E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯

কলকাতা‌য় ট্রাম চলার সার্ধশতবর্ষ

ট্রামকে রক্ষার দায়িত্ব পালন করুক রাজ্য সরকার

সুবীর বোস


১৮৭৩ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি কলকাতা শহরে ট্রাম চলাচল শুরু হয়। শহরের পরিচিতির অন্যতম মুখ ট্রাম। ঘোড়ায় টানা ট্রামের প্রথম যাত্রাপথ ছিল শি‌‌য়ালদহ থেকে আর্মেনিয়াম ঘাট পর্যন্ত। পণ্যবাহী যান হিসাবে ট্রাম চালু হলেও প্রথম দিন থেকে যাত্রীবাহী গাড়ি হিসাবে জনপ্রিয়তা পায়। কিছুদিন ট্রাম চলার পর তা বন্ধ হয়ে যায়।

১৮৮০ সালের ১ নভেম্বর কলকাতা করপোরেশনের সাথে ৩জন ব্রিটিশ ব্যবসা‌য়ী কলকাতায় ট্রাম চালানোর চুক্তি করে। এই চুক্তির নাম ‘‘ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ’’। ওই বছর ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ট্রাম কোম্পানি রেজিস্টিকৃত হয়। তৈরি হয় ‘‘দি ক্যালকাটা ট্রামওয়েজ কোম্পানি লিমিটেড’’। ১৮৮২ সালে ট্রামে স্টিম ইঞ্জিন চালু হয়। ৭টি স্টিম ইঞ্জিন, ১,০০০টি ঘোড়া ও ১৮৬টি কাঠের গাড়ির সাহায্যে শহরের ১৯ কিলোমিটার রাস্তায় ট্রাম চলত। কয়েক বছরের মধ্যেই তা শহরের উত্তর থেকে দক্ষিণ পর্যন্ত প্রসার ঘটে।

১৯০০ সালে ট্রামের বৈদ্যুতিকীকরণের কাজ শুরু হয়। ১৯০২ সালে খিদিরপুর ডি‍‌পো থেকে ধর্মতলা পর্যন্ত বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলাচল শুরু করে। ১৯০৩ সালে হ্যারিসন রোড, বেলগাছিয়া, রাজাবাজার-মোমিনপুর, বেহালা, টালিগঞ্জে বিদ্যুৎচালিত ট্রাম চলাচল প্রসারিত হতে থাকে। ১৯০৫ সালে হাওড়া শহরে ট্রাম চলাচল শুরু হয়। ১৯৪৩ সালে হাওড়া ব্রিজ দিয়ে ট্রাম চলাচল শুরু হবার পর কলকাতা-হাওড়া ট্রামের মধ্যে যোগাযোগ ঘটে। এই সময় ট্রাম চলত ৬৮ কিলোমিটার পথে। ট্রাম গাড়ি ছিল ৪৭৮টি। সংস্থায় কর্মীসংখ্যা ছিল প্রায় ১৪,০০০জন। শহরের যাত্রী পরিষেবার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করত ট্রাম পরিবহণ। যা শহরের যাতায়াতের জীবনরেখা ছিল।

ব্রিটিশ মালিকের কোম্পানি, শ্রমিকদের উপর শোষণের মাত্রা ছিল তীব্র। মজুরি ছিল ন্যূনতম। শ্রমিকদের অধিকার বলতে মালিকের ইচ্ছা। শহরে অন্যতম বড়ো শিল্প ট্রামে ছিল না শ্রমিকদের সংগঠন করার অধিকার। এর মধ্যেই শ্রমিকরা গোপনে মহল্লা, মেসে সংগঠিত হতে থাকেন। গড়ে তোলেন তাদের সংগঠন। শ্রমিকদের সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রে মহম্মদ ইসমাইল, হীরেন মুখার্জি, নরেন সেন, গোপাল আচার্য প্রমুখ সহ কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা ছিল অসীম। ট্রাম শ্রমিকদের নিজস্ব দাবি আন্দোলনের পাশাপাশি দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনে ট্রাম শ্রমিকরা অংশগ্রহণ করেন কমিউনিস্ট নেৃতত্বের প্রেরণায়।

