৬০ বর্ষ ৩০ সংখ্যা / ১০ মার্চ, ২০২৩ / ২৫ ফাল্গুন, ১৪২৯
ভারতীয় দর্শন প্রসঙ্গে (এক)
শ্রীদীপ ভট্টাচার্য
● ভারতীয় দর্শনের আলোচনায় প্রবৃত্ত হওয়ার ইচ্ছা বহুদিন ধরেই ছিল। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ সম্পর্কে আলোচনায় বারবারই মনে হয়েছে ভারতীয় দর্শনে বস্তুবাদ ও ভাববাদের সংঘাত প্রসঙ্গ এনে আলোচনাকে সত্যই আরও বেশি প্রাসঙ্গিক করা সম্ভব। সেই ইচ্ছাকে বাস্তবায়িত করতে পারার আনন্দ এক আলাদা বিষয়। যদিও কাজটা সত্যই কঠিন। তাও এই কাজটায় হাত দিলাম।
● প্রতিটি মার্কসবাদীর আজ ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ (আরএসএস) তাদের উগ্র হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন পরিচালনার স্বার্থে ভারতের ইতিহাস বিকৃত করছে। প্রাচীন ভারতের বিদ্যাচর্চা ও দর্শনচর্চাকে সংকীর্ণ স্বার্থে পরিকল্পিতভাবে নিজেদের মনোমত বিকৃত করছে, স্বাভাবিকভাবেই এই বিকৃতির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হলে প্রকৃত ভারতের ইতিহাস ও ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে সঠিক ধারণাই হতে পারে শক্তিশালী হাতিয়ার।
● মানব সভ্যতার ইতিহাসে দর্শনের রয়েছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা। দর্শনের অর্থ দৃষ্টিভঙ্গি। অর্থাৎ চতুঃপার্শ্ব সম্পর্কে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি যার ভিত্তিতে মানুষের পক্ষে সঠিকভাবে পদক্ষেপ নির্ধারণ করা সম্ভব হয়। সমস্ত সচেতন মানুষের জীবনে অবধারিতভাবে দর্শন জড়িয়ে রয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত মার্কসবাদী দার্শনিক আন্তোনিও গ্রামসি সমস্ত সচেতন মানুষকেই দার্শনিক হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আবার দর্শন প্রসঙ্গে কার্ল মার্কস-এর বক্তব্য বিশেষভাবে স্মরণে রাখা প্রয়োজন। ‘‘every true philosophy is the intellectual quintessence of its time’’ (প্রতিটি প্রকৃত দর্শনই সেই যুগের বুদ্ধিগত বিকাশের প্রতিচ্ছবি।) আসলে প্রাচীনকালে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখার অস্তিত্ব ছিল না। সমস্ত জ্ঞানের শাখাকে দর্শন বলে অভিহিত করা হতো। ভারতের সুপ্রাচীন সভ্যতার বুদ্ধিগত যে বিকাশ ঘটছিল তার প্রতিফলন ঘটেছিল সেই সময়ের ভারতীয় দর্শনে। ঐহিত্যপূর্ণ ভারতীয় ইতিহাসে বহু দার্শনিক উপাদান রয়েছে।
● ভারতের করপোরেট মিডিয়া ভারতীয় দর্শন ও দার্শনিক ভাবনাকে নানা কুসংস্কার যেমন আত্মা, পুনর্জন্ম, ব্রহ্ম, মায়াবাদ, নিয়তিবাদ প্রভৃতিকে পুষ্ট করার লক্ষ্যে উপস্থিত করে। রেডিও, দূরদর্শন ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে তারা এই কাজ করে চলেছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলি যেমন তৎপরতার সাথে এই কাজ করে চলেছে, আবার তারই সাথে করপোরেট লুণ্ঠনকে অব্যাহত রাখার জন্যও তারা এই প্রয়াস জারি রাখে।
ভারতীয় দর্শনকে বিকৃত আকারে যারা উপস্থিত করছে অর্থাৎ উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি, যারা একটি অত্যন্ত পশ্চাৎপদ ও প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের প্রতিনিধি। এই বিপজ্জনক মতাদর্শের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে, আমাদের এমন এক মতাদর্শের বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে যারা জনগণকে বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মতান্ধতা, ধর্ম ব্যবসা, কূপমণ্ডূকতা ইত্যাদি পিছিয়ে-পড়া চেতনায় আবদ্ধ রাখতে চায় ও এই বিশ্বের প্রকৃত বস্তুগত বিকাশের প্রতি মানুষকে উদাসীন রাখে।
