৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
আন্তর্জাতিক নারী দিবস - পুনঃপাঠ
মিনতি ঘোষ
ক্লারা জেটকিন
আন্তর্জাতিক নারী দিবস - ৮ মার্চ। সিদ্ধান্ত ১৯১০ সালে। তা কার্যকর করার ঘোষণা ১৯১৪ সালের ৮ মার্চ থেকে। মনে হয় এই তো সেদিন। কিন্তু এই বিশেষ দিনটি অর্জনের পেছনে জড়িয়ে আছে লক্ষ লক্ষ নারীর মর্মবেদনা, ক্লেদ, রক্ত, ঘাম। জন্মের পর মুহূর্তে লিঙ্গ চিহ্নিত করে নারী পুরুষের ভেদ তৈরি করার পর থেকেই তাকে হীন প্রতিপন্ন করার অমোঘ বাণী উচ্চারিত হয়েছে তথাকথিত পুরুষ কণ্ঠে। বিভিন্ন ধর্মের প্রবক্তাবৃন্দ ঘোষণা করে দিয়েছেন - নারী নরকের দ্বার, যৌন সম্ভোগের উপকরণ, বিধবার সব ভোগ-আহ্লাদ থেকে বঞ্চনা, কিন্তু রাত্রির অন্ধকারে তাকে সম্ভোগ করা যায় জাতিধর্ম নির্বিশেষে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের অধিকার, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার মুষ্টিমেয়র জন্য; সাধারণ নারী অন্তঃপুরচারিণী। সমাজে ব্যক্তি মালিকানার উদ্ভব এবং পরিবার প্রথাই পুরুষ ও নারীকে বিভাজিত করে। উৎপাদিকা শক্তির বিকাশের বিভিন্ন স্তরে নারীর সামাজিক, অবস্থানগত পরিবর্তন ঘটতে থাকে।
নারীর বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটেছে ধনতান্ত্রিক বিকাশের যুগে। শিল্প সভ্যতা নারীকে ঘর গেরস্থালির কাজের বাইরে নারী শ্রমিক হিসাবে আত্মপ্রকাশের সুযোগ করে দেয়। একদিকে পরিবারের মধ্যে তার স্বাধীনতা, সমানাধিকার পাবার বাস্তব সম্ভাবনা তৈরি করে অপরদিকে নারী কর্মক্ষেত্রে মজুরি বৈষম্যের শিকারও হলেন। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় লিঙ্গভিত্তিক শ্রম শোষণের মূল কারণ তার দৈহিক শক্তির অবমাননা। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় নারীকে লিঙ্গ বৈষম্য, মজুরি বৈষম্য, যৌন হেনস্তা, পারিবারিক, সামাজিক অত্যাচারও সয়ে যেতে হচ্ছে।
১৮৬৮ সালে কার্ল মার্কস শ্রমিকশ্রেণির প্রথম আন্তর্জাতিক গড়ে তোলার সময়ই নারীর অধিকারের প্রশ্নটি উত্থাপন করেন। কিন্তু তা সহজে মেলে? এই সময়েই শিল্পোন্নত দেশগুলিতে নারী শ্রমিকরা সংগঠিত হতে শুরু করেন। ১৮৭১ সালে প্যারি বিপ্লবে অভিজাত-অ-অভিজাত - এমনকী গণিকাবৃত্তিতে যুক্ত নারীদের অভূতপূর্ব লড়াই বিশ্বের নারী সমাজকে উজ্জীবিত করেছে। পরবর্তী সময়ে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, আমেরিকায় মহিলাদের আন্দোলন তীব্র হতে শুরু করল।
আন্তর্জাতিক নারী দিবসে সোভিয়েত ইউনিয়নের পোস্টার।
১৮৮৯ সালে প্যারি শহরে আন্তর্জাতিক শ্রমিক সম্মেলনে বিশ্ববরেণ্য কমিউনিস্ট নেত্রী ক্লারা জেটকিন নারী পুরুষের সমানাধিকারের পাশাপাশি নারীর ভোটাধিকারের দাবি উত্থাপন করেন।
১৯০৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ক্লারা জেটকিন সম্পাদিকা নির্বাচিত হলেন।
১৯০৮ সালে নিউ ইয়র্কের বস্ত্রশিল্পের সাথে যুক্ত নারী শ্রমিকরা বিশাল মিছিলে দাবি তুলেছিলেন মজুরি বৃদ্ধি, কর্মক্ষেত্রে পরিবেশের উন্নতি, আট ঘণ্টা কাজের অধিকার, ভোটাধিকারের।
১৯১০ সালে ডেনমার্কের কোপেনহেগেন শহরে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক নারী সম্মেলনে ৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস বা নারীর ভোটাধিকার দাবির দিবস হিসাবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯১৪ সালের ৮ মার্চ থেকে এই দিনটি পালিত হয়ে আসছে।
