E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১০ নভেম্বর, ২০২৩ / ২৩ কার্তিক, ১৪৩০

‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিন’ থেকে

‍‌(জন রীড-এর জীবনীকারের ভাষ্য)

সূর্য মিশ্র


এইচ জি ওয়েলস লিখেছেন, ‘‘ইসলামের অভ্যুত্থানের পর রুশ বিপ্লবই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা।’’ হ্যারল্ড লাস্কির মতে আসলে এটা ছিল ‘‘খ্রিস্ট জন্মের পর সবচাইতে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা।’’ এই উদ্ধৃতিগুলো দিয়েই অ্যালবার্ট উইলিয়ামস ‘থ্রু দি রাশিয়ান রেভোলিউশন’ নামের গ্রন্থটি লেখা শুরু করেছিলেন। যাঁরা জন রীড-এর লেখা ‘দুনিয়া কাঁপানো দশদিন’ পড়েছেন, তার রুশ সংস্করণের (১৯২৩) বাংলা অনুবাদের শেষাংশে জন রীডের জীবনী পড়ে থাকবেন, এই জীবনীকারই হলেন অ্যালবার্ট উইলিয়ামস। অ্যালবার্ট এবং রীড সহ পাঁচজন আমেরিকাবাসী ১৯১৭ সালের ৭ নভেম্বর আমেরিকান সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কার্স পার্টির পক্ষে স্মোলনিতে অনুষ্ঠিত সো‍ভিয়েতগুলির মহা সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। এঁরা দু’জন বিপ্লবের আগে ও পরে একসাথে রুশ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরেছেন। রীড কিডনির অসুখ নিয়েই এসেছিলেন রাশিয়াতে। ১৯২০ সালের ১৭ অক্টোবর তাঁর জীবনাবসান হয়। তাঁর অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী ক্রেমলিনের দেওয়ালের গায়ে তাঁর সমাধির প্রস্তর ফলকে লেখা হয়েছিল, ‘‘জন রীড, তৃতীয় আন্তর্জাতিকের প্রতিনিধি, ১৯২০।’’ রুশ বিপ্লবের অভিজ্ঞতা নিয়ে উইলিয়ামস-এর লেখা পূর্বোক্ত পুস্তকে ‘লেনিনের সঙ্গে দশ মাস’ এবং অন্যান্য অংশের বিবরণ থেকে বোঝা যায় উইলিয়ামস রীডের আগে ও পড়ে অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ সময় রাশিয়াতে কাটিয়েছেন এবং লেনিন-স্তালিনের মৃত্যুর পরও তিনি সোভিয়েত ইউনিয়ন সফর করেছেন। তাঁর নিজের লেখায় ‘‘জনগণ - শ্রমিক এবং কৃষক - এঁরাই হলেন বিপ্লব।’’ তাই তাঁর লেখায় বার বার ঘুরে ফিরে আসে বিপ্লবে এদের ভূমিকা। তাঁর মতে ‘‘শেকসপিয়রের নাটক হ্যামলেট নিয়ে আলোচনা খোদ হ্যামলেটকে বাদ দিয়ে হয় না।’’ এই লেখার স্বল্প পরিসরে সেরকম দু-তিনটি বিষয় কেবল এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে।