কর্মজীবনে ব্রিটিশ মালিকদের অত্যাচারের অভিজ্ঞতা ও দেশের জন্য স্বাধীনতা সংগ্রাম - ট্রাম শ্রমিক সংগ্রামকে একসূত্রে বাঁধে। ট্রাম শ্রমিকরা জীবনজীবিকার আন্দোলনের পাশাপাশি স্বাধীনতা সংগ্রামের আন্দোলনের ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলন থেকে শহরব্যাপী দাঙ্গার বিরুদ্ধে ট্রাম শ্রমিকদের ভূমিকা স্মরণীয়। দেশের শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ট্রাম শ্রমিকদের ঐক্যকে মহাত্মা গান্ধী দেশের অন্য শ্রমিকদের অনুসরণ করার পরামর্শ দিতেন। ট্রাম শ্রমিকরা হয়ে উঠেছিলেন ‘‘বাহাদুর ট্রাম শ্রমিক’’। শ্রমিকদের এই প্রেরণার উৎস ছিল তাদের সংগঠনের বামপন্থী মতাদর্শ। কমিউনিস্ট নেতৃত্বের সহযোগীর ভূমিকা।

দেশের স্বাধীনতার পর ব্রিটিশ মা‍‌লিকানাধীন ট্রামকে জাতীয়করণের দাবি ট্রাম শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে তোলা হয়। কমরেড মহম্মদ ইসমাইল সহ কমিউনিস্ট পার্টি এই দাবিতে সোচ্চার হয়। বিধানসভায় এই দাবিকে তুলে ধরেন কমরেড জ্যোতি বসুর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির বিধায়কগণ। ডাঃ বিধান রায়ের সরকার ট্রাম জাতীয়করণের দাবিকে উপেক্ষা করে ব্রিটিশ কোম্পানির সাথে চুক্তি করে আরও ২০ বছর ব্রিটিশ কোম্পানিকে ট্রাম চালানোর সুযোগ করে দেয়।

১৯৭১ সাল পর্যন্ত ট্রাম চালানোর চুক্তি থাকলেও ১৯৬৭ সালে ব্রিটিশ মালিকরা ট্রাম কোম্পানি ছেড়ে পালিয়ে চলে যায়। কলকাতায় ট্রাম বন্ধ। বিপন্ন ১৪ হাজার ট্রাম শ্রমিকের জীবন। কলকাতা যাত্রী পরিবহণ বিপর্যস্ত। রাজ্যে যুক্তফ্রন্ট সরকার, উপমুখ্যমন্ত্রী এবং পরিবহণ মন্ত্রী জ্যোতি বসু। তাঁর নেতৃত্বে ট্রাম প্রশাসনকে অধিগ্রহণ ও ১৯৭৮ সালে তাঁর মুখ্যমন্ত্রীত্বে অধিগ্রহণের মধ্য দিয়ে ট্রাম কোম্পানি রাজ্য সরকারি সংস্থায় পরিণত হয়।

দু’টি দশক ট্রামে কোনো বিনিয়োগ নেই। সংস্থার অবস্থায় গভীর সংকট। তার মধ্যেই ১৯৭৮ সালে বামফ্রন্ট সরকারের উদ্যোগে ৪২ কোটি টাকা সংস্থায় বিনিয়োগ হয় যা শিল্পে নতুন জীবনীশক্তি তৈরি করে। ১৬৯টি লোহার ট্রাম গাড়ি সহ ২৫টি কাঠের গাড়ি সংস্থায় চালু হয়। ট্রাম লাইন/ওভার হেড/সাব-স্টেশন সহ সংস্থার পরিকাঠামোর মৌলিক পরিবর্তন ঘটে। জোকা-বিধাননগর ট্রাম পরিষেবায় যুক্ত হয়। স্থায়ী কর্মী নিয়োগ, সংস্থার উৎপাদন বৃদ্ধি পায়। বাড়ে দৈনিক যাত্রী পরিষেবা ও যাত্রী সংখ্যা।

