E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪৩ সংখ্যা / ১০ জুন, ২০২২ / ২৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

শ্রমিকনেতা থেকে কমিউনিস্ট নেতা

দীপক দাশগুপ্ত


গত ২রা জুন। ভোর ৩টার সময় হাওড়া জেলার শ্রমিকনেতা তথা কমিউনিস্ট নেতা কমরেড নিমাই সামন্ত’র জীবনাবসানে জেলার শ্রমজীবী মানুষের শ্রেণি ও গণআন্দোলনের এক অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে।

১৯৬৭ সালে সিপিআই(এম)’র সদস্যপদ লাভ করেছিলেন এবং শেষ‍‌ নিঃশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত ছিলেন পার্টি সদস্য। পার্টির জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন এবং দীর্ঘকালব্যাপী সিপিআই(এম) হাওড়া জেলার নেতা হিসাবে কাজ করেছেন। কমরেড নিমাই সামন্তের জন্ম হয় এক শ্রমিক পরিবারে এবং তিনি স্কুল শিক্ষা সমাপ্ত করে ঘুসুড়ির গ্যাস-ওয়েলডিং কারখানায় শ্রমিক হিসাবে কাজে যুক্ত হন। শ্রমিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করে শ্রেণিচ্যুত না হয়ে তিনি শ্রমিকই থেকে গেছিলেন। এরকম এক তরুণ শ্রমিক কমরেড চিত্তব্রত মজুমদার ও কমরেড খগেন অধিকারীর নজরে পড়ে গেলেন। তাঁরা তাঁকে গণআন্দোলনের মধ্যে নিয়ে এলেন এবং অল্প কিছুদিনের মধ্যে কমরেড নিমাই সামন্ত পার্টি সদস্য পদ লাভ করলেন।

তাঁর নিপুণ কর্মকুশলতা তাঁকে একজন প্রকৃত বিপ্লবী হিসাবে গড়ে তুলেছিল। ফলশ্রুতিতে কমরেড নিমাই সামন্ত অল্প কিছুদিনের মধ্যেই কর্মস্থল ছেড়ে দিয়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হিসাবে পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের কাজ করতে লাগলেন। এবং আমৃত্যু তিনি সর্বক্ষণের কর্মীই থেকেছেন।

সাধারণভাবে সিপিআই(এম)’র সর্বক্ষণের কর্মী ও তাঁদের পরিবারবর্গ অত্যন্ত দারিদ্র্যের মধ্যে তাঁদের জীবন অতিবাহিত করেন। কমরেড নিমাই সামন্ত ও তাঁর পরিবারবর্গ এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। চরম দারিদ্র্য মোকাবিলা করে তিনি জনগণ ও তামাম শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে সর্বদা কাজ চালিয়ে যেতেন। কমরেড নিমাই সামন্ত চটকল শ্রমিকদের মধ্যে ট্রেড ইউনিয়ন ও পার্টি গঠন করার জন্য প্রচেষ্টা চালাতেন। হাওড়া জেলার বিশেষ করে উত্তর হাওড়া ও বালি, বেলুড় অঞ্চলের জুটমিলগুলি ছিল তাঁর কর্মক্ষেত্র। তিনি বিসিএমইউ’র সাংগঠনিক সম্পাদক হিসাবে গোটা রাজ্যের চট শ্রমিক আন্দোলনের অন্যতম শীর্ষ নেতা ছিলেন। এছাড়াও তিনি হাওড়া জেলার ছোটো ও মাঝারি ইঞ্জিনিয়ারিং ও ঢালাই শিল্পের ট্রেড ইউনিয়নগুলির জন্য গঠিত ‘‘ফেডারেশন অফ মেটাল অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কার্স ইউনিয়ন’’-এর সাধারণ সম্পাদক হিসাবে দীর্ঘকাল উক্ত শিল্পের শ্রমিক-কর্মচারীদের আন্দোলনেও নেতৃত্ব দিয়েছেন।

হাওড়ার গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প ব্রীজ অ্যান্ড রুফ-এর এমপ্লয়িজ ইউনিয়ন-এর প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন এবং সিআইটিইউ সংগঠনে তিনি ছিলেন আমার একান্ত ঘনিষ্ঠ সহযোগী।

