৫৭ বর্ষ ৪৬ সংখ্যা / ১০ জুলাই ২০২০ / ২৫ আষাঢ় ১৪২৭
কোভিড-১৯-এর বিরুদ্ধে অসম যুদ্ধ ও অপবিজ্ঞান
তপন মিশ্র
খবর ১: বিশ্বায়িত পেটেন্ট নীতির মার
অসম যুদ্ধে একদিকে পরাভূত এবং অন্যদিকে পেশিশক্তিতে বিজয়ী সেনাপতি ডোনাল্ড ট্রাম্প। যুদ্ধের প্রতিপক্ষ করোনা এবং অস্ত্র হলো রেমডিসিভির। পরাভূত, কারণ আমেরিকায় এখন পর্যন্ত করোনা সংক্রমণ এবং মৃত্যু পৃথিবীর সর্বাধিক। বিজয়ী, কারণ আগামী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিশ্বে তৈরি হতে পারে এমন প্রায় সব রেমডিসিভির কিনে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র আমেরিকা। কয়েকদিন আগে ভারত সরকারের মাথায় প্রায় বন্দুক ঠেকিয়ে হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন নিয়ে নিয়েছিল আমেরিকা। গত এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজেই ভারত সরকারকে ধমক দেন। ভারত সরকারের সিদ্ধান্ত ছিল যে, হাইড্রক্সিক্লোরোকুইন রপ্তানি নিয়ন্ত্রিত করা হবে। তখনও ওষুধটির কোভিডের উপর কার্যকারিতা বিজ্ঞানসম্মতভাবে প্রমাণিত হয়নি। অর্থাৎ প্রেসক্রিপশনটা ট্রাম্পের এবং ধমকটাও। আমদের ৫৬ ইঞ্চি ছাতির মোদী সরকার মাথা নত করে তা মেনে নেয়। হাইড্রক্সিক্লোরোকুইনের বড়ো উৎপাদক হলো সরকারি সংস্থা বেঙ্গল কেমিক্যাল, আর রেমডিসিভিরের উৎপাদক বেসরকারি সংস্থা গিলিয়াড-সায়েন্স। এবেলা মোদী সরকার নির্বাক।
রেমডিসিভির করোনা ভাইরাসের পরীক্ষিত একটি অ্যান্টি ভাইরাল ওষুধ। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত যে, এই ওষুধ ব্যবহার করে কোভিড-১৯ থেকে দ্রুত সেরে ওঠা যায়। গিলিয়াডের দাবি যে, ওষুধটির প্রয়োগের ফলে কোভিড রোগীর হাসপাতালে থাকার সময় ৪দিন কমে যাবে। ইতিমধ্যে ট্রাম্প প্রশাসন গিলিয়াডের সাথে এক চুক্তির মাধমে প্রায় ৫ লাখ ডোজ রেমডিসিভির কিনে নিয়েছে। এই পরিমাণ হলো গিলিয়াডের জুলাই মাসের উৎপন্ন হওয়ার সমস্তটা, আগস্টের ৯০ শতাংশ এবং সেপ্টেম্বরের ৯০ শতাংশ। অর্থাৎ পৃথিবীর অন্য কেউ আপাতত এই ওষুধ পাবে না। রেমডিসিভির ওষুধটির পেটেন্ট যুক্তরাষ্ট্র-আমেরিকা ভিত্তিক বায়োফার্মাসিউটিক্যাল কোম্পানি গিলিয়াড সায়েন্স-এর। চুক্তির ফলে গিলিয়াডও এই ওষুধটি অন্য কাউকে বিক্রি করতে পারবে না।
ওষুধটি প্রথমে ইবোলা ভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য তৈরি করা হয়েছিল। ক্লিনিক্যাল পরীক্ষায় দেখা গেছে, নভেল করোনা ভাইরাস সহ আরও কিছু ভাইরাস মানুষের দেহে প্রবেশ করে যেভাবে বংশবৃদ্ধি করে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করে, সেই প্রক্রিয়াটি কিছুটা হলেও থামানোর সক্ষমতা রয়েছে এই ওষুধের।
