E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১০ নভেম্বর, ২০২৩ / ২৩ কার্তিক, ১৪৩০

জাতিবিদ্বেষ আর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মুক্তির দিশারি নভেম্বর বিপ্লব

সুদীপ সেনগুপ্ত


‘‘সে রামও নেই, সে অযোধ্যাও নেই! তোদের সাধের সোভিয়েত ইউনিয়ন তো ভেঙেচুরে গিয়েছে ৩০ বছরেরও আগে। এখনও তোরা সেই ঘিয়ের গন্ধ শুঁকে যাবি! নভেম্বর আসলেই নভেম্বর বিপ্লব নিয়ে মাতামাতি করিস কেন?’’

প্রতিবছর এই এক ধরনের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হয় বিশ্বের প্রায় সমস্ত কমিউনিস্টকে।

এবছর নভেম্বর বিপ্লবের ১০৭তম বর্ষ। অন্যান্য বছরের মতো এবারও আমরা নভেম্বর বিপ্লব বার্ষিকী উদ্‌যাপন করছি। নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সোভিয়েত ইউনিয়ন বা সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার অবলুপ্তি ঘটেছে এ কথা ঠিকই, যে ১৫টি রিপাবলিক নিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়েছিল, সেই ১৫টি রিপাবলিকই আজ পৃথক পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে, সোভিয়েত ব্যবস্থার অবলুপ্তি ঘটেছে, সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে গেছে। নভেম্বর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যে সমস্ত ভূখণ্ডে সর্বপ্রথম সমাজতান্ত্রিক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সেখানে নতুন করে ‘গণতন্ত্র’র নামে কায়েম হয়েছে বুর্জোয়া স্বৈরতন্ত্র। তারই মধ্যে দুই প্রধান শক্তি রাশিয়া আর ইউক্রেনের যুদ্ধ চলছে বিগত ৬২০ দিন ধরে। দুই দেশের দ্বন্দ্ব শত্রুতা দেখে মনে হয় যেন এই বিরোধ চলছে আবহমানকাল ধরে!

অথচ বিবিসি’র সাংবাদিক ডিনা নিউম্যান ২০১৬ সালে ইউক্রেনের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট লিওনিদ ক্রাভচুক, বেলারুশের সাবেক প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচের সঙ্গে কথা বলে আমাদের শুনিয়েছিলেন সেই অত্যাশ্চর্য কাহিনি - ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়নের তিনটি প্রজাতন্ত্র - রাশিয়া, ইউক্রেন এবং বেলারুসের নেতারা সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে বের হয়ে যাওয়ার জন্য গোপনে একটি চুক্তিতে সই করেছিলেন ১৯৯১ সালের ডিসেম্বর মাসে। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে, বাকি প্রজাতন্ত্রগুলোকে কিছু না জানিয়েই তারা এটি করেছিলেন। বৈঠকটি হয়েছিল পশ্চিম বেলারুসে। ডেকেছিলেন বেলারুসের প্রেসিডেন্ট স্তানিস্লাভ শুশকেভিচ। তার সঙ্গে যোগ দেন রাশিয়ার নেতা বরিস ইয়েলৎসিন এবং ইউক্রেনের লিওনিদ ক্রাভচুক।’’

বৈঠক শুরু হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তির ব্যাপারে সমঝোতার প্রথম পরিচ্ছদটি লিখতে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।

‘‘আমার জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই লাইনটি আমি মনে রাখব। এটি ছিল আমাদের সমঝোতার শুরুর লাইন। কোনো ধরনের তর্কাতর্কি ছাড়াই এই লাইনটির ব্যাপারে আমরা একমত হয়েছিলাম। লাইনটি ছিল এরকমঃ ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা এবং আন্তর্জাতিক আইনের বিষয় হিসেবে ইউনিয়ন অব সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিকস বা ইউএসএসআর-এর কোনো অস্তিত্ব আর নেই।’’ - শুশকেভিচ!

এর পরের কয়েক ঘণ্টায় চুক্তির মোট ১৪টি অনুচ্ছেদ গৃহীত হয়। রাত তিনটে নাগাদ তৈরি হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়নের বিলুপ্তি ঘোষণার কাগজপত্র। তখন পুরো বিশ্বকে সেটা জানানোর পালা। বেলারুসের নেতা শুশকেভিচ বলেন, ‘‘ইয়েলৎসিন এবং ক্রাভচুক কৌতুক করে আমাকে বললেন, আমরা দু’জন মিলে আপনাকে মনোনীত করেছি গর্বাচভকে বিষয়টি জানানোর জন্য। তখন আমি হেসে বললাম, মিস্টার ইয়েলৎসিন, আমি আর ক্রাভচুক মিলে আপনাকে মনোনীত করছি আপনার প্রিয় বন্ধু প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশকে ফোন করার জন্য।’’