জন রীড

‘লেনিনের সঙ্গে দশমাস’ দিয়েই শুরু করা যেতে পারে। নভেম্বর বিপ্লবের আগে ও পরে কিছু বাছাই-করা বিদেশি সাংবাদিক, যাঁরা মতাদর্শগতভাবে বলশেভিকদের পক্ষে ছিলেন লেনিন তাঁদের প্রায় প্রত্যেককেই চিনতেন এবং তাদের জন্য সময় দিতেন। বেশিরভাগটা শোনার জন্য তিনি নিজে খুব কম বলতেন। আলাপচারিতার মূল বাঁধা হচ্ছে ভাষা। লেনিন ইংরেজি বলতেন, উ‍‌ইলিয়ামসের মতে প্রায়শই কাব্যিক ঢঙে। কারণ বেশিরভাগটাই পড়ে শিখেছেন। তাঁর নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই লেনিন তাঁদের অন্য ভাষা শিখবার ও কথা বলবার পদ্ধতি-পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন প্রথম বিশেষ্য (noun) শব্দগুলি আয়ত্ত করতে হবে। তারপরে ক্রিয়াপদ। ওই ভাষায় কথা বলতে হবে, তারচেয়েও বেশি মন দিয়ে শুনতে হবে। অক্ষরজ্ঞান হলে পড়তে হবে। যেমন রুশ ভাষায় বলশেভিকদের পোস্টার-প্যামপ্লেট দিয়ে শুরু করতে হবে। নাওয়া-খাওয়ার সময় ছিল না। কমিউনে সকলের খাওয়ার বরাদ্দ সমান। লেনিন এত কঠোরভাবে তা অনুসরণ করতেন যে, তাঁর জন্য বরাদ্দের চেয়েও কম গ্রহণ করতেন। ড্রয়ারেই থাকত রুটি, লেখার সময় মাঝে মাঝে প্রায় অন্যমনস্কভাবে একটা কামড় দিয়ে আবার সেখানে রেখে দিতেন। অবস্থা এমন হতো, লেনিন একটু উঠে গেলেই ক্রুপস্কায়া এক-আধখানা রুটি সেখানে ঢুকিয়ে দিতেন। একদল কৃষক এসে তাঁদের খেতে ফলানো ফলমূল এবং অন্যান্য খাদ্যসামগ্রী দিয়ে লেনিনকে বলে গেলেন যে, তিনি কম খাচ্ছেন - এমনটা চলতে পারে না। বলা বাহুল্য - লেনিন ওসবে কান না দিয়ে কৃষকদের হালচাল সমস্যা নিয়ে খোঁজখবর নিয়ে অনেক প্রশ্ন করতেন। নিজে কম বলতেন, বেশিরভাগ সময় শুনতেই বেশি সময় ব্যয় করতেন। তাঁরা চলে যাওয়ার পর কৃষকদের আনা ফলমূল সব কমিউনের ভাঁড়ারে পাঠিয়ে দিতেন। তিনি আপাত শত্রু বিরোধীদের সঙ্গেও কথা বলতে কুণ্ঠাবোধ করতেন না। শুরুতে বলেই দিতেন, আমরা পরস্পর-বিরোধী হলেও দু-একটা বিষয়ে সহমত হতেই পারি। বলশেভিকদের কোনো এক সভায় লেনিনের কঠোর সমালোচনা হচ্ছে, বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে, লেনিন নিরুত্তাপ। একবার তো একটা কম্বল গোছের কিছু একটা নিয়ে এক কোণায় পেতে শুয়েই পড়লেন চোখ বুঁজে। শুধু কান খোলা রেখে। যখন তাঁর বলার সময় এলো, তিনি আগে থেকেই প্রস্তুত হয়ে গেছেন। অবশ্য এসব ঘটনার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ জন রীডের বইয়েই বেশি পাওয়া যায়। বলশেভিকদের সমর্থক বিদেশি সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের কাজ ছিল নিজ নিজ দেশে রাশিয়ার খবর ও অভিজ্ঞতা নিয়ে লেখা পাঠানো। এখানকার লিফলেট-পোস্টার অনুবাদ সহ নিজ নিজ দেশে পাঠানো। উইলিয়ামসের লেখায় লেনিন সম্পর্কে মোট আঠারোটি বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে, যা এখানে বিশদে আলোচনার সুযোগ নেই। এখানে কেবল লেনিনের সঙ্গে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাতের অভিজ্ঞতার কিছু অংশ উল্লেখ করা হচ্ছে।