নারীর সমানাধিকারের দাবি বাস্তবায়িত হয়েছে ১৯১৭ সালের বিপ্লবের মধ্য দিয়ে। স্বল্প পরিসরে তার বিস্তৃত বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। সোভিয়েভ বিপ্লবের পর নারী মুক্ত হলেন পারিবারিক দাসত্বের শৃঙ্খল থেকে। নারীর শ্রম এই প্রথম সামাজিক শ্রমে রূপান্তরিত হলো। ১৯১৮ সালের আন্তর্জাতিক নারী দিবসে লেনিন বললেন - ‘‘দুনিয়ার সর্বত্র বরফ গলছে। সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে জনগণের মুক্তি, ধনতন্ত্রের কবল থেকে পুরুষ ও নারী শ্রমিকের মুক্তি দুর্নিবার গতিতে এই লক্ষ্যের পথে আমাদের এগিয়ে দিচ্ছে লক্ষ লক্ষ পুরুষ ও নারী শ্রমিক, পুরুষ ও নারী কৃষক।’’
সোভিয়েত রাশিয়ার পতন ঘটেছে। ছোট্ট কিউবা আজও লড়াই করে নারীর স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, পার্লামেন্টে উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব রক্ষা করছে। নারী অধিকার, সমানাধিকারের বিরুদ্ধে ছিল ফ্যাসিবাদ। ১৯৪০ সাল থেকে ’৪৫ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের পরাজয় ঘটেছে।
ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি আমাদের দেশেও। হিটলারের সদম্ভ উক্তি - জার্মান ফর জার্মানি। এখানে আরএসএস ঘোষণা করেছে হিন্দুরাষ্ট্র প্রবর্তন করবে। সংখ্যালঘু মুসলমান, খ্রিস্টান, জৈন, বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা ভয়ঙ্কর আক্রমণের মুখে। সবচেয়ে আক্রান্ত আজ সব ধর্মের নারীরা। পশ্চাদগামী চিন্তার দিকে তাঁদের ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। ভজন-পূজন, গর্ভাবস্থায় ধর্মগ্রন্থ পাঠের নিদান চলছে। একদিকে বাড়ছে নারীর প্রতি হিংসা, কন্যাভ্রূণ হত্যা, নারীপাচারের ঘটনা অপর দিকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কাজের অধিকার, পুষ্টকর খাদ্যের বদলে জুটছে সীমাহীন লাঞ্ছনা। মিথ্যার কুহক জালে আসল সত্যকে আড়ালে রেখে মিডিয়া অবিরত নরেন্দ্র মোদী আর রাজ্যে মমতার সাফল্যের জয়গাথা প্রচারে ব্যস্ত। এর ফাঁকে সরকারি বেসরকারি সংস্থা পদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে বেকারের জীবনে অন্ধকার নামিয়ে আনার কাজটি সুচতুরভাবে করার চেষ্টায় রত। শ্রম কোডের নামে শ্রমিকের অধিকার আজ আক্রান্ত। আকণ্ঠ দুর্নীতিতে নিমজ্জিত দুটি দলের সরকার। এই সবেতে আক্রান্ত নারী শ্রমিকরাও।
পুঁজির বিশ্বায়নের ফলে লুঠেরা সাম্রাজ্যবাদ সমস্ত ক্ষেত্রে বহুজাতিক পুঁজির প্রবেশকে নিশ্চিত করছে। কাজের চরিত্র বদলাচ্ছে, নারী পুরুষ কারও স্থায়ী কাজ নেই। কাজের মজুরি নেই। চুক্তিভিত্তিক কাজের সংখ্যা বাড়ছে। এই অবস্থায় গৃহশ্রম, বাইরের কাজে পর্যুদস্ত নারীর জীবন।
১৯৪৫ সালে রাষ্ট্রসঙ্ঘ ঘোষিত দাবিসনদের একটিও এখনও পূরণ হয়নি। নারীর অধিকারের ক্ষেত্রটি শূন্যই থেকে গিয়েছে।
‘অধিকার’ শব্দটির যথার্থ অর্থ প্রতি ঘরে পৌঁছে দেবার শপথ গ্রহণের দিন ৮ মার্চ।
মজুরি বৈষম্যের অবসান চাই। শিশু শ্রম বিলোপ করার দাবি তোলার দিন ৮ মার্চ। যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে শপথের দিন ৮ মার্চ। পশ্চাদগামী চিন্তা থেকে মেয়েদের মুক্ত করার শপথের দিন ৮ মার্চ। এই লক্ষ্যে পথ চলি আমরা সবাই। রাজ্যে, দেশে, সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ুক ৮ মার্চের বার্তা।