E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রক্ষার স্বার্থেই বাংলায় আরএসএস’র বিস্তার প্রতিরোধ করা দরকার

সুপ্রতীপ রায়


১৭ মে আমাদের রাজ্যে আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবত এসেছিলেন। ছিলেন ১৯ মে পর্যন্ত। পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার প্রশাসনিক বৈঠকে পশ্চিমবাংলার মুখ্যমন্ত্রী মোহন ভাগবতকে ফুল মিষ্টি পাঠিয়ে স্বাগত জানানোর নির্দেশ প্রশাসনকে দেন। এছাড়া সরসঙ্খচালকের নিরাপত্তা ও যত্নের জন্যও প্রশাসনকে হুকুম দেন। এর মধ্য দিয়ে আরএসএস তৃণমূল সম্পর্ক যে কতটা গভীর সেটা আর একবার প্রমাণিত হয়েছে।

তৃণমূল কংগ্রেস তৈরি হওয়ার সময় থেকে আরএসএস এবং তৃণমূলের গভীর সম্পর্ক সবাই জানেন। ১৯৯৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচন এবং ১৯৯৮-৯৯ সালে দুটি লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল-বিজেপি জোট হয়েছিল। আরএসএস-কে তৃণমূলের “স্বাভাবিক মিত্র”, “প্রকৃত দেশপ্রেমিক” বলতেও মমতা ব্যানার্জিকে অতীতে শোনা গেছে। অন্যদিকে আরএসএস-ও তৃণমূল সুপ্রিমোকে “সাক্ষাৎ মা দুর্গা” বলে প্রকাশ্যেই সম্বোধন করেছিল।

তৃণমূলের রাজত্বে পশ্চিমবাংলায় আরএসএস’র সংগঠন বেড়েছে। এতে স্বভাবতই দেশপ্রেমিক, ধর্মনিরপেক্ষ মানুষ চিন্তিত। কিন্তু কেন? ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর আরএসএস’র কর্মসূচিকে রূপায়িত করে চলেছে। সংঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদী অভিযানকে সফলভাবে রূপায়িত করার জন্য আরএসএস-বিজেপি “দেশপ্রেম”, “জাতীয়তাবাদ”-এর প্রশ্নকে কেন্দ্র করে হামলাকে কেন্দ্রীভূত করছে। ১৯২৫ সালে রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের জন্ম হয়। আরএসএস’র উদ্দেশ্য হলো “হিন্দুত্ব” এবং “অখণ্ড হিন্দুরাষ্ট্র”র ধারণা সমাজের সর্বস্তরে পৌঁছে দেওয়া ও গোটা সমাজকে সেই উদ্দেশে চালিত করা। তারা ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের বদলে “হিন্দু রাষ্ট্র” কায়েম করতে চায়। সেই অভিমুখেই আরএসএস তার সংগঠন ও নানা শাখা সংগঠন গড়ে তোলে।

আরএসএস আদতে চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী একটি সংগঠন। আরএসএস যে চরম ব্রাহ্মণ্যবাদী দল তার পরিচয় মেলে ভানোয়ার মেঘওয়ানশি’র “ম্যায় এক স্বয়ংসেবক থা” বইতে (২০১৯); এই বইটির ইংরেজি অনুবাদ করেছেন জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপিকা নিবেদিতা মেনন – “I could not be Hindu-The Story of a Dlit in the RSS” (2020)। “অখণ্ড হিন্দু রাষ্ট্র” গঠনের স্বপ্ন নিয়ে রাজস্থানের দলিত কিশোর ভানোয়ার মেঘওয়ানশি আরএসএস-এ যোগদান করেছিলেন। কিন্তু অচিরেই তার আরএসএস সম্পর্কে মোহভঙ্গ ঘটে। কিন্তু কী কারণে?

হিন্দু-জাতীয়তাবাদের আবেগে মাত্র ১৩ বছর বয়সে ভানোয়ার মেঘওয়ানশি আরএসএস’র শাখায় যুক্ত হন। শাখাতে প্রতিদিন (দুবার করে) দৌড়, শারীরিক ব্যায়াম, খেলাধূলা, যোগ, প্রার্থনা, বৌদ্ধিক চর্চা ছাড়াও ছুরি-লাঠি-তরোয়াল চালনার পাঁচ দিনের প্রারম্ভিক প্রশিক্ষণ, ১৫ দিনের আধিকারিক প্রশিক্ষণও সে গ্রহণ করে। হিন্দু ধর্মের সামরিকীকরণ ও সামরিক বাহিনীর হিন্দুত্বকরণই সংঘের আসল উদ্দেশ্য।