বাস্তবিকই সেইদিন গর্বাচভ এবং বুশকে জানানো হয় সেই ঘোষণাপত্রের কথা একইসাথে। শেষ পর্যন্ত তিনটি আঞ্চলিক পার্লামেন্টই এই সমঝোতা অনুমোদন করে। এর পরের কয়েক সপ্তাহ ধরে সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্য প্রজাতন্ত্রগুলোও এতে যোগ দেয়। ১৯৯১ সালের ২৫ ডিসেম্বর প্রেসিডেন্ট গর্বাচভ পদত্যাগ করেন। এর মধ্য দিয়ে বিলুপ্ত হয়ে যায় সোভিয়েত ইউনিয়ন। ঘরে ও বাইরের ষড়যন্ত্রকারীদের যুগপৎ প্রচেষ্টার সাফল্যের মধ্য দিয়ে।

‘কখনো সময় আসে, জীবন মুচকি হাসে।’ আজ সেই সমস্ত ‘বন্ধু প্রজাতন্ত্র’ স্বাধীন দেশের তকমা গায়ে শুধুমাত্র জাতিদাঙ্গায় বিধ্বস্ত নয়, একে অপরের সাথে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত। আর অন্যদিকে সেই মার্কসের কথায় ‘প্রতিবাদহীন প্রতিরোধহীন বিশ্বে লাগামহীন উন্মত্ত ঘোড়ার মতো লাফালাফি করা সাম্রাজ্যবাদের’ মূর্তি দেখে ভীত সন্ত্রস্ত মানুষ আবার নতুন করে অনুধাবন করছে নভেম্বর বিপ্লবের তাৎপর্য।

ব্যক্তিগত ভোগবাদ নয়, সামাজিক মূল্যবোধ - এই মতাদর্শকেই তো ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছিল নভেম্বর বিপ্লব। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রের বিপ্লবই শুধু নয়, চিন্তাধারার ক্ষেত্রে, শ্রমিকশ্রেণির মতাদর্শের ক্ষেত্রেও এ এক বিপ্লব।

বিশ্বজুড়ে প্রতিটি মেহনতি মানুষের প্রকৃত মানুষ হওয়ার দিগ্‌দর্শন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আজ আর নেই, কিন্তু নভেম্বর বিপ্লবের আগে ১১টি সাম্রাজ্যবাদী দেশ যে ১০৭টি দেশকে শৃঙ্খলিত করে রেখেছিল, পরাধীন করে রেখেছিল আজ ওই সমস্ত দেশই সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলমুক্ত। নভেম্বর বিপ্লবের পরেই দেশে দেশে স্বাধীনতা আন্দোলন দুর্বার হয়ে ওঠে, পুরোনো ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা ভেঙে পরে। নভেম্বর বিপ্লবই সারা বিশ্বের সংগ্রামী মানুষকে প্রকৃত মুক্তির স্বাদ দেয়।

তার পাশাপাশি নভেম্বর বিপ্লবকে অস্বীকার করা মানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফ্যাসিস্ত শক্তির নৃশংস তাণ্ডব থেকে বিশ্ব সভ্যতাকে মুক্ত করবার মরণজয়ী সংগ্রামে অবিসংবাদিত নেতা সোভিয়েতের ভূমিকাকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করা। ইতিহাসকেই অস্বীকার করবার প্রচেষ্টা।

আমরা ভুলি কী করে ১৯৪৫ সালের ১ মে সোভিয়েত লালফৌজের কাছে হিটলারের ফ্যাসিস্ত বাহিনী আত্মসমর্পণ করার পরেই ৯ মে (৮ মে গভীর রাতে) সম্মিলিত মিত্র বাহিনী - সোভিয়েত, ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে জার্মান বাহিনীর সর্বাধিনায়ক উইলহেলম্ কাইটেল আত্মসমর্পণ করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়। প্রায় দুই কোটি প্রাণের বিনিময়ে সোভিয়েতের অকুতোভয় লড়াই-ই প্রধানত পর্যুদস্ত করে হিংস্র ফ্যাসিস্ত বাহিনীকে।

অথচ যখন ১৯৪১ সালের ২২ জুন তারিখে অনাক্রমণ চুক্তি ভেঙে হিটলার সোভিয়েত ইউনিয়নের উপর আকস্মিক ঝাঁপিয়ে পড়লেন, কয়েক হাজার জার্মান বিমান বিমানক্ষেত্রগুলোর উপর বোমাবর্ষণ করল অতর্কিতে, হাজার হাজার ট্যাঙ্ক সীমান্তের বাঁধা চূর্ণ করে এগিয়ে এলো, তাদের পিছনে পিছনে সোভিয়েত ভূখণ্ডে প্রবেশ করলো লক্ষ লক্ষ সৈন্য, হিটলার দাবি করেছিলেন, “দুনিয়ার ইতিহাসে এত বড়ো সামরিক অভিযান আর কখনো হয়নি” বার্লিন, লন্ডন আর ওয়াশিংটনের ধারণা ছিল, সমগ্র সোভিয়েত এক মাসের ঝটিকা-আক্রমণের ফলে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে। হিটলার বড়াই করে বলেছিলেন, ৯০ লক্ষ লোক রণাঙ্গনে নেমেছে, আরও বহু লক্ষ লড়াই করার অপেক্ষায় প্রস্তুত হয়ে আছে।

