E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১০ নভেম্বর, ২০২৩ / ২৩ কার্তিক, ১৪৩০

স্বীকৃত সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার প্রয়াসেই প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বিল-২০২৩

শামিম আহমেদ


বিগত কয়েক মাস ধরে বহুল চর্চিত কতগুলো বিষয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকারের প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায়সংহিতা, ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা ও ভারতীয় সাক্ষ্য অধিনিয়ম। এই বিষয় নিয়ে দ্বন্দ্ব থাকা উচিত নয় যে, ঔপনিবেশিক আইনের পরিবর্তন বা পরিবর্ধন প্রয়োজন, বর্তমান সমাজের প্রয়োজনীয়তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তোলার জন্য। বর্তমান সমাজ ব্যবস্থার প্রেক্ষিত আলোচনাসাপেক্ষে এই পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করা উচিত।

সংবিধান রচনার পূর্বের সমস্ত আইন যা সংবিধানের কোনো ধারার পরিপন্থী, তা সংবিধানেরই ১৩ নম্বর ধারায় বাতিল করা হয়েছে।

Article 13(1) - All laws in force in the territory of India immediately before the commencement of this Constitution, in so far as they are inconsistent with the provisions of this Part, shall, to the extent of such inconsistency, be void.

ফলত এটা বুঝে নিতে অসুবিধা নেই যে, ভারতীয় দণ্ডবিধি, ফৌজদারি কার্যবিধি এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্ট সংবিধানের কোনো ধারার পরিপন্থী নয়। ফলে কি উদ্দেশ্যে নতুন আইন নিয়ে আসা হলো তা বুঝে নেওয়া জরুরি, যা নিশ্চিতরূপে আইনপ্রণেতারা মনে করেন সংশোধনের মাধ্যমে সম্ভব নয়। কী কী নতুন ধারা প্রবর্তিত হলো যা সমাজে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেবে। এছাড়া, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলো, যে সমস্যাগুলি আগের আইনের মধ্যে ছিল, সেই সমস্ত সমস্যাকে দূর করা গেল কিনা।

সংসদে প্রস্তাবিত নতুন আইনের ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, ইংরেজদের দ্বারা প্রণীত আইনের পরিসমাপ্তি চান। যারা রাজনৈতিকভাবে ইংরেজদের তোষামোদ করে গেছে দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে, তারাই আইন পরিবর্তনের মাধ্যমে সংসদে দাঁড়িয়ে কোথাও জাতীয়তাবাদী প্রমাণ করার একটা মরিয়া চেষ্টা দেখিয়েছে। রাজনৈতিক কারণ বা তার ব্যাখ্যা অন্য পরিসরে করা যাবে। আইনি ব্যাখ্যার মধ্যেই এই চর্চা সীমাবদ্ধ রাখতে চাই।

যেকোনো আইন রচনাকালে যে বিষয়গুলি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে মাথায় রাখা প্রয়োজন, তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো -
১. প্রণীত বা প্রস্তাবিত আইন সংবিধানের কোনো ধারার পরিপন্থী নয়।
২. সংবিধানের ১১ নম্বর পর্বের এক নম্বর পরিচ্ছেদ এবং সপ্তম তফশিল অনুযায়ী কেন্দ্রীয় সরকার বা রাজ্য সরকার লোকসভার বা বিধানসভার মাধ্যমে যে আইনটি আনতে চলেছে সেই আইনটি প্রণয়নের অধিকার তাদের আছে।
৩. আইন প্রণয়নের প্রক্রিয়ার মধ্যে এমন কিছু না থাকে যা থেকে এই ধারণায় উপনীত হওয়া যায়, যে উদ্দেশ্যে এই আইন প্রণয়ন করা হয়েছে আর যে উদ্দেশ্যে এটা ব্যবহার করা হবে তা ভিন্ন। অর্থাৎ আইন প্রণেতাদের কু-উদ্দেশ্য যদি পরিলক্ষিত হয় (coulorable exercise of power)।

