E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৯ বর্ষ ৫ সংখ্যা / ১০ সেপ্টেম্বর, ২০২১ / ২৪ ভাদ্র, ১৪২৮

প্রয়াত দুই কমিউনিস্ট নেতার স্মরণে

শঙ্কর ঘোষাল


কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরা

সম্প্রতি পূর্ব বর্ধমান জেলায় কৃষক আন্দোলন ও গণআন্দোলনের দুই বিশিষ্ট নেতার জীবনাবসান ঘটেছে। দক্ষিণ দামোদর অঞ্চলের কৃষক নেতা কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরা ও কালনার গরিবের ডাক্তার এবং সিপিআই(এম) নেতা কমরেড গৌরাঙ্গ গোস্বামী প্রয়াত হয়েছেন। কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরা সত্তরের আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের সময়ে কৃষক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনকে দক্ষিণ দামোদর এলাকায় প্রসারিত করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্যদিকে কালনা শহর শুধু নয়,মহকুমার গরিব, শ্রমজীবী মানুষের চিকিৎসক হিসাবে ও গণআন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে গেছেন কমরেড ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামী। জগদ্বন্ধু হাজরা ছিলেন সিপিআই(এম)'র অবিভক্ত বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য এবং কমরেড গৌরাঙ্গ গোস্বামী ছিলেন পার্টির পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য। দু'জনের মৃত্যুই পার্টির ও গরিব মানুষের কাছে অপূরণীয় ক্ষতি।

কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরার গত ২৮শে এপ্রিল বর্ধমানের এক বেসরকারি নার্সিংহোমে জীবনাবসান ঘটে। তিনি দীর্ঘ কয়েক বছর বার্ধক্যজনিত রোগে অসুস্থ ছিলেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৯৫ বছর। তাঁর স্মৃতিচারণা করে পার্টির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরা ১৯৫১ সালে প্রাথমিক শিক্ষক হিসাবে খণ্ডঘোষের সরঙ্গা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। সংসারে অভাবের মধ্যেও তিনি ১৯৮৩ সালে চাকুরি থেকে স্বেচ্ছায় ইস্তফা দিয়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হন। তিনি আমৃত্যু পার্টির কাজ করে গেছেন। সকলের জন্য শিক্ষা ও তার পাশাপাশি শিক্ষকদের সংগঠন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তার পাশাপাশি তৎকালীন পার্টি নেতা কমরেড গোকুলানন্দ রায়ের সঙ্গে এলাকায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তোলার কাজে উদ্যোগী হন। এলাকায় কৃষক আন্দোলন গড়ে তোলার ক্ষেত্রেও গোকুলানন্দ রায়ের সঙ্গে কাজ করেছেন। এর ফলে প্রতিক্রিয়ারশক্তির রোষের মুখে পড়েন বারে বারে। জেলও খাটেন। ১৯৫৪ সালে তিনি পার্টির সদস্যপদ অর্জন করেন। ১৯৬২ সালে নিজের গ্রামে বাস্তু উচ্ছেদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে নেতৃত্ব দেন। সেই সময় দুই ভাই সহ গোটা পরিবার আক্রান্ত হন জোতদারের বাহিনীর হাতে। ১৯৭৩ সালেও তিনি আক্রান্ত হন শাসকদলের হাতে। সাতের দশকে অনেকটা সময় তাঁকে আত্মগোপন করে থাকতে হয়। ১৯৭০ সালে কৃষক নেতা অমিয় বটব্যাল খুন হন, ১৯৭১ সালে আহ্লাদীপুরে নব সাঁই’র নেতৃত্বে হামলা হয়, ৪ জন পার্টি কমরেড খুন হন। গোটা গ্রামে আগুন ধরিয়ে দেয় শাসকদলের দুষ্কৃতীরা। সমগ্র এলাকায় আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস নামিয়ে আনে কংগ্রেস। এর বিরুদ্ধে সংগঠন ও সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। তিনি গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন চাগ্রাম তরুণ সংঘ পাঠাগার। তৎকালীন সময়ে মহাজনি শোষণের হাত থেকে কৃষক ও কৃষিকে বাঁচাতে তিনি চাগ্রামে সমবায় সমিতি গড়ে তোলেন। সাংস্কৃতিক আন্দোলনেও তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। তিনি যাত্রাদলেও নিয়মিত অভিনয় করতেন। তাঁর পরিচালনায় ও নির্দেশনায় 'রক্তে রোয়া ধান' নিজের গ্রাম ছাড়িয়ে আশেপাশের গ্রামেও অভিনীত হয়েছে। সেই সময় সাংস্কৃতিক আন্দোলন ছিল হ্যামলিনের বাঁশির সুরের মতোই। তা না হলে ১৯৭৩ সালে উখরিদ গ্রামে এই যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হবার কিছুক্ষণ আগে ১৪৪ ধারা জারি করে পুলিশ যাত্রাপালা বন্ধ করে দেয়। তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে ওই রাতেই পাশের গ্রাম সুলতানপুরে সেই যাত্রাপালা মঞ্চস্থ হয় এবং দর্শকরাও সেই যাত্রার টানে চলে আসেন পাশের গাঁয়ে। সেখানেই সফলভাবে অভিনয় করেন কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরা ও তাঁর সহ শিল্পীরা। ১৯৬৭, ১৯৬৯ সালে খণ্ডঘোষ থানা এলাকায় ব্যাপক ভূমিআন্দোলনে তিনি শীর্ষ নেতৃত্বে ছিলেন। সাতের দশকে রায়না-খণ্ডঘোষের পার্টি পরিচালিত হতো যুক্তভাবে। পরবর্তীকালে পৃথক খণ্ডঘোষ এল ও সি গঠিত হলে তিনি আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তিনি এলাকায় স্কুল নির্মাণ, নদী ভাঙন, রাস্তাঘাটের উন্নয়নেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে যান। এলাকায় গরিব মানুষের মধ্যে কাজ করতে তিনি বেশি পছন্দ করতেন। তাঁদের রুটি-রুজির সংগ্রামে তিনি সব সময় পাশে থেকেছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত তাঁর পার্টির প্রতি ও মার্কসবাদ-লেনিনবাদের উপর অবিচল আস্থা ছিল। তাঁর মৃত্যুতে শুধু পার্টির নয়, দক্ষিণ দামোদর এলাকার গরিব মানুষেরও বিরাট ক্ষতি হলো।