১৯৯২ সালে ট্রামের সহায়ক হিসাবে কোম্পানি বাস পরিষেবা শুরু করে। সংস্থার ট্রাম ও বাস পরিষেবা বিস্তার, যাত্রী বৃদ্ধি/আয় বৃদ্ধি স‍‌র্বোপরি নতুন কর্মসংস্থান বৃদ্ধিতে শিল্পে-কর্মচঞ্চলতার ব্যাপ্তি ঘটে। ১৯৯১ সালের পর দেশে বিশ্বায়িত অর্থনীতির কারণে সরকারি পরিবহণে নতুন সংকট শুরু হয়। কেন্দ্রীয় সরকার সরকারি পরিবহণ সংস্থার বার্ষিক পরিকল্পনা খাতে টাকা দেওয়া কমিয়ে দিতে দিতে ১৯৯৭-৯৮ সালে একেবারে বন্ধ করে দেয়। সরকারি পরিবহণের সমস্ত আর্থিক দায় রাজ্য সরকারগুলি উপর পরে। বন্ধ হয়ে যায় সরকারি পরিবহণ। বিহার, ওডিশা, আসাম তার উদাহরণ। এই সংকট এই রাজ্যেও ট্রাম সংস্থার উপরও আসে। সংস্থায় শুরু হয় নতুন করে লড়াই। ‘‘আয় বাড়াও ব্যয় কমাও’’ - এই স্লোগানকে সামনে রেখে সরকারি পরিবহণকে টিকিয়ে রাখার লক্ষ্যে সরকার ও শ্রমিক সংগঠন কাজ শুরু করে। ট্রামকে টিকিয়ে রাখার জন্য ‘‘সময়োপযোগী ট্রাম’’ তৈরি করে কর্মীরা। ১ কামরার গাড়ি তৈরি করে মাত্র ১৪ লক্ষ টাকায়। সিদ্ধান্ত হয় বছরে ১০টি করে গাড়ি তৈরি করা হবে। এর জন্য অতিরিক্ত অর্থ বরাদ্দ ও ট্রাম লাইনের আধুনিকীকরণের জন্য ১০৯ কোটি টাকা বরাদ্দে ৫৭ কিলোমিটার নতুন সময়োপযোগী ট্রাম লাইন শহর কলকাতা পায়। ট্রামের বহুমুখী এই উদ্যোগের মধ্যেই রাজ্যে ২০১১ সালে রাজ্য সরকারে পরিবর্তন ঘটে। তৃণমূল কংগ্রেস সরকার গঠনের ২দিনের মধ্যেই বেহালা-জোকা থেকে ট্রাম তুলে দেবার সিদ্ধান্ত এবং তার পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন ট্রামলাইন বন্ধ করার মধ্য দিয়ে ট্রাম সম্পর্কে শাসক দলের ভাবনার প্রকাশ ঘটতে থাকে। ২০১১ সালে সংস্থায় কর্মী সংখ্যা ছিল ৭৩০০ জন স্থায়ী ও অস্থায়ী কর্মী ৪০০ জন। ট্রাম চলত ২৪২টি, বাস চলত ২৮৬টি দৈনিক। ট্রাম রুটের সংখ্যা ছিল ২৭টি। দৈনিক যাত্রীর সংখ্যা ট্রামেই ছিল ১ লক্ষের উপর। বিগত ১০ বছরে ট্রামের পরিকল্পনা খাতে টাকা বরাদ্দ ক্রমশ কমেছে। ২০২০-২০২৩ সালে কোনো বার্ষিক বিনিয়োগ নেই, বর্তমানে দৈনিক গাড়ি চলেছে ১৪-১৬টি। ৩টি রুটে গাড়ি চলছে। সংস্থায় কর্মী সংখ্যা নেমে এসেছে ২২০০ জন। অস্থায়ী ঠিকাকর্মীর সংখ্যা বাড়ছে। গত এক দশকে একজনকেও স্থায়ী করেনি সরকার। সংস্থায় বর্তমানে ২৪৮টি ট্রাম গাড়ি আছে। যার মধ্যে ৭৫টি গাড়িকে যেকোনো সময়ে চালানো যায়। ট্রামের যে পরিকাঠামো বর্তমানে আছে তার আর্থিক মূল্য প্রায় ১,৫০০ কোটি টাকা।

