৬১ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১১ আগস্ট, ২০২৩ / ২৫ শ্রাবণ, ১৪৩০
কমরেড মুজফ্ফর আহ্মদের জন্মদিনে শপথ
সাম্প্রদায়িক বিভাজনের রাজনীতিকে পরাস্ত করার আহ্বান
কাকাবাবুর জন্মদিবসের অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন মহম্মদ সেলিম।
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ দেশের সাংবিধানিক কাঠামোকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সাম্প্রদায়িক-করপোরেট যুগলবন্দিকে পরাস্ত করতে হবে। বামপন্থী দলগুলি এবং ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে পরাজিত করতে হবে বিজেপি-আরএসএস-কে। এরাজ্যে পরাজিত করতে হবে তৃণমূল কংগ্রেসকে। কাকাবাবু মুজফ্ফর আহমদের জন্মদিনে এটাই আগামী লড়াইয়ের শপথ। ৫ আগস্ট মুজফ্ফর আহমদের জন্মদিন উপলক্ষে মহাজাতি সদনে আয়োজিত সভায় একথা বলেন নেতৃবৃন্দ।
ভিড়ে ঠাসা এই সভা থেকে প্রতিবছরের মতো মুজফ্ফর আহমেদ স্মৃতি পুরস্কার কমিটির পক্ষ থেকে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয় প্রাপকদের হাতে। এ বছর মুজফ্ফর আহমদ স্মৃতি পুরস্কারের প্রাপক দুটি বইয়ের নাম ‘দি পলিটিকাল মার্কস আইজাজ আহমদ ইন কনভারসেশন উইথ বিজয় প্রসাদ’ এবং বিশিষ্ট ত্বক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক জয়ন্ত দাসের লেখা ‘বিবর্তন - আদি যুদ্ধ আদি প্রেম’। প্রথম বইটি নয়াদিল্লির 'লেফটওয়ার্ড' প্রকাশনার। অনুষ্ঠানে বই দু’টি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেন পুরস্কার কমিটির সভাপতি শ্রীদীপ ভট্টাচার্য।
এদিন বিমান বসু এবং পার্টির পলিট ব্যুরো সদস্য সূর্য মিশ্র এবং রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম ডাঃ জয়ন্ত দাসের হাতে মানপত্র, উত্তরীয় এবং চেক তুলে দেন। ইংরেজি বইটির অন্যতম আলোচক বিজয় প্রসাদ বিদেশে থাকায় 'লেফটওয়ার্ড'-এর প্রতিনিধির হাতে পুরস্কার তুলে দেওয়া হয়।
সভায় বিমান বসু বলেন, জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে দেশে কমিউনিস্ট সংগঠন গড়ে তোলা এবং মতাদর্শ প্রচারের জন্য গত শতাব্দীর দ্বিতীয় দশক থেকে কাকাবাবু মুজফ্ফর আহমদ কাজ করেছেন। প্রচণ্ড প্রতিকূল পরিবেশে দাঁড়িয়ে তিনি মানুষের মুক্তির জন্য শ্রেণি শোষণের অবসান ঘটানোর কাজে শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বিপ্লবাত্মক কাজে অংশগ্রহণ করেছেন। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় তিনি নিজের সওয়াল করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন যে দেশের মানুষের বিরুদ্ধে তিনি বা তার সহযোগী কমিউনিস্টরা কোনো চক্রান্ত করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন সাম্প্রদায়িকতা মানবতার শত্রু। শোষিত বঞ্চিত মানুষের লড়াই সংগ্রামে ছুরি মারে সাম্প্রদায়িকতা - নানা লেখায় তিনি এ কথা বারবার লিখেছেন। শ্রমিক-কৃষক ঐক্য গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কেও তিনি অবহিত করেছেন আমাদের। বর্তমানে সাম্প্রদায়িক বিভাজনের যে রাজনীতি চলছে তার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের শপথ আজ আমাদের নিতে হবে।