প্রাথমিক বিহ্বলতা কাটিয়ে ফ্যাসিস্তদের পর্যুদস্ত করতে লড়াইয়ের ময়দানে নামতে দ্বিধা করেনি কমরেড স্তালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েতের সাধারণ মানুষ। প্রকৃত অর্থেই এই যুদ্ধ পরিণত হয় সমগ্র সোভিয়েত জনগণের যুদ্ধে।

জার্মানরা সদ্য ইয়োরোপ জয় করে এসেছিল। একের পর এক দেশ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল জার্মানদের আক্রমণের মুখে। কমরেড স্তালিন প্রথম থেকেই তাই মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির ভিত্তিতে সমগ্র পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ করে এই মহান যুদ্ধ পরিচালনা করেন। আর যে বিষয়গুলির ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয় সেগুলি হলো (১) এই মহান যুদ্ধে যে কোনো পদ্ধতিই হোক না কেন সোভিয়েত ইউনিয়নের সমস্ত মানুষকে সমবেত করা; (২) লালফৌজকে যথার্থ অর্থে শক্তিধর ফৌজে রূপান্তরিত করা এবং (৩) ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সংহতি গড়ে তোলা।

মিত্রবাহিনীর অন্যান্য নেতৃত্ব যখন যুদ্ধে দ্বিতীয় ফ্রন্ট খুলতে গড়িমসি করেছে প্রায় দুই বছর ধরে, সোভিয়েতকে তার ফল ভোগ করতে হয়েছে একাকী জার্মান, ফিনল্যান্ড, রোমানিয়া, ইতালি এবং হাঙ্গেরির সম্মিলিত ফ্যাসিস্ত বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করে, তখনও একদিকে মস্কো-স্তালিনগ্রাদ সহ সোভিয়েত ভূখণ্ডে অভূতপূর্ব লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ত বাহিনীকে আটকে রাখবার পাশাপাশি স্তালিন বারংবার বলে গিয়েছেন এই মরণপণ সংগ্রামের উদ্দেশ্য, লালফৌজের মহান দায়িত্ব, ফ্যাসিস্ত বাহিনীকে কেবলমাত্র সোভিয়েত ভূখণ্ড থেকে বিতাড়ন করা নয়, ইয়োরোপীয় ভূখণ্ডে যে সমস্ত অঞ্চলে ফ্যাসিস্ত শক্তি জনগণের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে সেখান থেকেও জার্মান ফ্যাসিস্তদের বিতাড়ন করা। সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও স্বাধীনতার সপক্ষে এবং ফ্যাসিস্ত সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সেদিন যেভাবে বিশ্ব জনমত সংগঠিত হয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল ঘটনা।

স্তালিন নিজেই বলেছেন, ‘‘সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে আজ যে আন্তর্জাতিক যোগসূত্র তৈরি হয়েছে তা আর পূর্বে লক্ষ করা যায়নি। এই যোগসূত্র দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে, শক্তিশালী হচ্ছে। বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষ আজ জার্মান ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়েছেন। বিশ্বের প্রতিটি শান্তিপ্রিয় মানুষের দৃষ্টি আজ সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে। স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব এবং আত্মমর্যাদার জন্য সমস্ত সোভিয়েত জনগণ যে মরণজয়ী সংগ্রাম পরিচালনা করেছেন সেই সংগ্রাম আজ বিশ্বের সকল প্রগতিশীল মানুষের কাছে প্রশংসিত। এই সংগ্রামের বিজয় বিশ্বে স্বাধীনতা এবং প্রগতির শক্তিকে উৎসাহিত করবে, উদ্দীপিত করবে।’’

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত জয়ের মুহূর্তেও সেই কারণেই কমরেড স্তালিন বারেবারে ঘোষণা করেছিলেন যে, এই জয় মেহনতি মানুষের জয়, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষের জয়।

সোভিয়েত ইউনিয়নকে অস্বীকার করবার অর্থ এই মহান গণসংগ্রামকে অস্বীকার করা, যা সমগ্র পৃথিবীটাকে রক্ষা করেছিল উন্মত্ত দানবের হাত থেকে।

আজও তাই একদিকে যখন পুঁজিবাদের সংকটের মাঝে বিভিন্ন দেশে দেশে নব্য ফ্যাসিবাদীদের উত্থান, আমাদের দেশেও আরএসএস’র প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে মোহন ভাগবতের পৈশাচিক ঘৃণা বর্ষণকারী ভাষণ, তখন নতুন করে প্রতিদিন নভেম্বর বিপ্লব আর সেই বিপ্লব থেকে প্রতিষ্ঠিত সোভিয়েতের মহান ভূমিকার কথা বারবার স্মরণ করা প্রয়োজন।