E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭

কেন্দ্রের সরকারের নীতির কারণেই বাড়ছে ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ

শংকর মুখার্জি


দেশের ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় অনুৎপাদক সম্পদ (নন্‌ পারফমিং অ্যাসেট) এক গুরুতর সমস্যা। ২০১৬ সালের মে মাসে ইনসলভেনসি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপসি কোড (আইবিসি) প্রণয়ন করে বিজেপি পরিচালিত এনডিএ সরকার। সরকার এখনও দাবি করে যে, বৃহৎ ঋণগ্রহীতাদের ঋণখেলাপির ফলে সৃষ্ট অনুৎপাদক সম্পদ উদ্ধারে আইবিসি একটা কার্যকর আইন। কিন্তু বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্য কথাই বলছে। ব্যাঙ্কের অনুৎপাদক সম্পদ কমাতে এই আইন খুব একটা কাজে দেয়নি। বরঞ্চ বর্তমান আর্থিক বছরে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ অবিশ্বাস্যরকমের বাড়ার একটা পরি‍‌স্থিতি তৈরি হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত করোনা-ত্রাণ প্যাকেজের ব্যাখ্যা দিতে পরপর পাঁচদিন সাংবাদিক সম্মেলন করেছিলেন অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামন। নিন্দুকেরা বলছে, ওই পাঁচদিন অর্থমন্ত্রী আসলে ঋণমেলার আয়োজন করেছিলেন। তবে ওই সাংবাদিক সম্মেলনেই অর্থমন্ত্রী একটি তথ্য আমাদের দিয়েছেন। তাতে বলা হয়েছে : ‘‘আইবিসি আইন প্রণয়নের পর ২২১টি, শতাংশের হিসেবে ৪৪ শতাংশ কেসে সফলতা পাওয়া গেছে।’’ এই সফলতার প্রচারটা যে কত শূন্যগর্ভ তাও প্রকাশ করে ফেলেছেন অর্থমন্ত্রী। তাঁর কথায় : ‘‘এই অনাদায়ী ঋণগুলিতে আদায়যোগ্য দাবি ছিল ৪ লক্ষ ১৩ হাজার কোটি টাকা। ঋণগুলিকে মিটমাট করে দেওয়া হয়েছে ১ লক্ষ ৮৪ হাজার কোটি টাকা দিয়ে।’’ অর্থাৎ, অর্থমন্ত্রীর কথাতেই পরিষ্কার যে, উল্লিখিত ওই ২২১টি ঋণমামলায় কর্পোরেট সংস্থাগুলিকে ২ লক্ষ ২৯ হাজার কোটি টাকা ঋণমকুব করা হয়েছে।

অর্থমন্ত্রী যে ৪৪ শতাংশ ঋণ মামলার কথা বলেছেন সেই সংখ্যাটাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়। এবছরের ২২ মে তারিখে ‘বিজনেস লাইন’ পত্রিকায় একটি খবর প্রকাশিত হয়েছে। যাতে বলা হচ্ছে, অর্থমন্ত্রীর ঘোষিত ২২১ কেস সংখ্যাটি মোট কেসের ৪৪ শতাংশ নয়, মাত্র ১৪ শতাংশ। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে ২০২০ সালের মার্চ পর্যন্ত ৪৫ মাস (২০১৬’র মে থেকে) সময়কালে ন্যাশনাল কোম্পানি ল টাইব্যুনালের কাছে ১৬০৪টি ঋণখেলাপের কেস গিয়েছিল। যার মধ্যে ২২১‍‌টি অর্থাৎ মাত্র ১৪ শতাংশের মীমাংসা হয়েছে। বাকি ৮৬ শতাংশ কেসে টাকা উদ্ধার হয়নি।