অ্যালবার্ট উইলিয়ামস

প্রথম সাক্ষাতের দিনটি ছিল ৭ নভেম্বর, ১৯১৭, স্মোলনি হলে। এর আগে লেনিনের জীবনের দীর্ঘদিনই কাটাতে হয়েছে কারাবাসে ও সাইবেরিয়ায় নির্বাসনে, তারপর দেশ-দেশান্তরে অজ্ঞাতবাসে। মেনশেভিকরা প্রচার করে দিল স্বয়ং লেনিনের দেখা নেই, কোথায় লুকিয়ে আছেন? কংগ্রেসের প্রতিনিধিরাও চিন্তিত উৎকণ্ঠায় অপেক্ষায়। জনা ষাটেক বলশেভিক-বিরোধী তখন বেরিয়ে গেছে। অরোরা যুদ্ধ জাহাজ থে‍‌কে শীত প্রাসাদ কাঁপিয়ে কামান গর্জন শোনা যাচ্ছে। আসলে সেখানে কোনো গোলা আঘাত করেনি, কেরেনেস্কি তাঁর মন্ত্রীসভা সহ সেখানে অবরুদ্ধ, পালাবার পথ নেই। তার বেশ কিছু পরেই প্রেসিডিয়াম ঘোষণা করল - ‘এখন কমরেড লেনিন কংগ্রেসের উদ্দে‍‌শে ভাষণ দেবেন’। সঙ্গে সঙ্গে স্মোলনি উত্তাল হয়ে উঠল। তুমুল হর্ষধ্বনি, চিৎকার, স্লোগান, শেষ রাতের সবার ঝিমুনিটা কেড়ে নিলো। উইলিয়ামসের ভাষায় - ‘‘আমরা যারা কখনও দেখি‍‌নি তাঁরা লেনিনকে প্রথম দেখায় নিরাশই হলাম। ছোটোখাটো মানুষ টাক মাথায় চুল ও দাড়ি অবিন্যস্ত। তিনি বলা শুরু করলেন সাদামাটা নিরুত্তাপ কথা বলার ঢঙে - ‘কমরেডগণ, আমরা এখন সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার কাজ নিয়ে আলোচনা করব।’ কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো এক ঘণ্টার পরও অসীম ধৈর্যের সঙ্গে তা বুঝে নিচ্ছিলেন।’’ এককথায় সোভিয়েতগুলির হাতে সব ক্ষমতা এবং জমি, রুটি ও শান্তির দাবিগুলি অনুমোদিত হলো।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ছেড়ে যাবার দিন লেনিনের সঙ্গে শেষ সাক্ষাতের কথাও লিখেছেন উইলিয়ামস। সাক্ষাৎকারের সময় আগে থেকেই নির্দিষ্ট করা ছিল। লেনিন কঠোরভাবেই সময়ানুবর্তিতা মেনে চলতেন। কিন্তু দেড় ঘণ্টার মাথায় ডাক পড়ল। আসলে ঘরে ঢোকার আগেই লেনিন নিজে বেরিয়ে আসেন। বিলম্বের জন্য দুঃখ প্রকাশ করলেন। বললেন, তিনি একজন কৃষক প্রতিনিধির সঙ্গে কথা বলছিলেন। শুনছিলেন বলাই ভালো। এসবে তাঁর আগ্রহ খুঁটিনাটি জানবার চেষ্টা সবাই জানেন। যাইহোক, একগাদা জিনিস বোঝাই বাক্স যার মধ্যে বইপত্র, পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদিই বেশি উইলিয়ামসের জন্য প্রস্তুত করে রেখেছিলেন। যাতে এগুলো নিয়ে ফেরার পথে তাঁর (উইলিয়ামসের) কোনো অসুবিধা না হয় তার জন্য সংশ্লিষ্ট কমরেডদের মনে করিয়ে দিলেন।

