৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
দুঃসময়ের চালচিত্র - ২
বরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়
গত সপ্তাহে দুঃসময়ের চালচিত্র-১ শেষ করেছিলাম রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়ে। এবার দুঃসময়ের চালচিত্র-২। যেখান থেকে শেষ করেছিলাম সেখান থেকেই শুরু করি। মানে রবীন্দ্রনাথকে দিয়েই। ১৮৮৫ সালের ১৫ এপ্রিল প্রকাশিত হয় প্রবন্ধ গ্রন্থ ‘আলোচনা’। যেখানে ‘ডুবিবার ক্ষমতা’ প্রবন্ধে তিনি লিখছেন - ‘…ক্ষুদ্রেরা মনে করেন, জগতের সর্বত্রই তাঁহাদের হাঁটুজল, ডুবজল কোনোখানেই নাই। জগতের সকলেরই উপরে ইহারা মাথা তুলিয়া আছেন-…। ইহারা যে জগতের অসম্পূর্ণতা ও নিজের মহত্ব লইয়া গর্ব করিতেছেন, ইহাদের গর্ব ঘুচিয়া যায় যদি জানিতে পারেন ডুব দিবার ক্ষমতা ও অধিকার সকলের নাই।…’ কে ক্ষুদ্র, কে বৃহৎ - সে বিতর্কে না ঢুকেও সাধারণভাবেই বলা যায় - ডুববার ক্ষমতা, ডোবানোর ক্ষমতা বা ডুবিয়ে দেবার ক্ষমতা সকলের থাকে না। তিলে তিলে সম্পূর্ণ ডুবে যাওয়া অথবা গা ঝাড়া দিয়ে ভেসে ওঠা। তার জন্য লড়াই, সংগ্রাম - এই নিয়েই তো মানুষের বেঁচে থাকা। আমরা সকলেই যার যার মতো করে কাজ করি - ঘটনা পরম্পরা বিচার করে পরে সিদ্ধান্ত হয়। এই কর্মপদ্ধতিতে মনুষ্যকুল কতটা ডুবল বা কতটুকু ভাসল। যেহেতু ‘দুঃসময়ের চালচিত্র’ - এ একটা বিশেষ বা নির্দিষ্ট সময়কে ধরার চেষ্টা করছি, তাই আর ভণিতা না করে সরাসরি বরং আলোচনায় ঢুকি।
পৃথিবী জুড়ে সাম্প্রতিক বিপর্যয় যেহেতু করোনাকে ঘিরেই আবর্তিত - তাই এখানেও মূল আলোচ্য অবশ্যই করোনা। তবে করোনাময় বিশ্ব নিয়ে নয়। আমরা কোনো সীমান্ত বিবাদে যাব না। ভারত নিয়েই থাকব। আমাদের করোনা সংক্রমণ নিয়ে ভয় পাওয়া উচিত, নাকি করোনাকে শিখণ্ডী করে এই সময়েই ‘এই কোরোনা’ ‘ওই কোরোনা’ বলে অনেক কিছু করে নেওয়াকে নিয়ে উদ্বেগে থাকা উচিত তা নিয়েই আলোচনার গণ্ডী কেটে নেওয়া যাক। লকডাউনে সবকিছু বন্ধ থাকার সময়, দেশের বহু মানুষ যখন দু’মুঠো খাবারের জন্য হাহাকার করছেন, তখনই তো রামমন্দিরের নির্মাণ শুরু করে দেওয়া হয়েছে। কাজেই মহাকাব্য রামায়ণ শিরোধার্য করে ভারতের ‘করোনায়ন’ পর্বে আমিও নাহয় আমার আলোচনায় লক্ষ্ণণের গণ্ডী কাটলাম।
আলোচনার সুবিধার জন্য করোনার একটা কালানুক্রম করে নেওয়া যেতে পারে। তাতে ‘আচ্ছে দিন’-এর কালান্তক মিথ্যে নেশায় বুঁদ হয়ে থাকা অবুঝদের বুঝতে হয়তো কিছুটা সুবিধা হবে।
৩০ জানুয়ারি কেরলে ভারতের প্রথম করোনা সংক্রমিতের খোঁজ পাওয়া গেছিলো। বিদেশ ফেরত ২০ বছর বয়সী এক যুবতীর শরীরে। ১০ মার্চ দেশে প্রথম করোনা সংক্রমিতের মৃত্যু হয় কর্ণাটকে। ৭৬ বছর বয়সী ওই বৃদ্ধেরও বিদেশ থেকে ফেরার ইতিহাস ছিলো। অর্থাৎ একটা জিনিস স্পষ্ট যে, করোনা আমাদের দেশে আমদানি হয়েছে বিদেশ থেকেই। প্রশ্ন একটাই - ৩০ জানুয়ারি থেকে ১০ মার্চ বা লকডাউন যেদিন ঘোষণা হলো - ২৪ মার্চ রাত ৮টা। মাঝের এই ৫৪ দিন আমরা কী করলাম? করোনা মোকাবিলায় যথেষ্ট প্রস্তুতি কি নিলাম? নাকি অন্য কিছু করলাম?
