৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
হাকিমনামা, হুকুমনামা
পল্লব সেনগুপ্ত
ছোটবেলা থেকে শুনে এসেছি, আদালত হলো - ইংরেজিতে যাকে একটু ঠাট্টার ভঙ্গিতে বলা হয় ‘‘সিজার’স ওয়াইফ’’, মানে সব নিন্দেমন্দর বাইরে - সেইরকমের একখানা জবরদস্ত প্রতিষ্ঠান। আমি তো ছাপোষা মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলে, ওইসব আপ্তবাক্য-মার্কা কথাবার্তা কিছু কিঞ্চিৎ দুরুদুরু বক্ষেই মানতে অভ্যস্ত! যাঁরা ‘সোচ্চার চিন্তা’ - এই কলামটা বছরের-পর-বছর ধরে পড়ে আসছেন, তাঁদের কারুর-কারুর নিশ্চয়ই মনে পড়বে যে, এমনধারা মধ্যবিত্ত-সতর্কতার কিন্তু মাঝে-মধ্যে একটু-আধটু যে ব্যতিক্রম ঘটেনি, এমনটা নয়; তবে ইদানিং পরপর এমনকিছু ব্যাপার স্যাপারের সঙ্গে একাধিক হাইকোর্ট, মায় খোদ সুপ্রিম কোর্ট এবং স্বয়ং প্রধান বিচারপতি মহোদয়ের নামও জড়িয়ে গেছে, যে আর রেখেঢেকে কিছু বলতে গেলে ঢোক গিলতে বাধবে। জানি মশাইরা, পাছে আদালত-অবমাননা হয়ে যায়, এমনই ভাবছেন আপনারা! না, আদালতের কোনো সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ করছি নে; শুধু যে খানকতক প্রশ্ন গুড়গুড়িয়ে উঠছে মাথার মধ্যে, সেগুলোই একটু সোচ্চারে নিবেদন করি বরঞ্চ।
এক নম্বর প্রশ্নের বয়স অন্যগুলোর চেয়ে একটু বেশি। মাস দুই দেড়েক আগের কথা। কেরল রাজ্যের বিখ্যাত গুরুভায়র মন্দিরের পক্ষ থেকে ওই রাজ্যের করোনা-আক্রান্ত এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বিপন্ন মানুষদের চিকিৎসা এবং ত্রাণের জন্য কেরল সরকারের হাতে দান তুলে দেওয়া হয়েছিল। কয়েক সপ্তাহ আগে কিছু ‘ধর্মপ্রাণ’ হিন্দু এই দানের বিরুদ্ধে তিরুবনন্তপুরম হাইকোর্টে একটা মামলা দায়ের করেছেন। ওঁদের বাহানা হলো, ‘দেবতার’ সেবায় নিবেদন করা সম্পদ ‘মানুষের’ সেবায় লাগালে শুধু অন্যায় নয়, ‘পাপ’ হবে! এ হেন পাপ-পুণ্যের ‘দৈবীবিধান’ আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত কিনা, সেই বিচার না করেই মহামান্য হাইকোর্ট মামলাটিকে গ্রহণ করেছেন। অস্যার্থ, ধর্মনিরপেক্ষ বলে সংবিধান নির্দিষ্ট বিধিকে এখানে প্রকারান্তরে অমান্যই করা হলো। যতই স্বামী বিবেকানন্দ প্রমুখ মনীষীরা ‘‘জীবে প্রেম করে যেইজন, সেইজন সেবিছে ঈশ্বর’’ বলুন না কেন, স্বঘোষিত ঈশ্বরভক্তরা সেসবে কান দেবেন না এবং তাঁদের সেই মানবতা-বিরোধী ভগবদ্ভক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়া হলো ন্যায়াধিকরণ থেকে। জানিনে, সুপ্রিমকোর্টের নির্দেশে শবরীমালা মন্দির সমস্ত বয়সের মেয়েদের জন্য উন্মুক্ত করে দেবার ‘অপরাধেই’ ক্রুদ্ধ-থাকা এই ধর্মধ্বজীরা কেরল সরকারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছে কিনা এবং সেই সুমহান-ইতরতাকে প্রশ্রয় দিয়েছেন মহামান্য হাইকোর্ট!!! ...আচ্ছা, আমার প্রথম বয়সে শোনা একটা লোকপ্রসিদ্ধির উল্লেখ যদি এখানে করি ধর্মপ্রাণংদের পরিভাষায় ‘পাপ’ হবে কি? ...হলে হবে, তবু বলি: জীবনের প্রথম তিনটে দশক কালিঘাট পাড়ার বাসিন্দা ছিলুম। তো, ওখানে একটা মুখ চল্তি কথা আছে, ‘‘কালিঘাট পাড়ায় কাউকে কিছু দিয়ে থুয়ে ফেরত চাইলে মায়ের মন্দিরের কুকুর হয়ে জন্মায় পরের বার।’’ এধরনের কোনো কিছু লোকপ্রবচন গুরুভায়ুর মন্দিরের মহল্লায় প্রচলিত আছে কিনা, এই অভাজনের সেটা অবশ্য জানা নেই!!
