E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯

তৃণমূলের অপশাসন, সাগরদিঘির উপনির্বাচন এবং রাজ্যে সংখ্যালঘু জনগণ

সেখ সাইদুল হক


গত ১২ বছর রাজ্যে তৃণমূলের সীমাহীন দুর্নীতি, লুটে খাওয়ার রাজনীতি, করপোরেট (আদানি) প্রীতি, বিভাজনের রাজনীতি, বেকারত্ব বৃদ্ধি, শিক্ষায় নৈরাজ্য, ক্রমবর্ধমান জীবন যন্ত্রণা এবং রাজ্যে কাটমানি কালচারের বাড়বাড়ন্ত গোটা রাজ্যকে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে। আক্রান্ত গণতন্ত্র, আক্রান্ত সম্প্রীতি, আক্রান্ত মানুষের রুটি রুজি। এই পটভূমিতে তৃণমূল দল তাদের অপশাসনকে আড়াল করতে নতুন তৃণমূলের ধারণাকে সামনে এনে নিজেদের অপশাসনকে নতুন মোড়কে ঢাকতে চেয়েছে। পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের পরিত্রাতা হিসাবে থাকতে চেয়ে ও নিজেদেরকে বিজেপি’র বিকল্প হিসাবে দেখাতে চেয়ে বিভাজনের রাজনীতিতে মদত জুগিয়ে চলেছে। একদিকে সংখ্যালঘু জনগণকে দুধেল গাই হিসাবে দেখতে চেয়েছে। তাদেরকে ভোট ব্যাঙ্কের রাজনীতির বাটখাড়া হিসাবে পেতে চেয়েছে, অপরদিকে দুর্গাপুজো কমিটিকে সরকারি অর্থ প্রদান, সরকারি অর্থে দুর্গাপুজোকে নিয়ে কার্নিভাল, দীঘায় জগন্নাথ ধাম নির্মাণ, মোদির পদাঙ্ক অনুসরণ করে গঙ্গারতির ব্যবস্থা করে ভোটের ময়দানে সংখ্যাগুরু মানুষের ধর্মপ্রীতিকে ব্যবহার করে তাকে কাজে লাগাতে চেয়েছে। তৃণমূল নেত্রী ভেবেছিলেন এইভাবেই কিস্তিমাত করবেন। কিন্তু মুর্শিদাবাদের সাগরদিঘির উপনির্বাচন তার পাশাও উলটে দিয়েছে। রাজ্য রাজনীতিতে সাগরদিঘির এই ফলাফল সুদূরপ্রসারী। আর তাই চিন্তিত মুখ্যমন্ত্রী সংখ্যালঘুর মন বুঝতে কমিটি বানিয়েছেন। হতাশা ব্যক্ত করে বলেছেন, সংখ্যালঘুদের জন্য এত এত কাজ করেছি তাহলে কেন এই ফল। অর্থাৎ তিনি রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগণকে হয় ভিখারি, না হয় অনুকম্পা প্রার্থী ভেবেছিলেন। কিন্তু সাগরদিঘির উপনির্বাচনের ফল তার সেই ভাবনাকেই সঠিকভাবেই জোর ধাক্কা দিয়েছে।