এখানে একটা কথা বলে নিতেই হবে। ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে এক ট্যুইটে কংগ্রেস সাংসদ রাহুল গান্ধী করোনা নিয়ে সাবধান করেছিলেন। ১২ ফেব্রুয়ারি বিকেল ৩.৪৬। news.harvard.edu-র ‘Coronavirus cases hit 17,400 and are likely to surge’ শীর্ষক প্রতিবেদন উদ্ধৃত করে তিনি লিখেছিলেন - “করোনা ভাইরাস আমাদের দেশের মানুষ এবং দেশের অর্থনীতির জন্য এক ভয়ঙ্কর বিপদ। আমার মনে হয় সরকার বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে দেখছে না। সময়মত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
এর ঠিক পরের দিন, ১৩ ফেব্রুয়ারি সরকারি সূত্র উদ্ধৃত করে বিকেল ৫.৩১ মিনিটে এক ট্যুইট বার্তায় সংবাদসংস্থা পিটিআই (বর্তমানে প্রসার ভারতীর দ্বারা দেশদ্রোহীর তকমাপ্রাপ্ত) জানায় - “Coronavirus is not a health emergency”. অর্থাৎ করোনা বিষয়টা ততটা গুরুত্বপূর্ণ নয় একেবারেই। অথচ জানুয়ারির ৩০ তারিখ প্রথম করোনা সংক্রমণ ধরা পড়ার পর ততদিনে সংক্রমিতের সংখ্যা ১০০ ছুঁই ছুঁই। যদিও ওই সময়ে দেশে করোনা সংক্রমণে প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে গেছে কর্ণাটকে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডাঃ হর্ষবর্ধন এর কিছুদিন আগেই এক বিবৃতিতে জানিয়েছিলেন - দেশ করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় সম্পূর্ণ প্রস্তুত এবং এক মন্ত্রীগোষ্ঠী এই বিষয়ে লক্ষ্য রাখছেন। আর হ্যাঁ, কোনো কিছুরই তোয়াক্কা না করে ২৪ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পকে লক্ষ মানুষের সমাবেশ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছে। যার পোশাকি নাম ছিলো ‘নমস্তে ট্রাম্প’।
‘ক্রোনোলজি’ শব্দটা শেষ কয়েক মাসে এতবার ব্যবহৃত হয়েছে যে আর ব্যবহার করতে ইচ্ছে করেনা। অনেকটা ওই উন্নয়ন, অনুপ্রেরণা শব্দগুলোর মত। যাক সেকথা। তবে একথাও সত্যি, ৩০ জানুয়ারি থেকে ১৩ মার্চ পর্যন্ত - ৪৩ দিন করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ঠিক কী কী হয়েছে সে প্রশ্ন আগামীদিনে উঠবেই।
এরই মধ্যে করোনাজনিত পরিস্থিতির কারণে দায়িত্বশীল ভূমিকার পরিচয় দিয়ে ঘোষিত কর্মসূচি বাতিল করে সিপিআই(এম)। ১৭ মার্চ বিকেল ৩.২২ মিনিটে এক ট্যুইট বার্তায় পলিট ব্যুরোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি লেখেন - করোনা ভাইরাস মহামারী পরিস্থিতির কারণে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে কোনো বড়ো জমায়েত বা সমাবেশ করা হবেনা। তাই শহিদ ভগৎ সিং, রাজগুরু, সুখদেব-এর আত্মবলিদান দিবস প্রতীকীভাবে উদ্যাপন করা হবে। বলে নেওয়া ভালো ১৭ মার্চ তারিখে দেশে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ছিলো ১৩৭ এবং সংক্রমণে মৃত্যুর সংখ্যা ছিলো ৩।
