৫৯ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ২৪ ভাদ্র, ১৪২৮
২৭শে সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধ
মুজফ্ফরপুরে সুবিশাল কিষান মজদুর মহাপঞ্চায়েতের ঘোষণা
রাজ্য বামফ্রন্টের সমর্থন
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকে ভারত বন্ধ হবে ২৭ সেপ্টেম্বর। ৫ সেপ্টেম্বর মুজফ্ফরনগরে অনুষ্ঠিত কৃষক মজদুর মহাপঞ্চায়েত থেকে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। এদিনের মহাপঞ্চায়েত আহ্বান জানিয়েছে, সর্বত্র পরাস্ত করতে হবে বিজেপি-কে। বিজেপি সরকারই আমাদের এক নম্বর শত্রু। তাই শাস্তি দিতে হবে বিজেপি-কে। আগামী বছরের শুরুতেই উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ডের নির্বাচন। এই দুই রাজ্যেই বিজেপি-কে হারানোর জন্য ‘মিশন উত্তর প্রদেশ এবং উত্তরাখণ্ড’ ঘোষণা করেছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা। মহাপঞ্চায়েতের ডাকা এই ধর্মঘটকে সমর্থন জানাল রাজ্য বামফ্রন্ট। ৭ সেপ্টেম্বর বামফ্রন্টের পক্ষ থেকে একটি বিবৃতি দিয়ে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর সংযুক্ত কিষান মোর্চার ডাকা সর্বভারতীয় ধর্মঘটকে পশ্চিমবঙ্গে সমর্থনের ঘোষণা করা হয়েছে। বিবৃতিতে জানানো হয়েছে সংযুক্ত কিষান মোর্চা যেসব দাবিতে সারা ভারত ধর্মঘটের আহ্বান জানিয়েছে সেই সব দাবিকে বামফ্রন্ট সমর্থন করছে। পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র গ্রাম-শহরের এই ধর্মঘটে প্রত্যক্ষভাবে বামফ্রন্ট অংশগ্রহণ করবে। রাজ্যবাসীর কাছে বামফ্রন্টের আবেদন এই ধর্মঘটে শামিল হন এবং ধর্মঘটকে সফল করুন।
প্রসঙ্গত, গত ২৬ ও ২৭ আগস্ট সিঙ্ঘু সীমান্তে অনুষ্ঠিত সংযুক্ত মোর্চার দু’দিনের কনভেনশন থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধের ডাক দেওয়া হয়েছিল। সেখানেই স্থির হয়েছিল ৫ সেপ্টেম্বর উত্তর প্রদেশের মুজফ্ফরনগরে হবে কিষান মজদুর মহাপঞ্চায়েত। এই মহাপঞ্চায়েত থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে ২৫ সেপ্টেম্বরের পরিবর্তে ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধ হবে। সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম) ঘোষণা করেছিল, মুজফ্ফরনগরের মহাপঞ্চায়েত লাখো কৃষকের সমাবেশে ঐতিহাসিক আকার নেবে। এদিন সমস্ত প্রত্যাশা ছাপিয়ে অন্তত ১০ লক্ষ কৃষকের সমাবেশ হয়েছে মুজফ্ফরনগরে। এদিন শহরের সমস্ত গলিতে, মহল্লায়, পথেঘাটে কৃষকদের প্লাবন নামে। শুধু পশ্চিম উত্তর প্রদেশই নয়, রাজ্যের সমস্ত জেলা থেকেই কৃষকরা যোগ দিয়েছিলেন এই মহাপঞ্চায়েতে। এছাড়া অন্যান্য রাজ্য থেকেও যেমন প্রতিনিধিত্বমূলক উপস্থিতি থেকেছে, তেমনি সংলগ্ন রাজ্য রাজস্থান, হরিয়ানা, পাঞ্জাব এবং উত্তরাখণ্ড থেকে অগণিত কৃষক এসেছেন এদিনের মহাপঞ্চায়েতে। বিশেষ করে হরিয়ানা ও পাঞ্জাব থেকে জমায়েত ছিল চোখে পড়ার মতো।
