E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯

গর্বের পঞ্চায়েত ধ্বংসের কিনারায়

অমিয় পাত্র


(শেষাংশ)

রাজ্যের পঞ্চায়েত এখন চোরদের দখলে। যদিও মানুষ চোরদের ক্ষমতায় বসায়নি। বেশিরভাগ এলাকায় গায়ের জোরে, পুলিশ, গুন্ডা ও সমাজবিরোধীদের দাপটে পঞ্চায়েত কুক্ষিগত করেছে। দলের উপর মহল থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়েছে কার কোনটা করে খাওয়ার জায়গা। এদের জনপ্রতিনিধি বলা যায় না, দলের দ্বারা মনোনীত লুটেরা। দাদা দিদিদের নগদ টাকা দিয়েই এদের পঞ্চায়েত নির্বাচনে অংশগ্রহণের টিকিট পেতে হয়েছে। আবার কাটমানি বা কমিশনের ভাগ নেতানেত্রীদের দিতে হয়। এই দুর্নীতি আসলে দলের নির্ধারিত ছকেই হচ্ছে। এই বিষবৃক্ষ শিকড়সমেত উৎখাত করতে হবে। যত দিন যাচ্ছে চুরির বহর বাড়ছে। গত এক দশকে রেগার কাজে বেলাগাম দুর্নীতি, আবাস যোজনায় প্রকৃত প্রাপকদের বঞ্চনা এবং কাটমানির কেলেঙ্কারি, শিক্ষাক্ষেত্রসহ সব ধরনের নিয়োগে বিপুল অর্থের লেনদেন, কয়লা, বালি, পাথর, জঙ্গলের গাছ লুটপাট ও পাচার, গোরু পাচারের ঘটনা ঘটেই চলেছে। বর্তমানে আদালতের নির্দেশে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ডজনখানেক নেতা-মন্ত্রী-কর্মকর্তা জেলে গেছেন। পরিস্থিতির গতিপ্রকৃতি থেকে এটা বলা যায় দলের বেশিরভাগ নেতাই জেলে যাবেন। সাধারণ মানুষ যা দেখছেন সেটা হিমশৈলের চূড়ামাত্র।

রাজ্যের দেনার পরিমাণ ৬ লক্ষ কোটি টাকা অতিক্রম করেছে। এই বিপুল ঋণের বোঝা নিয়ে রাজ্যের ঘুরে দাড়ানো ক্রমশ কঠিন হয়ে পড়ছে। মুখ্যমন্ত্রীর কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। অসত্য, ভিত্তিহীন বাতেলাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। রাজ্যে কাজ নেই, শিল্প নেই, ফসলের মূল্য নেই, শিক্ষাক্ষেত্র বিপন্ন। ছাত্র আছে শিক্ষক নেই, শিক্ষক আছে ছাত্র নেই ,দেখভাল করার লোক নেই। যারা আছেন তাঁরা কাটমানির জন্য আছেন, পঠন-পাঠনের জন্য নয়। এক বছরে মাধ্যমিকে পরীক্ষার্থী কমেছে চার লক্ষ, পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণিতে পৌঁছাতে ২২ শতাংশ ছাত্র হারিয়ে যায়। শিক্ষা দপ্তর চাকুরি বিক্রির দোকানে পরিণত হয়েছে। বাচ্চাদের মিড ডে মিলের খাবার, মা ও শিশুদের পুষ্টি প্রকল্পের খাবার সেখানেও কাটমানি খাচ্ছে। রাজ্যজুড়ে সীমাহীন লুটতরাজ চলছে। দুর্নীতির ধাক্কায় একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রকল্প বন্ধ হচ্ছে। স্বাস্থ্য পরিষেবা বেহাল- ডাক্তার, নার্স,স্বাস্থ্যকর্মীর বহু পদ শূন্য। বহুক্ষেত্রে গ্রামের রাস্তাঘাট ব্যবহারের অবস্থায় নেই। সরকার এখন সম্পদ বেচার রাস্তা ধরে এগোচ্ছে।মাদার ডেয়ারি, তাজপুর বন্দরের পর এবার বিক্রির তালিকায় ট্রামের জমি, বন্ধ কলকারখানার জমি, জেলখানার জমি, সরকারের হাতে থাকা খাস জমি। এরজন্য আইন সংশোধন করে বলা যায় আটঘাট বেঁধেই সরকার নেমে পড়েছে। বর্তমানে রাজ্যে মদের বিক্রি বেড়েছে, লুট-পাচার বেড়েছে, পুলিশের জুলুম বেড়েছে, সংবাদমাধ্যমের গোলামি বেড়েছে। এর কোনোটাই গৌরবের নয়, সাধারণ মানুষ এসব পছন্দ করেন না। এই দুর্নীতি ও অরাজকতার শেষ দেখার সময় এসেছে।

