৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
সন্ত্রস্ত পরিবেশে ত্রিপুরায় বিজেপি মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ
রাজ্যে হিংসা অগ্নিসংযোগ লুটপাট অব্যাহত
তত্রিপুরায় আরএসএস বিজেপি’র নির্বাচন-পরবর্তী সন্ত্রাসের প্রতিবাদ ও হিংসা বন্ধের দাবিতে এবং
পশ্চিমবঙ্গে গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধের বিরুদ্ধে কলকাতায় মিছিল। রয়েছেন বিমান বসু, মহম্মদ সেলিম সহ নেতৃবৃন্দ।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাস আর বহ্নুৎসবের মধ্যেই ৮ মার্চ ত্রিপুরায় শপথ নিয়েছে বিজেপি-আইপিএফটি জোট সরকার। ২ মার্চ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পর থেকেই রাজ্যজুড়ে সিপিআই(এম) কর্মী-সমর্থক সহ বিরোধীদের উপর নির্বিচারে আক্রমণ, বাড়ি-ঘর, রিকশা-টোটো-অটো-গাড়ি পুড়িয়ে, রাবার বাগান জ্বালিয়ে সব কিছু ছারখার করে দিচ্ছে বিজেপি’র হিংস্র দুর্বৃত্তরা। ওরা এতই নৃশংস যে, সিপিআই(এম) কর্মীর বাড়িতে আগুন দিয়ে গোয়াল ঘরের গোরু, বাছুরও পুড়িয়ে মেরেছে। গো মাতার স্বঘোষিত রক্ষকরা হিংস্র সন্ত্রাস চলাতে গিয়ে অবলা প্রাণীগুলোকেও ছাড় দেয়নি। ওদের উন্মত্ততায় বাদ যায়নি মাধ্যমিক-উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী সহ ছাত্রছাত্রীরা। তাদের চোখের সামনেই বইখাতা জ্বালিয়ে দিয়ে তাদের ভবিষ্যতের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। এভাবেই রাজ্যের নানা প্রান্তে সাধারণ মানুষের বাড়িঘর,আসবাবপত্র সব কিছু ধ্বংস করছে মোদি-অমিত শাহের বাহিনী। এছাড়া রাজ্য জুড়ে সিপিআই(এম) দপ্তর সহ বিভিন্ন গণসংগঠনের দপ্তরগুলিও ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হচ্ছে। দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় এসে এভাবেই ত্রিপুরায় উগ্র হিন্দুত্ববাদী বিজেপি বাহিনী ধ্বংসলীলায় মেতে উঠে সাধারণ মানুষের ঘর গেরস্থালি, জীবন জীবিকা, ভবিষ্যতের সঞ্চয়-স্বপ্ন সব কিছুকে ধ্বংস করে দিচ্ছে।
এমনই ভয়াবহ হিংসা, সন্ত্রাস ও আতঙ্কের আবহে ত্রিপুরায় রাজ্য মন্ত্রীসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ ময়দানে। কিন্তু এদিন আগরতলা শহর দেখে মনে হয়েছে আতঙ্কের শহর। সর্বত্র বিরাজ করেছে ত্রাসের পরিবেশ। রাস্তাঘাট ছিল শুনশান। এদিন রঙের উৎসব হোলি থাকলেও তা অজানা আতঙ্কে ম্লান হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সহ কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী অমিত শাহ,বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা, আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্ব শর্মার মতো অনেকেই। তবুও এই অনুষ্ঠানে সেভাবে কোনো উচ্ছ্বাস দেখা যায়নি, ভিড়ও তেমন হয়নি। বরং শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান কার্যত বিবর্ণ থেকে গেছে। রাজ্যের এই ভয়ার্ত পরিবেশে প্রধানমন্ত্রী নির্বিকার থেকে শুধুমাত্র সৌজন্য বিনিময় করেই প্রস্থান করেছেন।
এদিকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান শেষে ‘ভিআইপি’-রা রাজ্য ছাড়ার আগেই আগরতলা শহর সংলগ্ন বিভিন্ন স্থানে ফ্যাসিস্তসুলভ হামলা চালায় বিজেপি’র দুর্বৃত্ত বাহিনী। প্রতাপগড় কেন্দ্রে বামফ্রন্টের জয়ী প্রার্থী রামু দাসের বাড়ি ভাঙচুরের মধ্যদিয়ে সন্ত্রাস শুরু করে শাসকদলের দুর্বৃত্তরা। এদের হামলায় পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারান রামু দাসের ৭৫ বছর বয়সি বৃদ্ধা মা। তাঁকে হাসপাতালে ভরতি করতে হয়। এলাকার অন্যান্য বাড়ি, দোকানপাটেও হামলা চালানো হয়েছে। গত কয়েকদিন ধরে খোয়াই, বিলোনীয়া, ধর্মনগর, শান্তিরবাজার, সোনামুড়া, উদয়পুর প্রভৃতি বিভিন্ন স্থানেও মারাত্মক সন্ত্রাস চালিয়েছে বিজেপি বাহিনী। এই হামলা-আক্রমণে আট থেকে আশি মহিলা, বৃদ্ধ, শিশু কেউই বাদ যাচ্ছেনা। বিজেপি’র দুর্বৃত্তদের বেলাগাম সন্ত্রাসে আতঙ্কগ্রস্ত মানুষজন অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে বাড়িঘর ছেড়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছেন। বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের কাছ থেকে নির্বিচারে জরিমানা আদায় করা চলছে। এছাড়া তাদের মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ইতিমধ্যেই বিজেপি’র নৃশংস হামলায় দু’টি প্রাণ চলে গেছে। কোথাও কোথাও পুলিশের সামনেই এই সমস্ত নাশকতামূলক কার্যকলাপ চলতে থাকলেও তারা ছিল নির্বিকার। এই সমস্ত ঘটনা পশ্চিমবঙ্গের তৃণমূলী জমানার বর্বরোচিত হামলা- সন্ত্রাসের কথা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে।
প্রসঙ্গত, ৬০ সদস্য বিশিষ্ট ত্রিপুরা বিধানসভায় এবারে বিজেপি-আইপিএফটি জোট ৩৩টি আসন (বিজেপি ৩২, আইপিএফটি-১) পেয়ে সরকার গড়েছে। এখানে তিপ্রাল্যান্ডের দাবিদার তিপ্রা মথা ২২.১ শতাংশ বিরোধী ভোট কাটার ফলে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস প্রার্থীরা ২৪টি আসনে জয়লাভ করতে পারেনি। এছাড়া তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কাটার ফলে রামনগর কেন্দ্রে সামান্য ভোটের ব্যবধানে পরাজিত হয়েছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। সামগ্রিকভাবে এবারের নির্বাচনে প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটার বিরুদ্ধে ভোট দিলেও ভোট বিভাজনের সুযোগ নিয়ে সরকার গড়তে পেরেছে বিজেপি।
এদিকে শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আগের রাতে হিমন্ত বিশ্ব শর্মা এবং শপথের পরই অমিত শাহের সঙ্গে তিপ্রা মথা প্রধান প্রদ্যোত কিশোরের বৈঠক নিয়েও নানা প্রশ্ন উঁকি দিচ্ছে।
ত্রিপুরায় সিপিআই(এম) সহ বামফ্রন্ট কর্মী এবং বিরোধীদের উপর বিজেপি’র বর্বরোচিত আক্রমণের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়েছে সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো।
সিআইটিইউ’র পক্ষ থেকেও এই নৃশংস আক্রমণের তীব্র নিন্দা করে সারা দেশে বিক্ষোভ সংগঠিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে শ্রমিক শ্রেণির কাছে।
সন্ত্রাস বন্ধে কড়া ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে রাজ্য পুলিশের মহা নির্দেশকের কাছে ডেপুটেশন দিয়েছেন বামফ্রন্ট-কংগ্রেসের নেতৃত্ব। সন্ত্রাস বন্ধ করে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় পুলিশের থানা স্তরের অফিসারদের নির্দেশ দেওয়া এবং দুষ্কৃতকারীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছেন তাঁরা। সন্ত্রাস বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবিতে রাজ্যের মুখ্যসচিবের সাথে কথা বলেছেন সিপিআই(এম) নেতৃত্ব। প্রাথমিকভাবে হাতে আসা শত শত সন্ত্রাসের ঘটনার তথ্য নামধাম সহ মুখ্যসচিবের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। সেই তথ্য পুলিশের মহা নির্দেশকের কাছে পাঠিয়েছেন মুখ্যসচিব। প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করে দোষীদের গ্রেপ্তার করার দাবি জানিয়েছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস। আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে যদি পুলিশ কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ না করে তাহলে যে সন্ত্রাসের লাগাম টানা যাবে না সেটাও স্পষ্টভাবেই জানিয়েছেন বামফ্রন্ট ও কংগ্রেসের নেতৃত্ব।
মুখ্যসচিব জে কে সিনহার সঙ্গে সাক্ষাতের পর ফিরে সাংবাদিক সম্মেলনে এ কথা বলেছেন সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক জীতেন্দ্র চৌধুরী। তিনি এই সন্ত্রাস বন্ধ করতে সরকারকে কড়া ব্যবস্থা নেবার দাবি জানিয়েছেন। তিনি সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবার আহ্বান জানিয়েছেন। সমস্ত আক্রান্তদের প্রয়োজনীয় আর্থিক ও চিকিৎসা সহায়তা দিতেও সরকারের কাছে দাবি করেছে সিপিআই (এম)।
হতাশা থেকে রাজনৈতিক হিংসা
