E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১০ নভেম্বর, ২০২৩ / ২৩ কার্তিক, ১৪৩০

সিপিআই(এম) রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশনের ঘোষণা

বিজেপি-কে পরাস্ত করাই মূল রাজনৈতিক কর্তব্য

রাজ্যে বিজেপি এবং তৃণমূল উভয়কেই পরাস্ত করতে হবে


রাজ্য বর্ধিত অধিবেশনে উদ্বোধনী বক্তব্য রাখছেন সীতারাম ইয়েচুরি। মঞ্চে রামচন্দ্র ডোম ও মহম্মদ সেলিম।

বিশেষ প্রতিনিধিঃ আগামী লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি-কে পরাস্ত করাই পার্টির সামনে প্রধান রাজনৈতিক কর্তব্য। আর পশ্চিমবঙ্গে বিজেপি এবং তৃণমূল কংগ্রেস উভয় শক্তিকে পরাস্ত করার লক্ষ্য নিয়ে পার্টি অগ্রসর হবে। ৩-৫ নভেম্বর সিপিআই(এম)’র রাজ্য কমিটির বর্ধিত অধিবেশনে সমগ্র পার্টির সামনে এই আহ্বানই রাখা হয়েছে।

অধিবেশনে ‘সাম্প্রদায়িক বিজেপি-কে পরাস্ত করো’ শীর্ষক একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। প্রস্তাবে বলা হয়েছেঃ বর্তমান সময়ে সাম্প্রদায়িকতাবাদ ও মৌলবাদ যেভাবে ‘এক দেশ-এক নীতি-এক নেতা’ স্লোগানের আড়ালে অভিন্নতার দোহাই দিয়ে জাতীয় সংহতি এবং ঐক্যের ওপর আঘাত হানতে চাইছে, যারফলে দেশের সংহতিই বিপন্ন হয়ে পড়বে। আরও উন্নততর দেশ গঠন ও ভারতকে মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষার লক্ষ্যে সাম্প্রদায়িক বিজেপি-কে পরাস্ত করার জন্য সংকল্পবদ্ধ হতে হবে।

এই সময়ে সাংগঠনিক স্তরে আশু কাজ হবে বুথ সংগঠন গড়ে তোলা। রাজ্যের একটা বুথকেও এথেকে বাদ রাখা যাবে না। প্রতিটি বুথে ব্যাপক প্রচার সংগঠিত করতে হবে। যাতে ভেঙে চুরমার করে দেওয়া যায় বিজেপি-তৃণমূলের বাইনারি রাজনীতির সমস্ত অপচেষ্টাকে। এই প্রচারাভিযানে পার্টির সর্বশক্তি এবং সম্ভাব্য সমস্ত উপায়কে ব্যবহার করতে হবে। অধিবেশন শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে অধিবেশনে আলোচনা এবং সিদ্ধান্তসমূহের একথা জানান পার্টির রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। তিনি জানিয়েছেনঃ ব্যাপক প্রচারের অংশ হিসেবে নভেম্বর ও ডিসেম্বর মাসজুড়ে রাজ্যে সর্বত্র মানুষের কাছে যাওয়ার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। হবে পদযাত্রা, পথসভা, হাটসভা। যত নির্বাচন সামনে আসবে, বিজেপি রামমন্দির নিয়ে সুর চড়া করবে। তৃণমূলও জগন্নাথ বা অন্য কোনো মন্দিরের কথা বলবে। এর বিপরীতে আমরা জনগণের ইস্যুগুলি - মূল্যবৃদ্ধি, খাদ্য, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, তৃণমূলের দুর্নীতি ও লুঠ নিয়ে রাস্তায় সোচ্চার হবো। পঞ্চায়েতে ভোটলুটের বিরুদ্ধে মানুষ লড়েছে। ভোটলুট, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মানুষ একজোটও হচ্ছেন। একে আরও সংহত করার লক্ষ্য নিয়েই এই প্রচার অভিযান চলবে।

রাজ্য কমিটির এই বর্ধিত অধিবেশন হয়েছে পার্টির হাওড়া জেলা দপ্তরে। রাজ্য কমিটির সদস্য সহ রাজ্যের সব জেলা ও গণফ্রন্ট থেকে ৩৫৯ জন অগ্রণী সংগঠক অধিবেশনে অংশ নিয়েছিলেন। অধিবেশনে রক্তপতাকা উত্তোলন করেন পার্টির বর্ষীয়ান নেতা বিমান বসু। উদ্বোধনী বক্তৃতা দেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি।



সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য ২৬ তম সম্মেলনের পরবর্তী দেড় বছরের রাজনৈতিক-সাংগঠনিক পরিস্থিতি ও আন্দোলন-সংগ্রামের পর্যালোচনা করা হয়েছে বর্ধিত অধিবেশনে। রাজ্য সম্মেলনে চারটি বিষয় নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। প্রথমত, চরম দক্ষিণপন্থী ও চূড়ান্ত উদারবাদী অর্থনীতির ক্রমবর্ধমান আক্রমণের বিরুদ্ধে শ্রেণি এবং গণসংগ্রামগুলিতে ব্যাপকতম সমাবেশ ঘটাতে হবে। দ্বিতীয়ত, বামফ্রন্টকে আরও সংহত ও শক্তিশালী করতে হবে। তৃতীয়ত, বামফ্রন্ট বহির্ভূত বাম ও সহযোগী দলগুলিকে নির্দিষ্ট কর্মসূচির ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিতে শামিল করতে হবে। চতুর্থত, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ওপরে আক্রমণের মোকাবিলায় তৃণমূল ও বিজেপি বিরোধী সমস্ত দল, গোষ্ঠী, বিভিন্ন সংস্থা, সামাজিক সংগঠন, সামাজিকভাবে গ্রহণীয় এবং সমাজের মতকে প্রভাবিত করতে পারে এরকম বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ব্যাপকতম মঞ্চে সমবেত করতে হবে। এরসাথে ছিল ২৩তম পার্টি কংগ্রেসের নির্দেশ এবং গৃহীত রাজনৈতিক লাইন।

বর্ধিত অধিবেশনে পেশ করা রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনে রাজ্য সম্মেলনে ও পার্টি কংগ্রেসে নির্দিষ্ট-করা বিষয়সমূহ কার্যকর করার ক্ষেত্রে পার্টির ভূমিকা গ্রহণ এবং সাফল্য-ব্যর্থতা, মধ্যবর্তী সময়ে আন্দোলন-সংগ্রামের অভিজ্ঞতার পর্যালোচনা, সংগঠন, আগামী লোকসভা নির্বাচন নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। ‘গণলাইন’ প্রসঙ্গে প্রতিবেদনে বলা হয়েছেঃ গণলাইন কার্যকর করার অর্থ পার্টির নেতৃত্ব সহ সকল সদস্যকে দৈনন্দিন কার্যধারায় এক বড়ো সময় জনগণ ও পার্টিকর্মীদের মধ্যে ব্যয় করতে হবে। জনগণের মনোভাব, মতামত ও কথাগুলি শুনতে হবে। শ্রমিক মহল্লায়, গরিব মানুষের বস্তিতে, নিম্নবিত্ত ও মধ্যবিত্ত মানুষের বসতি এলাকায় সভা করে চলে আসা নয়, সেখানে জনগণের সাথে আলাপচারিতায় সময় দিতে হবে। বেশি করে তাদের কথা শুনতে হবে। জনগণকে মর্যাদা দিতে হবে। তাদের আস্থা ও ভরসা অর্জন করতে হবে।এককথায় বলা যেতে পারে, কাজের স্টাইলের পরিবর্তন করতে হবে। শুধুমাত্র পার্টি ও গণফ্রন্টের দপ্তরে বসে নিজেদের মধ্যে আলোচনায় নিমগ্ন থাকা নয়, জনগণের সাথে তাদের জীবন্ত সমস্যাকে কেন্দ্র করে সময় ব্যয় করাই গণলাইনের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই প্রতিবেদন অধিবেশনে পেশ করেন মহম্মদ সেলিম।



এই নভেম্বর মাসেই পার্টি কংগ্রেসে গৃহীত রাজনৈতিক লাইন অনুসারেই লোকসভা নির্বাচনে যাদের সঙ্গে নিয়ে বিজেপি এবং তৃণমূলের বিরুদ্ধে লড়াই করা হবে তাদের সাথে পার্টি আলোচনা করবে। এপ্রসঙ্গে মহম্মদ সেলিম বলেছেনঃ প্রথমে বামফ্রন্টে আলোচনা, এরপর বামফ্রন্টের বাইরের সহযোগী বামশক্তি ও গোষ্ঠীগুলির সঙ্গে আলোচনা।অন্য যেসব দল ও শক্তি দেশের সংবিধান রক্ষা করতে, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াইতে এবং তৃণমূল-বিজেপি’র বিরুদ্ধে লড়াই করতে চায় - এরকম সবার সাথে আমরা আলোচনা করব। কংগ্রেস এবং আইএসএফ সহ আরও অনেকের সাথে আমাদের কথা হবে।