সূর্য মিশ্র বলেন, কাকাবাবুকে তাঁর লেখা এবং দেশে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তোলায় তাঁর ভূমিকার মধ্যে দিয়ে আমরা চিনি। নজরুলের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ বন্ধুত্ব এসবের পাশাপাশি পার্টির কাজে আবদুল হালিম এবং ডাক্তার ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত প্রথম যুগেই তাঁর পাশে এসে দাঁড়ান - এ কথা তিনি আলাদা করে উল্লেখ করেছেন। এই নামগুলিকে আমাদের খেয়াল রাখতে হবে।
তিনি বলেন, বিপ্লব মানে রাষ্ট্রের চরিত্রের মৌলিক পরিবর্তন। বিপ্লবের পথ ফুল বিছানো নয়, কাঁটা বিছানো। তা যত কঠিনই হোক না কেন আমরা তা ছেড়ে যাব না - একথা কাকাবাবু বারবার বলেছেন । আমাদের দেশ সহ বেশ কয়েকটি দেশে এখন দক্ষিণপন্থী উগ্রপন্থার উত্থান হচ্ছে। এর আগে গণআন্দোলনের ওপর আক্রমণ, আধা ফ্যাসিস্ত-সন্ত্রাস এসব আমরা দেখেছি, কিন্তু এই ধরনের বিপদের আমরা আগে সম্মুখীন হইনি। অর্থনীতিতে একটা পরিবর্তন ঘটে গেছে। লুটেরা পুঁজি টাকা থেকে টাকা করছে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের সময়ও লুট ছিল, কিন্তু এখন চরিত্রটা ভিন্ন। ওখানে আদানি আর এখানে বালি, কয়লা চুরি - সর্বত্র লুট চলছে। দেশজুড়ে করপোরেট এবং সাম্প্রদায়িক আঁতাত স্বাধীনতা সংগ্রামসহ সংবিধানের প্রতিটি অক্ষরকে মুছে ফেলতে চাইছে।
তিনি সাম্প্রদায়িকতার বিপদ সম্পর্কে বলেন, মানুষ ধর্ম আচরণ করেন অসহায়ত্ব থেকে কিন্তু সাম্প্রদায়িকতাকে নির্মাণ করা হয়। এই মৌলিক কথাগুলি খেয়াল রাখতে হবে। ফ্যাসিবাদ বা নয়া ফ্যাসিবাদের চ্যালেঞ্জটা কী? ফ্যাসিবাদ শুধুমাত্র আক্রমণ সন্ত্রাস করে কায়েম হয় না তা মানুষের সম্মতি আদায় করে। এই সম্মতি এবং সন্ত্রাসের ঐক্য সম্ভব হয় মিথ্যা কথা বারবার বলার মধ্য দিয়ে, ইতিহাসকে বিকৃত করা এবং ইতিহাস সম্পর্কে বিস্মৃতির মধ্য দিয়ে। জ্যোতিবাবু বলতেন, সত্যি কথাগুলি বারবার বলতে হবে। এখন সারাদেশে বিজেপি’কে বিচ্ছিন্ন করে পরাস্ত করতে হবে। বামপন্থীসহ ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক বিভিন্ন শক্তি যে যেখানে লড়াই করতে পারে, তাদের একসাথে নিয়ে আসতে হবে। লড়াইতে না থাকলে পরিবর্তন করা যাবে না।
মহম্মদ সেলিম কাকাবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেন, মার্কসবাদী পথে মার্কস-লেনিনের শিক্ষা নিয়ে শ্রমজীবী মানুষকে সংগঠিত করে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে কাজ করছে কমিউনিস্টরা। উল্টোদিকে দক্ষিণপন্থীরা লুটের সাম্রাজ্যকে টিকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে। দেশে এবং এই রাজ্যে সংখ্যাগুরুবাদের রাজনীতি এই লক্ষ্যই কাজ করছে। আমরা চেতনা বৃদ্ধির জন্য মতাদর্শের চর্চাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে কাকাবাবুর জন্মদিনে বইকে পুরস্কৃত করছি, মানুষের সক্ষমতার তৈরির জন্য। সেখানে দক্ষিণপন্থীরা বলছে, রাজনীতিটা ভাবনার বিষয় অর্থাৎ যুক্তি বুদ্ধি বা তর্কের বিষয় নয়। আজকে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করা হচ্ছে যুক্তিবাদকে শেষ করার জন্য।
