৬১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১০ নভেম্বর, ২০২৩ / ২৩ কার্তিক, ১৪৩০
দলিত স্বার্থ ও হিন্দুত্ব
শঙ্কর খেলো
হাজার হাজার বছর ধরে ভারতীয় সমাজকে পীড়িত করেছে সম্পূর্ণরূপে প্রতিক্রিয়াশীল বর্ণ এবং বর্ণপ্রথা। বিশ্বের একমাত্র দেশ ভারতই, যেখানে এই ধরনের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এবং এখনও আছে। বর্ণ ও বর্ণপ্রথা পবিত্র করা হয়েছিল হিন্দু ধর্ম এবং বৈদিক শাস্ত্রের সমন্বয়ে। এটি তার একত্রীকরণের প্রধান কারণ ছিল। তথাকথিত পাঠ্য মনুস্মৃতি তৎকালীন প্রচলিত সামাজিক রীতিনীতিগুলিকে সংহিতাবদ্ধ করে। এবং শূদ্র, অতিশূদ্র তৎসহ নারীদের সম্পূর্ণরূপে অসম ও দুর্বিষহ অস্তিত্বে পতিত করেছিল। বর্ণপ্রথার স্বতন্ত্রতা ছিল। এটি ছিল বংশগত, বাধ্যতামূলক এবং অন্তঃবিবাহ। সামাজিক নিপীড়ন এবং জাতিভেদ ব্যবস্থার দ্বারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে দলিত বা অতিশূদ্র বা তফশিলি জাতি। ভারতে আদিবাসীরাও যুগে যুগে সামাজিক নিপীড়নের সম্মুখীন হয়েছে, ভিন্নভাবে। রামায়ণে রামের শূদ্র শম্বুক হত্যা এবং মহাভারতে দ্রোণাচার্যের কৌশলগতভাবে প্রাপ্ত একলব্যের ‘বুড়ো আঙুল’ - গল্পগুলি প্রাচীন ভারতে হিন্দু-সমাজের অসমতাবাদী প্রকৃতির ধ্রুপদি (Classic) সাক্ষ্য।
দলিত কারা
মারাঠি সাহিত্য থেকে ‘দলিত’ শব্দটি এসেছে। এর অর্থ হলো - দমন করা বা বলপূর্বক দমিয়ে রাখা। এই নিরিখে দলিত হলো এমন এক জাতিগোষ্ঠী বা জনগোষ্ঠী যারা সমাজের উচ্চবর্ণ দ্বারা অবদমিত। সংস্কৃত কিংবা হিন্দি ভাষায় শব্দটির অর্থ হচ্ছে ‘ভগ্ন’ বা ‘ছিন্নভিন্ন’। এই দৃষ্টিকোণ থেকে দলিত হলো চতুর্বর্ণ ব্যবস্থা বহির্ভূত একটি বর্ণ, যা ‘পঞ্চমা’ নামেও পরিচিত। সাধারণভাবে ভারতীয় হিন্দু সমাজব্যবস্থায় অধিকারবিহীন, পিছিয়ে পড়া, সার্বিকভাবে অনুন্নত সম্প্রদায়ই ‘দলিত’ নামে পরিচিত। এরা সর্বতই ছিল উচ্চবর্ণের মানুষের দ্বারা অবহেলিত, পদদলিত।
১৯৩৫ সালের পূর্বে ব্রিটিশ রাজের জনগণনার শ্রেণি বিভাজনের সময়ের দলিত শব্দটি ‘শোকগ্রস্ত শ্রেণি’ (Depressed Class) বলে উল্লেখ করা হতো। ডঃ বি. আর. আম্বেদকর জাতি-বর্ণ নির্বিশেষে সমস্ত শোকগ্রস্ত লোককে দলিত সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করেন।
ভারতে দলিত শব্দের সরকারি ব্যবহারকে ‘অসাংবিধানিক’ আখ্যা দেওয়া হয়। এবং ‘অনুসূচিত জাতি’ শব্দের ব্যবহারকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। বর্তমানে দলিতরা হিন্দু ধর্ম, বৌদ্ধ ধর্ম, শিখ ধর্ম, খ্রিস্টধর্ম এবং বিভিন্ন লোকধর্ম সহ বিভিন্ন ধর্মীয় বিশ্বাসকে বিশ্বাস করে। ২০১১ সালের ভারতের জনগণনা অনুযায়ী দলিতদের সংখ্যা ২০.১৪ কোটি যা ভারতের জনসংখ্যার প্রায় ১৬ শতাংশ। এই সম্প্রদায় কেরলে ‘এজহারা’, আমিলনাডুতে ‘নাদার’, মহারাষ্ট্রে ‘মাহার’ দিল্লিতে ‘বাল্মিকী’, পাঞ্জাব, উত্তর প্রদেশ ও ছত্তিশগড়ে ‘চামার’ বাংলায় ‘নমশূদ্র’ এবং সরকারি পরিভাষায় ‘তফশিলিভুক্ত জাতি’ নামে পরিচিত।