২০১৫ সালে গিলিয়াড ভারতে ওষুধটির পেটেন্টের জন্য আবেদন করে। ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০-তে এই পেটেন্ট অনুমোদিত হয়। অর্থাৎ গিলিয়াড না চাইলে এই ওষুধ আমাদের দেশে অন্য কেউ তৈরি করতে পারবে না। আর ট্রাম্পের দাপটে আমেরিকা থেকে আমদানিও করা যাবে না। বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার নির্দেশে বা বকলমে আমেরিকার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির ইচ্ছাপূরণ করতে ভারত সরকার বিশ্বায়িত পেটেন্ট চুক্তিতে স্বাক্ষর করে এবং ২০০৫ সালে ১৯৭০ সালের পেটেন্ট চুক্তির পরিবর্তন করে।
গিলিয়াড অবশ্য আমাদের দেশে পাঁচটি সংস্থা যেমন সিপলা, হেটিরো ল্যাব, জুবিলিয়ান্ট লাইফসায়েন্স এবং আরও দুটিকে রেমডিসিভিরের জেনেরিক সংস্করণ তৈরি এবং বাজারজাত করার অনুমতি দিচ্ছে। যদি ভারত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার সঙ্গে আপস না করত অর্থাৎ ১৯৭০-এর পেটেন্ট নীতি অনুমোদিত প্রোসেসে পেটেন্ট (Process patent)-এর পরিবর্তন করে প্রোডাক্ট পেটেন্ট চালু না করত তাহলে আমাদের দেশের গবেষকরা অন্য কোনো নতুন পদ্ধতিতে (Process patent-এর সুবিধা নিয়ে) এই ওষুধটি তৈরি করে ফেলতে পারতেন। তাহলে ওষুধটির দামও অনেক কম হতে পারত। এখন এর জন্য খরচ পড়ছে আমেরিকায় রোগী প্রতি ৩১২০ ডলার অর্থাৎ ভারতীয় মুদ্রায় ২,৩৩,০০০ টাকা মাত্র। ভারতে এর জেনেরিক সংস্করণের দাম পড়ার কথা প্রতি ডোজ ৫০০০ থেকে ৬০০০ টাকা (কালোবাজারে ১৫,০০০ থেকে ১৬০০০ টাকা), অর্থাৎ রোগী প্রতি প্রায় ১ লক্ষ টাকা। বহুজাতিকদের থেকে অনেক চড়া দামে আমাদের এই ওষুধ কিনতে হবে। চড়া দাম কারণ উৎপাদন খরচের সঙ্গে গবেষণার খরচও যুক্ত আছে। এভাবেই আগ্রাসী সাম্রাজ্যবাদের নগ্ন চেহারা ফুটে উঠছে সর্বসমক্ষে। দেশে সরকারি ভেষজ গবেষণাগার ও দক্ষ গবেষকদের ঘাটতি নেই। তা সত্ত্বেও আমাদের নির্ভর করতে হয় বহুজাতিকদের উপর। কারণ সরকার কেন্দ্রীয় গবেষণা সংস্থায় বরাদ্দ কমিয়ে দিয়েছে। বর্তমানের সঙ্কটকাল নাহলে এই চেহারা আমদের চোখে পড়ত না।
খবর ২: সরকারি বাবার মহৌষধী
শোনা যাচ্ছে গত ২ জুলাই রামদেব বাবার করোনিল কোভিডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধী ক্ষমতা (Immunity booster) গড়ে তোলার ওষুধ হিসাবে অনুমোদন পেয়েছে। দ্য ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস-এর খবর বলছে যে, ইতিমধ্যে আমাদের দেশের আয়ুস্ মন্ত্রক (Ministry of Ayurveda, Yoga & Naturopathy, Unani, Siddha and Homoeopathy সংক্ষেপে AYUSH) রামদেব বাবার করোনিল’কে বাজারজাত করার অনুমতি দিয়েছে। রামদেব হরিয়ানা রাজ্যের ব্রান্ড অ্যামবাসাডর এবং রাজ্যের কাবিনেট মন্ত্রীর সমকক্ষ - তাই ইনি সরকারি বাবা। আয়ুস্ মন্ত্রক ইমুনিটি বুস্টার হিসাবে কি যেকোনো সামগ্রীকে বাজারে নিয়ে আশার অনুমতি দেয়? রামদেবের সাঙ্গোপাঙ্গরা করোনিলের কার্যকারিতা DCGI (Drug Control General of India) পদ্ধতি মেনে কোভিড নিরাময়কারি ওষুধ হিসাবে পরীক্ষা করার দাবি করছেন আর অনুমতি পাচ্ছেন ইমুনিটি বুস্টার হিসাবে? এ কেমন আইনি ব্যবস্থা? বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য সঙ্কটকালে এই সরকারি ধাপ্পা মানুষকে কেবল বিভ্রান্ত করছে না বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছেও।
