৬১ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১১ আগস্ট, ২০২৩ / ২৫ শ্রাবণ, ১৪৩০
হরিয়ানায় বুলডোজার রাজনীতি
লক্ষ্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ
হরিয়ানায় বুলডোজার দিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ হরিয়ানার নুহুতে বিশ্বহিন্দু পরিষদের শোভাযাত্রা থেকে উসকানি এবং হিংসা ছড়ানোর পরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে যে সাম্প্রদায়িক হিংসা ছড়িয়ে পড়ে, তাতে হিন্দুত্ববাদীরা সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করেছে। পুলিশই তার প্রমাণ দিয়েছে। এই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ গত ৮ আগস্ট তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। দু’জনের খোঁজ চলছে। পুলিশই জানিয়েছে, সোশ্যাল মিডিয়ার উসকানিমূলক পোস্ট দেখেই ওই পাঁচ যুবক গ্রামের মাজারে আগুন লাগানোর পরিকল্পনা করেছিল।
যে মাজারে আগুন লাগিয়েছিল দুর্বৃত্তরা, সেই মাজারে হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের মানুষ আসতেন। এই ঘটনায় স্থানীয় গ্রামবাসীদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ ছড়ায়।
বিশ্বহিন্দু পরিষদ ব্রিজমণ্ডল জলাভিষেক যাত্রা করে গুরগাঁও এবং নুহুতে দাঙ্গা বাঁধানোর পর রবিন্দর এবং তার দুই সহকর্মীকে আশ্রয় দিয়েছিল গুরগাঁও আলোয়ার জাতীয় সড়ক সংলগ্ন খেদলা গ্রামের বাসিন্দা আনিস। সেদিন তিনি অচেনা তিনজনকে শুধু আশ্রয়ই দেননি, খাবারের ব্যবস্থা সহ তাঁদের যাতে কোনো সমস্যা না হয়, তার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করেছেন। তারপর পরিস্থিতি একটু শান্ত হলে রবিন্দরদের নিরাপদে এলাকা থেকে বের করে দিয়েছেন। ধর্মীয় বেড়াজাল থেকে সেদিন মানুষে মানুষে চিরন্তন ভালোবাসা ও সম্প্রীতির নজির রেখেছিল আনিসের পরিবার। মানবিকতার এই অসামান্য নজির গড়া সেই আনিসের বাড়িটাই গুঁড়িয়ে দিয়েছে খাট্টারের বুলডোজার। এই চরম অমানবিক ঘটনায় আবার প্রকট হয়েছে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো দাঙ্গাবাজ হিসাবে সংখ্যালঘুদের দেগে দিয়ে হরিয়ানার বিজেপি প্রশাসন পরপর সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, ব্যবসাস্থল বুলডোজার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিচ্ছে।
হরিয়ানার ঘটনার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ৬ আগস্ট সিপিআই (এম)-র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, হরিয়ানাতে নির্বিচারে গ্রেপ্তার এবং বুলডোজার রাজনীতির তীব্র নিন্দা করছে সিপিআই (এম)। আমাদের কাছে যা খবর আছে, বহু মানুষের সম্পত্তির মালিকানার প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আছে, তাঁদের অনেকের হাতে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে আদালতের স্থগিতাদেশের নির্দেশ আছে। কিন্তু কোনো কিছুকেই পাত্তা না দিয়ে বুলডোজার চালানো হচ্ছে। আসলে হরিয়ানার বিজেপি সরকার সাম্প্রদায়িক উত্তেজনাকে জিঁইয়ে রাখতে চাইছে। সরকারের কাজ স্বাভাবিক অবস্থা ফেরানো, শান্তি প্রতিষ্ঠা করা। তার পরিবর্তে সরকার একটি সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে টার্গেট করেছে এবং নিশ্চিত করতে চাইছে এই সাম্প্রদায়িক বিভাজন যাতে আরও তীব্রতর হয়। তাদের ভোটব্যাঙ্ক রাজনীতিকে নিশ্চিত করতেই আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে ধ্বংস করছে।
