E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

সরকার তুমি কার!

বিশ্বম্ভর মণ্ডল


করোনার আক্রমণের উদ্ভব থেকে আজ পর্যন্ত ভিয়েতনাম, কিউবা, উত্তর কোরিয়া, চীন সহ অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে এই একেবারে অচেনা পরিস্থিতির সামনেও রাষ্ট্র নেতাদের হাঁটু কাঁপতে দেখা যায়নি। আত্মবিশ্বাসী চেহারায় আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে তারা শুধু নিজের দেশের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন তাই না, অন্য দেশের পাশেও দাঁড়িয়েছেন। নিজের দেশের মানুষকে রক্ষা করার কাজে লেজে গোবরে হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন সহ সেই সমস্ত দেশ যারা দেশের মানুষের বেঁচে থাকার জন্য স্বাস্থ্য সংক্রান্ত ন্যূনতম ব্যবস্থাটুকু সরকারের হাতে থাকার প্রয়োজনীয়তা বোধ করেন না ও সেটা সাড়ম্বরে প্রচার করে বেড়ান ৯০’র দশক থেকে। যে দেশে সরকারি হাসপাতাল বেশি কিংবা যে দেশে স্বাস্থ্যব্যবস্থা সরকারের নিয়ন্ত্রণে তারা দিব্যি ছিলেন বা আজও আছেন। কারণ পৃথিবী জুড়ে সেই সরকারগুলিই শুধুমাত্র চূড়ান্ত সফলতা পেল যারা স্বাস্থ্যখাতে সরকারের বাড়তি বরাদ্দের প্রয়োজন অনুভব করেছেন ও সরকারের দায়িত্ব অস্বীকার করেননি।

বিগত তিন দশকের বেশি সময় ধরে উদার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের মহিমাময়ী, লাস্যময়ী, মোহময়ী রূপের প্রচারে মার্কিন দেশের নেতৃত্বে একদল দেশ সদাসর্বদাই ব্যস্ত থেকেছেন। উদার অর্থনীতি আর বিশ্বায়নের সমর্থকদের তৈরি করা সদা উজ্জ্বল ঝা চকচকে ভাবমূর্তির মুখে কোভিড-১৯ ঝামা ঘষে দিয়েছে।

নিশ্চয়ই সকলের মনে আছে কোভিড-১৯ সামলাতে পৃথিবীর অনেক দেশে যখন বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়ে গিয়েছে, সেই সময়ে ট্রাম্প বাবু দেশের নির্বাচনে নিজের সিংহাসন সামলানোর প্রয়োজনে শিল্পপতিদের নিয়ে সফরে বেরিয়েছিলেন। দেশের মানুষকে বিপন্ন করেও তাঁকে রেড কার্পেট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পরিণতিতে রোগ ছড়ানোর সর্বনাশের বীজ পোঁতার ব্যবস্থা নিশ্চিত হয়ে গেছে দেশজুড়ে। অপরিচিত ও বিপজ্জনক এই রোগের প্রতিরোধে মোমবাতি, থালা-বাটি বাজাতে বলে দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে আর বিপদ বাড়িয়েছে। প্রকৃতপক্ষে দিশাহারা মানুষকে পথ দেখাতে বারবার ব্যর্থ হয়েছে সরকার। সরকারের কথায় মোমবাতি জ্বেলেছে মানুষ, থালা-বাটি বাজিয়েছে, মুখ ঢাকতে বলেছে, ঢেকেছে। সরকারের সব কথা শুনেও মানুষ অবাক চোখে বিস্ময়ের সাথে দেখেছে সরকার সবাইকে ঘর বন্দি করে দিলেও নিজেরা ঠাণ্ডা মাথায় একে একে রেল, ব্যাঙ্ক, এলআইসি সহ লাভজনক সব সরকারি প্রতিষ্ঠান বেচে দেওয়া শুরু করেছে। সরকারের দেশভক্ত ও দেশপ্রেমিক মন্ত্রীরা একে একে সব সরকারি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার তুলে দিয়ে চলেছে সেই সব শিল্পপতির হাতে যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতায় তারা ক্ষমতায় এসেছে।