● এই ধরনের বিপজ্জনক প্রয়াসকে মোকাবিলা করার জন্য আমাদের ভারতীয় দর্শন সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি গড়ে তোলা বড়ো বেশি প্রয়োজন। আমাদের দেশে মার্কসবাদীদের যে মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হচ্ছে তার জন্য নিজেদের প্রস্তুত করতে হলে এই আলোচনা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান সময়ে ভারতীয় সমাজে মতাদর্শগত সংগ্রামের গুরুত্ব বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মতাদর্শগত সংগ্রামের প্রয়োজনে ভারতীয় দর্শনের আলোচনা খুবই প্রাসঙ্গিক। আমাদের অতীতের দর্শনকে জানতে হবে এবং আজকের প্রেক্ষাপটে তার প্রয়োজনীয় অংশকে জানতে হবে। আমাদের দার্শনিক পরম্পরা থেকে যুক্তিগুলি গ্রহণ করতে হবে যাকে ভিত্তি করে আজকের মতাদর্শগত সংগ্রাম পরিচালনা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, চিরাচরিত চিন্তাধারার প্রগতিশীল চিন্তাধারাকে পুষ্ট ও সমৃদ্ধ করার দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। আবার জনপ্রিয় চেতনার পশ্চাৎপদ ও জনবিরোধী মর্মবস্তুকে নির্মূল করতে হবে। স্মরণে রাখতে হবে, উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তি আরএসএস হিন্দুরাষ্ট্র স্থাপন করার লক্ষ্য সফল করা ও করপোরেট লুণ্ঠনের কাজটি সমান তৎপরতার সাথে চালু রাখার লক্ষ্যে তাদের মতো করে বিকৃতভাবে ভারতীয় দর্শনকে উপস্থিত করছে।
ভারতে দর্শন চর্চা
● ভারতে দর্শন চর্চার এক দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম-ষষ্ঠ শতাব্দীর প্রাচীনতম উপনিষদ থেকে ষোড়শ-সপ্তদশ শতকের ‘নব্যন্যায়’ (গদাধরকৃত)-এর প্রাচীন ভাষ্যে বিপুল দার্শনিক সম্পদ সম্ভার রয়েছে। তার মানে হলো, প্রায় ২৫০০ বছর ধরে এক বৈশিষ্ট্যপূর্ণ দার্শনিক পরম্পরা রয়েছে। প্রসঙ্গত, সিন্ধু সভ্যতার লিপির অর্থ উদ্ধার না হওয়ার কারণে ওই সময়ের দর্শন চর্চাকে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়নি। তবে ওই যুগেও দর্শনের অস্তিত্ব ছিল। সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কারের ফলে ভারতীয় সভ্যতার প্রাচীনত্ব কয়েক হাজার বছর বেড়ে গেছে। এটা লক্ষ করা যায় যে, উত্তরকালের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সিন্ধুযুগের ধ্যানধারণা ও পূজা উপাসনার সাদৃশ্য অত্যন্ত নিকট। আজ পর্যন্ত ভারতীয় দর্শনের সংগৃহীত যত দলিল তার পরিমাণও যথেষ্ট।
● মার্কসীয় দর্শনের মৌলিক মতবাদ প্রচার তথা আলোচনার সময়ে আমাদের ভারতের অতীতের ঐতিহাসিক সীমাবদ্ধতা, দুর্বলতা ও অন্তর্নিহিত ত্রুটির কথা মনে রাখার সাথে সাথে বস্তুবাদী ও নাস্তিক দর্শনের ধারার প্রসার ঘটাতে হবে। আমাদের জোরের সঙ্গে অতি অবশ্যই তুলে ধরতে হবে যে, ভারতের শ্রমিকশ্রেণি আমাদের অতীতের সকল বস্তুবাদী, নাস্তিক দর্শনের প্রকৃত উত্তরাধিকারী।
পূর্বেই বলা হয়েছে, ভারতে দর্শন চর্চার এক সুদীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ভারতকে অনেক সময়ে ‘আধ্যাত্মিকতার দর্শন’-এর দেশ বলে অভিহিত করা হয়। যা অত্যন্ত ভ্রান্ত ব্যাখ্যা। এ প্রসঙ্গে আলোচনা পরবর্তী সময়ে করা হবে। তবে একটি কথা বিশেষভাবে বলা প্রয়োজন, উপনিষদের যুগ থেকে গদাধরকৃত ‘নব্যন্যায়’-এর যুগ, অন্তর্বর্তী সময়কালে অসংখ্য দর্শনের গ্রন্থ এই ভারতে প্রকাশিত হয়েছে। ভারতে দর্শন চর্চার প্রাচীনত্ব উপলব্ধি করার ক্ষেত্রে এইটাই যথেষ্ট।
(ক্রমশ)