎ বসুকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের দায়িত্ব দিয়ে মন্ত্রিসভায় আনা তিনি ঠিক করেন। কিন্তু ব্রিটিশ হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ভাঙতে, মন্ত্রিসভার শপথের দিন সকালে গ্রেপ্তার করে শরৎ বসুকে। ’৩২ সালে চাকরি, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের উপস্থিতি সুরক্ষিত রাখার যে অধিকার মানুষ দীর্ঘ লড়াই করে পেয়েছিল, শ্যামাপ্রসাদ মুসলমানদের সেই অধিকার দেওয়ার তীব্র বিরোধী ছিলেন।

প্রথম মন্ত্রীসভাতে হিন্দু-মুসলমানের ভিতর আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক সমতা আনতে ফজলুল হক বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। যেমন, কলকাতা পৌর আইন সংশোধনী, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল - এগুলির ভয়ঙ্কর বিরোধিতা শ্যামাপ্রসাদ বিধানসভার ভিতরে ও বাইরে করেছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে পাবলিক সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগের ব্যবস্থা করতেই ফজলুল হক কলকাতা কর্পোরেশন সংশোধনী আইন এনেছিলেন। কারণ, অভিজাত হিন্দুদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত কলকাতা কর্পোরেশনে নিম্নবর্গের হিন্দু এবং মুসলমানের তখন চাকরি পাওয়ার কোনো উপায়ই ছিল না। কর্পোরেশনের অভিজাত হিন্দু কর্তাব্যক্তিরা বর্ণহিন্দু ছাড়া প্রায় আর কাউকেই তখন কর্পোরেশনে চাকরি পেতে দিতেন না। যোগ্যতার ভিত্তি হোক চাকরি পাওয়ার মাপকাঠি, জাতপাত বা ধর্ম নয়, - সেই উদ্দেশেই এই আইন এনেছিলেন ফজলুল হক। শ্যামাপ্রসাদ বর্ণহিন্দুদের স্বার্থহানির জন্যে এই আইনকে আটকাতে সবরকমভাবে সক্রিয় হয়েছিলেন। যদিও বঙ্গীয় আইনসভাতে ’৩৯ সালে এই আইনটি অনুমোদিত হয়।

চরম হিন্দু সাম্প্রদায়িক শ্যামাপ্রসাদকে ফজলুল হকের সঙ্গে ব্যক্তি সম্পর্ককে ব্যবহার করে তাঁর মন্ত্রীসভাতে ঢুকিয়ে দেওয়া ছিল আরএসএস’র-ই একটা কৌশল। সেই সময়ের বাংলায় সম্প্রীতি, ধর্মনিরপেক্ষতার পূজারি ফজলুল হক সম্পর্কে অতি উচ্চ ধারণা ছিল মুসলমান সমাজের সর্বস্তরে। মন্ত্রীসভাতে শ্যামাপ্রসাদকে অন্তর্ভুক্ত করবার কয়েকমাস আগেও ফজলুল হক সমালোচনায় মুখর ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ সম্পর্কে। সেই ফজলুল হককেই নানাভাবে তেল তামাক করে শ্যামাপ্রসাদ আরএসএস’র দুরভিসন্ধির প্রয়োগ ঘটাতেই তাঁর মন্ত্রীসভাতে ঢোকেন। শ্যামাপ্রসাদের মতো কট্টর হিন্দু সাম্প্রদায়িক ব্যক্তিকে মন্ত্রীসভায় পাঠিয়ে, মুসলিম সাম্প্রদায়িক শক্তি মুসলিম লিগকে ফজলুল হকের সম্পর্কে খেপিয়ে দেওয়াটাই ছিল আরএসএস, হিন্দু মহাসভার একমাত্র উদ্দেশ্য। ধর্মনিরপেক্ষ হক সাহেবের প্রতি সর্বস্তরের বাঙালি মুসলমানের যে শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, আস্থা আছে - সেটাকে টলানোর কৌশলেই শ্যামাপ্রসাদকে ফজলুল হকের মন্ত্রীসভাতে মন্ত্রিত্ব করতে পাঠায় আরএসএস। এভাবে মুসলমান সমাজের একটা বড়ো অংশকে একইসঙ্গে হিন্দু এবং সম্প্রীতির পক্ষের ফজলুল হকের বিরুদ্ধে খেপিয়ে তোলার প্ররোচনা দেয় আরএসএস। ফজলুল হককে মুসলমান সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করতে মুসলিম লিগের আড়কাঠির ভূমিকা পালন করেছিলেন শ্যামাপ্রসাদ। কারণ, হিন্দু-মুসলমান - দু’টি সম্প্রদায়েরই উচ্চবর্ণের সাম্প্রদায়িক নেতারা বুঝেছিলেন, ফজলুল হকের সার্বিক নিয়ন্ত্রণ মুসলমান সমাজের উপরে থাকলে, সাম্প্রদায়িক স্বার্থে বাংলাভাগ করা তাদের পক্ষে সম্ভবপর হবে না।