তিনি বলেন, আজকে মনিপুরে কী হচ্ছে? একটা জাতি জনগোষ্ঠীকে আর একটা জাতি জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেওয়া হয়েছে ভোটের জন্য। ওখানে মেইতি, নাগা কুকি তাঁরা যেমন ছিলেন তেমনি আদিবাসী তপশিলি সংখ্যালঘুরাও ছিলেন। এখানে ধর্মকে ধর্মের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হচ্ছে। বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে, খৃস্টান এবং হিন্দুদের মধ্যে লড়াই - তা নয়। দক্ষিণপন্থা লুটতন্ত্রকে বজায় রাখার চেষ্টা করে তাই আসলে জমি এবং খনিজ সম্পদের লুটের জন্য এটা করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, বিনা আলোচনায় সংসদে বন সংস্কার আইন পাশ হয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলকে বেসরকারি হাতে বেচে দেবার জন্য, আদিবাসীদের অধিকার খর্ব করার জন্য। পরিবেশ আইন ধুলিস্যাৎ করা হচ্ছে। অন্যদিকে সংসদের নতুন ভবনে যাগযজ্ঞের লাইভ টেলিকাস্ট হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী অবতার সাজছেন আর তার জেরে জলাঞ্জলি হচ্ছে গণতন্ত্রের। মিডিয়াতে কোন আলোচনা নেই।
মহম্মদ সেলিম বিরোধী দলগুলির মঞ্চ ‘ইন্ডিয়া’ সম্পর্কে বলেন, বিরোধীরা এই প্রথম ঐক্যবদ্ধভাবে মিটিং করছেন না। এর আগে এককেন্দ্রীকতার ঝোঁকের বিরুদ্ধে আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো বজায় রেখে রাজ্যের হাতে অধিক ক্ষমতার দাবিতে জ্যোতি বসু কনক্লেভ করেছেন। আর এখন দেশে এবং এখানে মিডিয়া পঞ্চায়েত ভোটে বিজেপি তৃণমূলের বাইনারি জন্য খবর করছিল। ঐ সভার নীতিগত প্রস্তাব নিয়ে নিশ্চুপ থেকেছে। লুটের প্রয়োজনেধ ইতিহাসকে বিকৃত করা হচ্ছে। এখন লড়াইটা তীব্র হয়েছে তাই প্রতিক্রিয়ার শক্তি মরিয়া হয়ে উঠেছে আরো। পঞ্চায়েত ভোটে আমরা বলেছি জীবন জীবিকার লড়াই নিয়ে যারা বামপন্থীদের সঙ্গে আসতে চায়। তাদের সব অংশকে এক করতে হবে। হরিয়ানায় জমির জন্য সিন্ডিকেটের পক্ষে দাঁড়িয়ে বুলডোজার চালাচ্ছে খাট্টার সরকার। আমরা বলেছিলাম ইন সিটি ডেভেলপমেন্ট তাই ঠিকা টেনেন্সি আইন তৈরি করা হয়েছিল আর এখন কলকাতায় এবং এরাজ্যে ভূমি সংস্কারকে উল্টে দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে। অন্যদিকে বিভাজন এবং লুট রুখতে আমরা বলেছি রাজ্যগুলির বাস্তবতার নিরিখে নির্বাচনী সমঝোতা হবে। বাম-গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ অংশকে সঙ্গে নিয়ে বিজেপি তৃণমূল উভয়ের দুর্নীতি-দুষ্কৃতীতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করবে বামপন্থীরা।
এদিন সকালে গোবরা কবরস্থানে মাল্যদান করেন নেতৃবৃন্দ। পার্টির রাজ্য দপ্তর, গণশক্তি প্রিন্টার্সে কাকাবাবুর আবক্ষ মূর্তিতে মালা দিয়ে শ্রদ্ধা জানান হয়। সল্ট লেকে এনবিএ দপ্তরেও অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে কাকাবাবুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদিত হয়।