৬১ বর্ষ ১৩ সংখ্যা / ১০ নভেম্বর, ২০২৩ / ২৩ কার্তিক, ১৪৩০
অরণ্যে আবাসস্থলের অধিকার ও অরণ্যবাসীরা
তপন মিশ্র
বইগা উপজাতি সম্প্রদায়।
কয়েকদিন আগে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে এমন একটা ছোট্ট খবরের কথা আলোচনা করি। খবরটি আমাদের খুব একটা আকর্ষিত করেনি। ছাত্তিশগড়ের ‘বইগা’ আদিবাসীদের সে রাজ্যের সরকার আবাসস্থলের অধিকার (হ্যাবিটাট রাইটস) বা অরণ্যে একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের জন্য বিভিন্ন ধরনের বাস্তুতান্ত্রিক অধিকার প্রদান করেছে। আমাদের দেশে এমন অনেক উপজাতির মানুষ আছেন যারা সম্পূর্ণভাবেই অরণ্য নির্ভর। আদিম যুগ থেকে এরা অরণ্যের বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে একীভূত হয়ে আছেন। ২০০৬ সালে অরণ্য অধিকার আইন সংসদে পাস হওয়ার সময়ে কেবল ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত অধিকার দেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। পরে অর্থাৎ ২০১২ সালে আবাসস্থলের অধিকারের আইন সংশোধনীর মাধ্যমে যুক্ত করা হয়। কিন্তু প্রায় এক দশকের বেশি সময় পরও এই আইনের সুযোগ পিছিয়ে-পড়া অরণ্যবাসীরা পাননি। অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের উপর নিবিড়ভাবে নির্ভরশীল দেশের ৭৫টি উপজাতির ক্ষেত্রে বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার একেবারেই উদাসীন।
হ্যাবিটাট রাইটস কী?
অরণ্য অধিকার আইন [The Scheduled Tribes and Other Traditional Forest Dwellers (Recognition of Forest Rights Act) 2006] অরণ্যবাসীদের বেশকিছু অধিকার প্রদান করে। ইউপিএ-১ সরকারের আমলে এই আইন অনেক আলোচনার মধ্যদিয়ে সংসদে গৃহীত হয়। বামপন্থীদের অবদান এক্ষেত্রে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ব্রিটিশ আমলে তৈরি অরণ্য আইন (ইন্ডিয়া ফরেস্ট অ্যক্ট-১৯২৭) অরণ্যবাসীদের অরণ্যের সঙ্গে সমস্ত ধরনের সম্পর্ক হরণ করে। এগুলি হলো জীবিকা, সংস্কৃতি এমনকী স্বাস্থ্যের জন্য অরণ্য নির্ভরশীলতা ইত্যাদি। ফলে অন্যায়ভাবে গড়ে ওঠা এই বিচ্ছিন্নতাকে ‘ঐতিহাসিক অপরাধ’ হিসাবে চিহ্নিত করে অরণ্য অধিকার আইন তৈরি হয়। প্রথম অবস্থায় যে অধিকারগুলি দেওয়া হয় সেগুলির মধ্যে ‘আবাসস্থলের অধিকার’ অন্যতম। যে সম্প্রদায়কে এই অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হয়, প্রথাগতভাবে তাদের বসবাসের অঞ্চল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক এবং তাদের অরণ্য নির্ভর জীবিকার অধিকার আইনতভাবে স্বীকৃত হয়।