অন্যান্য বিষয়গুলির মধ্যে উপরিউক্ত এই তিনটি বিষয়ের সন্তুষ্টি না থাকলে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের মতো যে কোনো সাংবিধানিক কোর্টে এই আইন বাতিলযোগ্য।

যাইহোক, ভারতের বহু পুরনো আইনব্যবস্থায় বদল আনতে কেন্দ্রীয় সরকার এই তিনটি নতুন বিল পেশ করেছে সংসদে। আপাতত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রকের স্থায়ী কমিটির বিবেচনায় রয়েছে ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস) বিল ২০২৩, ফৌজদারি কার্যবিধির বদলে প্রস্তাবিত ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা (বিএনএসএস) বিল ২০২৩ এবং ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের পরিবর্তে পেশ করা ভারতীয় সাক্ষ্য (বিএস) বিল ২০২৩।

এই তিনটি প্রস্তাবিত আইনের বইয়ের বিভিন্ন ধারার বিশ্লেষণে যাওয়ার আগে, যদি তিনটি প্রস্তাবিত আইনের নামকরণের দিকে নজর রাখি, তাহলেই আন্দাজ করা যায় যে, সাধারণের গ্রহণযোগ্য “Statement of object and reasons”-কে সামনে রেখে এই নতুন আইন প্রস্তাবিত হয়েছে, অথচ আইন প্রণেতারা হিন্দি ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে শুধুমাত্র সাংবিধানিক নির্দেশিকাকে লঙ্ঘন করেনি বরং একটি অভিসন্ধিমূলক অভিমুখ দেওয়ার চেষ্টা করেছে।

হ্যাঁ, আমরা সকলে জানি হিন্দি জাতীয় ভাষা নয়, বরং সংবিধান রচনাকালে সচেতনভাবেই হিন্দিকে official language-এর স্বীকৃতি দেওয়া হয়। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় দপ্তরগুলি সংযোগ রক্ষার কাজে হিন্দি ভাষাকে ব্যবহার করতে পারে। সংবিধানের ৩৪৮ ধারায় খুব স্পষ্টভাবে উল্লেখ আছে, যেকোনো আইন রচনাকালে ইংরেজি ভাষাকে প্রয়োগ করতে হবে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতা ২০২৩ বিলটির খসড়া তৈরি ও প্রস্তাবের কালে আইন প্রণেতারা সংবিধানের সেই নির্দেশকে লঙ্ঘন করেছে তা বলার অবকাশ রাখে না। আমাদের দেশে শুধু হিন্দি ভাষার নয় বাংলা, নেপালি, উর্দু থেকে শুরু করে বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ বাস করেন। তাই তো বহুত্ববাদকে আমাদের সংবিধানে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের নিজ নিজ আদর্শকে সামনে রেখে নির্বাচনী লড়াইয়ের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করে। ভিন্ন রাজনীতিক আদর্শ থাকলেও পার্লামেন্টে আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সংবিধানের পরিধির মধ্যে থেকেই তা করতে হবে। নির্বাচনে জয়যুক্ত করার মাধ্যমে যে বিশ্বাস দেশের নাগরিকরা নির্বাচিত সরকারের উপর রাখে, তা বজায় রাখার দায়বদ্ধতা ভুলে গিয়ে কায়েমি স্বার্থ মাথায় রেখে বৈষম্য সৃষ্টির বার্তা বহন করে নামকরণের ক্ষেত্রে হিন্দি ভাষার প্রয়োগ। হিন্দি ভাষাকে সচেতনভাবে জাতীয় ভাষা না করার যে সিদ্ধান্ত সংবিধান প্রণেতারা নিয়েছিলেন তাকে পক্ষান্তরে জাতীয় ভাষা করার মরিয়া চেষ্টা রাজনৈতিক অসততার পরিচয় বহন করে। অসৎ উদ্দেশ্য (colourable exercise of legislative power/legislative intent) নিয়ে প্রস্তাবিত/প্রণীত যে কোনো আইন-ই অসাংবিধানিক।

ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বিলে ভারতীয় দণ্ডবিধির ২২টি ধারা বাতিল করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ১৭৫টি বর্তমান ধারার পরিবর্তনের প্রস্তাবের পাশাপাশি ৮টি নতুন ধারার কথা বলা হয়েছে। দণ্ডবিধিতে ২৬টি অধ্যায়ে মোট ৫৭৬টি ধারা ছিল। নতুন বিলে ১৯টি অধ্যায়ে ৩৫৬টি ধারার কথা বলা হয়েছে।

ভারতীয় নাগরিক সুরক্ষা সংহিতায় ফৌজদারি কার্যবিধির ৯টি বিধান বাতিল এবং ১৬০টি বিধানে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে এবং ৯টি নতুন বিধান যুক্ত করার কথা বলা হয়েছে। এতে মোট ৫৩৩টি ধারা আছে।

ভারতীয় সাক্ষ্য বিল-এর ক্ষেত্রে বর্তমান ইন্ডিয়ান এভিডেন্স অ্যাক্টের ৫টি বিধান বাতিল এবং ২৩টি বিধানে পরিবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ১টি নতুন বিধান প্রবর্তনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এতে মোট ১৭০টি ধারা আছে।

স্বল্প পরিসরের মধ্যে তিনটি আইনের বিশ্লেষণ সম্ভব নয়। তাই এই পরিসরে আলোচনা সীমাবদ্ধ রাখা হচ্ছে ভারতীয় দণ্ডবিধির বদলে প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতা বিল নিয়ে কতগুলি উদাহরণ দিলে বা প্রস্তাবিত আইনের বিশ্লেষণ করলেই বোঝা যায় যে, শুধুমাত্র আইন-শৃঙ্খলার রক্ষার তাগিদে এই আইন প্রস্তাবিত হয়নি বরং স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে স্বীকৃত সাংবিধানিক অধিকার খর্ব করার যথেষ্ট প্রয়াস ছত্রে ছত্রে লিপিবদ্ধ হয়েছে।

এই প্রথম সাধারণ ফৌজদারি আইনে সন্ত্রাসবাদ এবং সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপকে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে ন্যায় সংহিতার ১১১ নম্বর ক্লজে। এতদিন যা ছিল দানবীয় ইউএপিএ’র অধীনে। এই ১১১ নম্বর ক্লজে রয়েছে, পাবলিক অর্ডারে বিঘ্ন ঘটাচ্ছে যে বা যারা - তারা সন্ত্রাসবাদী কার্যকলাপে অভিযুক্ত হবে। ঠিক কী ধরনের পাবলিক অর্ডার বিঘ্নের কথা বলা হচ্ছে - তা ভয়ঙ্কর রকম অস্পষ্ট।আবশ্যিক পরিষেবায় বাধা শাস্তিযোগ্য অপরাধ ধরে নিলেও প্রেক্ষিত বিচার বা বিবেচনা করা অত্যন্ত জরুরি। ‘‘Mens rea’’ অর্থাৎ অপরাধ করার মানসিকতা নিয়ে এই অপরাধ সংগঠিত হয়েছে কীনা। বহু ক্ষেত্রে শ্রমিকরা ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে আন্দোলন করেন, সে ক্ষেত্রেও সরকার নিত্যপ্রয়োজনীয় পরিষেবায় বাধা দিচ্ছে বলে নতুন বিল অনুসারে আন্দোলনকারীদের সন্ত্রাসবাদী ধারায় অভিযুক্ত করতে পারবে। অর্থাৎ গণআন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী তকমা দিয়ে স্তব্ধ করার ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এমনকী আগুন লাগলে অথবা বন্যা হলে সরকার একে সন্ত্রাসবাদীদের নাশকতামূলক কাজ বলে দেগে দিতে পারে।