জনগণের স্বার্থ উপেক্ষা করে মোদি সরকার বৃহৎ ব্যবসায়ী ও লুটেরা পুঁজির স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে। দলের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করা হয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানসমূহে। দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা বেহাল। জ্বালানি, ওষুধ, রাসায়নিক সার, খাদ্য পণ্য সহ নিত্যব্যবহার্য সামগ্রীর দাম হু হু করে বেড়ে চলেছে। কর্মসংস্থান নেই। শূন্য পদে নিয়োগ নেই। রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা ঢালাওভাবে হস্তান্তর করা হচ্ছে। ব্যাঙ্ক, বিমায় জনগণের গচ্ছিত অর্থ লগ্নি করা হচ্ছে আদানি-আম্বানি গোষ্ঠীর সংস্থায়। সংবাদমাধ্যমকে দলীয় নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। বিজেপি'র বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বিরূপ সমালোচনা বরদাস্ত করা হচ্ছে না। সিবিআই, ইডি, আয়কর দপ্তর এই জমানায় দমন পীড়নের হাতিয়ার। জাত-পাত, ধর্ম, পরিচিতি, মন্দির, মসজিদের জিগির তুলে মানুষের ঐক্য ভাঙার অপচেষ্টা চলছে। তৃণমূল এবং বিজেপি উভয় দলই দুর্নীতি ও লুটপাটে সিদ্ধহস্ত। অর্থ ও প্রলোভনের মাধ্যমে দলবদলের খেলায় কেউ কম যায় না। এদের কে কখন কোন দলে থাকবেন সেটা আর্থিক লাভ-ক্ষতির অঙ্কে ঠিক হয়, নীতির বালাই নেই। ক্ষমতার জন্য মানুষের মধ্যে বিভাজন তৈরি করা উভয় দলের সাধারণ কৌশল। নানা প্রলোভনে সমাজের আর্থিকভাবে পিছিয়ে-পড়া মানুষকে হিংসা ও ঘৃণার রাজনীতিতে জড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে। আঘাত বাড়ছে শান্তি ও সম্প্রীতির পরিবেশের উপর।

২ মার্চ ’২৩ রাজ্যে সাগরদিঘি বিধানসভার উপনির্বাচনের ফল ঘোষিত হয়েছে। জনগণের রায় থেকে এটা স্পষ্ট - মানুষ তৃণমূল এবং বিজেপি-কে আর বরদাস্ত করতে রাজি নয়। উপনির্বাচনে শাসক তৃণমূল কংগ্রেসের ভোট কমেছে ৩০,৫০৮ এবং বিজেপি-র ভোট কমেছে ১৯,৬১৬। বাম-কংগ্রেস জোটের ভোট বেড়েছে ৫১,৩২৩ অর্থাৎ তৃণমূল এবং বিজেপি’র হারানো ভোটের প্রায় সমপরিমাণ ভোট জোট প্রার্থীর অনুকূলে পড়েছে। প্রায় পঞ্চাশ হাজারের বেশি ভোটার যারা ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ওই দুই দলকে সমর্থন করেছিলেন তারা অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তৃণমূল এবং বিজেপি-কে আর সমর্থন করা যায় না। স্পষ্ট অবস্থান নিয়েছেন - তৃণমূলকে তাড়ান এবং বিজেপি-কে প্রত্যাখ্যান করুন। এটা শুধু সাগরদিঘি নয়, সারা রাজ্যেই এধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

সব কিছু স্বাভাবিকভাবে চলতে থাকলে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পরেই অর্থাৎ এপ্রিলের শেষার্ধে পঞ্চায়েত নির্বাচন হবে।এটা মাথায় রেখেই নির্বাচনী সংগঠন গড়ে তোলার কাজ নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ করতে হবে। এবারের নির্বাচনের বিশেষত্ব হলো - সাধারণ মানুষ আমাদের স্থানীয় নেতাকর্মীদের নিবিড় জনসংযোগের পরামর্শ দিচ্ছেন। প্রতি বাড়িতে, প্রতিটি ভোটারের কাছে বারে বারে যোগাযোগ করতে হবে। মানুষের মধ্যে চর্চার সাধারণ বিষয় হলো - চোরের দল তৃণমূলকে তাড়াতেই হবে, বিজেপি-কে একটি ভোটও নয়। বামফ্রন্টই বিকল্প। কিন্তু মানুষের এটাও অভিজ্ঞতা - কোনো কোনো এলাকায় আমাদের সক্রিয়তা চোখে পড়ছে না। পদযাত্রা হয়েছে কিন্তু সব গ্রাম, সব বুথে আমরা পৌঁছাতে পারিনি।