গত ২৩ জুন তারিখে হরিদ্বারে রামদেব পতঞ্জলির হেডকোয়ার্টারে একটি প্রেস কনফারেন্স করে করোনিল বাজারজাত খবর প্রচারমাধ্যমে দেন। পরিষ্কার বলা হয় যে, করোনিল কোভিড নিরাময়ের ক্ষমতা রাখে। তাঁর দাবি ছিল যে, তারা নির্মা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল করেছেন। এত নিশ্চিত যে, একটি ওষুধ তৈরি করে যে যে পদ্ধতির মধ্যদিয়ে তাকে বাজারে নিয়ে আসতে হয় সেই সমস্ত সরকারি বিধি এখানে অমান্য করা হচ্ছে।
দিব্য করোনিল তৈরিতে যে সমস্ত জড়ি-বুটির ব্যবহার হচ্ছে বলে তারা দাবি করছেন সেগুলি হলো তুলসী (Ocimum tenuiflorum), অশ্বগন্ধা (Withania somnifera) এবং গুলঞ্চ (Tinospora cordifolia)। এই গাছগুলি আমাদের অত্যন্ত পরিচিত। কিন্তু এগুলির মধ্যে কোন্ কোন্ জৈব-রাসায়নিক উপাদান, যাকে কার্যকরি উপাদান (Active Principle) বলা হয়, এই ভাইরাসের মরণ ঘটাতে পারে তা বলা হয়নি। ভাইরাস মারতে হলে মানবদেহে ভাইরাসের প্রোটিন তৈরি কিংবা আরএনএ তৈরি রোধ করার মতো ব্যবস্থা করতে হয় যাতে ভাইরাস সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে না পারে। অর্থাৎ এর উপযুক্ত প্রোটিন কিংবা আরএনএ তৈরির পথে যে উৎসেচক দরকার হয় তার উৎপাদন বন্ধ করতে হয়। তিনটি জড়ি-বুটি দিয়ে এই ঘটনা কি করে ঘটানো হচ্ছে তার বিজ্ঞান সম্মত বাখ্যাও রামদেবের মতো তাবড় বিজ্ঞানীরা দিতে পারেননি। বিজ্ঞানের পদ্ধতি ব্যবহার না করে মারণ রোগ থেকে মুক্তি পাওয়ার ভ্রান্ত দাবির জন্য রামদেব এবং তাঁর পারিষদদের বিরুদ্ধে ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ৪২০ ধারা প্রয়োগ করা যায় কি না তা আইনজীবীরা বলতে পারবেন। তবে করোনিলের সঙ্গে দিব্য কথাটি যুক্ত থাকায় এসব কথা বলার জন্য আপনি-আমি হিন্দুবিরোধী দেশদ্রোহী হয়ে যেতেও পারি।
রামদেবের দাবি প্রসঙ্গে আয়ুসে্র পূর্ণ দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয়মন্ত্রী শ্রীপদ নায়েক বলেন যে, করোনা চিকিৎসায় হোমিওপ্যাথি এবং অ্যালোপাথি ওষুধের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে বিভিন্ন দেশে। সেই ক্ষেত্রে ভেষজ উপাদান অশ্বগন্ধা, গুলঞ্চ এবং তুলসী দিয়ে তৈরি এই ওষুধ খারাপ নয়, মানুষের কোনো ক্ষতি করবে না এই ওষুধ। তবে পতঞ্জলির ভুলটি হলো, স্বাস্থ্যমন্ত্রকের গাইডলাইন না মেনে তারা ওষুধের প্রচার করতে শুরু করে দিয়েছিল। বর্তমান পরিস্থিতিতে যা সঠিক নয়। এতো শুঁড়ির সাক্ষী মাতাল!