সংগঠিত অপরাধের ধারণা অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১০৯ এবং ১১০ নম্বর ক্লজে। প্রস্তাবিত ১০৯ ধারায় “cyber crime having severe consequences” নামক অপরাধের কথা বলা হয়েছে ইনফরমেশন টেকনোলজি আইনের উল্লেখ ছাড়াই। এই কয়েকদিন আগে ফেসবুকে শাসকদলের এক নেতার ছবি ব্যবহার করে কৌতুক করার জন্য পুলিশ মধ্যরাত্রে অভিযুক্তকে বাড়ি থেকে অ্যারেস্ট করে। এমন ঘটনা এখন আকছার ঘটছে। ইনফরমেশন টেকনোলজি আইনে সাইবার ক্রাইম সংজ্ঞায়িত আছে। ভারতীয় ন্যায় সংহিতায় কোথাও সাইবার ক্রাইম আলাদা করে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। যদি তর্কের খাতিরে ধরে নেই যে, ইনফরমেশন টেকনোলজি এক আইনে যে অপরাধের কথা উল্লেখ করা আছে, সেই সংজ্ঞায়িত অপরাধকেই এই আইনের আওতায় ধরে নেওয়া হবে সেক্ষেত্রেও severe consequence কোন ক্ষেত্রে বলা হবে তা উল্লেখ না থাকায় এই আইনের অপপ্রয়োগ ঘটিয়ে একাধিক ব্যক্তিকে হেনস্তা করার সুযোগ যথেষ্ট।

Card skimming থেকে শুরু করে ATM-এ চুরি, বা পাবলিক এক্সামিনেশনের প্রশ্নপত্র বিক্রির বিষয়কে যেভাবে ছোটো অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে তা এই ধরনের অপরাধের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদেরকে উৎসাহিত করবে। এছাড়াও এই ধারার সুযোগ নিয়ে অনেক সংগঠিত বড়ো অপরাধের মূল্যায়ন হবে না এবং অপরাধীরা ছাড়া পেয়ে যাবে।

ন্যায়সংহিতার ১৫০ নম্বর ধারা আলোচনা করার আগে, কতগুলো পরিসংখ্যান বুঝে নেওয়া জরুরি। কেন্দ্র সরকারের স্বরাষ্ট্র দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৯ সালে গ্রেপ্তারের সংখ্যা ৭২ শতাংশ বেড়েছে। প্রায় ৫৯২২ জন অপরাধীকে গ্রেফতার করা হয়েছে ২০১৬ সাল থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে। এই ৫৯২২ জনের গ্রেপ্তার হওয়ার মধ্যে মাত্র ১৩২ জনের অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছে প্রশাসন। অর্থাৎ গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিদের মাত্র দুই শতাংশ সাজাপ্রাপ্ত হয়েছে। ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থায় ভারতীয় নাগরিকের কণ্ঠ রোধ করার জন্য দণ্ডবিধির ১২৪ (এ) ধারার দানবীয় আইন প্রয়োগ করা হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যে আইন প্রণয়নের প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে, সেই দণ্ডবিধির ১২৪ (এ) ধারায় সন্নিবিষ্ট রাষ্ট্রদ্রোহ আরও সম্প্রসারিতভাবে ন্যায় সংহিতার ১৫০ নম্বর ক্লজে আনা হয়েছেঃ ‘Whoever, purposely or knowingly, by words, either spoken or written, or by signs, or by visible representation, or by electronic communication or by use of financial mean, or otherwise, excites or attempts to excite, secession or armed rebellion or subversive activities, or encourages feelings of separatist activities or endangers sovereignty or unity and integrity of India; or indulges in or commits any such act shall be punished with imprisonment for life or with imprisonment which may extend to seven years and shall also be liable to fine’। অথচ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সংসদে ঘোষণা করেছেন, ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রদ্রোহের ধারা নাকি বাতিল করা হচ্ছে নতুন বিলে! ন্যূনতম সাজাও ৩ বছর কারাদণ্ডের বদলে বাড়িয়ে ৭ বছরের প্রস্তাব করা হয়েছে। উপরিউক্ত পরিসংখ্যান থেকে এ ধারণায় উপনীত হওয়া যায় যে, এই ধরনের আইনি ধারা কুরাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্য চিরকাল ব্যবহৃত হয়ে এসেছে। নাগরিক সুরক্ষা সংহিতা আইন বা সাক্ষ্য বিলের বিস্তারিত আলোচনা না করলেও আইন প্রণেতাদের অসৎ উদ্দেশ্য আরও বেশি করে পরিলক্ষিত হয় প্রস্তাবিত নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ১৮৭ নম্বর ধারায়; এই ধারা অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে সর্বমোট ১৫ দিনের পরেও পরবর্তী ৭৫ দিন পুলিশ হেফাজতে অভিযুক্তকে জেরার জন্যে নিয়ে যাওয়ার নয়া বিধান প্রস্তাবিত হয়েছে। এর ফলে হেফাজতে হিংসা, হত্যা আরও বাড়ার আশঙ্কা প্রবল। সব ধরনের বন্দিকে হাতকড়া পরিয়ে জনসমক্ষে নিয়ে যাওয়ার নয়া বিধান (নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ৪৩(৩) নম্বর ক্লজ) সুপ্রিম কোর্টের এই সংক্রান্ত নিষেধাজ্ঞাকেও আগ্রহ্য করছে।