একমাত্র হিন্দুদের সবই অখণ্ড ভারতে, জেরুজালেম বা মক্কা-মদিনায় নয়, কাজেই হিন্দুরাই ভারতমাতার প্রকৃত সন্তান - সংঘের এই বক্তব্য ভানোয়ায় গ্রহণ করেছিলেন। আরএসএস পরিচালিত শাখায় ভানোয়ার ধীরে ধীরে শিক্ষক থেকে শাখা প্রধান হয়ে উঠেছিলেন। একদিন ভানোয়ার রাজস্থানের যোধপুরের জেলা প্রচারক শিবাজী ভাই সাহাবের কাছে ঘর ও পরিবার ত্যাগ করে সংঘের সর্বক্ষণের কর্মী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু জেলা প্রচারক ভানোয়ারকে জবাব দেন, প্রান্তিক সমাজের যুবকের প্রচারক হওয়া যাবে না।

ভানোয়ার পরবর্তীতে উপলব্ধি করেন কেন সংঘের প্রতিষ্ঠার সময় থেকে যে ছ’জন সরসংঘচালক হয়েছেন তার মধ্যে পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও একজন ক্ষত্রিয় (রজু ভাইরা)। ভানোয়ার এও জানেন - সরসংঘচালক সবাই মনোনীত এবং সংঘের অখিল ভারতীয় প্রতিনিধিসভায় ৩৬ জন পদাধিকারীর মধ্যে ছাব্বিশ জন ব্রাহ্মণ, দলিত বা আদিবাসী একজনও নেই।

দলিতদের বাড়ির খাবার যে সংঘের লোকরা গ্রহণ করে না তাও ভানোয়ার নিজের অভিজ্ঞতায় দেখেছিলেন। সংঘের কর্মসূচি শেষে ওর বাড়িতে খাওয়ার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সাধু-সন্ত, সংঘ ও বিশ্বহিন্দু পরিষদের কর্মীদের মধ্যে এই প্রস্তাবে দ্বিধাগ্রস্থতা দেখা যায়। ভানোয়ারকে সংঘের এক কর্তা বলেন, খাবারগুলি তাদের সঙ্গে দিয়ে দিলে পাশের গ্রাম ভগবানপুরায় সবাইকে খাইয়ে দেওয়া হবে। খাবারগুলি সংঘের লোকেরা ভগবানপুরায় যাবার পথে রাস্তায় ফেলে দেয়। ভানোয়ার জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে বুঝেছেন - হিন্দুরাষ্ট্রের পতাকাবাহীদের কাছে সে একজন “শূদ্র” মাত্র। আরএসএস’র হিন্দু রাষ্ট্র শূদ্রদের হতে পারে না।

আরএসএস’র রাজনৈতিক মুখ বিজেপি। ১৯৪৮ সালে গান্ধীকে খুন করার পর আরএসএস নানা প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ে। তখন সংঘের অনুমোদিত রাজনৈতিক দলের প্রয়োজন হয়ে পড়ে। ১৯৫১ সালে “ভারতীয় জনসংঘ” প্রতিষ্ঠিত হয়। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায় ও সাধারণ সম্পাদক হন দীনদয়াল উপাধ্যায়। ১৯৫৩ সালে দলটি পুরোপুরি আরএসএস’র নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ১৯৮০ সালে দলটি অটলবিহারী রাজপেয়ী এবং এল কে আদবানির নেতৃত্বে বিজেপি-তে পরিণত হয়। বিজেপি আরএসএস’র নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয়। বিজেপি’র নেতৃত্বের পদে থাকার প্রাথমিক শর্তই হচ্ছে আরএসএস’র সঙ্গে যুক্ত থাকা ও সংঘের নিয়ন্ত্রণে থাকা। আরএসএস উগ্র অন্ধ জাতীয়তাবাদের জিগির তুলে ভারতকে ধর্মীয় ফ্যাসিস্ত রাষ্ট্রে পরিণত করতে চায়।

পশ্চিমবাংলায় আরএসএস’র বিস্তার উদ্বেগজনক। গত বিধানসভা নির্বাচনে পশ্চিমবাংলায় বিজেপি’র উত্থান আরএসএস’র সুনির্দিষ্ট ও দীর্ঘদিনের পরিকল্পনার ফসল। বাংলায় আরএসএস’র প্রভাব কম ছিল, কিন্তু আরএসএস’র সক্রিয়তা অতীতে ছিল। স্বাধীনতার পর পশ্চিমবাংলায় ধারাবাহিক বামপন্থীদের নেতৃত্বে আন্দোলন ও ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থানজনিত কারণে আরএসএস’র বিস্তার অনেকটাই প্রতিরোধ করা গিয়েছিল।