আইবিসি আইন অনুযায়ী তৈরি করা হয়েছে ইনসলভেনসি অ্যান্ড ব্যাঙ্করাপসি বোর্ড অব ইন্ডিয়া। ব্যাঙ্ক অনুৎপাদক সম্পদের বিষয়গুলি এই বোর্ডের কাছে নিয়ে আসে। বোর্ড বিষয়গুলিকে বিবেচনা করে ন্যাশনাল কোম্পানি ল টাইব্যুনালের কাছে স্থানান্তরিত করে। ল টাইব্যুনাল কেসগুলির দু’ভাবে মীমাংসা করে। হয় ঋণখেলাপি সংস্থাগুলিকে ১৮০-২৭০ দিনের মধ্যে অন্য সংস্থার কাছে বেচে অনুৎপাদক সম্পদ উদ্ধার করে, কিংবা সংশ্লিষ্ট সংস্থাকে দেউলিয়া ঘোষণা করে অংশ অংশ করে বিক্রি করে। শাসকদল দাবি করে, ওই আইনে ঋণের টাকা প্রথম উপায়ে শোধ না হলে দেউলিয়া ঘোষণার সুযোগ রয়েছে। সেই কারণে অনাদায়ী ঋণ এই আইনবলে বেশি আদায় হবে। কিন্তু তথ্য অন্য কথাই বলছে। ন্যাশনাল কোম্পানি ল টাইব্যুনালে যাওয়া ঋণখেলাপি কেসের মাত্র ১৪ শতাংশ মীমাংসা হয়েছে।

বৃহৎ অঙ্কের ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে টাকা আদায়ে এই আইন যে খুব একটা কার্যকর নয় তারও প্রমাণ রয়েছে। একটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি আরও পরিষ্কার হবে। রিজার্ভ ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার নির্দেশমতো ২০১৭’র জুন মাসে সব ব্যাঙ্ক মিলিয়ে ১২টি বৃহৎ অনুৎপাদক সম্পদের অ্যাকাউন্ট ন্যাশনাল কোম্পানি ল টাইব্যুনালের কাছে পাঠানো হয়। এর মোট পরিমাণ ছিল ৩ লক্ষ ৪৫ হাজার কোটি টাকা, যা ওই সময়ের মোট অনুৎপাদক সম্পদের ২৫ শতাংশ। এই ১২টি’র মধ্যে মাত্র ৭টি’র মীমাংসা হয়। যেখানে মোট দাবি ছিল ২ লক্ষ ১৩ হাজার ৭৩১ কোটি টাকা। কিন্তু উদ্ধার হয়েছে ১ লক্ষ ১২ হাজার ৮৯৪ কোটি টাকা। এবং এও শোধ করা যাবে ৪-৫ বছর ধরে কিস্তিতে। অর্থাৎ বাকি ১ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি অনাদায়ী ঋণ আর কোনোদিনই উদ্ধার হবে না।

এ সম্পর্কিত ভারত সরকার আরেকটি যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি দেশের অর্থনীতির পক্ষে আরও ভয়ানক। ২০২০ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইবিসি আইনের সুযোগ অনুযায়ী ১৩ হাজার ৫৬৬টি কেস ন্যাশনাল কোম্পানি ল টাইব্যুনালে আসার আগেই ভারত সরকার প্রত্যাহার করে নিয়েছে। এই কেসগুলিতে মোট অনাদায়ী ঋণের পরিমাণ ৫ লক্ষ কোটি টাকারও বেশি। সরকার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের কোনো ব্যাখ্যাও দেয়নি।

কেন্দ্রে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলিতে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ধারাবাহিকভাবে বেড়েই চলেছে। ২০১৪ সালে অনুৎপাদক সম্পদের পরিমাণ ছিল ২ লক্ষ ১৬ হাজার কোটি টাকা। এটাই ২০১৮ সালে বেড়ে হয় প্রায় ৮ লক্ষ ৯৫ হাজার কোটি টাকা, এবং ২০১৯ সালে সামান্য কমে ৭ লক্ষ ৩৯ হাজার কোটি টাকা। ২০২০ সালের হিসাব এখনও প্রকাশ হয়নি। একইভাবে ঋণমকুবের পরিমাণও গত ৪-৫ বছরে বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি ব্যাঙ্ক মিলিয়ে যেখানে ২০০৯-১৪ সাল পর্যন্ত ঋণমকুবের পরিমাণ ছিল ১ লক্ষ ২২ হাজার ৭৫৩কোটি টাকা, সেই পরিমাণই পরবর্তী ৪ বছরে অর্থাৎ ২০১৫-১৮-এ বৃদ্ধি পেয়ে হয় ৩ লক্ষ ৫৭ হাজার ৩৪১ কোটি। এই বৃদ্ধির পরিমাণ ওই সময়কালে পূর্ববর্তী ইউপিএ সরকারের সময়ের তুলনায় প্রায় ১৯১ শতাংশ বেশি।