৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯
অমৃতা দেবী - ভারতের প্রথম পরিবেশ শহিদ
তপন মিশ্র
মারওয়ারের অমৃতা দেবীর কথা আমাদের আবার নতুন করে লড়াইয়ের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। মরুভূমিতে সবুজ রক্ষার লড়াইয়ে ১৭৩০ সালে শহিদ হন অমৃতা দেবী এবং তাঁর অনুগামীরা। তখন আমরা কেউ ছিলাম না। তখন বিশ্ব উষ্ণায়নের এই বিতর্ক মুখে মুখে ঘুরত না। তখন রাজাস্থানের মারওয়ার অঞ্চলের রাজা ছিলেন অভয় সিংহ। রাজস্থানের যোধপুর অংশ হলো মারওয়ার। এখান থেকেই ভারতের একমাত্র উষ্ণ মরুভূমি থর শুরু হয়ে পশ্চিমে বিস্তৃত।
মরুভূমি মানেই জীবশূন্য নয়। মরুভূমিরও নিজস্ব এক জৈববৈচিত্র্য আছে। অবশ্য মানুষ সহ সমস্ত প্রাণের টিকে থাকার সংগ্রাম এখানে অনেকটাই কঠিন। আমাদের দেশের হিমালয়ের শীতল মরুভূমির জীবনও অনেকটাই কঠিন। সেই সময়ে মরুভূমির মাঝে খেজরি গাছ বাঁচানোর লড়াইয়ের সেনানেত্রী ছিলেন অমৃতা দেবী।
নতুন গড় স্থাপন করতে রাজা অভয় সিংহের অনেক কাঠের দরকার পড়ে। তখন সিমেন্টের আবিষ্কার হয়নি। চুন পুড়িয়ে ‘কুইক লাইম’ তৈরি করে ইট বা পাথরের জোড়া লাগিয়ে তৈরি হতো প্রাসাদ। চুনের ভাটি নিরন্তর জ্বালিয়ে রাখতে এবং নির্দিষ্ট তাপমাত্রা বজায় রাখতে দরকার হতো প্রচুর কাঠ। একারণে রাজা অনেক খেজরি গাছ কাটার নির্দেশ দেন। কিন্তু এই মরু অঞ্চলের আদি বাসিন্দা বিশনোই-দের এই নির্দেশ পছন্দ হয়নি। শুরু হয় এক অসম লড়াই।
খেজরির কথা
এখানকার বিস্ময়কর বৃক্ষ হলো ‘খেজরি’। প্রচণ্ড দাবদাহে নিশ্চিন্তে ডালপালা মেলে মরুভূমির অনেকটা জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকে যে বৃক্ষ তার নাম খেজরি (Prosopis cineraria) বা খেজারি বা খেজারালি। ভারত উপমহাদেশের পশ্চিমের মরুর শুষ্ক মৃত্তিকা অঞ্চলের স্বাভবিক উদ্ভিদ হলেও এদেশের গুজরাট , মধ্যপ্রদেশ, পাঞ্জাব ইত্যাদি রাজ্যে খেজরি গাছ দেখতে পাওয়া যায়।
পশ্চিম এশিয়ার বেশ কিছু দেশে যেমন আফগানিস্তান, বাহারিন, ওমান, সৌদি আরব, ইয়েমেন ইত্যাদি দেশে এমনকী দক্ষিণ-পুর্ব এশিয়ার ইন্দোনেশিয়াতেও এই গাছের দেখা মেলে। রাজস্থানের রাজ্য-বৃক্ষ (state-tree) হলো খেজরি। আরব আমিরশাহির রাষ্ট্রীয় বৃক্ষ হলো খেজরি বা ঘাপ (ও দেশের ভাষায়) অর্থাৎ জীবনদায়ী বৃক্ষ। বাহরিনের একটি খেজরি গাছ আছে যার বয়স প্রায় ৪০০ বছর। গাছটি বাহারিনের শাখীর মরুভূমির মধ্যে। এই বিশালাকায় গাছটির জলের এবং খনিজ লবণের উৎস এক বিস্ময়।