উইলিয়ামসের লেখায় বেশিরভাগ অংশ দখল করে আছে শ্রমিক, কৃষক ও সৈনিকদের সোভিয়েতগুলির মানুষের অভিজ্ঞতার কথা। থেকেছেন ওদের সঙ্গেই, ওদের পরিবারে। তার মধ্যে একটা রেলযাত্রার অভিজ্ঞতা - ভিড়ে ঠাসাঠাসি, শীতের হাওয়া বন্ধ করার জন্য জানালা দরজা বন্ধ, সুটকেস নেবার অনুমতি নেই। তাঁর বেলায় অবশ্য কেউ আপত্তি করেনি, কিন্তু সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখলেন সুটকেসটি নেই। বড়ো চিন্তা হলো পাসপোর্ট ও অন্যান্য মূল্যবান কাগজপত্র নিয়ে। সেগুলো অবশ্য পরে ফেরত পাওয়া গিয়েছিল মস্কো পুলিশের কাছ থেকে। ট্রেন যাত্রা যেখান থেকে শুরু সেখানে তাঁকে অনেকদিন কাটাতে হয়েছিল। সেটা একটা মির বা কমিউন - যা নভেম্বর বিপ্লবের বহু আগে থেকেই চালু ছিল। আসল কথা হলো, এখানে সব কাজটা হতো যৌথভাবে। মার্কস এবিষয়ে গভীর চর্চা করেই তাঁর মৃত্যুর ঠিক আগে কমিউনিস্ট ইশ্‌তেহারে এঙ্গেলসের সঙ্গে যৌথ স্বাক্ষরে রুশ সংস্করণে উল্লেখ করেছেন। বলশেভিকদের সমস্যা হলো সেই মির বা কমিউনগুলিকে বিপ্লবের পর কৃষকদের সোভিয়েতের স্তরে কীভাবে উন্নীত করা হবে তা নিয়ে। সে নিয়ে কৃষকদের দ্বিধা-সংশয় এবং কিছু অংশের বিরোধিতাও ছিল। ওই মির থেকে উঠে আসা এক বলশেভিক সে যাত্রায় উইলিয়ামসের সঙ্গে ছিলেন। কী করে কৃষকদের সঙ্গে গভীর আত্মীয়তা গড়ে তুলে শেষ পর্যন্ত তাঁদের সমর্থন পাওয়া গেছিল, তার বিবরণ পাওয়া যায় এই অধ্যায়ে।

ট্রেন ও পরে মোটর যোগে ১৯১৭ সালের সেপ্টেম্বরে জন রীড ও বরিস রেইনস্টেনের সঙ্গে তাঁর রিগা ফ্রন্টে যাত্রার অভিজ্ঞতাটাও চমকপ্রদ। রিগা ফ্রন্টে যাবার অভিমুখে দক্ষিণে ভেনদেনের দিকে যাওয়ার পথে জার্মান কামান থেকে গোলা বর্ষণ শুরু হয়ে গেল। জন রীড-তো জেদ ধরেই বসলেন ওই গাঁয়েই যেতে হবে। গাড়ির সামনে ও পিছনে দু’টো বোমা পড়ল। রীডের চিন্তা নেই, বরং আহ্লাদে আটখানা। যাই হোক এরপর উইলিয়ামস একটা নৌ সৈনিকদের সোভিয়েতে অভিজ্ঞতার কথাও লিখেছেন। এই সোভিয়েতের মূল কেন্দ্র ‘পোলার স্টার’ নামক জাহাজে উঠলেন। বলা যায়, এই এলাকার নৌবহরের ওটাই ছিল কেন্দ্রীয়‌ কার্যালয়। এখানে রাসপুটিন থেকে জার - এককালের আধিপত্য তখন আর নেই। একজন প্রাক্তন নৌবাহিনী অফিসার কানে কানে বল‍‌লেন, দেখুন বলশেভিকদের কাণ্ডকারখানা। প্রায় ২৫ হাজার রুবলের মেহগনি কাঠের তক্তাগুলো পালিশ করা তো দূরের কথা। তার উপর হলুদ রঙ লাগিয়ে দিয়েছে। জাহাজের ক্যাপ্টেন তো কাচুমাচু হয়ে বললেন, এখন আর কোনো ক্ষমতা নেই। সৈনিক সোভিয়েতের কমিটিই সব ঠিক করে। ওই সৈনিক সোভিয়েতের নেতারা অপেক্ষা করছিলেন অভ্যর্থনা জানাতে। বললেন, আমরা রাশিয়ান মেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদী। কাজেই আমেরিকান কমরেডদের জন্য তাঁরা এই অভ্যর্থনার আয়োজন করেছেন।

পোস্টারে বলা হচ্ছেঃ কসাক তুমি কোন দিকে? আমাদের সাথে না ওদের?