।। দুই ।।
এরপরের আদালতি-নিদানটি হেঁকেছিলেন ভারতের প্রধান বিচারপতি মান্যবর এস এ বোবড়ে মহোদয় স্বয়ং। এই করোনা-মহাযুদ্ধের ভয়ঙ্কর সময়ে যখন দেশের সর্বত্রই কমবেশি লকডাউন চলছে এবং বড়সড় জনসমাবেশ করা নিষিদ্ধ বলে সরকারি নির্দেশ জারি আছে ভারতজুড়ে, তখন পুরীর রথযাত্রার মিছিল না-বের করার জন্য সুপ্রিমকোর্টের সরাসরি নির্দেশ চেয়ে শুনানি চাওয়া হয়েছিল কোনো-কোনো সদ্বুদ্ধিসম্পন্ন গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে।
অল্প সময়ের মধ্যেই মামলার রায় ঘোষণা করলেন প্রধান বিচারপতি মান্যবর বোবড়ে মহোদয়। খুবই বাঞ্ছিত এবং স্বাগত রায়: এই করোনার ভরামরশুমে রথযাত্রার মিছিল - যেখানে কয়েক লক্ষের কাছাকাছি মানুষ জড়ো হন, সেখানে এমন জনসমাগম হতে দেওয়া যাবে না। এটাই বলা যথেষ্ট ছিল। কিন্তু মান্যবর আরও একটু এগিয়ে বলে বসলেন: ‘‘সেটা হতে দিলে প্রভু জগন্নাথই আমাদের ক্ষমা করবেন না!’’ ভারতীয় সংবিধান এখনও যেহেতু ধর্মনিরপেক্ষতা মেনে চলে (নাগপুরিয়া ব্রিগেড এখনও সেটাকে বাতিল করাতে পারেনি!) তাই কোনো আইনি রায় প্রভু ‘অমুক’নাথ, ‘তমুক’নাথের দোহাই পেড়ে ঘোষণা করাটা সংবিধানসম্মত হয়েছিল? জানিনে ভাই, আমার যতটুকু বিদ্যেসাধ্যি তাতে তো তেমন কোনো বিধিবিধান সেখানে আছে বলে তো মনে পড়ে না! আপনাদের পড়ে কি? কিন্তু ‘‘পিকচার আভি বাকি থা’’ ...ঠিক দু’দিনের মাথায় প্রভু জগন্নাথ তাঁহাদেরকে ‘ক্ষমা করিয়া দিলেন’ (কোন্ অজানা রহস্যের কারণে বলা কঠিন!)। খোদ বোবড়ে সাহেবই নিজের রায়ের পুনর্বিচার করে হুকুমনামা জারি করলেন যে: ‘‘হ্যাঁ, রথের মিছিল বেরোতে পারবে, তবে সরকারি বয়ানে যাকে সামাজিক-দূরত্ব বজায় বলা হচ্ছে সেটা মেনে!’’ তবে কি স্বয়ং জগন্নাথ ঠাকুরজিও মাননীয় ন-মো মহাশয়ের ওরফে গেরুয়া বাহিনীর নির্দেশের তর্জনী-সঞ্চালনের ফলশ্রুতিতে মহামান্য বোবড়েজি উচ্চারিত সেই ‘‘ক্ষমা’’ বিতরণ করলেন? ...মাননীয় বোবড়েজিকে নিয়ে পরে আরও কিছু কথা বলছি। তার আগে একটা কুটিল প্রশ্ন না করে পারছি ন! ...দেশের সর্বত্রই তবলিগ-ই-জমায়েতের সেই বহুচর্চিত সমাবেশ নিয়ে করোনা-মহামারীর সূত্রে বহু কথা হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, বিশেষ ধর্মীয় সমাবেশটির কারণেও এদেশে করোনা প্রথমদিকে কিছুটা বিস্তৃতি লাভ করেছে। এজন্যে যা কিছু যত কিছু বলা হয়েছে, হচ্ছে এখনও - তা কিছুটা ঠিক। কিন্তু তার চেয়েও বড় সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন স্বয়ং নরেন্দ্র মোদী ডোনাল্ড ট্রাম্পকে ভারতবাসীর ‘পেন্নাম’ জানাতে (মনে রাখবেন, ওই সমাবেশের আনুষ্ঠানিক নাম ছিল ‘নমস্তে ট্রাম্প’!) এবং গুজরাট ও মহারাষ্ট্রে করোনার এমন ভয়াবহ ব্যাপকতা ছড়ানোর উৎসে যে সেটিই, সে ব্যাপারে কিন্তু গৈরিক গুন্ডাদের ধামাধরা মিডিয়া একেবারে স্পিকটি নট! তবলিগি জমায়েতের সঙ্গে সংখ্যালঘুরা জড়িত বলে সেইটাকেই শুধু কাঠগড়ায় তোলা হবে, আর ট্রাম্প-বন্দনার জন্য জমায়েতের বাবদে দায়ী যিনি, তাঁকে ছাড় দেওয়া হবে - এ কেমন কথা? ...