৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ভূমিসংস্কারে পশ্চিমবঙ্গ ছিল পথিকৃৎ
বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে ভূমিহীনদের জমি, জমির পাট্টা বিলিতে দেশের মধ্যে সেরা ছিল পশ্চিমবঙ্গ। আইনের সাহায্যেই সিলিং বহির্ভূত জমি উদ্ধার, ভূমিহীন কৃষককে জমির পাট্টা প্রদান, বর্গাদারদের নাম নথিভুক্ত করার মাধ্যমে তাঁদের অধিকার সুনিশ্চিত করার মধ্যদিয়ে ভূমিসংস্কারের যে কর্মসূচি বামফ্রন্ট সরকার সূচনাপর্ব থেকে রূপায়ণ করেছে তার নজির দেশের কোথাও নেই। বামফ্রন্ট সরকারের এই গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপের ফলে গ্রামবাংলায় সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন হয়েছে।
তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকারের তথ্যেই প্রকাশিত হয়েছে, সেই সময় পর্যন্ত (২০১১) গোটা দেশে ভূমিসংস্কারের মাধ্যমে যত জমি পুনর্বণ্টিত হয়েছিল,তার ২২ শতাংশই হয়েছিল এ রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের ৩০ লক্ষাধিক গরিব ও প্রান্তিক কৃষক ১১ লক্ষ ২৭ হাজার একরেরও বেশি জমি পেয়েছিলেন বিনামূল্যে। গোটা দেশে জমি বণ্টনের ফলে যত মানুষ উপকৃত হয়েছিলেন তার ৫৫ শতাংশই ছিলেন এরাজ্যের। পাট্টা প্রাপকদের মধ্যে ছিলেন ৩৭ শতাংশ তপশিলি জাতিভুক্ত, প্রায় ১৮ শতাংশ আদিবাসী এবং প্রায় ১৮ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। এছাড়া ‘বনাধিকার আইন ২০০৬’ অনুযায়ী প্রায় ২৭ হাজার আদিবাসী পরিবার জমির পাট্টা পেয়েছে।
সেই সময়ে রাজ্যেভূমিসংস্কারের একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, কৃষক পরিবারের মহিলারাও পাট্টা পেয়ে হয়েছিলেন জমির মালিক। তাঁদের ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে ৬ লক্ষ ১৮ হাজারের বেশি যৌথ পাট্টা দেওয়া হয়েছিল।সেই সঙ্গে শুধুমাত্র মহিলাদের নামে ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি পাট্টা দেওয়া হয়েছিল।
শুধুমাত্র সপ্তম বামফ্রন্ট সরকারই ২০০৬ থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ১৬ হাজার ৭০০ একর জমির পাট্টা বিলি করে।
বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের ফলে রাজ্যে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ৮৪ শতাংশই ছিলেন কৃষি জমির মালিক। জাতীয় স্তরে তখন এই হার ছিল প্রায় ৩৪ শতাংশ।
পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্ট সরকার প্রায় ১৫ লক্ষ ১৩ হাজার নথিভুক্ত বর্গাদারের আইনি অধিকার সুরক্ষিত করেছিল। বর্গা উচ্ছেদ আটকাতে ১৯৭৭ সালের সেপ্টেম্বরেই ভূমিসংস্কার আইনের সংশোধন করেছিল সরকার। এই সরকারের সময়কালে বর্গা নথিভুক্ত জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল প্রায় ১১ লক্ষ ১৫ হাজার একর।
রাজ্যের ক্ষমতালাভের আশায় তৃণমূল নেত্রী, বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী কৃষকদের জন্য বিস্তর কুম্ভীরাশ্রু বর্ষণ করেছিলেন। কিন্তু ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর স্লোগান আওড়ে ক্ষমতায় এসেই তারা কৃষকদের অর্জিত অধিকার লুঠ করতে শুরু করে। আইনি অধিকার থাকা সত্ত্বেও তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা সরকারি মদতে কৃষক, বর্গাদার, পাট্টাদারদের নির্বিচারে জমি থেকে উচ্ছেদ করেছে। কৃষকদের জমির ধান ও ফসল লুঠ করেছে। এই ঘটনা ঘটেছে রাজ্যের সর্বত্র। তৃণমূলীরা হামলা চালিয়ে রায়তি ও রেকর্ডভুক্ত হাজার হাজার একর জমিতে চাষ করতেও বাধা দিয়েছে।
বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের সাফল্যে কৃষক, খেত মজুর, বর্গাদার, পাট্টাদাররা এরাজ্যে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছিলেন। অন্যদিকে বামফ্রন্ট সরকারের এই পদক্ষেপে জোতদার, জমিদার, সামন্তপ্রভুরা তাদের বেনামি ও সিলিং বহির্ভূত জমি হারিয়েছিল। এই পুরনো জোতদার-জমিদারদের স্বার্থবাহী তৃণমূল সরকার রাজ্যে আসার পর সেই জমিচোর জোতদার, জমিদারদের উত্তরসূরিরা সুযোগ বুঝে হারানো জমি ফিরে পাবার আশায় শাসকদল ও সরকারকে নিজেদের স্বার্থে কাজে লাগায়। শ্রেণি শত্রুরা সব একজোট হয়ে কৃষকদের অর্জিত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে নানা চক্রান্তে লিপ্ত হয় শাসকদলের সঙ্গে। এই শ্রেণির স্বার্থরক্ষা করতেই শাসকদল ও রাজ্য সরকার নানা কায়দায় কৃষক, খেতমজুর, বর্গাদার, পাট্টাদারদের ওপর হিংস্র আক্রমণ নামিয়ে এনে তাদের অর্জিত অধিকার ও জীবিকা নির্বাহের একমাত্র অবলম্বন জমি লুঠ করে তাদের উচ্ছেদ করে। বামফ্রন্ট সরকারের ভূমিসংস্কারের যে উদ্যোগ দেশে-বিদেশে প্রশংসিত ও স্বীকৃতি লাভ করেছিল, তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর কিছু মাতব্বর পরামর্শদাতা সেই ভূমিসংস্কার, অপারেশন বর্গা প্রভৃতি উদ্যোগকে ‘জমি ডাকাতি’ বলে আখ্যায়িত করে!
এর মধ্য দিয়েই স্পষ্ট হয়ে ওঠে এই সরকার কাদের স্বার্থরক্ষা করতে চায়। তাই গ্রামের গরিব কৃষক, খেত মজুর সহ সর্বস্তরের শ্রমজীবী প্রান্তিক মানুষের স্বার্থে প্রয়োজন জমি লুণ্ঠনকারী, করপোরেটদের স্বার্থবাহী তৃণমূলকে পঞ্চায়েত থেকে হটিয়ে মানুষের পঞ্চায়েত গড়ে তোলা।