আরএসএস’র অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কেশব বলিরাম হেডগেওয়ার ১৯১০-১৬ পর্যন্ত কলকাতায় পড়াশোনা করেছিলেন। ১৯১৬ সালে, ২৭ বছর বয়সে তিনি কলকাতার মেডিকেল কলেজ থেকে ডাক্তারি পাশ করেন। হেডগেওয়ারের পর আরএসএস প্রধান হন গোলওয়ালকর। তিনি ১৯৩৬ সালে মুর্শিদাবাদ জেলার সারগাছিতে বেলুড় মঠে স্বামী অভেদানন্দের কাছে যোগশিক্ষা নিয়েছিলেন। ১৯৩৯ সালে তিনি বাংলায় আরএসএস’র শাখা খোলার দায়িত্ব নিয়ে এখানে আসেন। মানিকতলায় একটি বিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে বাংলায় আরএসএস’র প্রথম “শাখা” প্রতিষ্ঠিত হয় গড়পাড়ে। মানিকতলার কাছে প্রথম শাখা খোলার কয়েকবছরের মধ্যে সিউড়ি, বর্ধমান, বহরমপুর, নবদ্বীপ, মেদিনীপুর, উত্তরপাড়া সহ কয়েকটি স্থানে আরএসএস’র শাখা প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৩৯ সালে সারা ভারত হিন্দু মহাসভার সভাপতি বিনায়ক দামোদর সাভারকর কলকাতায় আসেন। সেখান থেকে তিনি খুলনাতে হিন্দু মহাসভার সম্মেলনে যান। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ধারাবাহিক মুসলিম বিরোধী বক্তব্য হাজির করেছেন। এমনকী ১৯৪৩- র মন্বন্তরের সময়ও তিনি সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করে গিয়েছেন। কিন্তু বাংলায় আরএসএস’র বিস্তার যেভাবে হওয়া উচিত ছিল তা হয়নি। বাংলাভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান থেকে দলে দলে উদ্বাস্তু আসার সময় বা তার পরেও যেভাবে আরএসএস’র প্রসার ঘটা উচিত ছিল তা ঘটেনি। এমনকী ১৯৬৫ সালে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় যে পরিবেশ তৈরি হয়েছিল তাকে ব্যবহার করেও পশ্চিমবাংলায় আরএসএস দাঁত ফোটাতে পারেনি।

কিন্তু কেন? কারণ পশ্চিমবাংলায় কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন, উদ্বাস্তু আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, ট্রাম ভাড়া বৃদ্ধির বিরুদ্ধে আন্দোলন, জমির আন্দোলন, গণতন্ত্রের দাবিতে আন্দোলন সমস্ত সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্যবোধ গড়ে তুলেছিল। দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকার ও ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের অবস্থানের কারণেও আরএসএস পশ্চিমবাংলায় সেভাবে বিস্তার ঘটাতে পারেনি।

রামমন্দির-বাবরি মসজিদ বিতর্কের সময় আরএসএস কিছুটা পশ্চিমবাংলায় অগ্রগতি ঘটাবার চেষ্টা করে। “রামশিলা” পূজার মধ্যে দিয়ে উন্মাদনা তৈরির চেষ্টা করেছিল। ১৯৯৮ সালের ১ জানুয়ারি তৃণমূল কংগ্রেস দল তৈরি হয়। ওই দল তৈরিতে আরএসএস’র সহায়তা ছিল। আরএসএস তৃণমূলের সাহায্যে শাখা বৃদ্ধির চেষ্টা করে। সিপিআই(এম) রাজনৈতিকভাবে সংঘবিরোধী প্রচারকে তীব্র করে। ফলে আরএসএস’র শাখার পরিমাণ কমতে থাকে। ২০০৩ সালে আরএসএস’র শাখা কমে ১০০০-এ দাঁড়ায়। ২০১১-তে বামফ্রন্ট সরকার যখন বিদায় নিচ্ছে তখন শাখার সংখ্যা খুবই কম ছিল।

২০১১ সালে তৃণমূল সরকারে আসার পর আরএসএস’র শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। বামফ্রন্ট সরকার বিদায় নেওয়ার অল্প কিছুদিনের মধ্যেই নদীয়ার গয়েশপুরে ১০,০০০ স্বয়ংসেবককে নিয়ে তিনদিনের এক বিশাল শিবির সংগঠিত করা হয়। তৃণমূল-আরএসএস সম্পর্ক খুবই মধুর। একারণে আরএসএস’র মুখপত্র “পাঞ্চজন্য” পত্রিকায় মমতা ব্যানার্জিকে “ব্যতিক্রমী রাজনীতিবিদ” হিসাবে প্রশংসা করা হয়। আরএসএস’র মূল লক্ষ্য বাংলার মানুষের ধর্মনিরেপক্ষ দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটানো। ২০১১-২১ এই দশ বছরে আরএসএস’র শাখার সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে পেতে দু’হাজারে দাঁড়িয়েছে।

