৫৯ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ২৪ ভাদ্র, ১৪২৮
বিশ্বভারতী ও ছাত্রআন্দোলন
অমিতাভ সেনগুপ্ত
বিশ্ববিদ্যালয় থাকবে, অথচ ছাত্র আন্দোলন থাকবে না, এটা এক প্রকার অসম্ভব। ছাত্রছাত্রীদের দাবিদাওয়া ও প্রতিবাদ ধ্বনিত হবেই। বিশ্বভারতীও এর বাইরে নয়। বিশেষত যখন থেকে এটি কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হয়েছে তখন থেকেই এখানে মূলত বাম-ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছে, তা অভ্যন্তরীণ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হোক বা দেশে-বিদেশে ঘটে যাওয়া ঘটনার প্রেক্ষিতেই হোক। স্বাভাবিকভাবেই দক্ষিণপন্থী শাসকরা তা দমন করার জন্য বিভিন্ন উপায় অবলম্বন করেছে এবং সুচতুর উপায়ে তাকে চাপা দেওয়ার চেষ্টার ত্রুটি করেনি। অনেকটা রবীন্দ্রনাথের ‘অচলায়তন’ এর মতোই। আজ ২০২১ সালেও তার ব্যতিক্রম ঘটবে, এটা ভাবা বাতুলতা মাত্র। তাই আর কথা না বাড়িয়ে এবার আমরা বর্তমানে এখানকার ছাত্র আন্দোলনের দিকে তাকাই।
এখনকার ছাত্র আন্দোলন ব্যাখ্যা করতে গেলে আমাদের চলে যেতে হবে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে, নাগপুরের আরএসএস’র কেন্দ্রীয় কার্যালয় থেকে বিশেষ পরামর্শ নিয়ে এখানকার উপাচার্য পদে যোগ দিলেন অধ্যাপক বিদ্যুৎ চক্রবর্তী। আসল লক্ষ্য এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৈরিকীকরণ। এসেই বুঝে নিলেন বাম ছাত্র সংগঠন এখানে সক্রিয়, তাই প্রথমেই ভরতি থেকে শুরু করে ছাত্রদের বিভিন্ন বিষয়ে ৩০০ থেকে ৪০০ শতাংশ খরচ (ফিস)বাড়িয়ে দেওয়া হলো। প্রথমেই আঘাত রবীন্দ্রনাথের নীতি-আদর্শকে। এর প্রতিবাদে গর্জে উঠল শান্তিনিকেতন। ওই বছর নভেম্বর মাসে বাম ছাত্র (বাম ছাত্র বলতে মূলত এসএফআই এবং তাদের সমর্থনে এগিয়ে আসা নকশালপন্থী ছাত্র সংগঠন। তাই এখন থেকে এই লেখাতে আমরা বামছাত্র বলেই উল্লেখ রাখব, যেহেতু এখনও এই দুই বাম ছাত্র সংগঠন যৌথভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, বাম-অধ্যাপক সংগঠন এই আন্দোলনে ছাত্রদের পক্ষেই আছেন) আন্দোলন ব্যাপক আকার লাভ করল। আন্দোলন আংশিক সফল হলো। কর্তৃপক্ষ ৮০ জনের ছাত্রদলকে আলোচনার টেবিলে আহ্বান করলে এসএফআই তাদের ৮০ জন প্রতিনিধিকে সেই আলোচনায় পাঠায়। আলোচনার অব্যবহিত পরেই ওই ৮০ জন ছাত্রের অভিভাবকদের কাছে ছাত্রদের কার্যকলাপ যে কর্তৃপক্ষ ভালো চোখে দেখছে না তা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হলো। কিন্তু অভ্যন্তরীণ বাম ছাত্র আন্দোলন এতে থেমে গেল না, বরং তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পেতে থাকল। ২০১৯ এর প্রজাতন্ত্র দিবসের ভাষণে কার্যত দেশের সংবিধানকে উপাচার্য মশাই আক্রমণ করে বসলেন এবং তাঁর এই বক্তব্য রেকর্ড করার অপরাধে এক ছাত্রকে বহিষ্কার করা হলো। এর বিরুদ্ধে বাম-ছাত্র আন্দোলন ব্যাপক আকার নিল। ক্যাম্পাসের বাইরে ততদিনে ভেতরকার এই দমন পীড়নের ঘটনা ছড়িয়ে পড়ায় বোলপুর এবং বীরভূম জেলা তথা রাজ্য এসএফআই -এর নেতৃত্বে শুরু হলো একের পর এক মিছিল, গণ-কনভেনশন - যার মূল স্লোগান ছিল বিশ্বভারতীর ঐতিহ্য ধ্বংসকারী উপাচার্যের অপসারণ নতুবা তিনি নিজেই পদত্যাগ করুন। কিন্তু ততদিনে মাননীয় উপাচার্য