বিশনোই সম্প্রদায়ের মানুষ খেজরি গাছকে পবিত্র বলে মনে করেন। এই পবিত্রতার ধারণা সেই গাছের নানাবিধ উপযোগিতা থেকে যে এসেছে এবিষয়ে সন্দেহ নেই। শিম্বি জাতীয় (leguminous) গাছ হওয়ার কারণে এই গাছের ফলে অন্য যে কোনো ডালশস্যের মতো প্রোটিনের পরিমাণ বেশি। এটি একটি নাইট্রোজেন সংশ্লেষকারী উদ্ভিদ হওয়ায় মৃত্তিকার মানোন্নয়নে এই গাছ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। এ ছাড়াও এই গাছের ফল খাদ্য হিসাবে, পাতা পশুখাদ্য হিসাবে, গাছের গুঁড়ি উন্নত মানের কাঠ হিসাবে ব্যবহৃত হয়। গাছটির বহুমাত্রিক বাস্তুতান্ত্রিক উপযোগিতা (ecological services)-ও সুবিদিত। মরুঝড়ের তীব্রতা স্তিমিত করে পাশের চাষজমিকে রক্ষা করে এই গাছের সারি। এক একটি খেজরি গাছ যেন এক একটি সম্পূর্ণ বাস্তুতন্ত্র (complete ecosystem)। কত ধরনের পোকামাকড়, পাখী, ছোটো স্তন্যপায়ী প্রাণী, ছোটো উদ্ভিদ ইত্যাদির প্রাণ জড়িয়ে আছে এই গাছের সঙ্গে তার কোনো সঠিক হিসেব নেই। একারণে গাছটি বহুল-উপযোগী (multipurpose tree) হিসাবে পরিচিত।
বিশনোই সম্প্রদায়ের গাছ ও হরিণদের প্রতি ভালোবাসা অপরিসীম।
অমৃতা দেবী এবং বিশনোই সমাজ
যে বৃক্ষের বহুমাত্রিক ব্যবহার জনজীবনে স্বীকৃত সেই গাছগুলি বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর জীবনের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে থাকে। ফলে রাজা অভয় সিং-এর খেজরি গাছগুলি কেটে ফেলার ফরমানের বিরুদ্ধে বিশনোই সমাজের ক্ষুব্ধ হওয়ারই কথা।
বিশনোইরা ২৯টি নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত এক আদিম সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত। এই নীতিগুলির বেশিরভাগই পরিবেশ রক্ষার সিদ্ধন্তের উপর প্রতিষ্ঠিত। এরা গাছ এবং বন্যপ্রাণীদের ক্ষতি করার বিরুদ্ধে কঠোরভাবে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ভারতের পশ্চিম রাজস্থানের মারওয়ার (যোধপুর) মরুভূমি অঞ্চলে ১৪৮৫ সালে গুরু মহারাজ জামবাজি নামে এক সমাজসেবীর দ্বারা বিশনোই সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠিত হয়। জামবাজি খরার সময় বিভিন্ন কারণে অবিরাম বৃক্ষ ছেদন এবং সেখান থেকে যে পরিবেশগত সমস্যা অনুধাবন করেন এবং তার উপরে দাঁড়িয়ে তিনি ২৯টি নীতি প্রণয়ন করেন। এই ধারণার বশবর্তী হয়ে শুষ্ক মরুভূমি অঞ্চলের মাঝখানে বিশনোইরা সবুজ গাছপালা চাষ, প্রাণীদের যত্ন নেওয়া এবং পানীয় জল সংরক্ষণ বহুভাবে নিজস্ব পদ্ধতিতে চেষ্টা করে।
বিশনোই সম্প্রদায়ের গুরু জামবাজির ২৯টি নীতি লিপিবদ্ধ হওয়ার প্রায় ৩০০ বছর উদ্যাপনের জন্য যোধপুরের রাজা এই নতুন প্রাসাদ তৈরি করতে চেয়েছিলেন। তিনি খেজারালি গ্রামের নিকটবর্তী বনাঞ্চল থেকে কাঠ সংগ্রহ করতে সৈন্যদের পাঠান। এই বনাঞ্চল ছিল বিশনোই গ্রামবাসীদের দ্বারা সংরক্ষিত। যখন রাজার সৈন্যরা গাছের ক্ষতি করতে শুরু করে, তখন বিশনোইরা তীব্র প্রতিবাদ করতে থাকেন। কিন্তু সৈন্যরা এই প্রতিবাদ উপেক্ষা করে গাছ কাটা অব্যাহত রাখে। তখন গ্রামের অধিকাংশ পুরুষ কাজের জন্য গ্রামের বাইরে ছিলেন। রাজার সেনাদের বিরুদ্ধে এই অসম লড়াইয়ের নেতৃত্ব দিতে ছুটে আসেন তিন সন্তানের মা অমৃতা দেবী নামে একজন সাহসী মহিলা।