তিনি আরও বলেছেন, যারা অপরাধ করেছে, তাদের শাস্তি দিক প্রশাসন। যারা অন্যায় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিক। সেই নিয়ে কোনো ভিন্নমত নেই, কিন্তু নির্বিচারে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে আক্রমণ করা হচ্ছে, সেটা একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক দেশে হতে পারে না।
এদিকে জমিয়ত উলেমা হিন্দ গত ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করে বলেছে, নুহুতে সাম্প্রদায়িক হিংসার পর প্রশাসন বুলডোজার চালিয়ে যাঁদের বাড়িঘর ভেঙে দিয়েছে, তাঁদের ক্ষতিপূরণ দেবার নির্দেশ দিক সর্বোচ্চ আদালত।
টানা চারদিন ধরে বুলডোজার দিয়ে লাগামহীন ধ্বংসলীলা চালানোর পর ৭ আগস্ট পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্ট নুহুতে বুলডোজার চালানোর উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে। এদিন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে হাইকোর্ট এই নির্দেশ দিয়ে বলেছে, পরবর্তী নির্দেশ পর্যন্ত বুলডোজার চালিয়ে বাড়িঘর, দোকান ভাঙার কাজ বন্ধ রাখতে হবে। এই স্থগিতাদেশ দেবার আগে এদিন পাঞ্জাব-হরিয়ানা হাইকোর্ট হরিয়ানা প্রশাসন সম্পর্কে কঠোর মন্তব্য করেছে। আদালত বলেছে, আমাদের নজরে এসেছে হরিয়ানা সরকার গুরগাঁও এবং নুহুতে দাঙ্গার ঘটনার পরে বাড়িঘর ভেঙে দিচ্ছে বুলডোজার দিয়ে। বাড়িঘর ভেঙে ফেলার আগে কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি বা নির্দেশও দেওয়া হয়নি। আইন-শৃঙ্খলার সমস্যাকে ব্যবহার করা হচ্ছে বাড়িঘর ভেঙে ফেলার ফন্দি হিসাবে। এই কাজ করার জন্য আইনের যে পদ্ধতি আছে, তাকেও মান্য করা হচ্ছে না। বিচারপতি জিএস সান্ধাওয়ালিয়া এবং বিচারপতি হরপ্রীত কাউরের ডিভিশন বেঞ্চ এ সম্পর্কে কঠোরতম মন্তব্য করে বলেছে, এই বিষয়টিও উঠে এসেছে যে, একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের ভবনগুলি কি আইন-শৃঙ্খলার সমস্যার কারণে ভাঙা হচ্ছে, নাকি একটি সম্প্রদায়কে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষ্যে রাজ্য সরকার এই কাজ চালাচ্ছে? প্রসঙ্গত, সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনের ভিত্তিতেই আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে এই মামলা গ্রহণ করে।
এদিন দুটি ইংরেজি সংবাদপত্রের ৭ আগস্টের প্রতিবেদন উল্লেখ করে আদালত বলেছে, রাজ্যের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, বুলডোজার চালানোটা ‘চিকিৎসার’ একটা অংশ। অর্থাৎ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে - এমনই ইঙ্গিত করতে চেয়েছিলেন মন্ত্রী! সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে আদালত বলেছে, ক্ষমতা দুর্নীতির জন্ম দেয়। একচ্ছত্র ক্ষমতা দুর্নীতিকেও বল্গাহীন করে দেয়। বিচারপতিরা বলেন, ভারতের সংবিধান নাগরিকদের রক্ষা করে। আইন অমান্য করেও কোনো ধ্বংস-উচ্ছেদের কাজ করা যাবে না। এরপরই আদালত নির্দেশ দেয়, যদি এদিনও কোনো ধ্বংস বা উচ্ছেদ করার কাজ স্থির হয়ে থাকে, অবিলম্বে তা বন্ধ করার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে, কারণ তা আইন অনুযায়ী হচ্ছে না।
