E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৪২ সংখ্যা / ৩ জুন, ২০২২ / ১৯ জ্যৈষ্ঠ, ১৪২৯

পরিবেশ আলোচনা-২

বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২২

আবুবকর সেখ


আকাশ ভরা সূর্য-তারা,
বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারি মাঝখানে আমি পেয়েছি
আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান।


কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘‘বিশ্বভরা প্রাণ’’ আজ আমাদের কাছে আর্তনাদে পরিণত হয়েছে। পরিবেশের আমূল পরিবর্তনে মানবিক জীবন সংকটের সম্মুখীন। যে প্রকৃতি মুক্তহস্তে অক্সিজেন দিয়ে মানব সমাজকে বাঁচিয়ে রেখেছে আজ সে নিজেই আক্রান্ত। আর তার জন্য দায় কেবল মানুষের।

আর এক বিখ্যাত কবি দ্বিজেন্দ্র লাল রায় বলেছিলেন, ‘‘ধনধান্য পুষ্পে ভরা আমাদের এই বসুন্ধরা’’ - কঠিনভাবে আক্রান্ত। প্রাণভরে শ্বাস নেওয়ার মুক্ত বায়ু নেই। চারিদিকে অক্সিজেনের হাহাকার। পরস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে অর্থ দিয়েও মিলছে না অক্সিজেন।

এবছর এই কঠিন পরস্থিতিতেই ৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস পালিত হলো। এবারের ভাবনা ‘‘Invest in our Planet’’। দূষণমুক্ত পরিবেশ মানব জীবনে কতটা গুরুত্বপূর্ণ তা করোনা অতিমারী সময়ে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। গত ২০২০ সালে থিম ছিলঃ ‘‘জীবন বৈচিত্র্যে ভরে উঠুক পৃথিবী’’ এবং ২০২১ সালে থিম ছিলঃ ‘‘Restore our Earth’’.

প্রকৃতির দ্বান্দ্বিকতা গ্রন্থে ‘বানর থেকে মানুষে বিবর্তনে শ্রমের ভূমিকা’ অংশে এক জায়গায় ফ্রেডরিখ এঙ্গেলস লিখেছেন, ‘‘প্রকৃতির ওপর মানুষের এই জয়লাভে আমরা যেন খুব বেশি আত্মপ্রসাদ লাভ না করি। কারণ এইরকম প্রতিটি বিজয়ের জন্যই প্রকৃতি আমাদের ওপর প্রতিহিংসা গ্রহণ করে। একথা সত্য যে প্রত্যেকটি জয়ের ফলাফল সর্বাগ্রে আমাদের ধারণানুসারী। কিন্তু দ্বিতীয় ও তৃতীয় ক্ষেত্রে এর ফলাফল হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন এবং অকল্পিতপূর্ব, আর প্রায়শই তা শুধু প্রথম পরিণামটিকে নাকচ করে দেয়। মেসোপটেমিয়া, গ্রিস, এশিয়া মাইনর এবং অন্যান্য জায়গায় যারা চাষের উপযোগী জমি পাবার জন্য অরণ্যগুলি ধ্বংস করেছিল, তারা স্বপ্নেও কোনোদিন ভাবেনি যে অরণ্যের সঙ্গে এইভাবে জলীয়বাষ্প সংগ্রহ ও ধারণ করার কেন্দ্রগুলিও নিঃশেষিত করে তারা এইসব দেশের বর্তমান বিধ্বস্ত অবস্থার ভিত্তিস্থাপন করে যাচ্ছিল। উত্তরের ঢালু জমিতে যে পাইন অরণ্যগুলিকে এত যত্নে রক্ষা করা হয়েছে, আল্পস অঞ্চলের ইতালীয়রা যখন দক্ষিণের ঢালু এলাকার সেই পাইন অরণ্যগুলিকেই কেটে নিঃশেষ করে ফেলেছিল, তখন তাদের একটু ধারণা ছিল না যে, তারা এইভাবে তাদের পার্বত্য পশুপালনের মূলেই কুঠারাঘাত করছে। এতে করে তারা বছরের বেশিরভাগ সময়ের জন্য তাদের পার্বত্য ঝরনাগুলির জল অপহরণ করছে ও বর্ষাকালে সমতলভূমিতে তাদের আরো উন্মুক্ত জলস্রোত সম্ভব করে তুলেছে এ ধারণা তাদের ছিল আরো কম। যারা ইউরোপে আলু চাষের প্রসার ঘটিয়েছিল তাদের মনেও আসেনি যে এই খাদ্য-গুণসম্পন্ন কন্দগুলির (farinaceous tubers) মাধ্যমে তারা গলগন্ড রোগের (scrofula) জীবাণুও ছড়াচ্ছিল। এইভাবে প্রতিপদেই আমাদের মনে রাখতে হয় যে বিজেতা যেমন বিজিত জাতির উপর আধিপত্য বিস্তার করে, আমরা কোনো অর্থেই সেভাবে প্রকৃতির উপর প্রভুত্ব করি না। বরং রক্ত, মাংস আর মস্তিষ্ক নিয়ে আমরা প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত হই, প্রকৃতির মধ্যে আমাদের অস্তিত্ব প্রোথিত করি, এবং প্রকৃতির উপর আমাদের সমস্ত প্রভুত্বের সুবিধা এই যে অন্য সকল জীবের চেয়ে আমরা প্রকৃতির নিয়ম আয়ত্ত করতে এবং নির্ভুল প্রয়োগ করতে সক্ষম।’’ (পৃষ্ঠা-১১৩-১১৪)।