খেজরি গণহত্যা
যোধপুর থেকে মাত্র ১৮ কিলোমিটার দূরে খেজারালি গ্রাম। অভয় সিংয়ের সেনারা যখন গাছ কাটার প্রক্রিয়া শুরু করে, তখন অমৃতা দেবী এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এই সাহসী মহিলার স্লোগান ছিল ‘খেজারালি গাছের পরিবর্তে আমাদের শিরশ্ছেদ করো’। সে সময়ে রাজার আদেশের বিরুদ্ধাচরণ ছিল এক অসম্ভব প্রয়াস। সেদিন ছিল ১১ সেপ্টেম্বর, ১৭৩০ হঠাৎ গাছ কাটার কাজ শুরু হওয়ায় এর বিরুদ্ধে গ্রামবাসীদের সংগঠিত হওয়ার কোনো প্রস্তুতিই ছিল না। এমন এক সময়ে অমৃতা দেবী রাজার সৈনিকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নেন। তিনি গ্রামের মহিলাদের নিয়ে গাছগুলিকে আক্ষরিক অর্থে আলিঙ্গন করে রক্ষা করে রাখেন। সঙ্গে অমৃতা দেবীর তিন সন্তানের মধ্যে দু'জন ছিলেন। এ ভাবেই অমৃতা দেবী হয়ে যান এই গণহত্যার প্রথম শহিদ এবং নেত্রী।
ঠিক তার পরেই আশেপাশের গ্রামের বিশনোইরা জঙ্গলে এসে একে একে গাছগুলিকে আলিঙ্গন করে রাখে এবং সেগুলিকে কেটে ফেলা থেকে রক্ষা করে। দুঃখজনকভাবে মহারাজার লোকেরা নির্দয়ভাবে অমৃত দেবী এবং তাঁর সন্তানদের শিরশ্ছেদ করার পর মোট ৩৬৩ জনের শিরশ্ছেদ করে। যখন এক একজন গ্রামবাসী একটি গাছকে জড়িয়ে ধরে এবং কাটতে দিতে অস্বীকার করে তখন রাজার সৈন্যরা তাদের শিরশ্ছেদ করতে থাকে। খেজারালি গ্রামের অরণ্য রক্ষার লড়াইতে সেদিন ৩৬৩ জন বিশনোই গ্রামবাসীকে হত্যা করা হয়।
সেদিন যাঁরা তাঁদের প্রিয় গাছগুলিকে রক্ষা করতে গিয়ে মারা গিয়েছিলেন সেই ৩৬৩ জন বিশনোই শহিদের স্মরণে এলাকার চারপাশে বেশ কয়েকটি খেজরি গাছ লাগানো হয়। এই গাছগুলি এখনও উল্লেখযোগ্যভাবে প্রাণবন্ত এবং বেশ কয়েকটি প্রাণী প্রজাতিতে সমৃদ্ধ। অবশ্য এই ভয়াবহ অবস্থার সামাল দিতে মহারাজা শীঘ্রই গাছ কাটা বন্ধের নির্দেশ দেন। তিনি অবিলম্বে বিশনোই সম্প্রদায়ের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেন এবং তাদের বীরত্বের প্রশংসা করেন। এর পরই একটি ডিক্রিও জারি করা হয় এবং বিশনোইদের গ্রামের এবং এর আশেপাশে খেজরি গাছ কাটা এবং বন্যপ্রাণী শিকার করা নিষিদ্ধ করা হয়।
কিন্তু তা আর হলো কই