তিনি ১৯৮৭ সাল থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত জেলা সংগঠনের ওই পদে আসীন থেকে কাজ করেন ও ১৯৯৬ সালের মাঝামাঝি সময় দীপক দাশগুপ্ত সিপিআই(এম) হাওড়া জেলা কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হলে সিআইটিইউ’র জেলা সম্পাদকের পদ ত্যাগ করেন। ওই স্থানে কমরেড নিমাই সামন্তকে জেলা সিআইটিইউ’র সাধারণ সম্পাদক পদে নির্বাচিত করা হয়। তিনি ওই পদে জেলার শ্রমিক আন্দোলন পরিচালিত করেন। পরবর্তী সময়ে কমরেড নিমাই সামন্ত জেলা সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। সম্পাদক থাকাকালীন তিনি পার্টিরও নেতৃত্বে উঠেছিলেন। তিনি উত্তর হাওড়া বালি-বেলুড়কে নিয়ে গঠিত জোনাল কমিটির সম্পাদক ও পরবর্তী সময় উক্ত জোনাল কমিটি উত্তর হাওড়া ও বালি-বেলুড় ভিন্ন জোনাল কমিটি হলে তিনি উত্তর হাওড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে সম্ভবত ১৯৮৮’র ত্রিবান্দ্রম পার্টি কংগ্রেসের আগে দাশনগরে অনুষ্ঠিত জেলা সম্মেলনের মধ্য দিয়ে পার্টির হাওড়া জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য হয়েছিলেন। তিনি সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী ও সর্বভারতীয় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যও ছিলেন।

পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন

কমরেড নিমাই সামন্ত পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের ভিন্ন ভিন্ন সাংগঠনিক ভিত্তি ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে ও কাজ করতে দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। অতীতে পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের স্বাধীন সত্তা বজায় রেখে পথচলার যে অভ্যাস গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল তা বর্তমানে অনেকটা ক্ষুণ্ণ হয়েছে। পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের পারস্পরিক সম্পর্কের ভিত্তি শ্রেণিভিত্তিক গণসংগঠনের স্বাধীন সত্তা, ট্রেড ইউনিয়ন কোনো রাজনৈতিক দলের লেজুর নয়, এই বোধ পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন ফ্রন্টের কর্মীদের মননের গভীরে নিয়ে যাওয়া এক‍‌টি বড়ো কাজ।

কমরেড নিমাই সামন্ত পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন এবং অন্যান্য গণসংগঠনের পারস্পরিক সম্পর্ক বিষয়ে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। এটা আমাদের সকলের মনে রাখা প্রয়োজন যে, শ্রেণি ও গণসংগঠন কারও লেজুর নয়। প্রত্যেকটি শ্রেণি ও গণসংগঠনের স্বাধীন সত্তা ও অস্তিত্ব কখনই অস্বীকার করা উচিত নয়। অন্যথায় শ্রেণি ও গণসংগঠনগুলি ব্যাপক শ্রমজীবী মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আমাদের দ্বারা পরিচালিত শ্রেণি ও গণসংগঠনে এই ধারার সৃষ্টি হলে ভয়ঙ্কর ক্ষতি করবে। কমরেড নিমাই সামন্ত পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়নের নেতা হিসাবে এই প্রশ্নে সর্বদা সচেতন দৃষ্টি রাখতেন। যা বহুক্ষেত্রেই পার্টি, শ্রেণি ও গণসংগঠন পরিচালনার ক্ষেত্রে এ ধরনের ব্যাধি দেখা যায়। এর বিরুদ্ধে যারা সংগ্রাম করেছেন এবং এখনও করছেন তাদের মধ্যে কমরেড নিমাই সামন্ত অন্যতম।

কমরেড সামন্ত’র সাংস্কৃতিক আন্দোলন সম্পর্কে সঠিক মার্কসবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল। পার্টির হাওড়া জেলা কমিটির নেতা হিসাবে তিনি সাংস্কৃতিক ফ্রন্ট তথা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন। তিনি নিজে ভালো নাচ-গান করতে পারতেন। এছাড়া ভালো যাত্রা ও নাটক করতে পারতেন। ১৯৭০ দশকের গোড়ায় তিনি গণনাট্য সঙ্ঘের সদস্য ছিলেন। তাঁর উদ্যোগে ঘুসু‌্ড়িতে গণনাট্য সঙ্ঘের শাখা গড়ে উঠেছিল।

তিনি নিজে শ্রমিক সন্তান ও শ্রমিক হওয়ার কারণে একজন শ্রমিকের ন্যায় জীবনযাপন করতেন।

তিনি তাঁর পরিবারকে ‘কমিউনিস্ট পরিবার’ হিসাবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। তাঁর স্ত্রী ও কন্যা বর্তমানে পার্টি সদস্য। তার গোটা পরিবার পার্টি পরিবার - এই প্রশ্নে কমরেড নিমাই সামন্ত একজন সফল কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নেতা।

দীর্ঘকালব্যাপী আমরা পারস্পরিক ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখে পার্টি ও ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠনে কাজ করেছি। চিরকাল আমাদের ভ্রাতৃপ্রতীম সম্পর্ক অটুট ছিল। কমরেড সামন্তের দীর্ঘ অসুস্থতা ও মৃত্যু এই সম্পর্কে ছেদ ঘটালো। তবে নিমাই সামন্ত তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে অমর হয়ে থাকবেন। তিনি একজন শ্রমিক থেকে একজন কমিউনিস্ট নেতাতে উন্নীত হয়েছিলেন।

লাল সেলাম কমরেড নিমাই সামন্ত।