গণসংগ্রহ হয়েছে কিন্তু সব পরিবারে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সাগরদিঘির অভিজ্ঞতা হলো অতীতে আমাদের দলে ছিলেন, এমন সকলেই পুনরায় ফিরতে চাইছেন। সেই রাস্তা খোলা রাখতে হবে। টিএমসি কিংবা বিজেপি নেতা এবং তাদের সমর্থকদের এক মাপকাঠিতে বিচার করা ভুল হবে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নানা ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাতে সাধারণ সমর্থকদের বা ভোটারদের অবস্থান পরিবর্তন হয়। তাদের দরজায় আমাদের পৌঁছানো এই সময়ের গুরুত্বপূর্ণ কাজ। গ্রামের গরিব, খেটে খাওয়া মানুষ কখনো স্থায়ীভাবে শোষক বা প্রতিক্রিয়াশীলদের সাথে থাকতে পারে না। বিভ্রান্তি, ভয় বা প্রলোভনের জন্য সাময়িক ভুল পথে গেলেও এঁরা ফিরে আসবেন। কোনো অজুহাতেই শ্রেণিবন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগের বিষয়টি লঘু করে দেখা যাবে না।

এখন থেকে পার্টির নেতাকর্মীদের প্রতিদিনের গন্তব্য হবে গ্রাম বা পাড়া।মানুষের কথা শোনা এবং রাজ্যের, এলাকার বাস্তব অবস্থার কথা তাদের ভাষায় তাদের মতো করে বুঝিয়ে বলা। আমাদের মধ্যে একটা ভ্রান্ত ধারণা কাজ করে সেটা হলো, পুরুষদের সাথে মতবিনিময় করলে সেটা পরিবারের মহিলাদের মধ্যে পৌঁছে যাবে। এটা ঠিক নয়। মহিলাদের কথা শুনতে হবে। তাদের মধ্যেও প্রচার করতে হবে। গ্রামে যাওয়ার কর্মসূচির থেকে এই সময়ে অন্য কাজ প্রাধান্য না দেওয়াই সমীচীন। বড়ো সভা, বড়ো মিছিল এসব করা দরকার হলেও সেটা একপ্রস্থ বাড়ি বাড়ি যাওয়ার পর করতে হবে। সম্ভবত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত মাইক ব্যবহার করা যাবে না। তাই এই সময়ের কাজ হবে জনসংযোগ এবং নির্বাচনের জন্য বুথ কমিটি, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এবং প্রার্থী চয়ন সম্পূর্ণ করা। প্রতিটি বুথ এলাকার জনবিন্যাস একরকম নয়। এলাকার বাস্তবতার উপর ভিত্তি করে বামফ্রন্ট, বামফ্রন্টের বাইরে থাকা বাম শক্তি, টিএমসি-বিজেপি বিরোধী দল বা ব্যক্তি, এলাকার স্বচ্ছ ভাবমূর্তির গণতান্ত্রিক মানুষ সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে শক্তিশালী মঞ্চ গড়ে তোলাই আমাদের নির্বাচনী লড়াইয়ের অভিমুখ। জনগণের পঞ্চায়েত গড়ার লড়াই সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করেই লড়তে হবে।

প্রচার, মিডিয়া এবং আমাদের বোঝাপড়া

বাজারি মিডিয়া টিএমসি এবং বিজেপি এই দুই শিবিরে বিভক্ত। প্রচারে কোন মিডিয়া কেমন ভুমিকা নেবে সেটা কিছুটা অর্থিক লেনদেনের ভিত্তিতে ঠিক হয়। বিগত কয়েক বছর যাবত আমরা দেখে আসছি, রাজ্য রাজনীতিতে বামপন্থীদের ব্রাত্য করে রাখার মরিয়া চেষ্টা চলছে। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও সেই ধারাতেই প্রচার হবে। ছাপার মাধ্যম বা বৈদ্যুতিন মাধ্যমকে পাল্লা দিয়ে আন্দোলনের মাধ্যমে, কিছুটা সাংগঠনিক প্রচেষ্টায় বা সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে পার্টির কথা মানুষের মধ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। বিরোধী মিডিয়াকে পাল্লা দেওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের চালু পদ্ধতির প্রসার বৃদ্ধির পাশাপাশি পার্টি ও জনগণের মধ্যে ব্যবধান কমিয়ে আনতে হবে। নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে যে দু’টি দল করপোরেট সংস্থা থেকে বিপুল অর্থ পেয়ে থাকে সেই দলদু’টি হলো - বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস। প্রচারে অর্থ বিনিয়োগ করার ক্ষেত্রে এদের ধারেপাশে পৌঁছানোর ক্ষমতা কোনো দলের নেই। ভোটের গুটি সাজানোর কৌশল ঠিক করতে কোটি কোটি টাকা খরচ করে তৃণমূল কংগ্রেস একটা কোম্পানিকে নিয়োগ করেছে। সারা বছর জুড়েই এরা বুদ্ধি জোগান দেয়। এইখাতে বিজেপি’র বিনিয়োগ অনেকটাই বেশি। এই পরিস্থিতি বিবেচনায় রেখে ঠান্ডা মাথায় আমাদের কাজ করে যেতে হবে।