আরএসএস, হিন্দু মহাসভা যা চেয়েছিল, তাইই হলো। নাজিমুদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী, তমিজউদ্দিন খানেরা হক মন্ত্রীসভা তৈরির সাত মাসের ভিতরে বাংলা জুড়ে ৫০০ থেকে ৮০০ জনসভা করলেন। সেখানে তাঁরা হক সাহেবকে কুইসলিং শিরোপা দিয়ে অভিযোগ করলেন যে, গোটা বাংলাকে ফজলুল হক তুলে দিয়েছেন হিন্দু মহাসভার হাতে। আরএসএস’র পাতা ফাঁদে পা দিয়ে দৈনিক আজাদ, দি মর্নিং নিউজ, স্টার অফ ইন্ডিয়া’র মতো মুসলিম লিগ সমর্থকেরা হক মন্ত্রীসভার পতনের কামনার আড়ালে বাংলাভাগে চরম উসকানি দিতে থাকল।

শ্যামাপ্রসাদ সহ বর্ণহিন্দু নেতাদের কাজে চরম বিরক্ত হয়েও ফজলুল হক কিন্তু বাংলার মুসলমানদের সর্বোময় কর্তৃত্ব জিন্নার উপর ছাড়তে রাজি ছিলেন না (এ নিয়ে জিন্না-হকের উত্তপ্ত পত্র বিনিময় আছে। ’৪৩ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি জিন্নাকে কড়া চিঠি দেন হক। জিন্না তার উত্তর দেন ১৭ ফেব্রুয়ারি। পরের দিনই হক তার উত্তর দেন। স্টার অব ইন্ডিয়া নামক সংবাদপত্রে সেগুলি প্রকাশিত হয়েছিল)। কিন্তু আরএসএস এবং মুসলিম লিগ-দু’টি সাম্প্রদায়িক সংগঠনই চাইছিল, বাংলায় হিন্দুদের একমাত্র নেতা হোন শ্যামাপ্রসাদ আর মুসলমানদের জিন্না। শ্যামাপ্রসাদের শাগরেদ হয়ে থাকুন এন সি চ্যাটার্জিরা আর জিন্নার নাজিমুদ্দিনেরা।

হক মন্ত্রীসভাতে থেকেই ফজলুল হকের প্রতি কতোখানি প্রতিশোধপরায়ণ মানসিকতা নিয়ে চলতেন শ্যামাপ্রসাদ, তা তাঁর দিনলিপি পড়লেই বোঝা যায়। তাই প্রশ্ন জাগে মন্ত্রীসভার গোপন সারকুলার, নির্দেশাবলি অত্যন্ত সহজে তৎকালীন বাংলার গভর্নর জন হার্বার্ট থেকে শুরু করে মুসলিম লিগ নেতৃবৃন্দের হাতে পৌঁছে যাওয়া ঘিরে। মুসলিম লিগকে অন্তর্ভুক্ত করে জাতীয় সরকার তৈরির জন্যে ফজলুল হকের উপর হার্বার্টের যে চাপ, তার পিছনেও শ্যামাপ্রসাদের কোনো খেলা ছিল কি না, তা গভীর গবেষণার বিষয়।

বর্ণহিন্দুদের স্বার্থরক্ষায় নিবেদিত প্রাণ হিন্দু মহাসভা বা তাদের সেই সময়ের একজন নেতাও নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের সামাজিক-অর্থনৈতিক স্বার্থ নিয়ে ভাবেনি। তপশিলি জাতি-উপজাতির মানুষদের অধিকার ঘিরে সেদিন সবথেকে সচেতন এবং সরব রাজনীতিক ছিলেন যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল। সোহরাওয়ার্দি বা খাজা নাজিমুদ্দিনের মতো মানুষ তাঁকে যথেষ্ট রাজনৈতিক গুরুত্ব দিতেন। মর্যাদার আসনে বসিয়ে তাঁরা তাঁদের মন্ত্রীসভার সদস্যও করেছিলেন যোগেন মণ্ডলকে। অথচ হিন্দুস্বার্থ ঘিরে বাংলাভাগের সমর্থক শ্যামাপ্রসাদ কিন্তু ন্যূনতম সম্মান যোগেন মণ্ডলের প্রতি দেখাননি। হিন্দু মহাসভা বা শ্যামাপ্রসাদের কাছে হিন্দুস্বার্থ মানে ছিল কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ্যবাদী বর্ণহিন্দুদের স্বার্থ দেখা। সেইখানে নিম্নবর্গীয় হিন্দুদের এতোটুকু জায়গা ছিল না। নিজের দিনলিপিতে যোগেন মণ্ডল সম্পর্কে যে ধরনের মন্তব্য শ্যামাপ্রসাদ করেছেন, সমসাময়িক একজন রাজনৈতিক নেতা সম্পর্কে অতো কুরুচিকর মন্তব্য যে করা যায়, তা ভাবতেই আমাদের অবাক লাগে।