সাগরদিঘির উপনির্বাচন

সাগরদিঘির উপনির্বাচন রাজ্যের শাসকদল ও বিরোধী দলগুলির কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল। তৃণমূলের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল জয়ের মধ্য দিয়ে এটা প্রমাণ করা যে, দুর্নীতি নিয়ে যতই প্রচার হোক তৃণমূলের কোনো বিকল্প রাজ্যে নেই এবং রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগণের ভালোবাসা তাদের প্রতি অটুট আছে। বিজেপি’র কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত এই কেন্দ্রে তাদের জয় আসবে না জেনেও নিজেদের ভোটের শতাংশকে ধরে রেখে দ্বিতীয়স্থানে থেকে এটা প্রমাণ করা যে, বিজেপি’ই হলো তৃণমূলের বিকল্প। কংগ্রেসীদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল সংখ্যালঘু প্রধান এই জেলায় তাদের ক্রমহ্রাসমান সমর্থনের পতন আটকানো এবং তৃণমূলের অপশাসনের অবসান ঘটিয়ে দলের ভাঙনকে রোধ করা। বামপন্থীদের কাছে চ্যালেঞ্জ ছিল মোদি মমতার করপোরেট তোষণ এবং বিভাজনের রাজনীতির স্বরূপকে উন্মোচিত করে জনজীবনের জ্বলন্ত সমস্যাগুলিকে তুলে ধরা এবং রাজ্যে তৃণমূলের অপশাসন এবং মেরুকরণের রাজনীতির অবসান ঘটানো। সেই লক্ষ্যেই বামপন্থীরা এই কেন্দ্রে শক্তিশালী বিরোধী দল হওয়া সত্ত্বেও এবং বিগত বছরগুলিতে লাগাতার সংগ্রামের ময়দানে থেকেও ওই কেন্দ্রে ভোট ভাগাভাগি রুখতে কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করেছিল। নির্বাচনী ফলাফল প্রমাণ করলো বামপন্থীদের এই পদক্ষেপ সময়োপযোগী ছিল।

সাগরদিঘি উপনির্বাচনের ফলাফলকে কেউ কেউ নেতিবাচকভাবে বিশ্লেষণ করে বলছেন, তৃণমূলের সংখ্যালঘু ভোট বাম-সমর্থিত প্রার্থীর অনুকূলে গেছে বলেই জিতেছে। এটা কিছুটা সত্য। কিন্তু সবটাই নয়। এই ধরনের বিশ্লেষণ অতি সরলীকরণ ব্যাখ্যা হয়ে যাবে। ওই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ভোটারের সংখ্যা কমবেশি ৬৪ শতাংশ। ওই কেন্দ্রে ১১টি গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যে ৯টি গ্রাম পঞ্চায়েত সংখ্যালঘু প্রধান। একটি গ্রাম পঞ্চায়েত (বারালা) সংখ্যাগুরু প্রধান এবং আর একটি গ্রাম পঞ্চায়েতে (মোরগ্রাম) সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু ভোটার প্রায় সমান সমান। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যালঘু প্রধান কাবিলপুর গ্রাম পঞ্চায়েতে ৫৫৮৪ ভোটে এবং সাগরদিঘিতে ৪৬৫৪ ভোটে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থী লিড পেয়েছে, তেমনি সংখ্যাগুরু ভোটার প্রধান বারালাতেও ১১১৩ ভোটে লিড পেয়েছে এবং মোরগ্রামে সমান সমান ভোট পেয়েছে। ফলাফলে দেখা যাচ্ছে তৃণমূলের ১৬ শতাংশ ভোট কমেছে। বিজেপি’র ১০ শতাংশ ভোট কমেছে। অপরদিকে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীর প্রায় ২৮ শতাংশের বেশি ভোট বেড়েছে। এর থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সব অংশের মানুষ তৃণমূলের অপশাসন ঘটাতে এবং মেরুকরণের রাজনীতি বন্ধ করতে বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীকে ভোট দিয়েছে। এটাই হলো নির্বাচনের ফলাফলের ইতিবাচক দিক যা আগামীদিনে রাজ্য রাজনীতিতে নতুন দিশা দেখাবে।

এরই সাথে সাথে এটাও অবশ্যই আলোচনার মধ্যে আনতে হবে যে, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগণের বৃহৎ অংশ বিজেপি ভীতি থেকে বাঁচতে তৃণমূলকে ভোট দিয়েছিল এই ভেবে যে, তৃণমূল বিজেপি-কে আটকাতে পারবে। কিন্তু বিগত বছরগুলিতে মোদি-মমতার গোপন বোঝাপড়া, সংখ্যালঘুদের দাবার বোরে বানানো, মাদ্রাসা শিক্ষা ও আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি বঞ্চনা এবং আনিস খানের খুন, একমাত্র বিরোধী বিধায়ক নওসাদ সিদ্দিকিকে মিথ্যা মামলায় জেলে আটকে রাখা এবং তৃণমূল নেত্রীর নির্বাচনের সময় দেওয়া সংখ্যালঘু উন্নয়নের প্রতিশ্রুতিগুলি কার্যকর না করা, রাজ্যের সংখ্যালঘু জনগণের মধ্যে তৃণমূলের প্রতি যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি করেছে সেটাও এই উপনির্বাচনের ফলাফলে পরিস্ফুটিত হয়েছে। আর সেই কারণেই তৃণমূল সরকারের আমলে সংখ্যালঘু জনগণের উন্নয়ন ও নিরাপত্তাকে আলোচনায় আনতে হবে।