পরবর্তী সময়ে এই একই অঞ্চলে বন্দুকবাজদের প্রিয় শিকার হয়ে যায় কৃষ্ণসার হরিণ (Antilope cervicapra) বা ব্লাকবাক বা ইন্ডিয়ান অ্যান্টিলোপ। স্বাধীনতার আগে এবং পরেও ঝাঁকে ঝাঁকে শিকার হতে থাকে কৃষ্ণসার হরিণ। এই হরিণ বিশনোইদের কাছে আরাধ্য। একারণে বিশনোইরা মানুষ ও বন্যপ্রাণীর সহাবস্থানের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ১৯৭৪ সালে বিশনোইদের উদ্যোগে তৈরি হয় ‘বিশনোই জীব রক্ষা সভা’। ১৫ জানুয়ারি, ১৯৭৫-এ তা হয়ে ওঠে 'অল ইন্ডিয়া জীব রক্ষা বিশনোই সভা'। এদের উদ্যোগে পাঞ্জাবের ফজিলকা জেলার ১৩টি গ্রাম নিয়ে গড়ে উঠেছে কৃষ্ণসার হরিণের অভয়ারণ্য। এই প্রজাতির হরিণ ‘নিয়ারলি থ্রেটেন্ড’ বন্যপ্রাণীর অন্তর্ভুক্ত এবং ওয়াইল্ডলাইফ প্রোটেকশন অ্যাক্ট, ১৯৭২ (Wildlife Protection Act, 1972)-এর তালিকায় সিডিউল-১ অন্তর্ভুক্ত।
এসব সত্ত্বেও ১৯৯৮ সালের অক্টোবর মাসে বলিউডের বেশ কয়েকজন চিত্রতারকা এই হরিণ শিকারের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও এঁদের বিরুদ্ধে বিশনোইদের প্রায় ২০ বছরের আইনি লড়াই খুব একটা স্বস্তি দিতে পারেনি।
হাতে না মেরে ভাতে মার
বিশনোইদের এই আত্মবলিদান পরবর্তীকালে বৃহত্তর 'চিপকো আন্দোলন' সহ আরও অসংখ্য পরিবেশ আন্দোলনের অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠে যা আজও ক্রমবর্ধমান। সেই সময়ে যেমন অরণ্যবাসী এবং অরণ্য সংরক্ষণের মাঝে রাজশক্তি বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল, আজও একইভাবে আমাদের সরকারি ব্যবস্থা অরণ্যবাসীদের বিভিন্নভাবে বঞ্চিত করে চলেছে। ১১ সেপ্টেম্বর, ১৭৩০-এ সংঘটিত এই গণহত্যায় অমৃতা দেবী এবং অন্য বিশনোইদের স্মরণে ২০১৩ সালে এই দিনটিকে ‘জাতীয় বন শহিদ দিবস’ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। ঔপনিবেশিক শাসন ব্যবস্থায় বনবাসীদের যে বঞ্চনার শিকার হতে হয়েছে গত শতকের আশির দশকের পর তার একটু সুরাহা হলেও ২০১৪-র পর এই ব্যবস্থা আরও গুরুতরভাবে বনবাসীদের আঘাত করেছে। যে পরিবর্তন হয়েছে তা হচ্ছে কেবল কৌশলের। অর্থাৎ হাতে মারার পরিবর্তে ভাতে মারার পরিকল্পনা এখনও অব্যাহত। ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইনের পরিবর্তন করে বনাঞ্চলে যথেচ্ছ অরণ্য সংরক্ষণ বিরোধী কর্মকাণ্ডের উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। অরণ্য বাণিজ্যিকীকরণের সমস্ত বাধা দূর করার জন্য ২০২০ সালের অতিমারীর শুরুর প্রাক্বালে প্রথম লকডাউনের শুরু থেকে বিভিন্ন অরণ্য সংরক্ষণ বিরোধী এবং স্বাভাবিকভাবে অরণ্যবাসী বিরোধী আইনি সংশোধন করা হচ্ছে। তা সত্ত্বেও অমৃতা দেবীদের লড়াই ব্যর্থ হবে না। এদেশের উত্তর থেকে দক্ষিণে, পুর্ব থেকে পশ্চিমে, এরাজ্যে তিলাবনি থেকে দেউচা-পাচামি সর্বত্র অমৃতা দেবীর প্রতিরোধের আলোচনা আরও মুখরিত হোক। শ্রেণি আন্দোলনের সঙ্গে একীভূত হোক এ লড়াই।