শাসক দলের আসন এবং ভোট দুই-ই কমেছে। এই হতাশায় জিঘাংসাবৃত্তি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভাবনা থেকে বিরোধীদের উপর আক্রমণ সংঘটিত করছে। সংবাদমাধ্যমে দেওয়া প্রতিক্রিয়ায় এ কথা বলেছেন সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য মানিক সরকার।
তিনি বলেছেন, ভোটের ফলাফল সংক্ষেপে যদি বলি, শাসক বিজেপি দল পেয়েছে কম ভোট, জিতেছে বেশি আসন। তথ্য দেখলে বোঝা যাবে তাদের জোটের আসন ছিল ৪৪টি, কিন্তু পেয়েছে ৩৩টি আসন। তাদের ভোট ছিল প্রায় ৫১ ভাগ, এবার পেয়েছে ৪০ ভাগ। এর থেকে এটা পরিষ্কার, রাজ্যের ভোটারদের ৬০ ভাগ বিজেপি’র বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। কারণ তাঁরা এই সরকারের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। এই বিশ্বাস-আস্থা হারানোর কারণ, সরকারের পারফরমেন্স ছিল শূন্য। অর্থনৈতিক দিক থেকে মানুষের জীবনে নেমে এসেছিল দুর্বিষহ যন্ত্রণাকর অবস্থা। সবচেয়ে বড়ো কথা রাজ্যজুড়ে ফ্যাসিস্টিক সন্ত্রাস চালিয়েছে। তাই মানুষ চাইছিলেন বিজেপি যাতে সরকার তৈরি করতে না পারে।
কম ভোট পেয়েও কীভাবে বিজেপি বেশি আসন জোগাড় করতে পারলো? এটা প্রাথমিক ভাবে দেখা গেছে, বিজেপি বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনে বিজেপি’র বিরুদ্ধেই কথাবার্তা বলেছে। যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছে। তাতে বিজেপি-বিরোধী ভোট ভাগ হয়েছে। এটা বিজেপি-কে সাহায্য করেছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে মন্তব্য আসছে বিজেপি’র বিরুদ্ধে কথা বলে যারা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন, তাদের কোনো কোনো শক্তির বিজেপি’র সাথে আগে থেকেই নাকি বোঝাপড়া ছিল বা আছে। আমরা চট করে এ সম্পর্কে কোনও মন্তব্য করব না। বিজেপি বিরোধী ভোট ভাগের সুযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন জোগাড় করতে পেরেছে।
বিরোধী দলের কর্মী-সমর্থকদের উপর আক্রমণ নিয়ে মানিক সরকার বলেছেন, ঘটনাগুলো ঘটছে কেন? বিজেপি একটা চরম হতাশায় ভুগছে। ফলাফল বিজেপি-কে খুশি করতে পারেনি। বিপুল অর্থশক্তি নিয়ে এরা ভোটে নেমেছিল। টাকা হাওয়ায় উড়েছে। পেশিশক্তি তাদের সাথে পাঁচ বছর ছিল ও আছে। যদিও নির্বাচন কমিশন কিছু ভূমিকা নেওয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এদের পেশিশক্তি নিষ্ক্রিয় ছিল মনে করার কোনও কারণ নেই। আগে থেকেই এরা পরিস্থিতি ঘোলাটে করে রেখেছিল। অগণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি করে রেখেছিল।
বিধানসভা নির্বাচনে বামপন্থীরা শূন্য হয়ে যাবে বলেছিল শাসকদল। বলেছিল তাদের পক্ষে ফলাফলে নাকি সুনামি হবে। তারা সংখ্যালঘু হয়ে যাবার অবস্থা থেকে কোনোক্রমে বেঁচেছে। এর থেকে ক্রোধে যারা বিরোধী দলের জন্য কাজ করেছে জিঘাংসাবৃত্তি, রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ভাবনা থেকে তাদের উপর আক্রমণ চালানো হচ্ছে। এরা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে।
শান্তি রক্ষায় শাসকদলকে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা পালন করতে হয়। এই আক্রমণ নিয়ে আমরা বিস্মিত নই। আমরা মানুষের কথা বলে যাব। রক্ত ঝরলেও লড়াই চলবে।
বিরোধী কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে মানিক সরকার বলেছেন, কোনোরকম প্ররোচনার ফাঁদে পা দেবেন না। নিজেরাও এমন কোনো ভূমিকা নেবেন না যেটা প্ররোচনার শামিল হয়ে যাবে। দলমত নির্বিশেষে সর্বত্র এলাকাভিত্তিক ঐক্য তৈরি করে সম্প্রীতি সুদৃঢ় করে যারাই আইন শৃঙ্খলা হাতে নিয়ে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করছে, তারা যে দলেরই হোক তাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হোন। প্রশাসন যেখানে সততা নিয়ে এটা মোকাবিলার চেষ্টা করছে তাদের সহযোগিতা করুন।
এদিকে ত্রিপুরায় বিজেপি’র লাগামহীন সন্ত্রাস-আক্রমণের বিরুদ্ধে ৯ মার্চ রাজ্য বামফ্রন্টের ডাকে কলকাতার ধর্মতলায় লেনিন মূর্তির সামনে থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত বিশাল প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত হয়েছে।