রাজ্যে বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি

বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি আমাদের রাজ্যকেও এক সন্ধিক্ষণে দাঁড় করিয়েছে। ধর্মের নামে মোদি ও মমতার ভোট ব্যাংকের রাজনীতি আমাদের রাজ্যের ধর্মনিরপেক্ষতার যে সুমহান ঐতিহ্য আছে তাকে ভেঙে ফেলতে চাইছে। সংখ্যালঘু উন্নয়নের নামে তৃণমূল নেত্রী এমন সব প্রতিশ্রুতি দিয়ে চলেছেন এবং এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যাতে মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রভূত উন্নয়ন তো হয়নি, উলটে প্রতিবেশী জনগোষ্ঠীর মানুষের মধ্যে এক বিরূপ মনোভাব তৈরি করে তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষকেই রোপণ করেছেন। তিনি সংখ্যালঘুদের নয়, সংখ্যালঘু ভোটকে ভালোবাসেন। তিনি নির্বাচনে সংখ্যালঘু উন্নয়নের যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তার কয়টা কার্যকরী করেছেন? উলটোদিকে সংখ্যালঘু উন্নয়নে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন খাতে যে সব অর্থ বরাদ্দ করেছে তা খরচ করতে পারছেন না বা ফান্ড ডাইভার্ট করছেন। বর্তমানে রাজ্যে মাদ্রাসা শিক্ষার ভবিষ্যতকে অন্ধকারে ঠেলে দিয়েছেন। বাম আমলে তৈরি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে তৈরি হয়েছে অচলাবস্থা। মিল্লি আল আমিন কলেজের সংখ্যালঘু চরিত্রকে নসাৎ করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীর পুলিশ মাদ্রাসা চাকরি প্রার্থীদের ওপর যেভাবে লাঠিপেটা করেছে এবং আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকার নিয়ে আন্দোলনরত ছাত্র নেতা আনিস খানকে ছাদ থেকে ফেলে হত্যা করেছে তা বর্বরতাকেও হার মানায়। শুধু চটকদারি ঘোষণায় নয়, আচার আচরণে এমন ভাব দেখাচ্ছেন যেন দারুণ সংখ্যালঘু প্রীতি। একদিকে মাথায় হিজাব পরে ইফতার পার্টি অথবা রেড রোডের নামাজে অংশগ্রহণ করছেন, অন্যদিকে প্রতিটি বক্তৃতায় খোদা হাফেজ এবং ইনসাল্লাহ বলে সংখ্যালঘু উন্নয়নে দারুণ কাজ করছেন বলে প্রচার করছেন। এগুলি কি বার্তা নিয়ে যাচ্ছে? এতে শিক্ষায়, স্বাস্থ্যে, সাক্ষরতায়, আবাসনে, পরিকাঠামো নির্মাণে ও কর্মসংস্থানে মুসলিম জনগণের উন্নয়ন তো হচ্ছেই না, উলটে সংখ্যাগুরুর সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রসদ জোগাচ্ছে। এসবের ফলে রাজ্যে সম্প্রীতির পরিবেশ বিঘ্নিত হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হচ্ছে।