কমরেড গৌরাঙ্গ গোস্বামী

অপরদিকে সিপিআই(এম) নেতা ও কালনা পৌরসভার প্রাক্তন পৌরপতি ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামী প্রয়াত হয়েছেন গত ৪ সেপ্টেম্বর। তিনি সকলের কাছে পরিচিত ছিলেন কালনার গরিবের ডাক্তারবাবু নামেই। গরিব, শ্রমজীবী মানুষের জন্য তিনি আমৃত্যু চিকিৎসা ও কাজ করে গেছেন। কলকাতার একটি বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে চিকিৎসারত অবস্থায় তাঁর জীবনাবসান ঘটে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭১ বছর। গত ২১ আগস্ট বর্ধমান জেলার পার্টির মিটিং সেরে কালনার বাড়িতে ফেরার পথে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। বাড়ি ফিরে এসে তিনি নিজের চিকিৎসা নিজেই শুরু করে দেন। কিন্তু গত ২৬ আগস্ট তাঁর শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে স্থানীয় একটি বেসরকারি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে তাঁকে ভরতি করা হয়। পরে তাঁকে কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। সেখানেই জীবনদীপ নিভে যায়। তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তাঁর মৃত্যুর খবর কালনা শহর সহ গোটা মহকুমাতে ছড়িয়ে পড়লে বিভিন্ন অংশের মানুষের মনে বিষণ্ণতা নেমে আসে। তাঁর মরদেহ কলকাতা থেকে কালনায় তাঁর জন্ম এবং কর্মভূমিতে নিয়ে আসা হয়। সেখানে তখন তাঁকে শেষ চোখের দেখা দেখতে ও শ্রদ্ধা জানাতে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত ছিলেন কোভিডবিধি মেনে। অনেকেই তাঁদের সকলের প্রিয় গরিবের ডাক্তারবাবুর জন্য চোখের জল ফেলেছেন। প্রয়াত নেতা কমরেড গৌরাঙ্গ গোস্বামীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য মদন ঘোষ, অঞ্জু কর, জেলা সম্পাদক অচিন্ত্য মল্লিক, পার্টি নেতা অমল হালদার প্রমুখ। পার্টি নেতৃত্ব তাঁর পরিবারের প্রতিও সমবেদনা জ্ঞাপন করেছেন।