২০১৩ সালে এই মুজফ্ফরনগরে এমনই এক কৃষক পঞ্চায়েত ডেকে পশ্চিম উত্তর প্রদেশে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা বাঁধিয়েছিল হিন্দুত্ববাদীরা। যা ক্রমশ গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে মেরুকরণকে তীব্র করেছিল। যা থেকে ভোটে লাভবান হয়েছিল বিজেপি।
গত ৫ সেপ্টেম্বর সেই মুজফ্ফরনগরেই জাঠ-মুসলিম কৃষক একইসঙ্গে ট্রাক্টর-ট্রলিতে করে এসেছেন। মাথায় টুপি পড়ে মুসলিম কৃষকরা রাস্তার ধারে দূর থেকে আসা কৃষকদের হাতে সাধ্যমতো জল খাবার তুলে দিয়েছেন। জাঠদের সঙ্গে একই ট্রাক্টরে আসা মুসলিম যুবকদের উপর বজরঙ দলের আক্রমণের অপচেষ্টাকে জাঠরাই রুখে দিয়ে তাদের মেরে তাড়িয়েছে। সব মিলিয়ে অভূতপূর্ব ঐক্যের চেহারা পরিস্ফুটিত হয়ে উঠেছিল এদিনের মহাপঞ্চায়েতে।
এদিন সংযুক্ত কিষান মোর্চা (এসকেএম)-র পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে একদিকে কেন্দ্র, অন্যদিকে বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলির সরকারের বাধাকে উপেক্ষা করে মহাপঞ্চায়েতে আসার জন্য কৃষকদের অভিনন্দন জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে মহাপঞ্চায়েত থেকে ফিরে সমগ্র দেশে কৃষক আন্দোলনের বার্তা ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে। এসকেএম বলেছে, মুজফ্ফরনগরে কিষান মজদুর মহাপঞ্চায়েত ঐতিহাসিক দিন হিসেবেই চিহ্নিত হয়ে থাকবে। কৃষক আন্দোলনের ঐতিহাসিক মঞ্চ থেকে কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিল এবং ফসলের ন্যূনতম সহায়কমূল্য দেওয়া নিশ্চিত করার দাবিও জানানো হয়েছে।
সংযুক্ত কিষান মোর্চার পক্ষ থেকে এদিন সর্বত্র বিজেপি-কে হারানোর আহ্বান জানানো হয়। সংযুক্ত কিষান মোর্চা শুধু দিল্লিতে নয়, সব জেলাতে ছড়িয়ে পড়বে বলেও বক্তারা প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সংযুক্ত কিষান মোর্চার পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, আগামী দিনে আমাদের সামনে দু’টো কাজ। প্রথমত, ২৭ সেপ্টেম্বর ভারত বন্ধকে সর্বাত্মক চেহারা দেওয়া। দ্বিতীয়ত, আগামী দিনগুলিতে কৃষক আন্দোলনকে আরও ছড়িয়ে দেওয়া। আগামী ১১ এবং ১২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ এই লক্ষ্যে লক্ষ্ণৌয়ে বৈঠকে বসবেন বলে জানানো হয়েছে এদিনের সমাবেশ থেকে।
সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে সারা ভারত কৃষক সভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেছেন, আমাদের দেশের মানুষের সব থেকে খারাপ অবস্থা হয়েছে মোদী সরকারের সাত বছরে। মোদী সকলের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। তিন কৃষি আইন এবং চার শ্রমকোড এনেছে এই সরকার। যা কৃষক এবং শ্রমিকদের সর্বনাশ করবে। গরিব, মহিলা, তপশিলি জাতি, আদিবাসী সব অংশের মানুষের সঙ্গেই এই সরকার প্রতারণা করেছে। মোদী বলেছিলেন, কৃষকদের সঙ্গে দূরত্ব একটা ফোন কলের। কিন্তু কৃষকদের সঙ্গে এগারোটা মিটিং করার পরও সমাধান মেলেনি। সংসদে কৃষি আইন নিয়ে আলোচনা করা হচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী লালকেল্লায় দাঁড়িয়ে কৃষকদের নিয়ে বাণী দিচ্ছেন। সেখানে দাঁড়িয়ে অজস্র মিথ্যা কথা বলছেন। তিনি বলেন, কৃষকদের আত্মবলিদান ব্যর্থ হবে না। এই সরকারকে কৃষি আইন বাতিল করতেই হবে।
সমাবেশে বক্তব্য রাখতে গিয়ে এসকেএম নেতা রাকেশ টিকায়েত বলেন, এখানে আর বিজেপি-কে দাঙ্গা করতে দেব না। মোদী-যোগী-অমিত শাহ সব বহিরাগত, এদের এখান থেকে জিততে দেব না। উত্তর প্রদেশের মাটিতে এরাই দাঙ্গা করিয়েছে। এখানে হিন্দু-মুসলিম ঐক্যবদ্ধ ছিল, থাকবে। এটা আমাদের জেলা, আমাদের রাজ্য, আমাদের দেশ। মোদী-যোগী কৃষকদের ধোঁকা দিয়েছে। গোটা দেশে বেসরকারিকরণ হচ্ছে। এর ফলে মানুষের রোজগারের পথ বন্ধ হচ্ছে। কৃষকরা সঙ্কটে, শ্রমিকরাও সঙ্কটে।
এদিনের কিষান মজদুর মহাপঞ্চায়েতে অন্যান্যদের মধ্যে বক্তব্য রেখেছেন, বলবীর সিং রাজেওয়াল, ডঃ দর্শন পাল, যোগীন্দর সিং উগ্রাহান, যোগেন্দ্র যাদব, গুরনাম সিং চারুনি, মেধা পাটেকর, আশিস মিত্তাল, যশবীর কাউর, জগমতি সাঙওয়ান সহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
এদিনের এই কিষান মজদুর মহাপঞ্চায়েত সমাজের বিভিন্ন অংশের বিপুল সমর্থন পেয়েছে। জিআইসি গ্রাউন্ডে আয়োজিত এদিনের মহাপঞ্চায়েতে হাজার হাজার কৃষক ঢুকতেই পারেননি। মাঠের বাইরে দাঁড়িয়েই তাঁরা বক্তব্য শোনেন। এই মহাপঞ্চায়েতে পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, কেরালা, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র প্রভৃতি রাজ্যের কৃষক-মজদুররাও এসেছিলেন। ছিলেন যুবক-যুবতী কৃষক এবং মহিলারা।
এদিন কৃষকরা তেরঙ্গা ঝান্ডা সহ বিভিন্ন কৃষক-শ্রমিক সংগঠনের ঝান্ডা নিয়ে এসেছিলেন সমাবেশে। সমাবেশ থেকে মুহুর্মুহু বিজেপি-আরএসএস বিরোধী স্লোগান উঠেছে। এদিনের মহাপঞ্চায়েতে কয়েকশো লঙ্গর, মেডিক্যাল ক্যাম্প এবং ভ্রাম্যমান স্বাস্থ্যশিবিরের আয়োজন করা হয়েছিল।
এদিনের মহাপঞ্চায়েত ছিল কেন্দ্র ও রাজ্যের বিজেপি সরকারের কাছে হুঁশিয়ারি। ধর্ম, জাত, বর্ণের বিভাজনকে ঘুচিয়ে দিয়ে এদিনের বিশাল কৃষক সমাবেশের পরও যদি কেন্দ্র তিন কৃষি আইন বাতিল ও ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ঘোষণা না করে তাহলে দেশজুড়ে আরও বৃহত্তর আন্দোলন গড়ে তোলার কথা ঘোষণা করেছেন নেতৃবৃন্দ।