প্রস্তাবিত নাগরিক সুরক্ষা সংহিতার ২৫৪, ২৫৫, ২৫৬(৩) নম্বর ক্লজে তদন্তকারী পুলিশ-সহ অন্যদের বিচারের সময় অভিযুক্তের পালটা জেরার অধিকার খর্ব করা হয়েছে যা ন্যায়বিচার, সুষ্ঠু বিচার প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ বিরোধী।

নতুন সাক্ষ্য বিলের ১১৫ নম্বর ক্লজে বলা হয়েছে, ন্যায় সংহিতার যে সমস্ত ধারায় (যেমন ধারা ১৪৫, ১৪৬, ১৪৭, ১৪৮) রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, ফৌজদারি ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ইত্যাদি ক্ষেত্রে অথবা উপদ্রুত আইন যেখানে লাগু আছে, সেই সমস্ত ধারায় অভিযুক্তদের প্রমাণ করতে হবে, তাঁরা দোষী নন, নির্দোষ। অর্থাৎ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ঘোষণার অনুচ্ছেদ ১১ এবং আন্তর্জাতিক সুষ্ঠু ন্যায় বিচারের মৌল দর্শন - যতক্ষণ না অপরাধ প্রমাণিত হচ্ছে ততক্ষণ পর্যন্ত অভিযুক্ত নির্দোষ - এই মৌলিক ধারণার মূলে আঘাত হানা হয়েছে।

নতুন বিলে মৃত্যুদণ্ডের প্রাবল্য চোখে পড়ার মতো। ব্রিটিশ আমলে হত্যা-সহ একাধিক অপরাধে মৃত্যুদণ্ড সর্বদা এক নম্বরে থাকত। যাবজ্জীবন দু নম্বরে বিকল্প শাস্তি হিসাবে ছিল। মৃত্যুদণ্ড না দিয়ে যদি কোনো বিচারক দণ্ডিতকে যাবজ্জীবন দিতেন, তা হলে কারণ উল্লেখ করতে হতো; মৃত্যুদণ্ড দিলে কারণ উল্লেখ করতে হতো না। ঔপনিবেশিক এই মানসিকতার পরিবর্তন ঘটে স্বাধীন ভারতে পঞ্চাশের দশকে। পরে সুপ্রিম কোর্টও মৃত্যুদণ্ডের পরিধি ক্রমশ সঙ্কুচিত করে দিয়েছিল। এখন নানা ধরনের অপরাধে মৃত্যুদণ্ডকে এক নম্বরে স্থান দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছে। শুধু তাই নয়, মৃত্যুদণ্ড মকুব করার নানা সাংবিধানিক পদ্ধতিকে কাটছাঁট করার প্রস্তাবও রয়েছে ন্যায় সংহিতা বিলে।