বহুকাল পূর্বে (রচনাকালঃ ১৮৭৩-১৮৭৬ এবং প্রথম প্রকাশ ১৯২৫ সাল) এঙ্গেলসের বক্তব্য কত সঠিক ছিল তা বিগত কয়েক বছর পূর্বে উত্তরাখণ্ডের বিপর্যয় (হরপা বানে জীবনহানি, প্রাকৃতিক সম্পদ ও ঘরবাড়ির ব্যাপকভাবে ক্ষতি) আমাদেরকে স্মরণ করিয়ে দেয়।

দূষণমুক্ত পৃথিবী গড়ার তাগিদে প্রথম এগিয়ে আসে সুইডেন। ১৯৬৮ সালে ২০ মে জাতিসংঘের অর্থনীতি ও সামাজিক পরিষদের নিকট প্রকৃতি ও পরিবেশ দূষণের কথা জানিয়ে একটি চিঠি লেখেন। তাই পরিবেশ রক্ষার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা ও সমাধানের উপায় খুঁজতে সদস্য রাষ্ট্রগুলিকে নিয়ে জাতিসংঘের উদ্যোগে ১৯৭২ সালের ৫-১৬ জুন সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে মানব পরিবেশ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনটি ইতিহাসের প্রথম পরিবেশ-বিষয়ক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৩ সালে সম্মেলনের প্রথম দিন ৫ জুনকে জাতিসংঘ ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করে। ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতি বছর দিবসটি বিশ্বব্যাপী পালিত হয়ে আসছে।

বর্তমান সমাজে নানাভাবে পরিবেশ দূষিত হচ্ছে। তারমধ্যে নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কারণ তুলে ধরা হলো।

১) বনাঞ্চল ধ্বংস করে প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করা।

একটি দেশের ইকোলজি সাম্য বজায় রাখতে মোটামুটি ৩০ শতাংশের বেশি বনাঞ্চল থাকা প্রয়োজন। ভারতের ক্ষেত্রে তার ঘাটতি আছে। ‘ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’ কর্তৃক প্রকাশিত ‘ইন্ডিয়ান স্টেট অফ ফরেস্ট রিপোর্ট-২০১৯’ (ISFR-2019) অনুসারে ভারতে মোট বনভূমির বিস্তার ৭১২২৪৯ বর্গ কিলোমিটার, যা ভারতের মোট আয়তনের (৩২৮৭৪৬৯ বর্গ কিলোমিটার) সাপেক্ষে ২১.৬৭ শতাংশ। এই ঘাটতি অচিরেই পূরণ করা দরকার।

একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলের প্রাকৃতিক ভারসাম্য সঠিকভাবে বজায় রাখতে হলে ৩০ শতাংশের বেশি বনভূমি থাকা আবশ্যক।

পৃথিবীতে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১ শতাংশ ক্রান্তীয় বনভূমি ধ্বংস হয়ে থাকে মানুষের হাতে। বিগত ৭০ বছরে পৃথিবীর মোট ক্রান্তীয় বনভূমির ৫০ শতাংশ উজার হয়ে গেছে।

২) প্লাস্টিক ও থার্মোকলের উৎপাদন ও ব্যবহার কমিয়ে আনা আবশ্যক। প্লাস্টিক ও থার্মোকল রাস্তা-ঘাটে, বিভিন্ন ড্রেইনেজ, নদী-নালা, ডাম্পিং গ্রাউন্ড, ও সমুদ্রের জলে দূষণ ছড়িয়ে দিচ্ছে। প্লাস্টিক ও থার্মোকল আগুনে পোড়ানো হলে বাতাসে বিষাক্ত গ্যাস ছড়ায়।

এগুলির বিকল্প হিসেবে পাটের চাষ বাড়ানো দরকার। কারণ পাটজাত দ্রব্য-সামগ্রী সবসময়ই পচনশীল। পরিবেশের সঙ্গে মিশে যায়। পাট গাছ বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে কর্তনের পূর্ব পর্যন্ত প্রচুর অক্সিজেন বাতাসে ছাড়ে এবং কার্বনডাইঅক্সাইড শোষণ করে। আবার পাতাগুলি মাটিতে ঝড়ে পড়ে জমির উর্বরতা বৃদ্ধি করে। সুতরাং প্রয়োজন পাট চাষের পরিকাঠামো তৈরি করা এবং কৃষক বন্ধুদের সহায়তা প্রকল্প চালু করা।