না। বিরোধীরা যতই সাবধান করুক না কেন, দেশে রাজনীতির পাশা খেলায় দান উল্টে দেওয়া থেমে থাকেনি। এর মধ্যেই ২০ মার্চ ঘোড়া কেনাবেচা করে মধ্যপ্রদেশে সরকার ফেলে দেওয়া হয়। কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ১৫ মাসের কমলনাথ সরকার ফেলা হয় ২২ জন কংগ্রেস বিধায়ককে ইস্তফা দিইয়ে। কীসের বিনিময়ে সে বিতর্কে ঢোকার রুচি নেই। আর এই মুহূর্তে দলবদল করা ১১ কংগ্রেস বিধায়কই বিধায়ক না থেকেও মধ্যপ্রদেশে বিজেপি সরকারের মন্ত্রী হয়ে গেছেন।
ভারতের মাটিতে আন্তর্জাতিক উড়ান নামা নিষিদ্ধ হয় ২২ মার্চ। আর এই দিনই দেশে পালিত হয় ১৪ ঘণ্টার জনতা কারফিউ। সারাদিনের পরে বিকেল ৫টায় বড়ো বড়ো জমায়েত করে কেন দেশজুড়ে ‘গো করোনা গো’ বলে উদ্দাম নৃত্য বা থালা বাজানোর গণ হিস্টিরিয়া তৈরি তা স্পষ্ট নয়। তবে এতে করোনা যে তাড়ানো যায়নি তার প্রমাণ তো এখন পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যেই ২৩ মার্চ শপথ নেন শিবরাজ সিং চৌহান। ২৪ মার্চ রাত ৮ টায় চার ঘণ্টার নোটিশে লকডাউনের ঘোষণা। ২৫ মার্চ রাত ১২ টা থেকে দেশে প্রথম দফার ২১ দিনের লকডাউন শুরু। অর্থাৎ প্রথম সংক্রমণের খবর আসার পর থেকে নিজেদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড-টাণ্ড শেষ করে ব্যবস্থা নিতে পুরো ৫৫ দিন। যেদিন দেশে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ৬০৬ এবং মৃত ১০।
দেশে লকডাউন শুরুর পরেই প্রথম ক’দিন জ্ঞানবুদ্ধি থাকা বিচার বিবেচনা করতে পারা মানুষের আলোচনায় ছিল পরিযায়ী শ্রমিকদের দুর্দশার কথা। ছিল করোনা সংক্রমণের কথা। যদিও তাৎপর্যপূর্ণভাবে দিন কয়েকের মধ্যেই পরিযায়ী শ্রমিক, করোনার থেকেও বেশি আলোচনায় নিয়ে আসা হলো নিজামুদ্দিন, তবলিগি জামাত। এমনকি নিয়ম করে বিভিন্ন রাজ্যের করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা বলার সময় তাঁদের কতজনের নিজামুদ্দিন বা তবলিগি জামাত যোগ আছে তাও বলা হতো। যার পক্ষে বিপক্ষে ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে ঝড়। এর পাশাপাশি মানুষের মনে গেঁথে দেওয়া হলো-এটা নাকি রাজনীতি করার সময় নয়। অথচ বিষয়গুলো এমনই যে বলতে গেলে রাজনীতি ছাড়া আর কিছু আসবে না। আর এই সময় নিজামুদ্দিন, তবলিগি জামাত নিয়ে তাঁরাই বেশি বললেন, যারা ওই সময় প্রায় প্রতি ঢোকে একবার করে বলে গেছেন, ‘এই সময় রাজনীতি করবেন না।’
কিন্তু সবই যখন রাজনীতি তখন ছদ্ম আবরণ রেখে লাভ কী? এমনিতেই তো করোনা অনেকের আড়ালে থাকা মুখোশগুলোকে মুখের সামনে এনে দিয়েছে। এখন বেশ স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। তাই একটু নাহয় বলাই যাক। এইসময় রাজনীতি তো করতেই হবে। কারো কারো না পসন্দ হলেও।
তা নাহলে আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যান আর দেশীয় পরিসংখ্যানে আকাশ পাতাল ফারাকটা প্রতিদিন বাড়বে - আপনি তাল খুঁজে পাবেন না। পরিযায়ী শ্রমিকদের সমস্যা কখন নিজামুদ্দিনের দিকে ঘুরে যাবে রামায়ণ দেখতে দেখতে বুঝতেই পারবেন না। তখন উলটো গোণা শুরু করতে হবে... ছয় থেকে ফিরে যেতে হবে তিন...
