৬১ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১১ আগস্ট, ২০২৩ / ২৫ শ্রাবণ, ১৪৩০
সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহব্যাপী দেশজুড়ে প্রতিবাদ সংগঠিত করার আহ্বান সিপিআই(এম) কেন্দ্রীয় কমিটির
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ মূল্যবৃদ্ধি ও কাজের দাবিতে দেশজুড়ে প্রতিবাদ কর্মসূচির ডাক দিল সিপিআই(এম)। নয়াদিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির তিনদিনের বৈঠক শেষে ৭ আগস্ট এক বিবৃতিতে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে মূল্যবৃদ্ধি এবং কাজের সুযোগ সৃষ্টির দাবিতে ওই প্রতিবাদ আন্দোলনের ডাক দেওয়া হয়েছে। বিবৃতিতে দেশের বর্তমান রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক-সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অন্যান্য বামপন্থী দলের সঙ্গে আলোচনায় কিছু দাবিকে সামনে রেখে সম্মতির ভিত্তিতে দেশজুড়ে প্রচার ও যত শীঘ্র সম্ভব ঐ দলগুলিকে নিয়ে কনভেনশন সংগঠিত করা হবে বলা হয়েছে। কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নগুলির যৌথ মঞ্চ এবং সংযুক্ত কিষাণ মোর্চার আন্দোলনের কর্মসূচি এবং সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির ৫ অক্টোবরের দিল্লি সমাবেশকে সফল করা আহ্বান জানানো হয়েছে। এর পাশাপাশি মণিপুর এবং হরিয়ানার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে তীব্র উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি।
বিবৃতিতে কেন্দ্রীয় কমিটি হরিয়ানা ও মণিপুরের ঘটনাবলি উল্লেখ করে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ও বিভাজনের রাজনীতি এবং তার পিছনে বিজেপি’র ভূমিকার কড়া সমালোচনা করেছে। হরিয়ানার প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ওই রাজ্যের মেওয়াত অঞ্চলের নূহতে শুরু হয়েছিল সাম্প্রদায়িক হিংসা। সেখান থেকে তা ছড়িয়ে পড়ে গুরগাঁও এবং অন্যান্য জায়গায়। তাকে সামনে রেখে হরিয়ানার বিজেপি সরকার যে বর্বর বুলডোজার রাজনীতি শুরু করেছে, তা অত্যন্ত নিন্দনীয়। যারা অপরাধী এবং যারা এই হিংসায় উসকানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার বদলে হরিয়ানার বিজেপি সরকার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু বানিয়েছে। বিরাট সংখ্যায় মুসলিমদের ঘরবাড়ি ও দোকানকে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। তাঁদের অনেকের কাছেই রয়েছে মালিকানার আইনি নথি এবং অনেকের কাছে আছে আদালতের স্থগিতাদেশ। তা সত্ত্বেও হরিয়ানার বিজেপি সরকার এই সব সম্পত্তি ধ্বংস করে চলেছে। চার দিন ধরে ওই ধ্বংসকাণ্ড চলার পরে শেষ পর্যন্ত পাঞ্জাব ও হরিয়ানা হাইকোর্ট তাতে স্থগিতাদেশ জারি করেছে।
মণিপুরের পরিস্থিতিতে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, তিন মাসেরও বেশি সময় ধরে ওই রাজ্যে সাম্প্রদায়িক অভিমুখে জাতি সংঘর্ষ চলছে। ইতিমধ্যে শয়ে শয়ে মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষ ঘরছাড়া হয়ে অত্যন্ত অমানবিক পরিবেশের মধ্যে ত্রাণ শিবিরে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছেন। রাজ্য সরকারের ত্রুটি ও ব্যর্থতা স্পষ্ট। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর নীরবতা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের নিস্ফলা হস্তক্ষেপ পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছে, বড় নৈরাজ্য ও মারদাঙ্গার দিকে ঠেলে দিয়েছে রাজ্যকে। প্রধানমন্ত্রী নিজে দায় এড়ানোর পথ বেছে নিয়েছেন, সংসদের কাছে তাঁর দায়বদ্ধতাও এড়িয়ে যাচ্ছেন। পরিণতিতে সংসদের কাজ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। উত্তর-পূর্বের অন্যান্য রাজ্যে মণিপুরে সংঘর্ষের রেশ ছড়িয়ে পড়লে তার ফল হবে মারাত্মক। এই অবস্থায় মণিপুরে শান্তি ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সবার আগে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত করতে হবে এন. বীরেন সিংকে।