শ্রমিক সোভিয়েতগুলিতে কারখানার মালিক শ্রমিকরাই। শ্রমিক ও সৈনিক সোভিয়েতগুলি নভেম্বর বিপ্লবের আগে থেকেই গড়ে উঠেছিল। সেদিক দিয়ে কৃষকদের মধ্যে এই কাজটা পিছিয়ে ছিল। জন রীডের ‘দুনিয়া কাঁপানো দশ দিনে’র মধ্যেই কৃষক কংগ্রেসে সোশ্যালিস্ট রেভোলিউশনারিদের আধিপত্য ভেঙে তাদের কীভাবে লেনিন তাঁর ভাষণের মধ্য দিয়ে সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা, শান্তি, রুটি আর জমির দাবিতে বলশেভিকদের পক্ষে টেনে এনেছিলেন তার বিশদ বর্ণনা রয়েছে। শ্রমিক সোভিয়েতগুলি সম্পর্কে এখানে বিশদে যাবার অবকাশ নেই। তাঁদের একজন বলশেভিক নেতার বাড়িতে উইলিয়ামসের থাকার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তাঁর স্ত্রী বলশেভিকদের সক্রিয় সমর্থক। কিন্তু তাঁর স্বামীর মতো নাস্তিক নন। তার উপাসনা স্থলে কিন্তু একটি লাল তারা শোভা পাচ্ছিল। রাশিয়ার মানুষ তখন শা‍‌ন্তি চাইছিল। প্রথম বিশ্বযুদ্ধে হতাহত সৈনিকদের বড়ো অংশই ছিলেন কৃষক পরিবারের। শ্রমিক ও বিশেষত সৈনিকরাতো ছিলেনই। জার তারপরে মেনশেভিকদের কেরেনেস্কি সরকার জার্মানির সঙ্গে‍‌ বৈঠকে কী নিষ্পত্তি হয়েছিল তা কখনও খোলসা করে বলেনি। ট্রটস্কির বিরোধিতা সত্ত্বেও লেনিনের নেতৃত্বে বলশেভিকরা শান্তির জন্য কোনো অপ্রকাশ্য চুক্তি নয়, প্রকাশ্য চুক্তির মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠার দাবি তুলেছিলেন এবং তা কার্যকরী হয়েছিল। কিন্তু বাকি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি এবং তাদের অনুগামী য়ুঙ্কার, শ্বেত সন্ত্রাসবাদী ও ব্রিটেন, ফান্স সহ সাম্রাজ্যবাদী পৃষ্ঠ‍‌‍‌পোষক সতেরোটি দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল। বহু জীবন ও সমাজতন্ত্রের দিকে যাত্রার শুরুতেই তীব্র অর্থনৈতিক সংকটের বোঝার বিনিময়ে শেষ পর্যন্ত সমাজতন্ত্রই জয়যুক্ত হয়েছিল। জার সাম্রাজ্যের পরাধীন জাতিগুলি মুক্ত হয়েছিল। তাদের দেশগু‍‌লিতে নিজেদের স্বপ্নের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে স্বাধীন বিকাশের জন্য, বিচ্ছিন্ন হবার অধিকার বজায় রেখেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়ন গড়ে তুলেছিল। লেনিনের মৃত্যুর পর স্তালিনের নেতৃত্বে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ট আগ্রাসনকে পরাস্ত করে রাইখস্ট্যাগে লাল পতাকা উড্ডীন করেছিল। স্তালিনের মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভের নেতৃত্বে সংশোধনবাদ ও সর্বশেষ সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টিকে বেআইনি ঘোষণা করে গর্বাচেভ কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন নয়, পূর্ব ইয়োরোপের দেশগু‍‌লিতে সমাজতন্ত্র উৎখাত করে গৃহযুদ্ধ ও ভাঙন ডেকে এ‍‌নেছিলেন। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেই লেনিনের মূল থিসিস ‘সাম্রাজ্যবাদ পুঁজিবাদের সর্বোচ্চ স্তর’কে অস্বীকার করে দুনিয়ার ভারসাম্য সাম্রাজ্যবাদের অনুকূলে বদলে দিয়েছে। মানব সভ্যতার ইতিহাসের চাকা পিছনের দিকে ঘোরানো যায় না। মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূল শিক্ষাগুলি অনুসরণ করে একবিংশ শতাব্দীর নির্দিষ্ট পরিস্থিতির নির্দিষ্ট বিশ্লেষণের ভিত্তিতে মতাদর্শ, রাজনীতি, সংগ্রাম ও সংগঠন হলো বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবার একমাত্র হাতিয়ার।