এতদিন দণ্ডবিধির ৫৩ ধারায় শুধু যাবজ্জীবন সাজার কথা বলা ছিল। কার্যত ১৪ বছর কারাবাসের পরে মুক্তির আরজি বিবেচনার সুযোগও ছিল (ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৩৩ এ বা ৪৩২, ৪৩৩ ধারায় সাজা কমানোর সুযোগ ছিল)। কিন্তু প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায় সংহিতার ৪বি ক্লজে বলা হয়েছে - যাবজ্জীবন মানে জীবনের বাকি পুরো সময়ের জন্যেই কারাবাস। ফলত কারাগার থেকে সংশোধনাগারের যে আইন বহাল আছে তাকে অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয় সুপ্রিম কোর্ট বারে বারে নির্দেশ দিয়েছেন, দীর্ঘদিন কারাবাসে থাকা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ প্রাপ্ত অপরাধীদের ব্যবহার বিবেচনা করার জন্যে। এই ধরনের নির্দেশিকার উদ্দেশ্যই সংশোধনাগারে থেকে যদি জীবন ধারণের পদ্ধতির উন্নতি ঘটে তাহলে তাকে মুক্ত জীবনযাপন করতে দেওয়ার সুযোগ করে দেওয়া।

প্রস্তাবিত আইনের ১৪ নম্বর পরিচ্ছদে বেশ কিছু ধারায় পুলিশকে বা তদন্তকারী অফিসারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। একটু ধারার ব্যাখ্যা করলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধা হবে। প্রসাবিত আইনের ২৫৩ নম্বর ধারা - “Whoever, being a public servant, knowingly disobeys any direction of the law as to the way in which he is to conduct himself as such public servant, intending thereby to save, or knowing it to be likely that he will thereby save, any person from legal punishment, or subject him to a less punishment than that to which he is liable, or with intent to save, or knowing that he is likely thereby to save, any property from forfeiture or any charge to which it is liable by law, shall be punished with imprisonment of either description for a term which may extend to two years, or with fine, or with both.”

অর্থাৎ, সরকারি কর্মচারী হিসেবে কাজ করার সময় কোনো অপরাধীকে বাঁচানোর উদ্দেশে জেনেশুনে কোনো আইনসম্মত নির্দেশ অমান্য করলে তা ফৌজদারি অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই ধরনের আইনে অসুবিধা হচ্ছে যিনি প্রশাসকের ভূমিকায় থাকবেন তিনি নির্ভীকভাবে কাজ করার চেষ্টা করলে যে কোনো মুহূর্তে মিথ্যে অভিযোগের স্বীকার হতে পারেন। শাসকদল এই আইনকে ব্যবহার করে সরকারি কর্মচারীর উপর অযথা চাপ তৈরি করতে পারে, ফলে নির্ভীক সরকারি কর্মচারীরাও নিরপেক্ষভাবে কাজ করার দক্ষতা হারাবে।