বাসে উঠলে কন্ডাক্টর অনেক সময়েই বলেন “পিছনের দিকে এগিয়ে যান”। দেশেও একই অবস্থা। এগিয়েই চলেছে সবাই, তবে সামনের দিকে না, পিছনের দিকে - সেটাই আজ চূড়ান্ত প্রশ্নের মুখে। স্বাধীন হবার পর দেশে তখন ছিল বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক। কারো কাছে আর গোপন নেই যে, সেই সব ব্যাংক মানুষের টাকা লুঠ করে হঠাৎ হঠাৎ লালবাতি জ্বেলে দিচ্ছিল অর্থাৎ ব্যাংক বন্ধ করে দিয়ে মানুষকে ভিখারী বানিয়ে পথে বসাতে শুরু করেছিল। এই পরিপ্রেক্ষিতেই সেই সময়ে স্বাধীন দেশের সরকার মানুষকে বাঁচাতে ব্যাংকগুলোকে ধাপে ধাপে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এনেছিল। বেসরকারি মালিকানাধীন ব্যাংকের এমন কলঙ্কিত প্রেক্ষাপট সত্ত্বেও কোন্ ভরসায় সরকার বেসরকারি মালিকানার হাতে বা ঘুরিয়ে ব্যক্তি মালিকানায় ব্যাংক ব্যবস্থাকে হস্তান্তর করার পথে ঠেলতে শুরু করেছেন তার ব্যাখ্যা অর্থনীতির প্রকৃত প্রাথমিক জ্ঞান যাদের আছে তারা কেউই বুঝতে পারছেন না। মানুষের টাকা লুঠের পাকাপোক্ত আইনসম্মত বন্দোবস্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। সরকারি ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করলেও চলে কাদের? উত্তরটা সবাই জানে - বড়ো ব্যবসায়ীদের, শিল্পপতিদের - সবার না হলেও কারুর কারুর তো বটেই। ব্যাংকের টাকা পরিশোধ না করার যোগ্যতা একটাই – ছলেবলে কৌশলে শাসক দলের লোক হয়ে উঠতে হবে ও মনে প্রাণে টাকা পরিশোধ না করার ফন্দি-ফিকির শেখার প্রতিনিয়ত মনোযোগী ছাত্র হতে হবে। তাহলে সব বন্দোবস্ত হয়ে যাবে। কয়েক বছর অন্তর অন্তর এই গুণী দেশভক্ত ব্যবসায়ীদের, শিল্পপতিদের ব্যাংকের অনাদায়ী ঋণকে কুঋণ হিসাবে ঘোষণা করা হবে ও তারপর ব্যাংকের খাতা থেকে সেই ঋণের হিসাব কেটে দেওয়া হবে। তবে এই ‘সরকারি পরিষেবা’ প্রদানের জন্যে সরকারের কোনো আর্থিক লাভ না হলেও, এটা সকলেই বোঝে যে, মুফতে এই সুবিধা মেলে না। সুবিধা পাইয়ে দেবার নেপথ্য কারিগররা বিনিময়ে পাবেন - ব্যক্তিগত বা দলীয় সুযোগ-সুবিধা, নির্বাচনে প্রচারের খরচ, তাদের সমাজ কল্যাণের বিষয়ে সত্যমিথ্যা মিশিয়ে ব্যানারে, পোস্টারে, পত্রিকায়, টিভিতে নানান রঙে প্রচারের ব্যবস্থা, বিজ্ঞাপনের খরচের দায়দায়িত্ব ইত্যাদি ইত্যাদি।