বিদ্যুৎবাবু ঘোষণা করে দিয়েছেন ‘দিল্লি থেকে বিশেষ কাজ দিয়েই’ তাকে এখানে পাঠানো হয়েছে। শুরু হয় জার্নালিজম ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রকাশিত পত্রিকাতে সিএএ এবং এনপিআর-এর পক্ষে প্রচার, এমনকী ওই বিভাগের সাথে একযোগে ওয়ার্কশপ। এই সময়েই সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে রাজ্যসভার বিজেপি সাংসদ স্বপন দাশগুপ্তকে নিয়ে এসে সিএএ এবং এনপিআর-এর সপক্ষে ‘The CAS Understanding & Interpretation’ শীর্ষক সেমিনারে এখানকার শিক্ষকদের যোগ দিতে বাধ্য করানো হয়। এর প্রতিবাদে বাম ছাত্র আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। এর বিরুদ্ধে মাননীয় উপাচার্যমশাই ছাত্রদের বিরুদ্ধে শুধু যে তদন্ত কমিশন গঠন করলেন তাই-ই নয়, তার আশ্রিত গুন্ডাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে হোস্টেলে ঢুকে তাঁর উপস্থিতিতে ছাত্রদের মারধর পর্যন্ত করা হয় অনেকটা জেএনইউ-র ধাঁচে। স্বাভাবিকভাবে এবারেও বাম ছাত্র আন্দোলন যে অনেক বেশি তীব্র হয়ে ওঠে। এরপরে শুরু হয় দলীয় নেতা-মন্ত্রীদের যুক্ত করার মাধ্যমে সেমিনার ও বিভিন্ন অনুষ্ঠানগুলোকে বিজেপি-র দলীয় কর্মসূচিতে পর্যবসিত করার প্রয়াস। এই সময়ে ছাত্র আন্দোলনকে দমন করার প্রচেষ্টায় সিআইএসএফ মোতায়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।ছাত্ররা বিশেষত বাম ছাত্ররা মোটেও নিশ্চুপ হয়ে ছিল না। এই নয়া নিয়মের বিরুদ্ধে ও বিশ্বভারতীর ঐতিহ্যকে বাঁচাতে আন্দোলনের ঝাঁঝ আরও বাড়তে থাকে। ফলে সিআইএসএফ মোতায়েনের চিন্তা ভাবনা মুলতবি রাখতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। তবে এতদিনে এসএফআই নেতা সোমনাথ সৌ-কে চিহ্নিত করে ফেলেন উপাচার্যমশাই। শুধু তাই নয়, সেই ছাত্র নেতার সাথে থাকা আরও দুই ছাত্র নেতা ফাল্গুনী পান ও রূপা চক্রবর্তীকেও তিনি পেয়ে গেলেন এবং প্রথমে তিন মাস হিসাবে তিন বার মোট নয় মাসের জন্য সাময়িক বরখাস্ত করলেও, এঁদেরকে শেষ পর্যন্ত তিন বছরের জন্য বরখাস্ত করার সিদ্ধান্তই নেয় উপাচার্য গঠিত এক বেআইনি কমিটি।
বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরে যেভাবে ছাত্র আন্দোলন চলছিল তা চলতেই থাকল, যুক্ত হলো এসএফআই-এর আন্দোলন। বীরভূম জেলা তথা বোলপুর এসএফআই লাগাতার আন্দোলনের ধারা বজায় রাখল। ২৬ জানুয়ারি, ২০২১ বোলপুরে একটি নাগরিক মিছিল করা হয় এবং বিশ্বভারতীর অভ্যন্তরে বাম ছাত্র আন্দোলনকে পুরোপুরি সমর্থন জানিয়ে আন্দোলন তীব্রতর করার আহ্বান জানানো হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি ‘ফ্যাসিবাদ বিরোধী’ কনভেনশন করা হয়। যেখানে বক্তা হিসাবে হাজির ছিলেন পি সাইনাথ, কেশব ভট্টাচার্য-এর মতো ব্যক্তিত্ব, সাথে অন-লাইনে যুক্ত হন অধ্যাপক প্রভাত পট্টনায়ক। এর পরে রাজ্য এসএফআই’র রাজ্য সম্পাদক সৃজন ভট্টাচার্য এবং ডিওয়াইএফআই’র রাজ্য নেতা কলতান দাশগুপ্ত সহ জেলার অন্যান্য নেতৃত্বের উপস্থিতিতে বোলপুর-শান্তিনিকেতন সংযোগস্থল বকুলতলায় একটি পথসভা ও গণ-কনভেনশন আয়োজিত হয়। এই কর্মসূচি থেকে উপাচার্যের অপসারণের দাবি জোরদার করা হয়। ওই বকুলতলাতেই এরপর এসএফআই এবং ডিওয়াইএফআই’র ডাকে অন্য একটি পথসভাতে সংগঠনের বীরভূম জেলার নেতৃত্বের সাথে হাজির হন ডিওয়াইএফআই-এর রাজ্য সভাপতি কমরেড মীনাক্ষী মুখার্জি। সেখানে উপাচার্যের পদত্যাগের জোরালো দাবি তোলা হয়। তৃতীয়বার তিন ছাত্র-ছাত্রীর সাময়িক বহিষ্কারের নির্দেশ জারি হওয়ার পর এসএফআই’র বীরভূম জেলা কমিটি একনাগারে সাতদিন ধরে ধরনা চালিয়ে যায়। উপস্থিত হন এসএফআই’র সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক ময়ূখ বিশ্বাস।
এখানেই শেষ নয়, তিন বছরের বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত হওয়ার পর দিন ২৭ সেপ্টেম্বর থেকেই শুরু হয় উপাচার্যের বাসভবনের সামনে লাগাতার অবস্থান। প্রথমেই সমর্থনে এগিয়ে আসে বোলপুর এবং বীরভূম তথা রাজ্য এসএফআই। অবস্থান মঞ্চে দ্বিতীয় দিনে এসে উপস্থিত থাকেন জেলার অন্যান্য নেতৃত্বের সাথে ছাত্র নেতা নেতা ময়ূখ বিশ্বাস। শুধু তাই নয়, ২ সেপ্টেম্বর, ২০২১ এসএফআই-এর ডাকে বিভিন্ন জেলা ও বীরভূম জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা ছাত্র-যুব-মহিলা-সাধারণ মানুষের মিছিল বোলপুর স্টেশন থেকে সেন্ট্রাল অফিসের বাইরে পৌছায়। মিছিলে ছিলেন জেএনইউ’র ছাত্র সংসদের সভানেত্রী ঐশী ঘোষ সহ রাজ্য ও বীরভূম সহ বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এসএফআই’র নেতা কর্মীরা। মিছিলের শেষে এক পথসভায় দাবি তোলা হয় তিন ছাত্র-ছাত্রীর বহিষ্কার রদ করতে হবে ও ফ্যাসিস্ট উপাচার্যকে অবিলম্বে পদত্যাগ করতে হবে।
এর মধ্যে কর্তৃপক্ষ ছাত্র অবস্থানের বিরুদ্ধে আদালতের দ্বারস্থ হলে, আদালত রায়দান করে (১)ছাত্ররা তাদের অবস্থান মঞ্চ উপাচার্যের বাসস্থানের থেকে ৫০মিটার দূরত্বে রাখবে; (২) কোনোরকম মাইক্রোফোন ব্যবহার করা যাবে না; (৩) উপাচার্য কোনোরকম প্ররোচনামূলক কথাবার্তা বলতে পারবেন না; (৪) পরীক্ষা, ফলাফল, ভরতিব্যবস্থা অবিলম্বে স্বাভাবিক করতে হবে; (৫) ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মীদের স্বার্থে সমস্ত গেট খোলা রাখতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে এখানকার আশ্রমিকদের মতামত, গুরুদেব এখানে খোলামেলা এক বাতাবরণের সৃষ্টি করেছিলেন। সেখানে দাঁড়িয়ে ছাত্রদের সাথে শিক্ষকসুলভ আচরণই পারে এই অচলাবস্থার অবসান করতে। মূলত তাঁদের অঙ্গুলি নির্দেশ, গত ৫ সেপ্টেম্বর শিক্ষক দিবসের দিন ছাত্রদের পাঠানো ফুল, মিষ্টি উপাচার্য প্রত্যাখ্যান করে মোটেই শিক্ষকসুলভ বা অভিভাবকসুলভ আচরণ তিনি করেননি। এমত পরিস্থিতিতে তাঁর পদত্যাগ করাই বাঞ্ছনীয়।
এদিকে আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীরাও ঘোষণা করেছে, উপাচার্যের ফ্যাসিবাদী-স্বৈরাচারী কার্যকলাপ বন্ধ ও তিন ছাত্র-ছাত্রীর বহিষ্কারের অন্যায় নির্দেশ প্রত্যাহার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন জারি থাকবে।
সর্বশেষ খবর হলো, বুধবার, ৮ সেপ্টেম্বর, কলকাতা হাইকোর্ট বিশ্বভারতীর তিন ছাত্র-ছাত্রীকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্তের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেছে। বিচারপতি রাজাশেখর মান্থা অবিলম্বে বহিষ্কৃত তিনজনকে ক্লাসে ফেরানোর নির্দেশ দিয়েছেন। বিচারক মন্তব্য করেছেন, বিশ্বভারতীর উপাচার্য আইনের ঊর্ধ্বে নন।