কমরেড গৌরাঙ্গ গোস্বামীর পড়াশোনা কালনা শহরের অম্বিকা স্কুলে। ১৯৬৭ সালে চারটি বিষয়ে লেটার নিয়ে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করেন তিনি। বায়োলজিতে বর্ধমান জেলার মধ্যে সেরা নম্বর তুলেছিলেন। তারপরে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ডাক্তারি পড়ার সুযোগ পেয়ে সেখানে চলে যান। এমবিবিএস পাশ করার পর তিনি সেরামিক সার্জারি নিয়ে পড়াশোনা শুরু করেন। ডাক্তারি পড়া শেষে তিনি হোমিও মেডিকেল কলেজে কিছুদিন লেকচারার হিসেবে কাজ করেন। ছাত্র অবস্থাতেই তিনি বাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। কলকাতাতে থাকা অবস্থাতেই তিনি সিপিআই(এম)’র সদস্যপদ অর্জন করেন। কলকাতায় থাকার সময় তিনি পিআরসি-তে কর্মকর্তা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭৮ সালে কলকাতার পাট চুকিয়ে দিয়ে নিজের জন্মভূমি কালনা শহরে চেম্বার খুলে ৫ টাকা ফি-তে প্র্যাকটিস শুরু করেন। তিনি আমৃত্যু পাঁচ টাকা ফি-তে রোগী দেখে গেছেন। দীর্ঘদিন এই ফি-তে রোগী দেখার জন্য ‘৫ টাকার ডাক্তার’ তথা গরিবের ‘ভগবান’ নামে সুপরিচিত হয়ে ওঠেন। এই ব্যাপারে কেউ বললে, তিনি বলতেন ‘৫ টাকার নোট যতদিন থাকবে, ততদিন আমার ফি বাড়বে না। ৫ টাকায় আমার তো চলে যাচ্ছে, কোনো অসুবিধা হচ্ছে না’। তিনি ডিওয়াইএফআই’র অবিভক্ত বর্ধমান জেলার সভাপতিও নির্বাচিত হন। সাংস্কৃতিক জগতেও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। প্রয়াত ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামী তিন পুরুষ ধরে বাম রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। তাঁর বাবা বিশ্বম্ভর গোস্বামী এবং দাদু মোহিনী মোহন গোস্বামী কালনা পৌরসভায় বাম কাউন্সিলর হিসেবে জয়ী হয়েছিলেন। ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামী কালনা পৌরসভার ৬ বারের জয়ী কাউন্সিলর ছিলেন। দুইবার পৌরপতির পদও দক্ষতার সঙ্গে সামলেছেন। কালনা পৌরসভার ৪ নম্বর ওয়ার্ডে আগে কোনোদিনই বাম প্রার্থী জয়ী হতে পারেননি। বিগত পৌরসভা নির্বাচনে সেই ৪ নম্বর ওয়ার্ডেই ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামী দাঁড়িয়ে বিজয়ী হন এবং বিরোধীনেতা হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি সিপিআই(এম)’র কালনা শহর লোকাল কমিটির সম্পাদক এবং অবিভক্ত বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য ছিলেন। শেষে কালনা শহর এরিয়া কমিটির সম্পাদক এবং পূর্ব বর্ধমান জেলা কমিটির সদস্য হিসাবে কাজ করেছেন।প্রয়াত কমরেডের অন্তিমযাত্রায় উপস্থিত ছিলেন অগণিত মানুষ। তাঁদের অনেকেই বলেছেন, আমাদের করোনার হাত থেকে বাঁচিয়ে নিজেই চলে গেলেন। এদিন রাজবাড়ি ময়দানে তাঁর দেহ রাখা হয়।সেখানেই কোভিড স্বাস্থ্যবিধি মেনে শেষ শ্রদ্ধা জানান পার্টি ও গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

প্রবীণ পার্টি নেতা মদন ঘোষ প্রয়াত গৌরাঙ্গ গোস্বামীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করে বলেছেন, তাঁর এই অকাল মৃত্যু কল্পনার বাইরে। তিনি শুধু আমাদের পার্টির নেতা ছিলেন না, ভাল চিকিৎসকও ছিলেন। তাঁদের গোটা পরিবার বামপন্থী। প্রয়াত নেতার মা কমরেড কৃতিরূপা গোস্বামী কালনার মহিলা আন্দোলনের নেত্রী ছিলেন। আধা ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাসের সময় বহু পার্টি কর্মী ও নেতাকে তাঁদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছেন। কমরেড হরেকৃষ্ণ কোঙারেরও দীর্ঘদিন তাঁদের বাড়িতে যাতায়াত ছিল। গরিবের ডাক্তার হিসাবে তাঁর পরিচিতি ছিল কালনা শহরে। আমাদের গৌরাঙ্গের মৃত্যুতে রাজনৈতিক, সাংগঠনিক ক্ষতি হলো, তার সাথে কালনার সাধারণ গরিব মানুষেরও বড়ো ক্ষতি হয়ে গেল।

বর্তমানের এই সার্বিক সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে কমরেড জগদ্বন্ধু হাজরা ও কমরেড ডাঃ গৌরাঙ্গ গোস্বামীর মতো দুই নেতার প্রয়াণে প্রকৃত অর্থেই ক্ষতি হয়ে গেল পার্টি, গণআন্দোলন, সর্বোপরি গরিব সাধারণ মানুষের। প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে এই দু'জন বিশিষ্ট নেতার জীবনাবসান হলেও সাধারণ মানুষের কল্যাণে তাঁদের বিস্তৃত কর্মকাণ্ডের উজ্জ্বল স্মৃতি অনেকের মধ্যেই সজীব থাকবে দীর্ঘকাল।