আবাসস্থলের অধিকারের মধ্যদিয়ে অরণ্যের জৈববৈচিত্র্য এবং বাস্তুসংস্থানের সঙ্গে যুক্ত পরম্পরাগত জ্ঞান, প্রাকৃতিক সম্পদের ব্যবহার সম্পর্কে ঐতিহ্যগত জ্ঞান সংরক্ষণ এবং তারসাথে এই সম্পদগুলির ব্যবস্থাপনা ও সংরক্ষণের সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্টদের অধিকার প্রদান করা হয়। যুগ যুগ ধরে এই উপজাতির মানুষরা অরণ্য ও তার সঙ্গে যুক্ত প্রাকৃতিক সম্পদ রক্ষা করে আসছে। অরণ্য অধিকার আইন অনুযায়ী এটাই লক্ষ্য ছিল যে, পারটিকুলারলি ভালনেরেবল ট্রাইবাল গ্রুপ - পিভিটিজি বা বিশেষভাবে দুর্বল উপজাতিগোষ্ঠীভুক্তদের এই অধিকার প্রদানের মধ্যদিয়ে তাদের ক্ষমতায়ন করা যাবে।
১৯৭৩ সালে ‘ধেবর কমিশন’ আদিম উপজাতি গোষ্ঠী (প্রিমিটিভ ট্রাইবাল গ্রুপ - পিটিজি)-কে একটি পৃথক বিভাগ হিসাবে সনাক্ত করে। যারা উপজাতি গোষ্ঠীগুলির মধ্যে কম উন্নত তাদেরই পিটিজি বলা হয়। ২০০৬ সালে ভারত সরকার পিটিজি-দের মধ্যে যারা বিশেষভাবে দুর্বল উপজাতি গোষ্ঠী তাদের পিভিটিজি হিসাবে চিহ্নিত করে। অরণ্য অধিকার আইনের ৩(১)(ই) [যেখানে উল্লেখ করা আছে যে ‘Rights including community tenures of habitat and habitation for primitive tribal groups and pre-agricultural communities’] ধারা অনুযায়ী ছত্তিসগড় সরকার গত ১০ অক্টোবর বইগা আদিবাসীদের এই অধিকার প্রদান করে। অরণ্য আধিকার আইনের ২(এইচ) ধারায় হ্যাবিটাট বা আবাসস্থল কথাটির সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সংজ্ঞা অনুযায়ী - “প্রাক-কৃষি সম্প্রদায়ের আদিম উপজাতি গোষ্ঠী এবং অরণ্যে বসবাসকারী তফসিলি উপজাতিরা যে সংরক্ষিত অরণ্য (রির্জাভ ফরেস্ট) বা প্রোটেক্টেড অরণ্যে প্রথাগতভাবে বসবাস করে সেই বনাঞ্চলকে তাদের আবাসস্থল (হ্যাবিটাট) হিসাবে চিহ্নিত করা যাবে।” এই অধিকারের ফলে অরণ্যবাসীরা যে অরণ্য বাস্তুতন্ত্রের অংশ তা প্রতিষ্ঠিত হওয়া সম্ভব।
অরণ্য অধিকার আইন অনুযায়ী বর্তমানে তিন ধরনের অধিকার বনবাসীদের দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। এগুলি হলো - ব্যক্তিগত অধিকার, কমিউনিটি অধিকার বা গোষ্ঠীগত অধিকার এবং হ্যাবিটাট বা আবাসস্থলের অধিকার। ২০১২ সালে অরণ্য অধিকার আইনের এক সংশোধনীর মধ্যদিয়ে আবাসস্থলের অধিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এই অধিকার সেই সমস্ত উপজাতি সম্প্রদায়কে দেওয়া হয় যারা একদিকে পিভিটিজি এবং অন্যদিকে সংবেদনশীল। এর কারণ তাদের জনসংখ্যা যেমন ক্রমশ কমে যাচ্ছে এবং একইভাবে তাদের সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে।
পিভিটিজি কারা?