তৃণমূলের আমলে আরএসএস’র সংগঠন যে বেড়েছে তারও প্রমাণ আছে। যেমন কোনো অঞ্চলে কাছাকাছি বেশ কয়েকটি শাখা থাকলে তাদের নিয়ে তৈরি করা হয় “মণ্ডল”। তৃণমূলের রাজত্বে উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর শাখা গড়ে উঠেছে। আলিপুরদুয়ারের বেশ কয়েকটি “মণ্ডল” গড়ে উঠেছে। গত কয়েকবছরে তরুণ স্বয়ংসেবকদের মধ্য থেকে অগ্রণী কর্মীদের উপর নজর দেওয়া হয়েছে। এদের নাগপুরে পাঠিয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। পশ্চিমবাংলায় “প্রচারক”-এর সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে। “প্রচারক” তাদেরই বলা হয় – যারা সংঘের জন্য জীবন উৎসর্গ করতে দ্বিধাবোধ করেন না, বিবাহ করেন না। প্রসঙ্গত, “প্রচারক” হওয়ার আগে কিছু দিন “বিস্তারক” হয়ে পূর্ণ সময়ের কর্মী হিসাবে কাজ করতে হয়।

পশ্চিমবাংলায় সংঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখা প্রশাখা কাজ করছে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল, সিংহবাহিনী, সেবা ভারতী, সক্ষম, দুর্গা বাহিনী, হিন্দু জাগরণ মঞ্চ, হিন্দু যুব বাহিনী, রাষ্ট্রীয় কলা মঞ্চ, ন্যাশনালিস্ট ল’ইয়ার্স ফোরাম, ভারত বিকাশ পরিষদ, রাষ্ট্র সেবিকা সমিতি, বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, আরোগ্য ভারতী, ভারতীয় কিষান সংঘ, ভারতীয় মজদুর সংঘ, সহকার ভারতী, সংস্কার ভারতী, বিজ্ঞান ভারতী, শক্তি বিদ্যাভারতী, আরোগ্য ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া, বনবন্ধু পরিষদ, শ্রী হরি সৎসঙ্গ সমিতি, ন্যাশনাল মেডিকোজ অর্গানাইজেশন, বঙ্গীয় শিক্ষক ও শিক্ষাকর্মী সংঘ, বঙ্গীয় নব উন্মেষ প্রাথমিক শিক্ষক সংঘ, এবিভিপি, ক্রীড়া ভারতী, প্রজ্ঞাসভা, বাস্তুহারা সহায়তা সমিতি, লঘু উদ্যোগ সমিতি প্রভৃতি।

এছাড়া আরও কয়েকটি সংগঠন স্থানীয় স্তরে আরএসএস আমাদের রাজ্যে পরিচালনা করে। যেমন বিদ্যাসাগর বিদ্যা বিকাশ পরিষদ, আলিপুরদুয়ার গণবিবাহ সমিতি, সেবায়ন পশ্চিমবঙ্গ, ধর্মীয় জাগরণ সম্বন্বয় শাখা, পরিবার প্রবোধন শাখা, মানবাধিকার রক্ষা মঞ্চ, সচেতন নাগরিক মঞ্চ, বঙ্গীয় জাতীয়তাবাদী পরিষদ প্রভৃতি।

সংঘ একাধিক স্কুল পশ্চিমবাংলায় খুলেছে। এই স্কুলগুলিতে সংঘের আদর্শগত শিক্ষা দেওয়া হয়। সংঘের শিক্ষা বিভাগটির নাম বিদ্যাভারতী। বিদ্যাভারতীর অধীনে পশ্চিমবাংলায় মোট ৩২২টি বিদ্যালয় আছে - যেখানে ৮৪ হাজারের বেশি ছাত্র-ছাত্রী পড়াশুনা করে। বিদ্যাভারতীর দক্ষিণবঙ্গ শাখার নাম “বিদ্যাসাগর বিদ্যা বিকাশ পরিষদ”। এরা সারদা শিশুতীর্থ, সারদা শিশু মন্দির ও সরস্বতী শিশুতীর্থ প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিচালনা করে। প্রতিটি শ্রেণি কক্ষে ওঁ সরস্বতী, ভারতমাতার ছবি লাগানো থাকে। স্কুলগুলিতে গীতার শ্লোক, গায়ত্রী মন্ত্র গাওয়া হয়। এই স্কুলগুলিতে আরএসএস’র ক্যাম্প হয়। আবার বিভিন্ন সময় আরএসএস’র প্রচারকরা এই বিদ্যালয়গুলিতে থাকেন।