দেশে ঘৃণামূলক অপরাধের বৃদ্ধিতেও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে কেন্দ্রীয় কমিটি। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি আরপিএফ’র এক কনেস্টবল নৃশংসভাবে খুন করেছেন এক জন অফিসার এবং তিন জন মুসলিম যাত্রীকে। এই হত্যাকাণ্ড এক অমানবিক ঘৃণামূলক অপরাধ। বিজেপি-আরএসএস’র পক্ষ থেকে মুসলিম সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে যে একপেশে প্রচার ও জঘন্য ঘৃণাভাষণ ছড়ানো হচ্ছে, তার পরিণতিতেই এমন অপরাধ বেড়ে চলেছে। হিন্দুত্ববাদী শক্তির বিষাক্ত কর্মসূচি যে কীভাবে ভারতীয় সাধারণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, এই ঘটনা থেকে তার শিক্ষা নিতে হবে।
সম্প্রতি বারানসীর জেলা আদালত মন্দিরের অবশেষ খুঁজে বের করার জন্য জ্ঞানবাপী মসজিদে এএসআই-কে সমীক্ষা চালানোর নির্দেশ দিয়েছে, যে নির্দেশকে বহাল রেখেছে এলাহাবাদ হাইকোর্ট এবং সুপ্রিম কোর্ট। সেই প্রসঙ্গে বিবৃতিতে বলা হয়েছে, বিচারবিভাগের সর্বোচ্চ স্তর ১৯৯১ সালের ধর্মীয় স্থান আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ না করায় কেন্দ্রীয় কমিটি উদ্বিগ্ন ও বিস্মিত। ওই আইনে স্বাধীনতার সময় থেকে সব ধর্মীয় স্থানে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। ওই আইন প্রণয়নের সময়ে শুধু অযোধ্যাকে ব্যতিক্রম হিসাবে বিবেচনা করা হয়েছিল, যেহেতু সংশ্লিষ্ট বিতর্ক সেই সময়ে বিচারাধীন বিষয় ছিল। সুপ্রিম কোর্ট ওই আইনের বৈধতাকে বারাংবার মান্যতা দিলেও জ্ঞানবাপীতে সমীক্ষার কাজ বন্ধ করেনি। ওই আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, সরকারি ঋণের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে, অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে দিল্লির আমলাদের নিয়োগ ও বদলির ক্ষমতা হাতে নিয়ে এবং জাতীয় সম্পদের লুটের ব্যবস্থা করে দিয়ে মোদী সরকার দেশের যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার উপর একের পর এক আক্রমণ নামিয়ে এনেছে। সম্প্রতি মোদী সরকার সরকারি ঋণের সংজ্ঞায় এমন পরিবর্তন এনেছে, যা রাজ্য সরকারগুলির কোষাগারীয় সক্ষমতাকে আরও সঙ্কুচিত করবে। নতুন নিয়মে রাজ্য সরকারগুলি বাজেট-বহির্ভূত ও বাজেটের অতিরিক্ত ঋণ নিলে তা সরকারি ঋণ বলে গণ্য হবে। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষেত্রে এই নিয়ম করা হয়নি। এর ফলে ২০২৩-২৪ সালে কেরালার মতো রাজ্যের কোষাগারে ১৭ হাজার ৩১০ কোটি টাকার মতো কম থাকবে। তাতে রাজ্য বিধানসভায় অনুমোদিত বাজেটে বিরাট ঘাটতি তৈরি হবে। রাজ্যগুলির অধিকারের উপরে এটি গুরুতর আঘাত। পাশাপাশি মোদী সরকার সুপ্রিম কোর্টের ৫ বিচারপতির সাংবিধানিক বেঞ্চের সাম্প্রতিক এক রায়কে নস্যাৎ করতে জঘন্য স্বৈরাচারী পদক্ষেপ নিয়ে দিল্লি অর্ডিন্যান্স জারি করেছে। সাংবিধানিক বেঞ্চের রায়ে বলা হয়েছিল, দিল্লির আমলাদের নিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে দিল্লির নির্বাচিত সরকারের হাতে। সেই রায়কে বাতিল করার লক্ষ্যে অর্ডিন্যান্স জারি করে শুধুমাত্র আদালত অবমাননা করা হয়নি, সংবিধানের যুক্তরাষ্ট্রীয় চরিত্রকে সরাসরি