আর রথযাত্রা, পুরীর শোভাযাত্রার যা ছবি দেখা গেল দূরপ্রেক্ষণে তাতেও তো সামাজিক-দূরত্বের বিধি থোড়াই মানা হয়েছে! এবং ওই ‘প্রভুর ক্ষমা’-র সুবাদে এই রাজ্যে আর যেসব রথের মিছিল বেড়িয়েছে সেখানেও তো ঘোষিত সরকারি বিধিকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়েছেন ভক্তকুল! তাহলে, বোবড়ে সাহেবের হুকুমনামা কি নেহাতই একটা ‘সছিদ্রবাচন’ ওরফে ‘ছেঁদো-কথা’ হয়ে যায়নি? নাকি হিন্দুধর্ম এবং সরকারি কর্ম - এরা আইনের, আদালতের এক্তিয়ারের বাইরে?
।। তিন ।।
এরপরের যে দুটি হাকিমি-ফরমানের কথা বলতে হচ্ছে, তার একটি হলো গুয়াহাটি হাইকোর্টের এবং অন্যটি বেঙ্গালেরুর। একটা বিবাহ বিচ্ছেদের মামলার বিচার করতে গিয়ে, গুয়াহাটির মান্যবর দুই বিচারক মহোদয়ে বলেছেন (খানিকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই) যে, হিন্দু ধর্মাবলম্বী ‘এয়োস্ত্রী’ যদি শাঁখা এবং সিঁদুর না পরেন, তাহলে স্বামী স্বচ্ছন্দে স্ত্রীকে ডিভোর্স করতে পারেন!! এই দুই মহামতি বিচারপতি কিন্তু তথাকথিত ‘শাস্তর’ ঘেঁটে এই ফতোয়া দেননি, কেননা সেরকম কোনো বিধানই সেসবের মধ্যে নেই। ওটা নিতান্তই দেশাচার। হিন্দু ধর্ম-স্বীকৃত আটরকম বিবাহ পদ্ধতির কোনওটিতেই সুনির্দিষ্টভাবে শাঁখা এবং সিঁদুরের কথা উল্লেখিত নেই। শাঁখাটা পূর্বভারতে প্রচলিত থাকলেও, দেশের অন্যত্র তার ব্যবহার দেখা যায় না। এমনকি উজানি-তথা উত্তর অসমেও তার চল নেই। পশ্চিম এবং দক্ষিণ ভারতের বহু মহিলা সিঁদুরের ব্যবহার করেন না। পক্ষান্তরে, গত শতাব্দীতেও নদীয়া, যশোর প্রভৃতি অঞ্চলের বহু গ্রামেই মুসলিম বিবাহিত মহিলারাও অঙ্গভূষণ হিসেবে সিঁদুর পরতেন যে, এ আমি ছোটবেলার স্মৃতি থেকে উদ্ধার করতে পারি।
মাননীয় বিচারপতিরা প্রাথমিকভাবেই যেটা বিস্মৃত হয়েছেন বলে মনে করা যায় যে, ধর্মবিশেষের বিবাহিতা মহিলাদের যদি বিয়ের ‘চিহ্ন’ হিসেবে কিছু পরা বা ধারণ করা ‘বাধ্যতামূলক’ হয়, তাহলে তো সংবিধান নির্দেশিত ‘‘কাস্ট, ক্রিড, রিলিজন অ্যান্ড জেন্ডার’’-এর মধ্যে অসাম্য না করার যে নির্দেশ আছে, সেটিও চৌপাট হয়ে যায়। কে শাঁখা পরবেন বা পরবেন না, সিঁদুর মাথায় ছোঁয়াবেন কি ছোঁয়াবেন না - সেটা তাঁর একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। কোনো আদালতই তাঁর সেই ব্যক্তিস্বাধীনতার হানি করতে অধিকারী নয়। শরিয়তি ফতোয়ার বিরুদ্ধে এতো সোচ্চার হন মহান আর্যধর্মের রক্ষকরা, তা এই শাঁখা-সিঁদুরীয় হুকুমনামার সঙ্গে শরিয়তি নিদানের সংকীর্ণতার মৌলিক কিছু ফারাক আছে কি?