যদিও এটা কোনো তুলনামূলক আলোচনা নয় তবু তিরুপতিতে গত ১৪ থেকে ১৯ মার্চ পর্যন্ত দর্শনার্থীর সংখ্যা কত ছিল তা একটু সংশ্লিষ্ট ওয়েবসাইটে গেলেই দেখা যাবে। সংখ্যাটা ৩ লক্ষের বেশি। না। একবারের জন্য আলোচনায় আসেনি সেই নাম অথবা নমস্তে ট্রাম্প নামক বড়ো জমায়েতের কথা।
অন্যদিকে পরিযায়ী শ্রমিকদের কী হলো? কোন্ রাজ্যে কত শ্রমিক আটকে পড়েছিলেন, কাদের জন্য তাদের এই দুর্দশা সে কথা বাদ দিন। দ্য ওয়ারের এক প্রতিবেদন অনুসারে - অপরিকল্পিত লকডাউনে অনাহার এবং অর্থনৈতিক দুর্দশায় - ৪৭ জন, হেঁটে বাড়ি ফিরতে গিয়ে - ২৬ জন, পুলিশি নৃশংসতায় - ১২ জন, চিকিৎসা না পেয়ে - ৪০ জন, আতঙ্কে আত্মহত্যা - ৮৩, বিভিন্ন দুর্ঘটনায় - ৭৪ জন, হিংসার ঘটনায় - ১৪ জন মারা গেছে। কুছ কা বিকাশ, সবকা নাশ।
ভুলে যাননি নিশ্চয়ই ৫ এপ্রিল রাত ৯টায় ৯ মিনিটের জন্য বিদ্যুৎ বন্ধ করে মোমবাতি জ্বালানোর কথা। যেদিন দেশে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ৩,৫৭৭ এবং মৃতের সংখ্যা ৮৩। মুশকিলের বিষয় হলো, করোনা যুদ্ধে লড়াই করবার জন্য যখন স্বাস্থ্যকর্মীদের যথেষ্ট সুরক্ষা সরঞ্জামের ব্যবস্থা করতে পারেনি কী কেন্দ্র, কী রাজ্য; প্রায় দিশাহীনভাবে আগের ৫৫ দিন কাটিয়েছে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মধ্যে, লকডাউন শুরুর দিন ২৫ মার্চ ভোরবেলা উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ দলবল নিয়ে পৌঁছে গেছেন অযোধ্যায় বিশেষ আরতি করতে - তখনই দেশের মানুষকে বৈজ্ঞানিকভাবে সচেতন করার বদলে এগিয়ে দেওয়া হয়েছে থালা বাজানো, মোমবাতি জ্বালানোর মতো কিছু অবৈজ্ঞানিক কাজে।
দুঃসময়ের চালচিত্র-২ আর বাড়াবো না। শুধু একবার জেনে নেওয়া আজ দেশে করোনা পরিস্থিতির টাটকা পরিসংখ্যান। ৯ জুলাই সকাল ৮টায় কেন্দ্রীয় সরকারের স্বাস্থ্য দপ্তর প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুসারে দেশে মোট করোনা সংক্রমিতের সংখ্যা ৭,৬৭,২৯৬। মৃত ২১,১২৯। আর হ্যাঁ। বিশ্বে করোনা সংক্রমিতের সংখ্যায় ভারতের স্থান এখন বিশ্বের মধ্যে তৃতীয়। ‘ভারত আবার জগৎ সভায় শ্রেষ্ঠ …’। না, বিশ্বাস করুন। বামপন্থীরা এভাবে ভারতকে জগৎসভায় শ্রেষ্ঠ দেখতে চায় না।