৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
কেমন চলছে রাজ্য!
আদালতের পর্যবেক্ষণেই তা স্পষ্ট
প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের নবান্ন অভিযানে পুলিশি বর্বরতা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ছাত্রনেতা আনিস খানের হত্যার তদন্ত থেকে শুরু করে এসসিসি-র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতি, টেট-এ ফেল করা সত্ত্বেও শিক্ষকতার চাকরি এবং সর্বশেষ সংগীত শিল্পী কেকে-র কলকাতায় অনুষ্ঠান করতে এসে আকস্মিক মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টে মামলা দায়ের ইত্যাদি ঘটনা রাজ্য সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকে নানা প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিক এই সমস্ত ঘটনায় রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ উঠেছে। ইতিমধ্যে রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী পার্থ চ্যাটার্জি থেকে শুরু করে শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীকে সিবিআই’র কাছে কয়েকবার হাজিরা দিতে হয়েছে। আবারও তাঁরা সিবিআই’র ডাক পাবার অপেক্ষায়। শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে যে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে, তা জানার জন্য আর কোর্টের রায়ের অপেক্ষায় থাকার প্রয়োজন নেই। এই দুর্নীতির কেন্দ্রে রয়েছে স্কুল সার্ভিস কমিশন। অভিযোগ উঠেছে খোদ মন্ত্রীর নির্দেশেই স্কুল সার্ভিস কমিশনের সদস্যরা বেআইনিভাবে যোগ্যতাবিহীন, অসফল প্রার্থীদের নিয়োগপত্র দিয়েছে। এই সমস্ত অবৈধ নিয়োগের মধ্য দিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা লেনদেনের খবরও উঠে এসেছে। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনায় আলোড়িত হয়েছে গোটা রাজনৈতিক মহল। কালিমালিপ্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ।
রাজ্যের শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী পরেশ অধিকারীর কন্যা অঙ্কিতা অধিকারীকে বেআইনিভাবে নিয়োগের জন্য হাইকোর্টের নির্দেশে শিক্ষিকা পদ থেকে ইতিমধ্যে বরখাস্ত করার ঘটনা রাজ্যবাসীর জানা। এই ঘটনার পর ফের এক শিক্ষককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে কলকাতা হাইকোর্ট। মুর্শিদাবাদ জেলার সুলুয়াডাঙা হাইস্কুলে নবম-দশম শ্রেণির গণিতের শিক্ষক পদে বেআইনিভাবে সিদ্দিকি গাজি নামে এক শিক্ষককে নিয়োগ করা হয়েছিল। ৬ জুন হাইকোর্ট তাকে বরখাস্তের নির্দেশ দিয়েছে।
এদিন বিচারপতি রাজশেখর মানথা মধ্যশিক্ষা পর্ষদকে এই বেআইনি নিয়োগ বাতিল করে সিদ্দিকি গাজি নামে ওই শিক্ষককে বরখাস্ত করার নির্দেশ দেন। এদিনই এসএসসি’র নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি মামলা দায়ের করা হয়েছিল। চাকরি প্রার্থী অনুপ গুপ্ত তাঁর আবেদনে জানিয়েছেন, নবম-দশম শ্রেণির গণিত বিষয়ে শিক্ষক নিয়োগের মেধা তালিকায় তাঁর নাম ছিল ২০০ নম্বরে। কিন্তু তাঁকে বঞ্চিত করে তালিকায় ২৭৫ নম্বরে থাকা সিদ্দিকি গাজিকে চাকরি দেওয়া হয়েছে।
এদিন আদালতে আবেদনকারীর আইনজীবী ফিরদৌস শামিম বলেছেন, শিক্ষক নিয়োগকে কেন্দ্র করে পাহাড় প্রমাণ দুর্নীতি হয়েছে। হাজার হাজার যোগ্য প্রার্থী বঞ্চিত হয়েছেন। মেধা তালিকা অনুযায়ী নিয়োগ হয়নি। মেধা তালিকার নিচের দিকে থাকা প্রার্থী এবং মেধা তালিকায় নাম নেই, এখন অনেক প্রার্থীকে বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, কলকাতা হাইকোর্টে এসএসসি সংক্রান্ত সমস্ত মামলার শুনানির দায়িত্বে ছিলেন বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়। স্কুলে শিক্ষক এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগে এসএসসি’র বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগে একাধিক মামলা এখনো বিচারপতি গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে রয়েছে। তিনি শিক্ষক নিয়োগ এবং শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতির মামলায় ইতিমধ্যে সাতটি ক্ষেত্রে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
এদিকে নতুন পদ্ধতিতে নবম ও দশম শ্রেণির শিক্ষক নিয়োগের জন্য রাজ্য সরকার সুপার নিউমারিক পোস্ট তৈরি প্রসঙ্গে ৮ জুন বিচারপতি রাজশেখর মানথা মন্তব্য করেছেন - ‘‘একটা অসুখ সারাতে আবার নতুন একটা অসুখকে ডেকে আনা হচ্ছে না তো! এই নতুন পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি হবে না তার প্রতিশ্রুতি দেবে কে?’’