সমাজবিজ্ঞানীরা সাক্ষ্য দেবেন। শাঁখা এবং সিঁদুর - দুটোই হলো ভারতীয় সামাজিক ধারায় অস্ট্রো-কোল নৃগোষ্ঠীর অবদান। সিঁদুর এবং শাঁখা দুটোর সঙ্গেই নারীর উর্বরতার একটা সংস্কার তাঁদের মধ্যে সুপ্রাচীনকাল থেকে প্রচলিত তাই বিয়ের পরে মেয়েদের উর্বরত্ব বিঘোষণের জন্য ওগুলির ব্যবহার তাঁদের জনজাতীয় প্রত্যয়ের লব্ধফল। হিন্দুধর্ম এগুলিকে নারীর অধীনতার চিহ্ন হিসেবে লুফে নিয়েছে - যদিও সামগ্রিকভাবে সমস্ত জনজাতি-আদিবাসী গোষ্ঠীকেই সীমানার বাইরে রাখতে চেয়েছেন সমাজপতিরা! তাই আজকে কোনো আদালতি রায়ে যদি সেই বকেয়া চিন্তাধারারই পোষকতা করা হয়, তাহলে তার চেয়ে আশ্চর্যজনক আর কী হতে পারে বলুন তো?
কর্ণাটকের জজসাহেবের রায়টিও বিচিত্র! এবং আপত্তিকর। একটি নারী ধর্ষণের মামলার বিচার করতে গিয়ে সংশ্লিষ্ট মান্যবর মন্তব্য করেছেন: ‘‘ধর্ষণের পরে (ক্লান্ত এবং বিধ্বস্ত হলেও) ঘুমিয়ে পড়ে অভিযোগকারিণী ‘ভারতীয়’ নারীত্বের যে ঐতিহ্য আছে, তার অবমাননা করেছেন।’’ অস্যার্থ, ধর্ষক দোষী কী না সেই বিচারের আগে, ধর্ষিতাকেই মান্যবর হাকিম দোষী বানিয়ে দিলেন! এমন কথা শুনলে তো ক্রুদ্ধ হতেও ঘৃণা হয়। কী বলতে চান হামিক? ধর্ষণ হওয়াটা ভারতীয় ঐতিহ্য এবং ধর্ষিতার সেই উৎপীড়নের পরে জাগ্রত থাকাটাও তাই? অভাগিনী মেয়েটি বিধ্বস্ত দেহে-মনে আচ্ছন্ন হয়েছিলেন এবং পরিণামে ঘুমিয়ে পড়েন ক্লান্তির ভারে। ঠিক এই কারণে, বিদ্বৎবর হাকিম ধর্ষণের ঘটনাটির সত্যতা নিয়েই সন্দিহান হয়েছেন এবং অভিযুক্তকে প্রায় বিনাশর্তেই জামিন দিয়েছেন।
অভিযোগকারিণী অভিযুক্তের পরিচিত এবং রাত্রে তাঁর দফতরে দেখা করতে গিয়েছিলেন - এই কারণেও ধর্ষণের সত্যতা নিয়েই সন্দিগ্ধ হাকিমবর! পার্ক স্ট্রিটের সেই সুজানের মামলাটার স্মৃতি উস্কে দিচ্ছে এইসব কথা। সেখানে শাসকবৃন্দ নিজেদের অনুগতের দোষ স্খলনের জন্য এই ধরনের খাম্-যুক্তির অবতারণা করেছিলেন রাজনৈতিক স্বার্থে। তবে কলকাতা হাইকোর্টে সেই অপযুক্তিগুলো ধোঁপে টেকেনি। কারণ আইন তেমনটা ভাবে না। কিন্তু কর্ণাটকে তো আইনি শিলমোহর মেরে দেওয়া হলো এবং সঙ্গে সঙ্গে, ‘‘ভারতীয় সংস্কৃতির ঐতিহ্য’’ ইত্যাদি কথা বলে বিপন্ন মেয়েটির গায়েই দোষীর ছাপ্পা মেরে নাগপুরিয়া পশ্চাদমুখিনতারই প্রশ্রয় দেওয়া হলো নাকি?