হিন্দু ও হিন্দুত্ব
‘হিন্দু’, ‘হিন্দ্’, ‘ইন্ডিয়া’ শব্দগুলির ব্যুৎপত্তি আমাদের জ্ঞাতব্য। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে পারস্য সম্রাট দরায়ুস বর্তমান সিন্ধু অঞ্চলকে নাম দিয়েছিলেন ‘হিন্দু’ বা ‘হিদু’। বিতস্তা (ঝিলম), বিপাশা, শতদ্রু এবং আধুনিক নামে পরিচিত রাভী ও চেনাব, সিন্ধুনদের এই পঞ্চশাখাকে এবং যমজ ভগিনীর মতো গঙ্গা ও যমুনাকে নিয়ে যে সপ্তসিন্ধু বিদেশিকে মুগ্ধ করেছিল, তাই থেকেই ‘হিন্দু’ নামের উদ্ভব। গ্রিকরা এসে সিন্ধুকে বলত ‘ইন্ডস্’, (Indos)। খ্রিস্ট- পরবর্তী প্রথম শতাব্দীতে চীনা ইতিবৃত্তে এ দেশকে বলা হয়েছে ‘তিয়েন্-চু’ (Tien-tu) কিংবা ‘চুয়ান্-তু’ (Chuan-tu) - এই শব্দেরও উদ্ভব ‘সিন্ধু’ থেকে। অষ্টম শতাব্দীতে চীনা পরিব্রাজক ইৎসিং লিখে গেছেন যে, এদেশের শুধু উত্তরাঞ্চলের লোক ‘হিন্দু’ নামে অভিহিত, অন্যত্র এ নাম তারা নিজেরাই জানে না।
ভারতের স্বাধীনতার পর আরএসএস (রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ) তার আদর্শকে সমাজের বিভিন্ন অংশে নিয়ে যাওয়ার জন্য বেশ কয়েকটি সহযোগী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে। তাদের মধ্যে অন্যতম হলো ভিএইচপি (বিশ্ব হিন্দু পরিষদ), যেটি ১৯৬৪ সালে হিন্দু ধর্মের সুরক্ষা ও প্রচারের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আরএসএস এবং তার সহযোগী সংগঠনগুলো একত্রে ‘সঙ্ঘ পরিবার’ নামে পরিচিত। এবং এদের দ্বারা পরিচালিত রাজনৈতিক দল হলো বিজেপি (ভারতীয় জনতা পার্টি)। ১৯৮৯ সালে পালামপুর রেজুলেশনে এই বিজেপি আনুষ্ঠানিকভাবে হিন্দুত্বকে তার আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিল।
বিজেপি দাবি করে যে, হিন্দুত্ব ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ এবং ‘ভারতীয় জাতিত্ব’-র ধারণার প্রতিনিধিত্ব করে। আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের মতে, এটি ‘ভারতের পরিচয়’। অপরদিকে, ‘হিন্দুত্ব’ হলো একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ যা হিন্দু জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক ন্যায্যতা এবং ভারতের মধ্যে হিন্দু আধিপত্য প্রতিষ্ঠার বিশ্বাসকে অন্তর্ভুক্ত করে। - এই রাজনৈতিক মতাদর্শটি ১৯২২ সালে বিনায়ক দামোদর সাভারকর প্রণয়ন করেন।
বর্তমান ভারতে কেমন আছে দলিতরা
ভারতে দলিত হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর ২০১৪ সালের পর নির্যাতন ও বৈষম্য আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় বেড়েছে। ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রিসার্চ ব্যুরো-র তথ্য মতে, বিগত বছরের তুলনায় বর্তমান বছরে উত্তর প্রদেশে দলিতদের বিরুদ্ধে অপরাধ বেড়েছে ২৫ শতাংশ। হরিয়ানা ও গুজরাটেও নির্যাতনের হার বৃদ্ধি পেয়েছে। India Today-র জরিপকৃত বিশ্লেষণ বলছে, প্রতি ১৫ মিনিটে ভারতে দলিতদের বিরুদ্ধে একটি করে অপরাধ সংঘটিত হয়। এবং বিগত ১০ বছরে দলিত নির্যাতন বেড়েছে ৬৬ শতাংশ। দলিত সম্প্রদায়ের জীবনমান নিয়ে ২০১১ সালের আদমসুমারিতে দেখা গেছে ৬০ শতাংশ দলিত কোনো অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিতে পারছে না। ৫৩.৬ শতাংশ দলিত শিশু অপুষ্টির শিকার। ২০ শতাংশ দলিত বিশুদ্ধ পানীয় জল ও স্যানিটেশন ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে না। ১৯৮৯ সালে তফশিলি জাতি ও আদিবাসী (SC & ST)-দের বিরুদ্ধে সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য যে আইন করা হয়েছিল তা ২০১৮ সালের এপ্রিলে আদালতের একটি রায়ের মাধ্যমে বাতিল করে দেওয়া হয়। India Today-র ভাষ্যমতে, এই আইনটি ছিল উচ্চবর্ণের হিন্দুদের নির্যাতন থেকে বাঁচতে দলিতদের নিরাপত্তা ঢাল। ভারতের ক্ষমতাসীন দলের রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ মূলত উচ্চবর্ণের হিন্দুদের প্রতিনিধি। এই আইন বাতিলের পেছনে তারাই মূল ভূমিকায় ছিল বলে বিশ্লেষকদের মত। দলিতদের ওপর নির্যাতনের এই খড়্গ ক্ষমতাসীনদের আচরণে আরও স্পষ্ট হয়। ২০১৬ সালে বিজেপি নেতা দয়াশংকর সিং দলিত নেত্রী মায়াবতীকে ‘পতিতার চেয়েও খারাপ’ বলে মন্তব্য করেছিলেন। ২০১৮ সালের ৩০ মার্চ তৎকালীন মন্ত্রীসভার সদস্য বিজেপি নেতা অনন্ত কুমার হেগড়ে প্রকাশ্যে দলিতদের কুকুরের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সঙ্গে দলিতদের সাক্ষাতের সময় পরিষ্কার হতে সাবান-শ্যাম্পু দেওয়া হয়।
উদারীকরণ নীতির প্রভাবে গরিব মানুষের অবস্থা
আমাদের দেশের শাসকশ্রেণির উদারীকরণ, বেসরকারিকরণ এবং বিশ্বায়নের সাম্রাজ্যবাদী নির্দেশিত নীতির সূত্রপাতের ফলে দলিত, আদিবাসী, অন্যান্য অনগ্রসর জাতি এবং সামগ্রিকভাবে গরিব শ্রমজীবী জনগণের সমস্যাগুলি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বেসরকারিকরণের উদ্যোগ সরাসরি তফশিলি জাতি ও আদিবাসীদের জন্য সংরক্ষণকে আঘাত করেছে। হাজার-হাজার কলকারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় লক্ষ-লক্ষ বেকার যুবক-যুবতী কর্মহীন হয়ে পড়েছে। এবং এটি দলিত ও অন্যান্য অনগ্রসর জাতিকেও আঘাত করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের ক্রমবর্ধমান বাণিজ্যিকীকরণ সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে পশ্চাদপদ অংশের অসংখ্য গরিব মানুষকে এই গুরুত্বপূর্ণ খাত থেকে দূরে সরিয়ে রেখেছে। এই পটভূমিতে, বেসরকারি ক্ষেত্রে সংরক্ষণ অত্যন্ত অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। কারণ, এই সময়কালে এসসি/এসটি-দের মধ্যে বেকারত্ব উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই নীতিগুলির সবচেয়ে বিপর্যয়কর প্রভাব দেখা দিয়েছে গভীর কৃষি সংকটে, যা গ্রামীণ ক্ষেত্রকে পীড়িত করেছে। গ্রামীণ কর্মসংস্থান দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে এবং এতে দলিত, আদিবাসী সহ মহিলাদের সবচেয়ে বেশি আঘাত হানছে। কৃষির যান্ত্রিকীকরণ সমস্যাটিকে আরও জটিল করে তুলেছে। কৃষক-শ্রমিকদের প্রকৃত মজুরি যাদের একটি বড়ো অংশ দলিত, অনেক রাজ্যে কমে গেছে। ন্যূনতম মজুরি আইন যেখানে বিদ্যমান সেখানেও তা বাস্তবায়নের কোনো প্রচেষ্টা করা হয় না। করা হয় না ন্যূনতম মজুরির পর্যায়ক্রমিক সংশোধনও। গণবণ্টন ব্যবস্থা (পাবলিক ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম) ভেঙে ফেলার ফলে ক্ষুধা বেড়েছে উদ্বেগজনক অনুপাতে। বিভিন্ন রাজ্যে হাজার-হাজার শিশুর অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর একটি অপ্রতিরোধ্য অনুপাত দলিত এবং আদিবাসী পরিবার থেকে। প্রায় ৯০ শতাংশ দলিত গ্রামাঞ্চলে বাস করে। অর্থনৈতিক শোষণ তাদের সবচেয়ে তীব্র সমস্যা। তারা প্রায় সকলেই প্রান্তিক কৃষক বা ভূমিহীন শ্রমিক। ভারতের বিভিন্ন অংশে বিপুল সংখ্যক গরিব মানুষ শহরে বা শ্রমহীন গ্রামীণ এলাকায় চলে যায়। এভাবেই নয়া উদারনীতি দেশে অর্থনৈতিক এবং সামাজিক বিভাজন উভয়কেই জোরদার করেছে।
ভূমিসংস্কারঃ দলিত স্বার্থবাহী একটি পদক্ষেপ
পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরায় বামফ্রন্ট সরকার এবং কেরালায় বাম-গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট সরকারগুলি তাদের অগ্রাধিকার কাজ হিসেবে ভূমিসংস্কারকে গ্রহণ করেছিল। তারা পঞ্চায়েতি রাজকে শক্তিশালী করে এটাকে একত্রিত করেছে। তৎকালীন সময়ে রাজ্যে অর্পিত ১৩.৮১ লক্ষ একরেরও বেশি কৃষি জমির মধ্যে ১০.৬৯ লক্ষ একর জমি ২৬.৪৩ লক্ষ মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়েছিল। বিস্ময়ের বিষয় হলো যে, ৫৬ শতাংশ সুবিধাভোগী তফশিলি জাতি এবং আদিবাসীদের অন্তর্গত। এটা জনসংখ্যায় তাদের অনুপাতের প্রায় দ্বিগুণ। বিতরণ করা জমির মধ্যে ৪.৪৮ লক্ষ পাট্টা পুরুষ ও মহিলাদের যৌথভাবে বণ্টন করা হয়েছিল। এবং ৫২,০০০ পাট্টা বিশেষভাবে মহিলাদের জন্য। এটা একটা উল্লেখযোগ্য রেকর্ড যে, দেশের মোট সিলিং উদ্বৃত্ত জমির ১৮ শতাংশ এবং দেশের মোট বণ্টিত জমির ২০ শতাংশ শুধুমাত্র পশ্চিমবঙ্গে।
এর পাশাপাশি, প্রায় ১৫ লক্ষ ভাগচাষির অধিকার রেকর্ড করা হয়েছে। এর মধ্যে ১১.০৮ লক্ষ একর জমি ছিল এবং ৫.৪৪ লক্ষ দরিদ্র পরিবারকে বসতভিটার জমি দেওয়া হয়েছিল। নথিভুক্ত ভাগচাষিদের ৪২ শতাংশের বেশি তফশিলি জাতি, তফশিলি আদিবাসীদের অন্তর্ভুক্ত। সেই সময় বামফ্রন্ট সরকারের গৃহীত ভূমিসংস্কার এবং অন্যান্য পদক্ষেপের ফলস্বরূপ, কৃষি উৎপাদন ২৫০ শতাংশ বা তার বেশি বৃদ্ধি পেয়েছিল।
আর এখন, সেই মানুষগুলো বহুবিধ আক্রমণের শিকার। ধর্মীয় মেরুকরণ এবং বিভাজনের রাজনীতি এদের দিশেহারা করে দিচ্ছে। এই তীব্র অর্থনৈতিক শোষণ ও সামাজিক পীড়নের বিরুদ্ধে সমন্বিত শ্রেণি আন্দোলন ও গণআন্দোলন গড়ে তুলতে হবে। এবং এর মাধ্যমে আগামীদিনে রাজ্যে শ্রেণি ভারসাম্য পরিবর্তনের কাজে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিগুলিকে কেন্দ্র-রাজ্যের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করতে হবে আমাদেরই।