আঘাত করা হয়েছে এবং আক্রমণ নামিয়ে আনা হয়েছে দায়বদ্ধতার রীতি ও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার উপরে। এখন লোকসভায় নিজেদের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা এবং রাজ্যসভায় বিজেডি ও ওয়াইএসআরসিপি’র মতো আঞ্চলিক দলের সমর্থনকে ব্যবহার করে এই অর্ডিন্যান্সকে আইনে পরিণত করতে চলেছে বিজেপি সরকার। এই সঙ্গেই মোদী সরকারের আমলে কর্পোরেট-সাম্প্রদায়িক আঁতাতে নতুন নতুন আইন তৈরি করে জাতীয় সম্পদের লুটকে বৈধতা দেওয়া হচ্ছে। সংসদের কাজে যখন বিঘ্ন ঘটছে, তখন তার মধ্যেই জাতীয় সম্পদের বেসরকারিকরণের লক্ষ্যে তাৎপর্যপূর্ণ সব বিল অনুমোদন করিয়ে নিচ্ছে মোদী সরকার। এর মধ্যে রয়েছে বনাঞ্চল সংরক্ষণ (সংশোধনী) বিল, যেখানে উন্নয়নের নামে কর্পোরেটদের জন্য অবাধ ছাড়ের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, যা জাতীয় সম্পদ লুটে বৃহৎ শিল্পপতিদের সহায়তা করবে। এর পরিণতিতে বনাঞ্চল যা ধ্বংস হবে, তা দেশের আবহাওয়ার উপরে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। লিথিয়াম সহ মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ খনিজ সম্পদের উত্তোলনকে বেসরকারি হাতে তুলে দেওয়ার রাস্তা প্রশস্ত করতে অনুমোদন করানো হয়েছে খনি ও খনিজ পদার্থ (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) সংশোধনী বিলও। তা ছাড়াও অশোধিত তেলের উত্তোলনের বেসরকারিকরণের উদ্দেশ্যে সংসদে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়েছে সমুদ্র তীরবর্তী অঞ্চল (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) বিল।
কেন্দ্রীয় কমিটি দেশে মহিলা ও কন্যাসন্তানদের বিরুদ্ধে আক্রমণ ও অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরো-র সর্বশেষ প্রকাশিত তথ্য-পরিসংখ্যান অনুসারে, ২০২১ সালে এদেশে প্রতিদিন গড়ে ৮৬টি ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়েছে। প্রতি ঘণ্টায় মহিলাদের উপর আক্রমণের ঘটনা ঘটেছে ৪৯টি। ধর্ষণের ঘটনার সংখ্যা ২০২০-তে ছিল ২৮ হাজার ৪৬, যা ২০২১-এ বেড়ে হয়েছে ৩১ হাজার ৬৭৭। ওই দুই বছরে মহিলাদের বিরুদ্ধে অপরাধের সংখ্যা ৩ লক্ষ ৭১ হাজার ৫০৩ থেকে বেড়ে হয়েছে ৪ লক্ষ ২৮ হাজার ২৭৮। বহু ঘটনায় মোদী সরকার অভিযুক্তদের আড়াল করছে। তাতে অপরাধীরা প্রশ্রয় পাচ্ছে।
ষষ্ঠ জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষা থেকে শরীরে রক্তাল্পতা ও প্রতিবন্ধকতা সংক্রান্ত প্রশ্ন বাদ দেওয়ায় কেন্দ্রীয় কমিটি কড়া সমালোচনা করেছে মোদী সরকারের। বিবৃতিতে এই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, আগের সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, ভারতের ৫৭ শতাংশের বেশি মহিলা এবং ৬৭ শতাংশের বেশি শিশু রক্তাল্পতার শিকার। মাতৃত্বকালীন মৃত্যু ও শিশু মৃত্যুর অন্যতম কারণ এই রক্তাল্পতা। সরকার সেই বিষয়ে তথ্য আর জানতে চাইছে না। সমীক্ষা থেকে প্রতিবন্ধকতা বিষয়ক প্রশ্ন বাদ দেওয়াও এক পশ্চাদমুখী পদক্ষেপ। ইতিমধ্যে মোদী সরকার এই সমীক্ষার দায়িত্বপ্রাপ্ত ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর পপুলেশন সায়েন্সেস-এর অধিকর্তা কে এস জেমসকে সাময়িক বরখাস্ত করেছে। কারণ, পঞ্চম জাতীয় পরিবার স্বাস্থ্য সমীক্ষার যে তথ্য-পরিসংখ্যান এই সংস্থা প্রকাশ করেছে, তা ‘ভারত এখন খোলা জায়গায় শৌচকর্ম মুক্ত’ দেশ-এর মতো মোদী সরকারের অনেক দাবির সঙ্গেই মেলেনি। কেন্দ্রীয় কমিটি বলেছে, আসলে মোদী সরকার নির্লজ্জভাবে তথ্যের কারচুপি করতে চাইছে। কারণ, এই সরকার প্রকৃত তথ্য-পরিসংখ্যানকে ভয় পাচ্ছে।