বিধাননগরে টেট উত্তীর্ণদের বিক্ষোভ।
প্রাথমিকে নিয়োগে দুর্নীতি
এসএসসি-র শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী নিয়োগে দুর্নীতি প্রকাশ্যে আসার পর প্রাথমিকেও শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতির অভিযোগ সামনে এসেছে। টেট পরীক্ষায় ফেল করেছেন, অথচ শিক্ষকতার চাকরি করছেন - এমন অভিযোগ জানিয়ে ৭ জুন দু’টি মামলা দায়ের হয়েছে কলকাতা হাইকোর্টে। টেট না দিয়েই শিক্ষকতা করছেন এমন ৮৭ জনের নাম দিয়ে একটি মামলা দায়ের হয়েছে বিচারপতি অভিজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের এজলাসে। তিনি গত ৮ জুন প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দুর্নীতির মামলায় সিবিআই তদন্তের নির্দেশ দেন। ২০১৪ সালের প্রাইমারি টেট’র ভিত্তিতে গত এপ্রিল মাসে ৭৩৮ জনকে বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছে, এদিন একটি জনস্বার্থের মামলা দায়ের হয়েছে প্রধান বিচারপতি প্রকাশ শ্রীবাস্তবের ডিভিসন বেঞ্চে। প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালের টেট নিয়োগ নিয়ে অসংখ্য অভিযোগ উঠেছে। প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে কলকাতা হাইকোর্টের এর আগেও বহু ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপের নজির রয়েছে। জনস্বার্থের মামলায় রাজ্য সরকারের কাছে হলফনামা চেয়েছে প্রধান বিচারপতির ডিভিসন বেঞ্চ। মামলার আবেদনকারী অভিযোগ করেছেন, ২০১৪ সালের টেট-র নিয়োগ এখনও চলছে। ৭৩৮ জনকে বেআইনিভাবে নিয়োগ করা হয়েছে বলে তিনি অভিযোগ করেছেন।
আনিস খানের খুনে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন হাইকোর্টের
ছাত্রনেতা আনিস খানের খুনের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ফের প্রশ্ন তুলেছে হাইকোর্ট। এই খুনের ঘটনায় সিবিআই তদন্ত চেয়ে মামলার শুনানি শেষ হয়েছে ৭ জুন। এদিন রায়দান স্থগিত রাখা হয়েছে। শুনানিতে বিচারপতি রাজশেখর মানথা পুলিশের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের উল্লেখ করে বলেছেন, পুলিশের বিরুদ্ধেই তো অভিযোগ। কোন পদমর্যদায় পুলিশ তদন্ত করছে, সেটা দেখার কোনো প্রয়োজন নেই। কারণ মূল অভিযোগ তো পুলিশের বিরুদ্ধে। একজন অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের ফোনের পরেই অভিযান হয়েছে, অন্তত অভিযোগ তাই আসছে। সেই পুলিশ আধিকারিককের বক্তব্য কোথায়? শুধু তাই নয়, এই ঘটনায় দেখা গেছে এক থানার পুলিশ অন্য থানা এলাকায় গিয়ে অভিযান চালিয়েছে, তা কী করে হয়, সেই রিপোর্ট কোথায়? এই প্রক্রিয়া ত্রুটিপূর্ণ বলে উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, এই ঘটনায় পুলিশের বিরুদ্ধেই অভিযোগ, ফলে কোনো ষড়যন্ত্র কী না তাও খতিয়ে দেখতে হবে। বিচারপতি আরও মন্তব্য করেছেন, গোটা মামলায় অভিযোগ কেবল পুলিশের বিরুদ্ধে। এরপরেও কী করে এই পুলিশের তদন্তে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস থাকবে - এনিয়ে তিনি প্রশ্ন তোলেন।
এদিনের শুনানিতে পরিবারের তরফে আইনজীবী বিকাশ ভট্টাচার্য বলেছেন, আদালত পুলিশকে সত্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব দিয়েছিল। রাজ্য পুলিশ সেই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। আনিসের বাড়ি পুলিশ ঘিরেছিল কেন? ওই ছাত্রনেতাকে তো আগেই খুনের হুমকি দেওয়া হয়েছিল। পুলিশ বাহিনী নিয়ে আনিসের বাড়িতে তল্লাশিতে গিয়েছিল। আনিসকে ধরা তাদের উদ্দেশ্য ছিল। শুধু আনিসের বাড়িতে নয় গোটা এলাকায় পুলিশ ছিল। তিনি প্রশ্ন তোলেন কেন সিভিক ভলান্টিয়ারদের এগিয়ে দেওয়া হলো? আনিসকে খুন করার পরে আত্মহত্যা বা দুর্ঘটনার তত্ত্বও পুলিশ তুলছে কেন? সেদিন রাতের ঘটনায় মৃত ছাত্রের কাছে এগিয়ে গেলেন না কেন? এটা একটি পরিকল্পিত হত্যার ঘটনা। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশের তদন্তে তা আসছে না। যদিও রাজ্যের তরফে জানানো হয় সিট-এর তদন্ত সঠিক পথেই চলছে।
জানা গিয়েছে আনিসের দ্বিতীয়বার ময়নাতদন্তের রিপোর্টের সঙ্গে প্রথমবার করা ময়নাতদন্তের রিপোর্টের অনেক ফারাক রয়েছে। বিশেষত দ্বিতীয়বারের ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে, আনিসের শরীরের বিভিন্ন অংশের হাড় ভাঙা রয়েছে। এই হাড় ভাঙার কোনো কথা প্রথমবারের ময়না তদন্তের রিপোর্ট ছিল না। এমনকী রাজ্যজুড়ে প্রবল প্রতিক্রিয়ার মুখে পুলিশ সে সময় আমতা থানার হোমগার্ড এবং একজন সিভিক পুলিশকে গ্রেপ্তার করেছিল। যদিও ধৃতরা বলেছি, ওপর মহল থেকে তাঁদের ফাঁসানো হয়েছে।
আমতা থানার ওসি-কে এই কাণ্ডের অন্যতম দায়ী বলে দাবি করেছে সিট। যদিও সুকৌশলে হাওড়া গ্রামীণ পুলিশ সুপারকে ছাড় দেওয়া হয়েছে।