সরকার এত মূল্যবান পরিকাঠামোকে ব্যবহার না করে চাইছে ট্রাম ডিপোর ‍‌জমিকে বিক্রি করতে। এর আগে সরকার জমি বিক্রি করে ২৫০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে।

ট্রাম শিল্পের বর্তমান অবস্থার পরিবর্তনের জন্য চাই সরকারের ট্রাম চালানোর ইতিবাচক মানসিকতা ও সিদ্ধান্ত। চাই বিনিয়োগের জন্য পরিকল্পনা খাতে অতিরিক্ত আর্থিক বরাদ্দ। ট্রাম শ্রমিক-কর্মচারী সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা দেখেছি যে, আগামী ৫ বছরে ট্রামের জন্য যদি ৩০ কোটি টাকা পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ভিত্তিতে বিনিয়োগ করা যায় তা হলে প্রতিদিন ১০০টি ট্রাম গাড়ি‍‌ শহরে চালানো সম্ভব। ৭৫টি এক বগির গা‍‌ড়ি আগামী ৩ বছরে কর্মশালায় তৈরি সম্ভব। ১৫-১৮টি রুটে গাড়ি চালানো যায়। কর্মীরা দৈনিক কাজ পায়। সংস্থায় কর্মচঞ্চলতা বাড়ে। যাত্রী পরিষেবার পরিধিকে আগামী দু’টি দশকের জন্য স্থায়ী করা সম্ভব হয়। আমরা জানি যে, বর্তমান ট্রামগুলিতে ট্রামের মৌলিক যে যন্ত্রাংশ আছে তার জীবনীশক্তি আগামী চার থে‍‌কে পাঁচ দশক চলার উপযোগী। ১টি বাসের গড় আয়ু ১০-১৫ বছর হলেও ট্রামের গড় আয়ু ৫০-৭০ বছর।

দূষণহীন যাত্রী পরিবহণ এখন সময়ের দাবি। যা একমাত্র ট্রাম শহরকে দিতে পারে। কলকাতা শহরে ট্রাম চলার দেড়শো বছর পূর্তিতে উৎসব হচ্ছে। সরকার টাকা খরচ করছে। কিন্তু ট্রাম শ্রমিকরা সেই উৎসবে আমন্ত্রণ পাইনি। বিরাট প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে চলা ট্রাম ১৫০ বছর পূর্তি করেছে।

বর্তমান রাজনৈতিক পরিসরে ট্রাম শিল্পকে রক্ষা করা এক‍‌টি কঠিন বিষয়। যার জন্য দরকার ট্রাম রক্ষার সংগ্রামে সমস্ত মতের মানুষের সক্রিয় সমর্থন ও সহযোগিতা। ট্রামকে রক্ষার দাবি নিয়ে ট্রামপ্রেমী সংস্থাসহ ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী) সক্রিয়ভাবে কলকাতা রাজপথে।

কলকাতা শহরের অন্যতম মুখ, ঐতিহ্য ও ইতিহাসের চলমান সাক্ষী ও শহরের আবেগ ট্রাম আরও ৫০ বছর পর ২০০ বছর পূর্তির দিনেও যাতে কলকাতায় থাকে তার জন্য শহরের জীবনের অন্যান্য দাবির সাথে যু্ক্ত করে শহরে ট্রামকে রক্ষার শপথ গ্রহণ করতে হবে আমাদের। ট্রাম রক্ষায় রাজ্য সরকারের ইতিবাচক ভূমিকার দাবিও আমরা জানাই।