প্রস্তাবিত আইনের ৬৪ (১) ধারায় ধর্ষণ ও তার শাস্তির কথা উল্লেখ আছে। ৬৪ (২) ধারায় হেফাজতকারীর দ্বারা ধর্ষণ আলাদাভাবে উল্লেখ করে একই অপরাধের দুটো ভিন্ন শ্রেণি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে। দুটি অপরাধের ক্ষেত্রে শাস্তির পরিমাণ একই হলেও কেন দুটি আলাদা শ্রেণিভুক্ত করা হয়েছে তা বোধগম্য হয় না। এছাড়াও প্রস্তাবিত আইনের ৬৫ (১) ধারায় ১৬ বছর কম বয়সি কিশোরীকে ধর্ষণ, ৬৫ (২) ধারায় ১২ বছরের কম বয়সি বালিকাকে ধর্ষণ, ৬৬ ধারায় ধর্ষণের জেরে মৃত্যু বা চিরকালের মতো পঙ্গুত্ব ঘটালে, ৭০ ধারায় একাধিক জন মিলে ধর্ষণ, ৭১ ধারায় দ্বিতীয় বার যৌন অপরাধ, ৭৯ ধারায় পণের জন্যে মৃত্যু ঘটানো, ৮৭ ধারায় মহিলার অসম্মতি সত্ত্বেও গর্ভপাত ঘটানো, ৮৮ ধারায় গর্ভপাত ঘটাতে গিয়ে মৃত্যু, ১০১ ধারায় খুন, ১০২ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যদি খুন করে, ১০৩ ধারায় অনিচ্ছাকৃত মৃত্যু ঘটানো, ১০৫ ধারায় শিশু বা মানসিক ভারসাম্যহীনকে আত্মহত্যায় প্ররোচনা, ১০৭ ধারায় হত্যার উদ্দেশ্যে আঘাত, ১০৭ (২) ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত যদি খুনের চেষ্টা করে, ১০৯ ধারায় সংগঠিত অপরাধে, ১১১ ধারায় ‘সন্ত্রাসবাদী অপরাধে’, ১১৭ (২) ধারায় গুরুতর আঘাতে, ১২২ (১) ধারায় অ্যাসিডে গুরুতর জখম করা, ১৩৭ (১) ধারায় অপহরণ, ১৩৭ (২) ধারায় ভিক্ষাবৃত্তি করাতে শিশুর অঙ্গহানি ঘটালে, ১৩৮ ধারায় মুক্তিপণ আদায় বা হত্যার উদ্দেশ্যে অপহরণ, ১৪১ ধারায় একাধিক জনকে, ১৪১ (৬) ধারায় শিশু পাচারে একাধিকবার অভিযুক্ত হলে, ১৪১ (৭) ধারায় পাচারে সরকারি কর্মী যুক্ত থাকলে আমৃত্য যাবজ্জীবন কারাবাসের কথা বলা হয়েছে। শিশু পাচারে, ১৪৩ ধারায় দাস ব্যবসায়, ১৪৫ ধারায় সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ-ঘোষণা, ১৪৬ ধারায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধের ষড়যন্ত্র, ১৪৭ ধারায় রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার উদ্দেশ্যে অস্ত্রসংগ্রহ, ১৫০ ধারায় ভারতের সার্বভৌমত্ব, একতা, অখণ্ডতা বিপন্ন করা, ১৫১ ধারায় ভারতের কোনো বন্ধু রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা, ১৫৪ ধারায় যুদ্ধাপরাধী বন্দিকে পালানোয় মদত দিলে সরকারি কর্মীর, ১৫৬ ধারায় এমন বন্দিকে আশ্রয়দান করলে, ১৫৭-১৫৮ ধারায় সেনায় বিদ্রোহে মদতে, ১৭৬-১৭৯ ধারায় জাল টাকার কারবারে যুক্ত থাকলে, জাল টাকা তৈরির যন্ত্রপাতি তৈরি বা সংগ্রহে রাখলে, ২২৮ (১) ধারায় কাউকে মৃত্যুদণ্ড-যোগ্য অপরাধে মিথ্যা সাক্ষ্যে ফাঁসালে, ২৬১ (বি) ধারায় আইনানুগ গ্রেপ্তারে বাধাদান, ৩০৬ (৭) ধারায় ভীতি প্রদর্শন করে তোলাবাজি, ৩০৭ (৪) ধারায় আঘাত করে ডাকাতির চেষ্টা, ৩০৮ (৩) ধারায় ডাকাতির সময়ে হত্যা, ৩০৮ (৬) ধারায় ডাকাতদলে যুক্ত হলে, ৩১৪ (৫) সরকারি কর্মীর অপরাধমূলক বিশ্বাসভঙ্গে, ৩১৫ ধারায় চোরাই সামগ্রী নিলে, ৩২৪ ধারায় অগ্নিসংযোগে, ৩২৫ ধারায় রেল ও বিমান ধ্বংসে, ৩২৯ (৭) ধারায় কোনো বাড়িতে জোর করে প্রবেশের সময়ে গুরুতর আঘাত ঘটালে, ৩৩০ ধারায় অপরাধ ঘটাতে কোনো বাড়িতে অনুপ্রবেশ, ৩৩৬ ধারায় দলিলপত্র বিকৃত করা, ৩৩৭ ধারায় বিকৃত নথি রাখা, ৩৩৯ ধারায় জালিয়াতি করতে নকল সিল তৈরি বা রাখা, ৩৪১ ধারায় দলিল নষ্টে শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের কথা বলা হয়েছে।