তৃণমূল সরকারে আসার পর আদিবাসী এলাকায় প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করে চলেছে। আদিবাসী অঞ্চলে সংঘের প্রভাব বৃদ্ধির প্রচেষ্টার নাম “একল অভিযান”। শ্রী হরি সৎসঙ্গ সমিতি, বনবন্ধু পরিষদ, আরোগ্য ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়ার মাধ্যমে “একল অভিযান” পরিচালিত হয়। ২০১৯ সালের হিসাব অনুসারে, আমাদের রাজ্যে ৩,৫৬৭ একল বিদ্যালয়ে ৮৭ হাজারের বেশি ছেলে-মেয়ে পাঠ গ্রহণ করেছে। পশ্চিমবাংলার বেশ কিছু আদিবাসী এলাকায় শ্রী হরি সৎসঙ্গ সমিতি “সংস্কার কেন্দ্র” তৈরি করেছে। এখানকার কাজ শুরু হয় “ভজন মণ্ডলী” দিয়ে। প্রতিসপ্তাহে ভজন শোনার জন্য লোক উপস্থিত করানো হয়। এছাড়া “হরিকথা” কর্মসূচির মধ্য দিয়ে সংঘের আদর্শ প্রচার করা হয়ে থাকে।

“আরোগ্য ফাউন্ডেশন অফ ইন্ডিয়া” - বিগত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন অঞ্চলে স্বাস্থ্য পরীক্ষা শিবির সংগঠিত করছে। বিনামূল্যে ওষুধও দিচ্ছে। “একল গ্রামোত্থান ফাউন্ডেশন”-এর মাধ্যমে গ্রামাঞ্চলে ফলের গাছ লাগাতে উৎসাহিত করা হচ্ছে। “একল গ্রামোত্থান ফাউন্ডেশন” মালদহ জেলার আদিবাসী প্রধান হবিবপুরে “গ্রামোত্থান রিসোর্স সেন্টার” গড়ে গোমূত্র থেকে কীটনাশক ও গোবর সার তৈরির কাজ করে। “একল অন হুইল” বিভিন্ন গ্রামে কম্পিউটার শিক্ষা দেয়। এগুলির মধ্যে দিয়ে আরএসএস নানাভাবে তার সক্রিয়তা তৃণমূলের আমলে বৃদ্ধি করেছে। সংগঠনও গড়ে তুলেছে পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে।

আরএসএস’র একাধিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। যারমধ্য দিয়ে আরএসএস তার আদর্শগত প্রচার করে। গত এক দশকে পশ্চিমবাংলায় আরএসএস প্রকাশিত পত্রিকাগুলির প্রচার সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। যেমন “স্বস্তিকা” (বাংলা ভাষায়) পত্রিকা। এই পত্রিকাটি সাপ্তাহিক। এর শারদ সংখ্যাও প্রকাশিত হয়। ১৯৪৭ সাল থেকে ইংরেজিতে “অর্গানাইজার” পত্রিকা (সাপ্তাহিক) প্রকাশিত হয়ে চলেছে। এই পত্রিকাটির ডিজিটাল সংস্করণও আছে। ১৯৪৮ সাল থেকে আরএসএস’র হিন্দী সাপ্তাহিক পত্রিকা “পাঞ্চজন্য” প্রকাশিত হচ্ছে। এছাড়া “স্বরাজ্য”, “হিন্দুস্তান সমাচার”, “স্বদেশ”, “রাষ্ট্রধর্ম”, “মাদারল্যান্ড” প্রভৃতি আরএসএস’র পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এগুলির প্রত্যেকটি পশ্চিমবাংলায় প্রচারিত হয় এবং এগুলির প্রচার সংখ্যাও বাড়ছে। এছাড়া গত কয়েক বছরে আমাদের রাজ্যে সংঘ নিয়ন্ত্রিত অসংখ্য প্রকাশনা সংস্থা গড়ে উঠেছে।

তৃণমূলের সৌজন্যে আমাদের রাজ্যে আরএসএস’র বিস্তার ঘটে চলেছে। যা উদ্বেগের। ধর্মনিরপেক্ষ ভারত রক্ষার স্বার্থেই বাংলায় আরএসএস’র বিস্তার প্রতিরোধ করা দরকার।