রাজ্যে সংখ্যালঘু নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জের মুখে

আমাদের রাজ্যে বাম জামানায় কখনো কখনো কোথাও কোথাও সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হলেও তা কখনও দাঙ্গার রূপ নিতে পারেনি। এর বড়ো কারণ সম্প্রীতি রক্ষার্থে বামফ্রন্ট সরকারের দৃঢ় অবস্থান ও গণতান্ত্রিক জনগণের পথে নেমে এর প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের রাজ্যে পর পর কয়েকটি দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে এবং বেশ কিছু জায়গায় দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। হাওড়ার ধূলাগড়ে, ২৪ পরগনার হাজিনগর, বাদুড়িয়া, বসিরহাট, নোয়াপাড়া, কাঁকিনাড়া, আসানসোল, রানিগঞ্জ, মুর্শিদাবাদ, পুরুলিয়া, হুগলি ও মালদহ সহ উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলায় দাঙ্গার ঘটনা ঘটেছে, কোথাও কোথাও দাঙ্গার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। দেখা গেছে বর্তমান শাসকদলের একটা অংশ দু-পক্ষকেই মদত জুগিয়ে পরিস্থিতিকে আরও ঘোরালো করেছে। এই পরিস্থিতি মোকাবিলায় শুভবুদ্ধিসম্পন্ন নাগরিকদের ঐক্য গড়ে তাদের পথে নামানো অপেক্ষা শাসকদলের নেতৃত্বের কেউ কেউ বহু জায়গায় ধর্মকে ব্যবহার করে ভোটের রাজনীতি করার লক্ষ্যে নিজেরাই রামনবমী ও হনুমান জয়ন্তীর মিছিল কিংবা মহরমের মিছিল সংগঠিত করেছে, কোথাও কোথাও সংঘ পরিবার মদতপু্ষ্ট আখড়াগুলিকে সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ সাহায্য করা হয়েছে। অর্থাৎ রাজ্যের শাসকদল সংঘ পরিবারের ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িক রাজনীতির মোকাবিলার পরিবর্তে নিজেরাই রাজনৈতিক ফয়দা লুটতে শামিল হয়েছে। এসবই সংখ্যালঘু নিরাপত্তাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

আমাদের মতো রাজ্যে যেখানে বাম গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রক্ষার আন্দোলন শক্তিশালী হওয়ার কারণে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্যের একটি দৃঢ় বাতাবরণ ছিল, সেখানে বর্তমান এই সরকারের অবস্থানের ফলে উভয় সাম্প্রদায়িক শক্তি ধর্মীয় বিভাজন প্রক্রিয়াকে বাড়াতে পারছে। সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গে হিন্দু বা মুসলিম বা খ্রিস্টান কোনো সাম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ সাম্প্রদায়িক নন। দেশব্যাপী সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতির আবর্তে তাদের টেনে নেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। এক মৌলবাদী শক্তি অন্য মৌলবাদীর সাম্প্রদায়িক খাদ্যের জোগান দেয়। এখানেও ঠিক তাই হচ্ছে।

লুটে খাওয়ার লুম্পেন রাজনীতি

গত ১২ বছর রাজ্যে চালু হয়েছে লুটে খাওয়ার লুম্পেন রাজনীতি। তোলাবাজি ও সিন্ডিকেট রাজের রাজনীতি। বিরোধীদের বিশেষ করে বামপন্থীদের চমকাও, ধমকাও। তার জন্য মজুত বাহিনী চাই। লুম্পেন চাই। এরা শাসকের হয়ে ভোট করাবে আর রসদ হিসাবে তোলাবাজি করবে। দুর্ভাগ্যের হলেও এটা ঘটনা যে, তৃণমূলের লুটে খাওয়া লুম্পেন বাহিনীর একটা অংশ খেটে খাওয়া সংখ্যালঘু গরিব পরিবার থেকে আসা। ফলে এই লুম্পেন রাজনীতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতি হলো সাম্প্রদায়িক রাজনীতি। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির পিছনে যেমন নির্দিষ্ট রাজনীতি থাকে তেমনি থাকে লুঠে খাওয়ার অর্থনীতি। আসানসোল, রানিগঞ্জের ঘটনার পিছনে আছে কয়লা মাফিয়া রাজনীতি। অন্যত্র আছে জমি মাফিয়া, বালি মাফিয়া, মাটি মাফিয়া, লোহা মাফিয়ার রাজনীতি। এরা শাসকদলের কোনো না কোনো নেতার স্নেহধন্য। এই সব মাফিয়াই শাসকদলের মজুত বাহিনী হিসাবে পঞ্চায়েত, পৌরসভা ভোটে বিরোধীদের মনোনয়ন জমা দিতে দেয়নি। আবার নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও বোর্ড গঠনে কোনো কোনো নেতার হয়ে ভাড়া খেটে অন্য গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ঝামেলা পাকায়। আবার লুটের ভাগ নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি খুনোখুনি করে। বগটুইয়ের ঘটনা, ক্যানিংয়ের ঘটনা বা অন্যত্র আরও কিছু ঘটনা এটা দেখাচ্ছে যে, সংখ্যালঘু পরিবার থেকে আসা ওই সব লুটে খাওয়ার বাহিনী কীভাবে নিজেদের মধ্যে মারামারি করছে এবং রাজ্যের সম্প্রীতি, শান্তি শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করছে।