নারী স্বাধীনতা নিয়ে বিচিত্ররকমের হইচই হলেও, বিগত দিনের ল কমিশনের সুপারিশ থাকলেও বৈবাহিক ধর্ষণ নিয়ে কিছু বলা নেই। খাপ পঞ্চায়েতের বিচার ও শাস্তিদানের ক্ষমতা নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের তীব্র নিন্দাসূচক রায় থাকলেও নতুন বিল এ সম্পর্কে নীরব। আবার নানা ধর্মে স্বীকৃত বিকল্প শাস্তি হিসাবে কমিউনিটি সর্ভিস নতুন বিলে যুক্ত হলেও, ঠিক কী ধরনের সর্ভিস দিতে হবে, কারাই বা ঠিক করবেন - তার কোনো ব্যাখ্যা নেই। ফলে স্বেচ্ছাচার ও নিষ্ঠুরতার প্রবল সম্ভাবনা।

একজন মহিলাকে তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে গর্ভপাত ঘটাতে বাধ্য করলে তাকে আইনের অধীনে শাস্তি দেওয়া উচিত এ বিষয়ে কোনো বিতর্ক নেই। তবে ‘‘গর্ভপাত ঘটানো’’ এবং ‘‘গর্ভাবস্থার চিকিৎসা সমাপ্তি’’ এর মধ্যে একটি স্পষ্ট পার্থক্য করা দরকার। ভারতীয় দণ্ডবিধি এবং প্রস্তাবিত ভারতীয় ন্যায়সংহিতার কোনোটাই গর্ভাবস্থায় একজন মহিলার তার শরীরের উপর নিয়ন্ত্রণের সুযোগ দেয় না। সত্যিকার অর্থে যদি ফৌজদারি আইনকে ঔপনিবেশিক ভাবনা থেকে মুক্ত করতে হয় বা যদি ফৌজদারি আইনের আধুনিকীকরণ করতে হয় তবে শুধুমাত্র বৈজ্ঞানিক ও চিকিৎসা ক্ষেত্রেই নয়, একজন মহিলার তার শরীরের উপর অধিকারের সাংবিধানিক বোঝাপড়াকেও সঠিকভাবে উপলব্ধি করা জরুরি।

এই সমস্যাকে সঠিকভাবে সমাধান করার জন্যে শুধুমাত্র মায়ের ইচ্ছার বিরুদ্ধে একটি অনাগত সন্তানের মৃত্যু ঘটানোকে যেমন অপরাধ হিসেবে গণ্য করতে হবে, অর্থাৎ ‘‘গর্ভপাত ঘটানো’’। তেমনি মায়ের ইচ্ছা অনুসারে বা তার সর্বোত্তম স্বার্থ বিবেচনা সাপেক্ষে গর্ভাবস্থার অবসানকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করা উচিত নয়। এই পার্থক্য বজায় রাখার জন্য দুটি কারণ রয়েছে - একটি বাস্তবসম্মত এবং একটি নীতিগত। ভারতীয় ন্যায়সংহিতা মূলত কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় দ্বারা পরিচালিত হয়। ফলে আইন পরিবর্তন বা পরিবর্ধনের নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে মূলত আইন-শৃঙ্খলার দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হয়, স্বাস্থ্য নয়। গর্ভাবস্থার চিকিৎসা কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রকের আওতার মধ্যে পড়ে। ফলে আইনে যেকোনো পরিবর্তন নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসা পেশার দৃষ্টিকোণ থেকে আসা উচিত। ফলে আইনে ‘‘গর্ভপাত ঘটানো’’ (miscarriage) এবং ‘‘গর্ভাবস্থার চিকিৎসার সমাপ্তি’’ (medical termination of pregnancy)-এর মধ্যে একটি স্পষ্ট রূপরেখা তৈরি করা উচিত।

প্রস্তাবিত তিনটি আইনের খসড়া তৈরিতে বিশেষজ্ঞ বা সাধারণ জনগণের খুব সীমিত সম্পৃক্ততার প্রকাশ পেয়েছে। বলার অপেক্ষা রাখে না, আইন তৈরিতে যাঁরা নির্বাচিত প্রতিনিধি তাঁদের উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ না থাকলে, তা যতটাই সুন্দর মনে হোক না কেনো, সমাজ বা সমাজ ব্যবস্থার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় না।