‘হিন্দুত্ব’-র বিরুদ্ধে দলিতদেরই লড়তে হবে
আরএসএস এবং বিজেপি-র হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূল ভিত্তি হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ তথা মনুবাদী উপাদান। সেই নিরিখে, দলিত-আদিবাসী মানুষের বিরুদ্ধে মনুবাদী জাতিবিদ্বেষ আজ প্রকাশ্যেই। সঙ্গে রয়েছে সংখ্যালঘু মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষের রাজনীতি। আমাদের রাজ্যে সংঘ পরিবারের এই জঘন্য কার্যকলাপকে সহায়তা করে চলেছে রাজ্যের শাসকদল।
সঙ্ঘ প্রধান মোহন ভাগবত স্পষ্টতই জানিয়ে দিয়েছেন যে, ‘হিন্দুত্ব’ এবং ‘চতুর্বর্ণ’ একে অপরের পরিপূরক। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষত মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যেভাবে সঙ্ঘ পরিবারের আক্রমণ চলছে, তাতে দলিত সম্প্রদায় যেন তাদের প্রতি একটু বেশিই বিশ্বস্ত হয়ে উঠছে। এই সম্প্রদায় মনে করছে, আমরা দলিতরা, তো হিন্দু। সুতরাং, ২০২৪ সালে কেন্দ্রে বিজেপি- সরকার গঠিত হলে আমাদের লাভই হবে।
প্রথমত, ২০২৪ সালে কেন্দ্রে যদি বিজেপি একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে তাহলে, ভারতে সংবিধানের জায়গা নিতে চলেছে ‘মনুসংহিতা’। এই ‘মনুসংহিতা’-য় নারী, দলিত, আদিবাসী সবাই ঘৃণ্য এবং ব্রাত্য। এতে উল্লিখিত চতুর্বর্ণের মধ্যে শূদ্র সম্প্রদায়কে ‘মানুষ’ বলেই স্বীকার করা হয়নি। এরা জন্মেছে শুধু উচ্চবর্ণের সেবা করার জন্য। শূদ্ররাই দলিত। কেবলমাত্র ভোট বৈতরণী পার হওয়ার জন্য বিজেপি নেতৃত্বের দলিত-প্রীতি।
দ্বিতীয়ত, এবার বিজেপি ক্ষমতাসীন হলে ভারতের নির্বাচনী ব্যবস্থাটা হয়তো পালটে যেতে পারে। সেক্ষেত্রে, হয়তো ‘জনগণ দ্বারা নির্বাচিত’-র পরিবর্তে ‘দলীয় মনোনীত’ ব্যবস্থা আসবে। তখন হয়তো আমাদের চোখের ঠুলি খসে পড়বে। কিন্তু করার জন্য তখন আর বাকি কিছু থাকবে না।
তাই, মতাদর্শগত ও সাংগঠনিক উপকরণ প্রস্তুত করার জন্য সক্ষম ব্যক্তিদের এগিয়ে আসতে হবে। উদ্যোগ কিন্তু শুরু হয়েছে। হিন্দুত্ববাদীরা যেভাবে যুক্তিহীনতা ও অপবিজ্ঞানকে প্রসারিত করছে তাকে মোকাবিলা করার জন্য যুক্তিবাদের ওপর প্রতিষ্ঠিত ধর্মনিরপেক্ষ বৈজ্ঞানিক মননকে প্রসারিত করতে হবে। মনে রাখতে হবে সামাজিক বঞ্চনা ও সামাজিক অবদমনের বিরুদ্ধে সংঘটিত লড়াইয়ে আমাদের সামনের সারিতে থাকতে হবে। সংঘ পরিবারের মনুবাদী, সাম্প্রদায়িক পুঁজিবাদী বিপদের বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই হবে সামাজিক ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার অভিমুখ। সাথে সাথে ভারতীয় সমাজব্যবস্থার বহুত্ববাদী দিককে তুলে ধরে এমন সাংস্কৃতিক কর্মসূচিও আমাদের সংগঠিত করতে হবে।