।। চার ।।
শেষ করব হুকুমনামা নয়, হাকিমনামার ব্যাখ্যানা করে। পুনরপি, মহামান্য প্রধান বিচারপতি বোবড়ে মহোদয়ের প্রসঙ্গ: ক’দিন আগে নাগপুরের পথে (আবার নাগপুর! অবশ্য বোবড়ে সাহেবও ‘নাগপুর-বিট্টা’, ওখানকার ভূমিপুত্র!!) তাঁর একটি অনবদ্য ছবি দূরপ্রেক্ষণ এবং সংবাদপত্র - দুই মাধ্যমেই দেখা গেছে। বিখ্যাত মার্কিনি মোটরবাইক সংস্থা হার্লে-ডেভিডসন কোম্পানির সদ্য-বাজারে-আসা একটি মডেলের বাইকে তিনি আসীন। তাতে কোনো দোষ নেই অবশ্য। কিন্তু ছবিতে দেখা যাচ্ছে তাঁর মুখে মাস্ক নেই (ভাগ্যিস নেই! তাহলে তো চেনাই যেত না বোধহয়!!) এবং দূরত্ববিধি না মেনেই তিনি বাইকাসীন হয়েছেন। তাছাড়া মাথায় হেলমেটও নেই যা প্রতিটি বাইকারোহীর পক্ষে বাধ্যতামূলক। যিনি ছবিটা তুলেছেন, সেই ভদ্রলোক বা ভদ্রমহিলা অবশ্য ওটাকে হার্লে-ডেভিডসন কোম্পানির বিজ্ঞাপনের এই নতুন মডেলটির (জান-পহচান লোকেরা বলছেন, সেটির দাম না কি ভারতীয় মুদ্রায় ৫০ লাখ টাকাও হতে পারে!!!) ক্যাম্পেন মেটিরিয়াল হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু যেভাবেই হোক ছবিটা ভাইরাল হয়ে যেতেই ঘটল বিপত্তি! নম্বর প্লেট দেখে জানা গেল ওটি নাগপুরের এক সেজো-মাপের বিজেপি নেতার সুপুত্রের সম্পত্তি। তিনি বাইকটি কিনে রাজভবনে এসেছিলেন এবং সেখান থেকে মান্যবর প্রধান বিচারপতি তাঁর বন্ধুপুত্রের বাইকটি দেখে শিশুর মতো সরল মনে করে তাতে চড়ে বসেন এবং টপাং করে সেই ছবি তোলা হয়েও যায় ক্যাম্পেন-মেটিরিয়াল রূপে।
বোবড়ে-সহচররা অবশ্য নানান সাফাই দিচ্ছেন এখন। উনি নাকি জানতেন না যে, ওটা কার এবং উনি বাইকপ্রেমি বলেই একটি বার শুধু চড়ে দেখছিলেন - তাই হেলমেটের কোনো ব্যাপারই সেখানে আসে না। বেশ, দেশের প্রধান বিচারপতি ‘কার-না-কার’(?) একটা বাইক ডিসপ্লে হচ্ছে দেখেই তাতে চড়ে বসবেন শুধু বাইক ভালবাসেন বলে? তাঁর পদমর্যাদার সঙ্গে এটা মানায়? তাছাড়াও ‘মাস্ক’ এবং ‘সামাজিক দূরত্ব’ এই শব্দ দুটো বেমালুম ভুলে গিয়ে? মারাহাব্বা!
সব শেষে একটা বিনীত ওবিভীত প্রশ্ন: আর সব কথা যদি মনেও না করি, তবুও একটা খিঁচ তো থেকেই যাচ্ছে; ভারতের প্রধান বিচারপতি মহোদয় জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে যেভাবেই হোক একটি বাণিজ্য সংস্থার বিপণনের মডেল হয়ে গেলেন যে! হার্লে-ডেভিডসন কোম্পানি তো ওটা চতুর্দিকে ক্যাম্পেন-মেটিরিয়াল রূপে ব্যবহার করবে!
সাধে কি আর ডি এল রায় ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে লিখেছিলেন: ‘‘সত্য সেলুকাস, কী বিচিত্র এই দেশ!’’