E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯

লুঠেরাদের হাত থেকে মানুষের পঞ্চায়েত পুনরুদ্ধারের লড়াই এবার

সন্দীপ দে


বামফ্রন্ট সরকারের সময়ের সাথে বর্তমানের তৃণমূলী জমানার পঞ্চায়েত - ফারাকটা আজ সুস্পষ্ট। সৃষ্টির সাথে ধ্বংসের যেমন ফারাক তেমনি। বামফ্রন্ট সরকারের আমলে গড়ে ওঠা জনস্বার্থের অভিমুখী উন্নয়ন ও অগ্রগতির পঞ্চায়েতে আজ তৃণমূলের কব্জায় ভুলুণ্ঠিত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও মানুষের অর্জিত অধিকার, উন্নয়ন সম্পূর্ণরূপে রুদ্ধ হয়ে সেখানে জাঁকিয়ে বসেছে স্থানীয় নেতা-মাতব্বরদের দৌরাত্ম্য আর অবাধ লুঠের কারবার!

বামফ্রন্ট সরকার পশ্চিমবঙ্গের গণতান্ত্রিক বিকেন্দ্রীকরণের নীতিতে পঞ্চায়েতকে দিয়েছিল অধিকার, ক্ষমতা, প্রকল্প তৈরি ও রূপায়ণের দায়দায়িত্ব। এরফলে ভূমি সংস্কারের সফল রূপায়ণ, সেচের প্রসার-কৃষির বিকাশ, গ্রামীণ পরিকাঠামো তৈরি, গ্রামে সামাজিক সম্পদ সৃষ্টি, কর্মসংস্থান,স্বাস্থ্য ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, মানবোন্নয়ন কর্মসূচির অগ্রগতিতে নজিরবিহীন সাফল্য অর্জন করেছিল পঞ্চায়েত। ১৯৭৮ সালে প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় বামপন্থীদের স্লোগান ছিল - ‘বাস্তুঘুঘুর বাসা ভাঙো’। এই স্লোগানের পাশাপাশি পঞ্চায়েত নির্বাচনের ফলে গ্রামের গরিব ও মধ্য শ্রেণির মধ্যে জনজাগরণ তৈরি হয়েছিল।

এছাড়াও এই পঞ্চায়েত ব্যবস্থা গ্রামের সামাজিক ও শ্রেণিশক্তির ভারসাম্য বদলে দিয়েছিল। সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশের মানুষ, আদিবাসী, তপশিলি সহ অন্যান্য অনগ্রসর অংশের মানুষ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন এবং সামাজিক সুরক্ষায় পঞ্চায়েত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।এরই পাশাপাশি মহিলাদের ক্ষমতায়ন ও সামাজিক ক্ষেত্রে তাঁদের ভূমিকা অনন্য দৃষ্টান্ত রেখেছিল। পশ্চিমবঙ্গ ছিল দেশের একমাত্র রাজ্য যেখানে পাঁচ বছর অন্তর নিয়মিত পঞ্চায়েতের নির্বাচন হয়েছে। পঞ্চায়েতকে ক্রমশ বেশি বেশি অধিকার ও ক্ষমতা দিয়ে বিকেন্দ্রীকরণের কাজ অব্যাহত থেকেছে। তখন লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক দলের পরিচয়ের ভিত্তিতে নয়, শ্রেণির ভিত্তিতে গ্রামের গরিব মানুষকে আরও ক্ষমতার অধিকারী করা। এই উদ্দেশ্য নিয়েই তৈরি করা হয়েছিল গ্রাম সংসদ। বলা হয়েছিল, গ্রাম সংসদেই গ্রামের পরিকল্পনা হবে। সেই পরিকল্পনার ভিত্তিতে টাকা বরাদ্দ হবে। আইন করেই গ্রাম উন্নয়ন কমিটি তৈরি করা হয়েছিল। কেবল নির্বাচিত সদস্যরাই নন, নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে ভোট প্রাপ্ত বিরোধীদের নিয়েও এই কমিটি করার আইন হয়েছিল। এছাড়া তপশিলি জাতি, আদিবাসী ও মহিলাদের জন্য আসন সংরক্ষিত হয়েছিল। অন্যান্য অনগ্রসর অংশ এবং ওবিসি-দের জন্য সংরক্ষণও নিশ্চিত করা হয়েছিল।

পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত ব্যবস্থার এই সাফল্য শুধু দেশেই নয়,আন্তর্জাতিক স্তরেও বারে বারে প্রশংসিত হয়েছে। বামপন্থীদের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত কর্মসূচি ও বামফ্রন্ট সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছার ফলেই গণ উদ্যোগে পঞ্চায়েত পরিচালনায় অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছিল।

বামফ্রন্ট সরকারের আমলে রাজ্যে যে সমস্ত ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জিত হয়েছিল,তার মধ্যে অন্যতম ছিল ত্রি-স্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থা। যে পঞ্চায়েত ছিল মানুষের অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন, অগ্রগতি ও সাফল্যের প্রতীক। ‘মা-মাটি-মানুষ’-এর স্লোগান দিয়ে তৃণমূল কংগ্রেস রাজ্যের ক্ষমতায় এসে চরম অগণতান্ত্রিক-স্বৈরাচারী ও হিংসাশ্রয়ী কার্যকলাপের মধ্য দিয়ে সেই পঞ্চায়েত ব্যবস্থাটাকেই ধ্বংস করে দিচ্ছে। আজ তৃণমূল কংগ্রেসের জমানায় পঞ্চায়েতে সম্পূর্ণ ধূলিসাৎ হয়েছে গণতান্ত্রিক বিধিব্যবস্থা। উন্নয়নের কাজ স্তব্ধ। সুষ্ঠু নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নানাভাবে বানচাল করে (বিরোধীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না দেওয়া, ভোটাধিকার হরণ করা, নির্বাচিত প্রার্থীদের অনৈতিকভাবে হারিয়ে দেওয়া ইত্যাদি) পেশিশক্তি ও প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে পঞ্চায়েত দখলের মতো কুৎসিত নজির তৈরি হয়েছে রাজ্যে। বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে ধান ও সবজি উৎপাদন,মৎস্য চাষ এবং বনসৃজনে গোটা দেশে সাফল্যের শিখরে থাকা পশ্চিমবঙ্গে আজ কৃষকেরা উৎপাদিত ফসলের উৎপাদন খরচটুকুও পাচ্ছেন না। খেতমজুরদের কাজ মিলছেনা। ফলে অভাবের তাড়নায় ও ঋণের জালে ফেঁসে কৃষক-খেত মজুররা আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন। এই ঘটনা বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ ৩৪ বছরের কালপর্বে ছিল কল্পনারও অতীত। তৃণমূল জমানায় পঞ্চায়েতে আজ আকাশছোঁয়া দুর্নীতি-লুঠ-তোলাবাজি একরকম প্রাতিষ্ঠানিক চেহারা নিয়েছে। এই অনৈতিক কারবারে অনেক ক্ষেত্রেই শাসক দলের স্থানীয় নেতা-মাতব্বরদের সঙ্গে জড়িয়ে গেছে সরকারি আমলা থেকে পুলিশ প্রশাসন। বিকেন্দ্রীকরণ ব্যবস্থার পরিবর্তে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী -জেলা শাসক ও বিডিও - এই তিন স্তরে। পঞ্চায়েতের কাজে জনগণের অংশগ্রহণ ও মতামত দেওয়ার সুযোগ পুরোপুরি বন্ধ। একদিকে বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প প্রাপকদের কাছ থেকে যেমন দেদার কাটমানি নেওয়া চলছে, তেমনি ঠিকাদার, সুপারভাইজারদের থেকে তোলা আদায় করে তৃণমূল নেতা থেকে পঞ্চায়েতের প্রতিনিধিরা নিজেদের বিপুল সম্পদশালী করে তুলছে। এসবের পরিণতিতে তৃণমূলের হাতে রাজ্যের পঞ্চায়েত ব্যবস্থা আজ একেবারে ধ্বংসের কিনারায়।

এই লুঠেরাদের কাছ থেকে মানুষের পঞ্চায়েত,এক সময়ের গর্বের পঞ্চায়েতকে রক্ষার কঠিন লড়াই এখন গ্রামের মানুষের সামনে।