আমাদের দেশের আইন অনুযায়ী যে সমস্ত উপজাতি সম্প্রদায় প্রযুক্তি ব্যবহারের দিকদিয়ে অনেকটা পিছিয়ে আছে, যাদের জনসংখ্যা বৃদ্ধি অনেকটা স্থবির হয়েছে বা ক্রমহ্রাসমান, সাক্ষরতার হার অত্যন্ত কম, অর্থনৈতিকভাবে অনেকটা পিছিয়ে কারণ তারা তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কেবল একটি বাস্তুতন্ত্রের উপর নির্ভর করে তারাই পিভিটিজি-র অন্তর্ভুক্ত। এদের স্বাস্থ্যের সূচকগুলি অনেকটা নিচের দিকে এবং তারা মূলত বিচ্ছিন্ন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছোটো এবং বিক্ষিপ্ত গ্রামে বা বাসস্থানে বসবাস করে। পিভিটিজি-রা প্রাক-কৃষি সম্প্রদায় অর্থাৎ এরা কৃষি প্রযুক্তি সম্পর্কে ভালভাবে পরিচিত নয়। এরা এখনও, কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে, সংগ্রাহক এবং শিকারী সম্প্রদায় হিসাবে পরিচিত। ভারত সরকারের উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রক দেশে ১৮টি রাজ্য এবং একটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলে, উপরে উল্লেখিত সূচকগুলির ভিত্তিতে ৭৫টি পিভিটিজি-কে চিহ্নিত করেছে। বইগা সম্প্রদায় ছত্তিসগড়ের রাজনন্দগাঁও, কাওয়ার্ধা, মুঙ্গেলি, গৌরেলা-পেন্দ্র-মারওয়াহি বা জিপিএম, মানেন্দ্র-ভারতপুর-চিরমিরি বা এমবিসি এবং বিলাসপুর জেলায় বসবাস করে। তবে এই সম্প্রদায়ের বিস্তৃতি মধ্যপ্রদেশের সংলগ্ন জেলাগুলিতেও রয়েছে। এই উপজাতির মানুষরা অধিক সংখ্যায় রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশে, ওডিশায়, ছত্তিশগড়ে, মধ্যপ্রদেশে এবং আন্দামান-নিকোবরে। পশ্চিমবাংলায় লোধা, টোটো এবং বিরহোর পিভিটিজি সম্প্রদায়ভুক্ত।
কীভাবে একটি আবাসস্থল ঠিক করা হয়?
২০১২ সালে সংশোধনীর পর ২০১৪ সালে ভারত সরকারের ট্রাইবাল অ্যাফেয়ার মন্ত্রক (এমওটিএ) বিশদ আইনগত পদ্ধতি ঘোষণা করে। এর পর ২০১৫ সালে মধ্যপ্রদেশে ভারিয়া উপজাতি (পিভিটিজি)-কে প্রথম আবাসস্থলের অধিকার দেওয়া হয়। এই পদ্ধতি অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘ। রাজ্যের চারটি মন্ত্রক যেমন বন, রাজস্ব, উপজাতি এবং পঞ্চায়েতিরাজ একযোগে পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতার মধ্যদিয়ে আবাসস্থল ঘোষণার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করে। তারপর কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমোদন দরকার হয়। মধ্যপ্রদেশের ভারিয়া উপজাতিদের পর ছত্তিসগড়ের ‘কামার’ উপজাতি এবং এখন ছত্তিশগড়ে বইগা উপজাতি এই অধিকার পায়।
বইগাদের আগে কামারদের অধিকার
কামার উপজাতি, ছত্তিশগড়ের আর একটি পিভিটিজি যাদের বন অধিকার আইনের অধীনে আবাসস্থলের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। উপজাতি বিষয়ক মন্ত্রকের খসড়া নির্দেশিকাগুলির উপর ভিত্তি-করে একটি ব্যাপক সমীক্ষার-পরে ৯ আগস্ট বিশ্ব আদিবাসী দিবসে এই ঘোষণা করা হয়। ছত্তিসগড়ের ধামতারি জেলার অরণ্যের কামার উপজাতি অধ্যুষিত ২২টি বসতিকে এই অধিকারের শংসাপত্র প্রদান করা হয়।
কামার উপজাতি এই রাজ্যের প্রথম পিভিটিজি যারা এই অধিকার পায় এবং এই পদক্ষেপ অরণ্য এবং আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ও জীবিকা সংরক্ষণের দিকদয়ে একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। বইগারা হলো দেশের তৃতীয় পিভিটিজি এবং ছত্তিসগড়ের দ্বিতীয় পিভিটিজি যারা এই অধিকার পেয়েছে।
কেন এই বঞ্চনা?
৭৫টির মধ্যে এপর্যন্ত ভারতে মাত্র তিনটি উপজাতি আবাসস্থলের অধিকার পেয়েছে। এরা হলো মধ্য প্রদেশের ভারিয়া উপজাতি এবং ছাত্তিসগড়ের কামার এবং বইগা উপজাতি। প্রাথমিকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ১৯টি গ্রামে ১,০৮৫টি পরিবারের ৬,৪৮৩ জন উপজাতি মানুষকে বইগা বাসস্থানের অধিকার দেওয়া হয়েছে।
আবাসস্থলের অধিকারের প্রাপ্তির ফলে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী পিভিটিজি গোষ্ঠীদের তাদের আবাসস্থলকে ক্ষতিকর উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড যেমন খনি, কারখানা, জলাধার ইত্যাদি তৈরি করা থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করবে। ব্যক্তিগত সম্পত্তির মালিকানা থাকবে না ঠিকই, কিন্তু যেকোনো উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য সংশ্লিষ্ট জনজাতি অধ্যুষিত গ্রামসভার সম্মতি এবং পরামর্শের প্রয়োজন হবে। এগুলি বাদে অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০), ২০১৩ সালের ভূমি অধিগ্রহণ আইন, এমনকী এসসি/এসটি প্রিভেনশন অফ আট্রোসিটিজ আইনের সমস্ত সুরক্ষা সহ পিভিটিজি-রা অরণ্য অধিকার আইন ২০০৬-এর বিশেষ সুবিধা পাবেন। সর্বোপরি যদি কোনো ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ড তাদের আবাসস্থলের অধিকারকে বাধা দেয় তাহলে সংশ্লিষ্ট আদিবাসী গোষ্ঠী বন অধিকার আইনের অধীনে বিষয়টি প্রশাসনের কাছে নিয়ে যেতে পারে এবং সমাধান না হলে বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতে পারে।
এই কারণে সরকার আতঙ্কিত। এই অধিকার দেওয়ার পর অরণ্যের সেই অংশে জমি অধিগ্রহণ সরকারের পক্ষে একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে। মুনাফার জন্য যে সমস্ত করপোরেট গোষ্ঠী খনি, কারখানা ইত্যাদি স্থাপন করবে তাদের কাছে পরিবর্তিত অরণ্য (সংরক্ষণ) আইন-২০২৩ যতটা সহজ হওয়ার কথা, আবাসস্থলের অধিকার প্রদত্ত হলে ততোটা সহজ থাকবে না। একারণে পিভিটিজি সহ অরণ্যবাসী-আদিবাসীদের যতটা কম অধিকার প্রদান করা যায় ততোটা সরকার এবং করপোরেটদের পক্ষে মঙ্গল।
ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রাম এবং ইন্টারগভর্মেন্টাল প্যানেল ওন ক্লাইমেট চেঞ্জ-এর বিজ্ঞানীদের সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ হলো - বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং অতিমারীর প্রাদুর্ভাবকে আটকাতে হলে একমাত্র উপায় হলো প্রাকৃতিক আবাসস্থলগুলির সংরক্ষণ এবং পুনর্জীবন। অরণ্যবাসীদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা অসম্ভব। তাই মাটির নিচে সম্পদ থাকলেও সময়ের দাবি হলো - প্রাকৃতিক বাস্তুতন্ত্র রক্ষার স্বার্থে এগুলিতে হাত না দেওয়া। কিন্তু সরকার সেপথে হাঁটছে না। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলি এ ব্যাপারে উদাসীন। দেশের মূল ভূখণ্ডের কথা বাদই দিলাম, কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল যেমন আন্দামান নিকোবর দ্বীপপুঞ্জের জারোয়া, ওঙ্গে, শম্পেন এবং সেন্টিনেলরা এখনও এই ধরনের অধিকার থেকে বঞ্চিত। দেশের মূল ভূখণ্ডে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চল বক্সওয়াহা, ওডিশার নিয়ামগিরি ইত্যাদি অঞ্চলে সরকারি মদতে আদিবাসী উচ্ছেদ বৃদ্ধি পাচ্ছে।