৩) কলকারখানার তরল বর্জ্য ও ধোঁয়া বৈজ্ঞানিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা। তরল বর্জ্য ড্রেনেজ হয়ে নদীতে জলের সাথে মিশে গিয়ে জল দূষণের পরিমাণ বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে কালো ধোঁয়া বাতাসে মিশে গিয়ে দূষণ ছড়িয়ে দেয়। আবার এই ধোঁয়া বাতাসে ভেসে গিয়ে উদ্ভিদের পাতার উপর আস্তরণ তৈরি করে। ফলে চাষের জমি ও বাগানের উৎপাদন কমিয়ে দেয়।

৪) জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমিয়ে জলবায়ু দূষণের মাত্রা কমিয়ে নিয়ে আসা। এই জীবাশ্ম জ্বালানির মধ্যে অন্যতম হলো কয়লা, খনিজ তেল ও প্রাকৃতিক গ্যাস।

শহরাঞ্চলে একদিকে গাছের সংখ্যা খুবই কম। তার ওপর হাজার হাজার মাল ও যাত্রী পরিবহণ গাড়ি, সরকারি ও বেসরকারি গাড়ি, ব্যক্তিগত গাড়ি প্রতি দিন টন টন কার্বনডাইঅক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে দেয় এবং পরিবেশের মারাত্মক ক্ষতি করে। কোনো কোনো সময় দূষণের মাত্রা এত পরিমাণ বৃদ্ধি পায় যে, রাস্তাই দৃষ্টিগোচর হয়না। তাই দূষণহীন জ্বালানির ব্যবহার করা একান্ত প্রয়োজন।

জলবায়ু নিয়ন্ত্রণের জন্য ২০১২ সালে প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তিতে বলা হয়েছিল এই শতাব্দীর শেষভাগে তাপমাত্রা কিছুতেই ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়তে দেওয়া হবেনা। চুক্তিতে আরও বলা হয়েছিল, ক্রমশ কমিয়ে আনা হবে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। কিন্তু তা বাস্তবায়িত হয়নি। এর জন্য মূলত ধনী দেশগুলিই দায়ী। তাদের প্রয়োজন কী করে মুনাফা অর্জন ও তা বৃদ্ধি করা যায়।

জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে ওঠার বিষয়ে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোম নিবাসী গ্রেটা থুনবার্গ (Greta Thunberg) ২০১৮ সালর ২০ আগস্ট প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ২০ আগস্ট ক্লাস ফাঁকি দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন সংসদ ভবন রিক্সড্যাগের উদ্দেশ্যে। প্ল্যাকার্ড হাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে থাকেন গেটের সামনে। প্ল্যাকার্ডে দাবি লেখেন জলবায়ুর জন্য স্কুল ধর্মঘট। ২০১৯ সালের ২০ আগস্ট শুক্রবার জলবায়ু ধর্মঘট আহ্বান করেন। সুইডিশ সরকারের নিকট দাবি করেন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি মেনে কার্বন উদ্গীরণ কমানো ও জীবাশ্ম জ্বালানি নির্ভরতা কমিয়ে আনা।

সারা বিশ্বে লক্ষাধিক ছাত্র-ছাত্রী এই জলবায়ু ধর্মঘটে শামিল হন।

ওই সময় আমাদের দেশের প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠি লেখেন গ্রেটা। তাতে গ্রেটা প্রধানমন্ত্রীকে ‘ডিয়ার মিস্টার মোদি’ সম্বোধন করে লেখেন, ‘‘জলবায়ু সংকট প্রতিরোধে আপনার এখনই উদ্যোগ নেওয়া উচিত। কেবল কথা নয়, শুধু বাগাড়ম্বর নয়। আপনি যদি এই মুহূর্তে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হন, তাহলে মানব ইতিহাসে আগামীদিনে আপনি জঘন্য এক খলনায়ক হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছেন।’’

বর্তমান সময়ে করোনা আবহের মধ্যে ব্ল্যাক ফাঙ্গাস সমস্যাকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে মানুষ কত অসহায় হয়ে পড়েছে। বিশ্বে ভারত অন্তত করোনা বিষয়ে প্রথম স্থানের সুনাম অর্জন করতে পেরেছে। পৃথিবীর প্রায় দেশগুলির নিকট নিন্দিত হয়েছে।

অন্যদিকে চীন সহ যে কয়েকটি সমাজতান্ত্রিক দেশ রয়েছে তারা খুব দ্রুত পরিস্থিতি সামাল দিতে পেরেছে।

পরিশেষে সুকান্ত ভট্টাচার্যের ভাষায় বলা যেতে পারে -
‘‘চলে যাব-তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি -
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’’


তাই সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য বৃক্ষ রোপণে প্রত্যেককেই এগিয়ে আসা উচিত।

একটি গাছ একটি প্রাণ -
গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান -