৫৯ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ২৪ ভাদ্র, ১৪২৮
পালানোর পথ নেই
সুপ্রতীপ রায়
দেখতে দেখতে অনেকদিন অতিক্রান্ত। ২৫ মার্চ ২০২০ ভারতে ঘোষিত হয়েছিল প্রথম লকডাউন। করোনা সংক্রমণ মোকাবিলার জন্য লক-ডাউন ঘোষিত হয়েছিল। এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি আমাদের আগে হতে হয়নি। অস্বাভাবিক এক পরিস্থিতি। গত বছরের ৩০ জানুয়ারি প্রথম সংক্রমণের খবর মিলেছিল ভারতে। দেড় বছরের বেশি সময় পেয়েছেন দেশের সরকার। এই পরিস্থিতিতে ভারত সরকারের ভূমিকা কী? সরকার মানুষের বিপদে রক্ষাকর্তার ভূমিকাতে অবতীর্ণ হবেন এটাই স্বাভাবিক। আমাদের অভিজ্ঞতা কী? গত দেড় বছরে আমাদের অর্থনীতি, সমাজ, শিল্প, কৃষি, শিক্ষার অবস্থা কী? আমরা কোন্ ভবিষ্যতের মুখে দাঁড়িয়ে?
বর্তমান পৃথিবীতে অন্যতম আলোচিত বিষয় করোনা ভাইরাস। এই ভাইরাসের আরেক নাম এসসিওভি-২, আমরা যাকে নোভেল করোনা ভাইরাস বলে জানি। ২০২০ সালে ১১ মার্চ ‘হু’ এই রোগটিকে বৈশ্বিক মহামারী হিসাবে ঘোষণা করেছে। বৈশ্বিক মহামারী বলতে কী বোঝায়? একটি বিশাল অঞ্চল জুড়ে যখন প্রচুর লোক আক্রান্ত হন ও ছড়িয়ে পড়ে তখন তাকে বৈশ্বিক মহামারী বলে। একথা বলার অপেক্ষা রাখে না কোভিড-১৯ ভারতের মানুষের জীবনকে থমকে দিয়েছে। দেশবাসী এক অনিশ্চিত সময় অতিক্রম করছেন।
এটা ঠিক মহামারীর কবলে ব্যাপক ক্ষতির মুখে আমরা। কিন্তু এই সংক্রামিত রোগের তথা মহামারীর বিস্তার অনেকটাই নিয়ন্ত্রণ করা যেতো যদি দেশের সরকারের মহামারী মোকাবিলার আন্তরিক ইচ্ছা, উদ্যোগ থাকত। করোনোর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াতে যেমন প্রচুর মানুষের মৃত্যু ঘটেছে, তেমনিই সুদূরপ্রসারী ফল হিসাবে সামাজিক মূল্যবোধের পরিবর্তন, বেকারত্ব, খাদ্য সঙ্কট, আর্থিক সঙ্কট দেখা দিচ্ছে।
আমাদের এটা ভাবতে অবাক লাগে, গত দেড় বছরে কোভিড মোকাবিলায় বিজ্ঞানসম্মত দৃষ্টিভঙ্গি প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে অনুপস্থিত। সাম্প্রদায়িক রাজনীতির ফেরিওয়ালারা এই বিপদের দিনে ধারাবাহিক ধর্মীয় গুজব ছড়াচ্ছেন এখনও। বিজেপি’র নেতারা প্রচার করলেন - ‘গোমূত্র আর গোবর করোনার প্রতিষেধক’। কাঁসর ঘণ্টা বাজিয়ে, মোমবাতি জ্বালিয়ে, ‘করোনা দেবীর পুজো’ করে করোনা জয়ের বার্তা দিয়েছিলেন আরএসএস এবং বিজেপি’র নেতারা। করোনা মহামারী মোকাবিলায় অগ্রাধিকারের তালিকায় হাসপাতালের বদলে স্থান পেলো মন্দিরের ভিত্তিস্থাপন। অন্যদিকে আর এক দল বলেছিলেন, ‘‘মসজিদে নামাজ পড়তে দিলে করোনা মুক্ত হবে’’।
করোনাকালে বৈজ্ঞানিক স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রচারের বদলে মধ্যযুগীয়, হিন্দুত্বের মতাদর্শ প্রচারের উপযুক্ত সময় বলে বিবেচনা করল হিন্দুত্ববাদী সংগঠনগুলি। ২০২০ সালের ১৩ মার্চ দিল্লিতে সমাবেশ করে গোমূত্র পান আর গোবর লেপন করে ঘোষণা করা হয়েছিল - এটাই করোনা রোধের ভালো উপায়। গত বছরের ১৯ মার্চ মোদী সংবাদমাধ্যমের সামনে বক্তৃতায় বলেছিলেন, জরুরি পরিষেবার কর্মীদের সমর্থনে থালি বাজাতে। এও আমরা দেখেছি করোনা তাড়াতে রাত ন’টায় ন’মিনিট ঘরের আলো নিভিয়ে মোমবাতি জ্বালানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী।
বিপদের দিনেও সমানে ধর্মীয় বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে বিজেপি। তেলেঙ্গানায় ছয়জন তবলিগ জামাতির শরীরে সংক্রমণ ধরা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিজেপি আর দলদাস মিডিয়া দ্বিগুণ তৎপরতায় নেমে পড়েছিল। এই তো সুযোগ একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উপর দোষ চাপিয়ে দেওয়ার। প্রচার করা হলো সব দায় মুসলিমদের।
দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজে তবলিগ জামাতের সম্মেলন বহু পূর্বেই স্থির হয়েছিল।গত বছরের ১৩-১৫ মার্চ সমস্ত সরকারি অনুমতি আদায় করেই অনুষ্ঠান হয়েছিল। ২০২০ সালের ১৮ মার্চ সমস্ত আগত বিদেশির কোয়ারেনন্টাইন ঘোষিত হয়েছিল। যদিও তার আগেই জামাতিদের সম্মেলন সমাপ্ত হয়েছিল। মারকাজ এক বিশাল মসজিদ। ওখানে প্রায় ১৫,০০০ মানুষ থাকতে পারেন। ছিলেন মাত্র ১,৫০০ জন। ১৯ মার্চ ‘সামাজিক দূরত্ব বিধি’ ঘোষিত হওয়ার পর মসজিদের বাইরে কেউ পা রাখেননি। কিন্তু তবলিগিদের জন্যই দেশে করোনা সংক্রমণ বাড়ছে, লব আগরওয়ালের (স্বাস্থ্য দপ্তরের তৎকালীন মুখপাত্র) ঘোষণার পর সারা দেশে মুসলিমদের উপর আক্রমণ বাড়তে থাকে।
রাজধানীর মারকাজ নিজামুদ্দিনে তবলিগ জামাতের সমাবেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ‘‘কোভিডের সাম্প্রদায়িকীকরণ’’ সংক্রান্ত মিডিয়া রিপোর্টের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে একটি আবেদনের শুনানি চলছে সুপ্রিম কোর্টে। সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট মন্তব্য করেছে - তবলিগ জামাত নিয়ে সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ছড়িয়েছে এক শ্রেণির মিডিয়া।
আমাদের দেশের সংবিধানে বলা আছে - রাষ্ট্র কোনো ধর্মের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না। করোনাকালে ধর্মীয় বৈষম্য, ধর্মীয় পক্ষপাতিত্ব সবই চলছে। গত বছর সিদ্ধি বিনায়ক মন্দির বন্ধ হয়েছিল ১৬ এপ্রিল। ৩০ জানুয়ারি ’২০ ভারতে প্রথম সংক্রমণ ধরা পড়ে কেরলে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা সতর্কবার্তা জারি করে বলেছিল, ‘‘পৃথিবীর সব দেশকে একযোগে এই ভাইরাসের মোকাবিলায় নামতে হবে’’। কিন্তু তিরুপতি মন্দির খোলা ছিল ১৬ মার্চ পর্যন্ত। বৈষ্ণদেবী মন্দির বন্ধ হয় ১৮ মার্চ, ২৩ মার্চ সাক্ষী মহারাজ মথুরায় এক মহতী হিন্দু সম্মেলন ঘোষণা করেছিলেন, ২০ মার্চ পর্যন্ত খোলা ছিল কাশী বিশ্বনাথ মন্দির।
এমনকি ২৫ মার্চ, ২০২০-তেও যোগী আদিত্যনাথ কয়েক হাজার মানুষ জমায়েত করে অযোধ্যায় গিয়ে রামলালা গৃহে প্রবেশ অনুষ্ঠান করেছিলেন। ৫ আগস্ট ’২০ বিপুল জমায়েত করে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাম পুজো হয়েছিল। করোনাকালে আরএসএস’র বিজ্ঞান পরপন্থী তথাকথিত উগ্রজাতীয়তাবাদীর পাঠ দিয়ে আধুনিক বিজ্ঞানকে নস্যাৎ করার প্রবণতাও ধরা পড়ছে।
করোনা বিষয়ে যে সতর্কতাগুলি জারি করা হয়েছে সেখানে একটা কথা বলা হয়েছে, ‘সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে’। ‘দৈহিক দূরত্ব’ কেন বলা হলো না? ‘সামাজিক দূরত্ব’ কথাটির মধ্য দিয়ে আসলে করোনাকালে রাষ্ট্র জনবিরোধী কোনো নীতি নিলে মানুষ যাতে প্রতিবাদের জন্য সমবেত না হতে পারেন তার ব্যবস্থা করা হলো। খুবই কৌশল করে শাসকশ্রেণি বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে।
মানুষে মানুষে সন্দেহের পরিবেশ ও বিচ্ছিন্নতার পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। মহামারী বা অতিমারী পরিবেশকে কাজে লাগিয়ে শাসকশ্রেণি বিভিন্ন দেশে বিভাজনের রাজনীতি করে চলেছে। মহামারীর প্রকোপের প্রথম দিকে আমেরিকায় একাধিক চৈনিক বংশোদ্ভূত মার্কিন নাগরিক জাতিবিদ্বেষের শিকার হয়েছিলেন। ভারতেও মুসলিম নাগরিকদের অনেকেই ধর্মীয় বিদ্বেষের শিকার হয়েছেন।
করোনা পুঁজিবাদী দুনিয়াতে বৈষম্যের রূপটিকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। ২৫মে ’২০ আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের নিহত হওয়ার ঘটনা আসলে এই বৈষম্যের সংস্কৃতিকেই তুলে ধরেছে। মৃত্যুর আগে ফ্লয়েডের শেষ বাক্য ছিল, ‘আই কান্ট ব্রিদ’। ওঁর এই শেষ আর্তি আসলে পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ভয়ঙ্কর বৈষম্যটিকেই তুলে ধরেছিল।
একটি পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকায় প্রতি একলক্ষ লোক পিছু যেখানে শ্বেতাঙ্গদের মৃত্যু হার ২০.৭ শতাংশ, সেখানে কৃষ্ণাঙ্গদের মধ্যে মৃত্যু হার প্রায় ৫০.৩ শতাংশ (সূত্রঃ ‘Black Americans dying of covid 19 at three-times the rate of white people’, The Guardian, May 20, 2020)। এই তথ্য বলে দিচ্ছে কৃষ্ণাঙ্গরা অনেক বেশি মহামারীর শিকার। আমেরিকায় স্বাস্থ্যখাতে একজন শ্বেতাঙ্গের চেয়ে একজন কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তি অন্ততপক্ষে বছরে প্রায় ১,৮০০ ডলার ব্যয় কম করতে বাধ্য হয়। রবার্ট ডিল পার্ল (স্বাস্থ্য গবেষক) সম্প্রতি মন্তব্য করেছেনঃ ‘করোনা পরিস্থিতিতে মার্কিন স্বাস্থ্য, তথা জনপরিষেবার ক্ষেত্রে অন্তর্নিহিত বর্ণবিদ্বেষী চাপা স্রোত এই সময়ে মৃত্যুহারের ব্যাপক ফারাকের মধ্যে ক্রমশ প্রতিভাত হয়ে পড়ে, যে বিষয়ে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ জেমস ফ্লয়েডের হত্যার ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিস্ফোরক রাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি করে।’ (সূত্রঃ প্রবন্ধ ‘মহামারী ও সামাজিক সংক্ষোভঃ এক ঐতিহাসিক অমোঘতার সূত্র-সন্ধান - উর্বী মুখোপাধ্যায় - ‘কোরক সাহিত্য পত্রিকা’ - শারদ ২০২০)।
করোনা মহামারীকালে ভারতসহ বিভিন্ন পুঁজিবাদী দেশে স্বাস্থ্য পরিষেবার ব্যর্থতা ও বৈষম্য দিনের আলোর মতো স্পষ্ট। গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে চলা নয়াউদারবাদী ব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য ক্রমবর্ধমান। মহামারী পরিস্থিতিতে তা আরও বেশি বেশি করে ধরা পড়ছে।
গত দেড় বছরে ভারতে সাধারণ মানুষের আর্থিক অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। বেকারত্বের সংখ্যা আরও বাড়ছে। লকডাউনে যারা চাকরি হারিয়েছেন, তাদের নতুন করে চাকরি ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। যে বিপুল পরিমাণে পরিযায়ী শ্রমিক ফিরে এসেছেন তাঁদের সম্পর্কে কোনো নীতি সরকারের নেই। করোনা অতিমারীর আবহে ভারতের কোটি কোটি মানুষ আর্থিকভাবে দুর্বল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য ভারত সরকার কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর যত মানুষ কাজ হারিয়েছেন, যত মানুষ চরম দরিদ্র হয়েছেন অতীতে এত মানুষ তা হননি।
২০২০ সালে অন্তত ৩ কোটি ২০ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্য সীমার নিচে চলে গিয়েছেন। মোদী আমলের বাজেটগুলিতে গ্রামীণ পরিকাঠামো, খাদ্য সুরক্ষা, কর্মসংস্থান, শ্রমিকদের সুরক্ষা, মিড ডে মিল চরমভাবে উপেক্ষিত। ভারতে ধনীদের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০১৮-১৯ সালে ১০০ কোটির বেশি সম্পত্তি ছিল এমন পরিবারের সংখ্যা ছিল ৭৭, ২০২০-২১-এ তা দাঁড়িয়েছে ২৩৬টি পরিবারে।
করোনাকালে দ্বিগুণ উৎসাহে দেশের আমজনতার সর্বনাশ করে চলেছেন মোদী। এ সময়ে কৃষিক্ষেত্রের সক্ষমতা ও কৃষকের স্বাধীন রোজগারকে নির্মূল করার বন্দোবস্ত পাকা করা হয়েছে, বিপন্ন করা হয়েছে শ্রমজীবী মানুষের জীবন-জীবিকাকে, ক্ষুদ্র শিল্প ও স্থানীয় বাণিজ্যকে লাটে তোলার ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোদীর নীতির ফলে যাবতীয় অর্থনীতির সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছে গুটি কয়েক কর্পোরেট হাউসের হাতে।
ব্যাঙ্ক ও স্বল্প সঞ্চয়খাতে মানুষ যে টাকা বিনিয়োগ করে তার খুব সামান্য অংশ যাতে মানুষের হাতে ফেরত আসে তার ব্যবস্থা ধাপে ধাপে চূড়ান্ত করা হচ্ছে। এই লক্ষ্যেই ধারাবাহিকভাবে সুদের হার কমানো হচ্ছে। এর পিছনে উদ্দেশ্য হচ্ছে-সরকারি আর্থিক প্রকল্পগুলি থেকে মানুষের আয় কমে গেলে তাঁরা বেশি আয়ের জন্য শেয়ার বাজারে যেতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ সাধারণ মানুষকে কার্যত বাধ্য করা হচ্ছে কর্পোরেট শেয়ার কিনে বা ইক্যুইটি ফান্ডে বিনিয়োগ করিয়ে বড়ো বড়ো কর্পোরেটদের হাতে নিজেদের সঞ্চিত অর্থ তুলে দিতে।
আমাদের দেশের শাসক গোষ্ঠী নয়াউদারবাদের নীতি অনুযায়ী যে অর্থনৈতিক কাঠামো গড়ে তুলেছেন তাতে কাঠামোগত সীমাবদ্ধতা আছে। উদারবাদে আয় বৈষম্য বাড়ছে। করোনা আবহে তা আরও বাড়ছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ৩০ কোটি দরিদ্র মানুষ (বাস্তবে আরও বেশি) আছেন - এঁদের আর্থিক সামর্থ্য নেই বললেই চলে। করোনাজনিত পরিস্থিতিতে এঁদের অবস্থা আরও খারাপ হয়েছে। সরকারের স্টিমুলাস প্যাকেজ এঁদের কাছে আসা উচিত ছিল। এটি আসলে বাজারে চাহিদা বাড়ত, বাজার চাঙ্গা হয়ে উঠত। কিন্তু বিজেপি সরকার কর্পোরেটদের সুরক্ষা দিয়েছে। ফল স্বরূপ করোনা সংক্রমণের মৃত্যু ছাড়াও প্রচুর মানুষ আর্থিক সঙ্কটে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হচ্ছেন। আগামীদিনে অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।
বিজেপি সরকার খাদ্য সুরক্ষা, পরিকল্পনা নীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য সব কিছুই বেসরকারি হাতে দিয়ে দিচ্ছে। দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের ভাণ্ডার চলে যাচ্ছে বিদেশিদের হাতে। আসলে স্বাধীনতা আস্তে আস্তে বহুজাতিক কর্পোরেটদের হাতে চলে যাচ্ছে। এটাকে দেশের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কী বলা যেতে পারে।
কৃষির তিনটি আইন বাতিলের দাবিতে যে লড়াই তা কী কেবল কৃষকদের বিষয়? আসলে ভারতের সমগ্র খাদ্য উৎপাদনকেই আম্বানি-আদানিদের নিয়ন্ত্রণে তুলে দিতে নতুন কৃষি আইনগুলি এনেছেন মোদী-শাহ। আদানিরা বিগত কয়েক বছরে ‘সাইলো’ বানিয়েছে। আধুনিক গোলা বা মাড়াইগুলিকে ‘সাইলো’ বলে। এক একটি গোলায় হাজার হাজার টন শস্য মজুত করে রাখা যায়। নয়া কৃষি আইনগুলির মধ্যদিয়ে বিজেপি কর্পোরেটদের হাতে দেশের সমস্ত কৃষি উৎপাদনের নিয়ন্ত্রণ তুলে দিতে চাইছে। রাষ্ট্রীয় শস্যভাণ্ডার তুলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে কর্পোরেটদের হাতে। চাষিকে ঠকিয়ে ফসল কিনে গুদামজাত করা হবে। বাজারে দাম বৃদ্ধি করে বিক্রয় করা হবে।
দেশের মানুষ রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্কগুলি থেকে ঋণ পান না। আর বড়ো বড়ো শিল্পপতিরা ভারতীয় ব্যাঙ্কের টাকা লুঠ করছে। ২৮ জন শিল্পপতি মিলে টাকা লুঠ করেছে প্রায় দশ ট্রিলিয়ন। এই ২৮ জনের মধ্যে বিজয় মালিয়া বাদ দিয়ে সবাই গুজরাটি।
এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। দেশের সম্পদ বিক্রির পক্ষে স্বাধীন দেশের অর্থমন্ত্রী যুক্তি দিচ্ছেন। কেবলমাত্র সড়কপথ বিক্রি করে ১৬ হাজার কোটি টাকা কোষাগারে তুলতে চাইছে ভারত সরকার। ২৩ আগস্ট কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী জাতীয় মনিটাইজেশন পাইপলাইন ঘোষণা করেছেন। ওই নীতি অনুযায়ী ২৫টি বিমানবন্দর, ৪০টি রেল স্টেশন, ১৫টি স্টেডিয়াম সহ বেশ কয়েকটি সরকারি পরিকাঠামো বিক্রি করার কথা বলা হয়েছে।
স্বাধীনতার পর জনগণের টাকায় যে সম্পদ সৃষ্টি হয়েছে সেগুলি মোদী-শাহ কর্পোরেটদের হাতে তুলে দেবেন। জাতীয় মনিটাইজেশন নীতিতে দেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবেন। কেন্দ্রীয় সরকারের আশা - রেলের সম্পদ বিক্রি করে পাওয়া যাবে ১৫ হাজার কোটি টাকা, বিদ্যুৎ সরবরাহের লাইনের বিলগ্নিকরণ করে পাওয়া যাবে ১০ হাজার কোটি টাকা, সরকারি গুদাম, বেসামরিক বিমান চলাচল, বন্দরের পরিকাঠামো, খেলার স্টেডিয়াম, খনির যন্ত্রাংশ বিক্রি করে আরও ১০ হাজার কোটি টাকা পাওয়া যাবে।
করোনাকে ঢাল করে চরম সর্বনাশের কিনারায় ভারতকে দাঁড় করিয়েছে মোদী। মানুষ সব দেখছেন। ভারতের মানুষের স্নায়ুতন্ত্র নিষ্ক্রিয় হয়ে যায়নি। দেশপ্রেমিক মানুষের চূড়ান্ত প্রতিরোধের মুখে হিন্দুত্ববাদীদের ‘নয়া মিরজাফর’দের পড়তে হবে।