পরিশেষে এটা বলা যায়, তৃণমূলের রাজত্বে সংখ্যালঘুরাও ভালো নেই। তাদের উন্নয়ন যেমন থমকে আছে, তেমনি তাদের নিরাপত্তাও বিঘ্নিত। সংখ্যালঘু উন্নয়ন বলতে শুধুই ইমাম ভাতা, মোয়াজ্জেম ভাতা বোঝায় না, সংখ্যালঘু উন্নয়ন মানে হলো শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, আবাসনে সংখ্যালঘু জনগণের কতখানি উন্নয়ন ঘটেছে। কার্যত তা হয়নি। পাশাপাশি এটাও মনে রাখতে হবে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে ধর্মনিরপেক্ষ মানুষের ঐক্য গঠনের মধ্য দিয়ে। আর সেই ঐক্য মজবুত হবে রুটি-রুজির সংগ্রাম, জীবনজীবিকার সংগ্রামকে আরও দৃঢ় ও বিস্তৃত করার মধ্য দিয়ে। এটা মনে করার কোনো কারণ নেই যে, রাজ্যে সংখ্যালঘু জনগণের বৃহৎ অংশ স্থায়ীভাবে তৃণমূলের দিকেই রয়ে যাবে। কয়েক মাস আগে অনুষ্ঠিত বালিগঞ্জ বিধানসভার উপনির্বাচনের ফলাফলে তার ইঙ্গিত মিলেছিল। ২০২১-এ বালিগঞ্জে তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ৭১ শতাংশ, ২০২২-এ বালিগঞ্জ উপনির্বাচনে তৃণমূলের ২১ শতাংশ ভোট কমে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। বিজেপি বালিগঞ্জে ২০২১ সালে পিয়েছিল ২১ শতাংশ, ২০২২-এ তা কমে দাঁড়ায় ১৩ শতাংশে। অপরদিকে বালিগঞ্জে ২১ সালে বাম-কংগ্রেস জোট পেয়েছিল ৬ শতাংশ, ২০২২ সালে সেখানে শুধু সিপিআই(এম)-ই ভোট পেয়েছে ৩০ শতাংশ। সাগরদিঘিতেও এই প্রবণতা আরও বিস্তৃত হয়েছে এবং তৃণমূল-বিজেপি-কে সরিয়ে সেখানকার জনগণ বাম-সমর্থিত কংগ্রেস প্রার্থীকেই ভালো ভোটে জিতিয়েছে। অর্থাৎ ওই কেন্দ্রে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু উভয় অংশের জনগণ মনে করেছে বিজেপি-তৃণমূলের বাইরে বাম ও গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ঐক্য এই মুহূর্তে তৃণমূলের অপশাসন হটানো এবং মেরুকরণের রাজনীতি বন্ধ করার একমাত্র বিকল্প। এই কাজেই বামপন্থীদের আরও পরিকল্পিত ও ধারাবাহিক সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।