খবর ৩: আর্সেনিকাম আলবাম বিভ্রাট
হোমিওপ্যাথি ওষুধ আর্সেনিকাম আলবাম-৩০ কোভিড-১৯ প্রতিষেধক হিসেবে আয়ুস্ মন্ত্রক যেসব প্রতিষেধকের তালিকা তৈরি করেছে, সেখানে এর নাম যুক্ত হয়েছে। এমনকি প্রতিষেধক ওষুধ হিসেবে এই ওষুধটিকে বেশ কিছু রাজ্যে সুপারিশ করা হয়েছে। ওষুধটি কোভিডের বিরুদ্ধে কাজ করে বলে কোনো বৈজ্ঞানিক তথ্য প্রমাণ মেলেনি শুধু এমনটা নয়, বেশ কয়েকজন খ্যাতনামা হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক এই অবৈজ্ঞানিক প্রয়োগের বিরুদ্ধে কথা বলেছেন।
আর্সেনিকাম অ্যালবাম ৩০ রাজস্থান, কর্ণাটক, তামিলনাড়ু ও অন্ধ্রপ্রদেশ সরকার সুপারিশ করেছে ও সুনির্দিষ্ট প্রটোকলও তৈরি করেছে। মহারাষ্ট্র সরকার এ নিয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত ঘোষণা না করলেও মুম্বইয়ের পৌর কর্তৃপক্ষ অন্তত দুটি ওয়ার্ডের অতিঝুঁকিসম্পন্ন এলাকায় এই ওষুধ বিতরণ করেছে। হরিয়ানা কারা কর্তৃপক্ষ ও মুম্বই পুলিশও যথাক্রমে বন্দি ও আধিকারিকদের মধ্যে এই ওষুধ বিতরণ করছে।
এমনকি যেসব রাজ্যে এই ওষুধ ব্যবহারের প্রটোকল তৈরি হয়নি, সেখানেও মানুষ আর্সেনিকাম অ্যালবাম কেনার জন্য হোমিওপ্যাথি ওষুধের দোকানে ভিড় করছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। এ ওষুধ বিক্রি হচ্ছে দুই থেকে তিনগুণ বেশি দামে। স্থানীয় কেমিস্টরাও এই ওষুধ মজুত করতে শুরু করেছেন।
এরইমধ্যে ভ্যাকসিন তৈরির ক্ষেত্রে অনেকটা এগিয়ে আছে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়। ভারতের ভারত-বায়োটেক নামে একটি বেসরকারি সংস্থা আইসিএমআর (Indian Council of Medical Research)-এর সহযোগিতায় “COVAXIN” নামে একটি প্রতিষেধক তৈরি করেছে। দ্রুত কোভ্যাকসিনের ট্রায়াল শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু ১৫ই অগস্টের মধ্যে এই প্রতিষেধক বাজারে আনার যে হুলিয়া জারি করেছে আইসিএমআর তা এক হঠকারি সিদ্ধান্ত হয়ে যেতে পারে। আমরা সবাই জানি যে, একটি নিরাময়কারি ওষুধ এবং একটি প্রতিষেধকের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের মধ্যে অনেকটা ফারাক আছে। দেশের Drugs and Clinical Trials Rules অনুযায়ী ৩টি দফায় (Phase) ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল (স্বেচ্ছাসেবীদের মধ্যে) এবং চতুর্থ দফায় post marketing surveillance-এর যে ব্যবস্থা আছে তা মানুষের স্বার্থে মানা দরকার। ঠিকই যে আপৎকালীন আবস্থায় কিছু পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু মহামারীর সময়ে বিধ্বস্ত মানুষকে যেন আর গিনিপিগ না করা হয়।