উদ্বোধনী বক্তৃতায় সীতারাম ইয়েচুরি সম্প্রতি জাতীয় স্তরে গড়ে ওঠা ‘ইন্ডিয়া’ মঞ্চ প্রসঙ্গে আলোকপাত করেন। তিনি বলেনঃ ইন্ডিয়া মঞ্চে তৃণমূল কংগ্রেসের উপস্থিতি সম্পর্কে প্রশ্ন উঠেছে।অনেকেই জানতে চাইছেন, ওরা যদি থাকে তবে আমরা ওই মঞ্চে কেন রয়েছি? কেন আমরা আলাদা হচ্ছি না। আমরা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই - তৃণমূল কংগ্রেস কোনোভাবেই বিজেপি’র বিরুদ্ধে বিকল্প না, কোনোদিন হতেও পারবে না। অতীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তারা বিজেপি’র থেকে সুবিধা নিয়েছে, জোট করে ভোটে লড়েছে। আমরা জানি ভবিষ্যতে তারা সমঝোতাও করতে পারে, এমন কাজ তারা আগেও করেছে। সংসদে বিজেপি’র বিরুদ্ধে ভোট দেওয়ার সময় তারা ধারাবাহিকভাবে অনুপস্থিত থেকেছে, নয়ত সমর্থন জানিয়েছে। এই মুহূর্তে ভারতকে বাঁচানোই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। দেশকে বাঁচাতে গেলে বিজেপি-কে সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার জায়গা থেকে সরাতে হবে। যতদিন না সেই কাজ শেষ হবে ভবিষ্যৎ ভারত নির্মাণের কাজ শুরু করা যাবে না। এই লক্ষ্যেই আমরা সবার কাছে আবেদন জানিয়েছি। তৃণমূল কংগ্রেস তাতে এসেছে বিজেপি বিরোধিতায়। পূর্বের অভিজ্ঞতায় আমরা জানি, যখনই ঐক্য সুদৃঢ় হবে তখনই বিজেপি’র সুবিধা করে দিতে তারা ঐক্যবিরোধী কাজ করবে। আমাদের এমন আশা করা উচিত নয় যে, তারা শেষ অবধি থাকবে। এমন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে বিজেপি বিরোধিতায় কিছু সাহায্য যদি কিছু থেকে হয় তাই আমরা তার বিরোধিতা করব না।



রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনের ওপর আলোচনায় ৪ মহিলা সহ ৫২ জন অংশগ্রহণ করেন। এছাড়াও চারটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর সমান্তরাল অধিবেশন সংগঠিত হয়। যাতে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে অধিবেশনের সমস্ত অংশগ্রহণকারী যোগদান করেন। চারটি সমান্তরাল অধিবশনের বিষয় ছিলঃ ক) আন্দোলন-সংগ্রামে স্থানীয় ইস্যু চিহ্নিতকরণ; খ) শাখার কার্যধারা, যৌথ কার্যধারা পরিচালনার গুরুত্ব; গ) গণসংগঠনে স্বাধীন গণতান্ত্রিক কার্যধারা, গণসংগঠনের সম্প্রসারণ, পার্টি গঠন; ঘ) গণলাইন কার্যকর করা ও ত্রুটি সংশোধন। এই চারটি সমান্তরাল অধিবেশনে সম্মিলিতভাবে ১৭৮ জন আলোচনা করেছেন। অধিবেশনে সর্বমোট ২৩০ জন আলোচনা করেছেন। অর্থাৎ ৬৪ শতাংশ অংশগ্রহণকারী আলোচনায় অংশ নেন, যা পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের এক উত্তম নির্দশনও বলা যায়। প্রতিটি সমান্তরাল অধিবেশনের আলোচনার সম্মিলিত রিপোর্ট পৃথক পৃথকভাবে মূল অধিবেশনে পেশ করা হয়। বর্ধিত অধিবেশনে এই বিশাল সংখ্যক অংশগ্রহণকারীর আলোচনায় অংশগ্রহণ সামগ্রিকভাবে পার্টির বোঝাপড়াকে উন্নত করেছে এবং রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রতিবেদনকে সমৃদ্ধ করেছে।

প্রতিনিধিদের আলোচনার ওপর নিজের পর্যবেক্ষণ ব্যাখ্যা করেন সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। জবাবি ভাষণ দেন রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। প্রতিবেদনে প্রাথমিকভাবে ১৯ দফা এই মুহূর্তের কর্মসূচি ঠিক করা হয়েছিল। অধিবেশনে সমগ্র আলোচনার ভিত্তিতে এই আগামী কর্মসূচিকে দ্রুত চূড়ান্ত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রাজ্য কমিটিকে।

সিপিআই(এম) পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটিতে তিনজনকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অধিবেশনে তাঁদের নাম জানান মহম্মদ সেলিম। এঁরা হলেনঃ বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্য, ফৈয়াজ আহমেদ খান এবং হিমগ্নরাজ ভট্টাচার্য।

তিনদিনের এই অধিবেশন পরিচালনা করেন রামচন্দ্র ডোম, শ্রীদীপ ভট্টাচার্য, দেবলীনা হেমব্রম, জিয়াউল আলম এবং সৃজন ভট্টাচার্যকে নিয়ে গঠিত সভাপতিমণ্ডলী। সমগ্র অধিবশনে পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্যকান্ত মিশ্র এবং নীলোৎপল বসু উপস্থিত ছিলেন। অধিবেশনে প্যালেস্তাইনে ইজরায়েলি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গৃহীত হয়, এবং ৮ নভেম্বর কলকাতায় বামপন্থী দলসমূহের আহ্বানে যুদ্ধবিরোধী মিছিলে ব্যাপক জমায়েতের ডাক দেওয়া হয়েছিল।