সরকার, প্রশাসন একদিকে যেমন বুলডোজার দিয়ে বাড়িঘর, হোটেল ভাঙচুর করছে, উচ্ছেদ করছে, অন্যদিকে মুসলিম বিরোধী জিগির জোরালো করতে হিন্দুত্ববাদীদের উদ্যোগে কর্মসূচি চলছে। গুরগাঁওয়ের যে মসজিদে আগুন লাগিয়ে ইমামকে হত্যা করেছিল হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা, সেই ঘটনায় ধৃত চার অভিযুক্তের মুক্তির দাবিতে মহাপঞ্চায়েতও করেছে হিন্দুত্ববাদীরা।
আদালতের নির্দেশের আগে পর পর চারদিন ধরে বুলডোজার চালিয়ে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর, দোকান, রেস্তোরাঁ, হোটেল ভাঙচুর করা হয়েছে, দাঙ্গাকারীদের ওপর ব্যবস্থা নেবার নামে নুহুতে লাগাতার সংখ্যালঘুদের টার্গেট করা হয়েছে। নুহুর ডেপুটি কমিশনার জানিয়েছেন, মোট ১৬২টি দালান এবং ৫৯১টি অস্থায়ী কাঠামো ভেঙে দেওয়া হয়েছে। এর অধিকাংশই ছোটোখাটো দোকান, রেস্তোরাঁ, হোটেল বা রুটি-রুজির সংস্থানের জন্য ব্যবসাকেন্দ্র। নুহুতে ৩৭টি জায়গায় ৫৭.৫ একর জমিতে এমন উচ্ছেদ চালানো হয়েছে বলে জানা গেছে। ৬ আগস্ট সাহারা পরিবারের যে হোটেলটি ভেঙে দেওয়া হয়েছে, তার কারণ হিসাবে বলা হয়েছে, গণ্ডগোলের দিন নাকি ওই হোটেল থেকে বিশ্বহিন্দু পরিষদ, বজরংদলের শোভাযাত্রায় পাথর ছোঁড়া হয়েছিল। সেখানেই নাকি দুষ্কৃতীরা আশ্রয় নিয়েছিল। এর আগে ৩ আগস্ট গুরগাঁওয়ের সেক্টর ৫৭-তে অঞ্জুমান মসজিদে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল হিন্দুত্ববাদীরা। সেখানে গুলি চালিয়ে ২৬ বছরের এক তরুণ ইমামকে হত্যা করে দুষ্কৃতীরা।
মসজিদে আগুন লাগানোর ঘটনায় ধৃত চার অভিযুক্তের মুক্তির দাবিতে টিগরা গ্রামে অবাধে মহাপঞ্চায়েত সংগঠিত করেছে হিন্দুত্ববাদীরা। সেখান থেকে অভিযুক্তদের মুক্তির দাবির পাশাপাশি উসকানিও ছড়ানো হয়। অথচ সাংসদ বিনয় বিশ্বমের নেতৃত্বে সিপিআই-র এক প্রতিনিধিদল ৬ আগস্ট হিংসা-কবলিত এলাকার মানুষের সাথে কথা বলতে গেলে, তাঁদের সেখানে যেতে বাধা দেয় পুলিশ। বাধ্য হয়েই তাঁদের ফিরে আসতে হয়।
একইভাবে ৮ আগস্ট কংগ্রেসের ১০ জনের এক প্রতিনিধিদলকেও নুহুতে আটকানো হয়। কংগ্রেস সাংসদ দীপেন্দর সিং হুদা বলেছেন, আমরা সাম্প্রদায়িক হিংসায় ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলতে গিয়েছিলাম। আজ আমাদের আটকানোর জন্য বিপুল বাহিনী মজুত ছিল। এই বাহিনী যদি সেদিন থাকতো, তাহলে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে হিংসা ছড়াতো না। যা ঘটেছে, তারজন্য রাজ্য সরকার সম্পূর্ণ দায়ী বলে তিনি অভিযোগ করেন।
৯ আগস্ট দাঙ্গা বিধ্বস্ত হরিয়ানার নুহু এবং গুরগাঁওয়ে নিহতদের পরিজনদের পাশে দাঁড়াতে, তাঁদের সঙ্গে কথা বলতে সেখানে যান সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য নীলোৎপল বসু সহ পার্টির তিন সাংসদ জন ব্রিটাস, এ. এ. রহিম এবং ভি. শিবদাসন।