যে বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের ধার মকুব হয়, তাদের বাড়ির ছাদে হেলিকপ্টার নামে। দেশকে, দেশের সরকারকে ভালোবেসে সরকারি ব্যাংকের ঋণ যারা পরিশোধ করে না, অর্থাৎ প্রতি বছর যাদের ঋণ সরকারের ব্যবস্থাপনায় মকুব করতে হয় - তারা হলো সরকারের ভাষায় “দেশভক্ত করপোরেট”। শোনা যায় দেশে দেশে এদের স্বজনরাই নাকি সরকারের নেপথ্য পরিচালক, এদের খুশি করে না চললে নাকি এরা দেশের সরকারকে উল্টে-পাল্টে দিতে পারে। তাই বোধহয় শুধুমাত্র ২০১৯ সালে কর্পোরেট ঋণ মকুব করা হয়েছিল ১,৭৫,০০০ কোটি টাকা। টাকা যারা মেরে দেয় তাদের বারবার ঋণ পেতে অসুবিধা হয় না; ঋণ পেতে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় যাদের তারা হলো গরিব, সাধারণ মানুষ, ছোটো ব্যবসায়ী, শ্রমিক আর চাষির, খেত মজুর, অসংগঠিত শ্রমিকদের। ঋণ নিয়ে পরিশোধ করতে দুদিন দেরি হলে হয়রানির শিকার হতে হতে লাখে লাখে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় এইসব গরিব, সাধারণ মানুষ, ছোটো ব্যবসায়ী আর চাষির। গত ২১ বছরে তিন লাখ চাষি সারা দেশে আত্মহত্যা করেছেন চাষের খরচ তুলতে না পেরে। তাদের ঋণ মকুব করতে সরকারের কলম সরে না। কিন্তু কোটি কোটি টাকা মেরে সরকারের ব্যবস্থাপনায় ‘সেফ প্যাসেজ’ ব্যবহার করে পালিয়ে যেতে অসুবিধা হয় না সেলিব্রিটি মর্যাদার বড়ো বড়ো ব্যবসায়ীদের। সাথে বিদেশে নিরাপদে থাকার ব্যবস্থা থেকে শুরু করে দেশে অনাদায়ী ঋণ মকুবের ব্যবস্থা করে দিতে পারে বন্ধু সরকার। সরকারের পর সরকার বদলে যায়, ‘গরিব দরদী মুখোশ’ সবাই পড়েন, কিন্তু সমস্যার মৌলিক সমাধানের কথা অধিকাংশই ভাবেন না। চাপ তৈরি করলে মেলে কখনো প্যাকেজ, কখনো কিছুই মেলে না। যেমন- কৃষকরা সমস্ত জিনিস সস্তায় বেঁচতে বাধ্য হয়, পাঁচ হাত ঘুরে বাজারে আসা সেই জিনিসই বাজার থেকে বেশি দামে কিনতে হয় সাধারণ মানুষকে। কয়েক বছর ধরে নতুন নিয়োগ প্রায় বন্ধ, পেনশন ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার মুখে, মানুষের আয় কমে গেছে কিন্তু ব্যয় বেড়েছে বিপুলভাবে। এক কথায় সাধারণ মানুষের নাভিশ্বাস অবস্থা, সরকারের প্রধানের ‘মন কী বাতে’র চমকে মানুষের পেট তো ভরে না। নানান উন্মাদনায়, চমকে মানুষকে ভুলিয়ে কয়েক বছর তো কেটে গেল, সাথে যোগ হয়েছে ‘ধমক’। সরকার বিরোধিতা আর দেশ বিরোধিতা সমার্থক করে তোলা হচ্ছে। সংবাদমাধ্যমের বড়ো অংশ অঘোষিতভাবে সরকারের অঙ্গুলিহেলনে চলছে। নির্বাচনী ইশতেহারে গরিবের স্বার্থে দেশ চালনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসে সরকারের চেহারা দেখে গরিবের আজ প্রশ্ন ‘সরকার তুমি কার’! বড়ো বড়ো গুটি কয়েক ব্যবসায়ীর? নাকি আম জনতার?