৬১ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১১ আগস্ট, ২০২৩ / ২৫ শ্রাবণ, ১৪৩০
স্বাধীনতা সংগ্রামে সংঘ পরিবারের ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতার বেনজির ইতিহাস
দীপ্তজিৎ দাস
ফ্যাসিবাদের উত্থানের অন্যতম উপাদান ছদ্ম দেশাত্মবোধ। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যখন স্বৈরাচারী শক্তি মাথাচাড়া দিয়েছে বারবার মানুষের মধ্যে প্রতিস্থাপিত করতে চেয়েছে জাতীয়তাবাদ সংক্রান্ত ভ্রান্ত ধারণাকে। সাধারণ মানুষের অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়ে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছে দেশ রক্ষার এক এবং অদ্বিতীয় শক্তি হিসেবে। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশের পরিস্থিতিও তার থেকে ব্যতিক্রম নয়। এক দেশ-এক ধর্ম-এক ভাষার কেন্দ্রীকরণের উদ্যোক্তা আরএসএস-বিজেপি আজ ব্যস্ত প্রগাঢ় দেশপ্রেমের প্রজ্জ্বলিত মশাল হিসেবে নিজেদের তুলে ধরতে। অথচ প্রায় ২০০ বছরব্যাপী এদেশের স্বাধীনতা ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া কোনো অবদান নেই সংঘ পরিবারের। তাই জনতাকে বিভ্রান্ত করার জন্য চলছে লাগাতার ভ্রান্ত প্রচার,বিকৃত হচ্ছে দেশের ইতিহাস।
প্রদেশে প্রদেশে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম যখন তীব্রতর হয়ে উঠেছে, দেশের মানুষের বিদ্রোহে যখন দিশেহারা ব্রিটিশরাজ,তখনই বিভাজনের বিষবাষ্প ভারতীয় সমাজে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে প্রবেশ করিয়েছিল তারা। প্যাট্রিক কার্নেগি নামক এক ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ‘Historic Cage of Tahsil Faizabad ‘নামক বই লেখেন, সেখানে বলা হয় যেখানে বাবরের মসজিদ আছে সেখানে আগে মন্দির ছিল। অন্যদিকে ডবলিউ ডবলিউ হান্টার নামক আরেকজন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ‘The Indian Musalmans’ নামক গ্রন্থ রচনা করেন, যেখানে বলা হয় মুসলিম এদেশে বৈষম্যের শিকার।ভারতীয় নাগরিকেরা ব্রিটিশ দ্বারা শোষিত হওয়ার এক ও অদ্বিতীয় চেতনার পরিবর্তে দেশের সমাজে প্রবেশ করে হিন্দু এবং মুসলমানের সংঘাতের স্বার্থ। ১৯০৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতের প্রথম ধর্ম কেন্দ্রিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লিগ। ১৯১৫ সালে মদনমোহন মালব্য প্রতিষ্ঠা করেন হিন্দু মহাসভার। এর পরবর্তীকালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা বিশ্বের ইতিহাসকে নতুন পথে পরিচালিত করে। এই সময়ই সামন্ততান্ত্রিক শোষণের শৃঙখল কেটে আত্মপ্রকাশ করে সোভিয়েত ইউনিয়ন। তার আলোকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গঠিত হতে থাকে কমিউনিস্ট পার্টি। তার আঁচ পড়তে থাকে ভারতের স্বাধীনতার লড়াইয়ে। সেই সময় বিভাজনের রাজনীতিকে ত্বরান্বিত করতেই ব্রিটিশের প্রচ্ছন্ন মদতেই ১৯২৫ সালে গঠিত হয় রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘ।
আরএসএস-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, প্রথম সরসংঘচালক কেশব বলিরাম হেডগেওয়ারের কথা থেকে জানা যায়, তাদের প্রতিষ্ঠিত সংগঠনের নাম হিন্দু স্বয়ংসেবক সংঘ রাখতে তারা সচেষ্ট ছিলেন। কিন্তু মানুষের মনে ব্যাপ্তির জন্য তারা রাষ্ট্রীয় শব্দটি ব্যবহার করেন। মনে করা হয় সম্ভবত ব্রিটিশদের পরামর্শেই তাদের এমন নামকরণের সিদ্ধান্ত। আরএসএস’র বিভিন্ন প্রচারে হেডগেওয়ারের নিজস্ব জীবনলব্ধ অভিজ্ঞতা এবং নীতির দ্বারা সংগঠনে প্রভাব বিস্তারের কথা জানা যায়। তার পরিবারের আদি বাসস্থান তেলেঙ্গানা অঞ্চলে হলেও নিজামের মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যে হিন্দুয়ানির পর্যাপ্ত বিকাশ সম্ভব নয় বলে তারা ভোঁসলেদের হিন্দু রাজ্যের নাগপুরে স্থানান্তরিত হন। নিজস্ব জীবনে শরীরচর্চাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিতেন তিনি। তবে দেশের সশস্ত্র বিপ্লবীদের মতন শারীরিক এবং মানসিক দৃঢ়তার দ্বারা ব্রিটিশ রাজের উৎখাতে নয়, মুসলমানদের বিরুদ্ধে তা কাজে লাগাতেই উৎসাহী ছিলেন তিনি। সংঘের অনুগামীদের মধ্যেও তিনি সেই চিন্তার ছাপ রাখেন। তাই আরএসএস কোনপদিনই ব্রিটিশকে দেশের প্রধান শত্রু মনে করেনি।
হেডগেওয়ারের জীবন সংক্রান্ত একাধিক ভ্রান্ত গল্প পরিবেশন করে আরএসএস তাকে ব্রিটিশ বিরোধী এক সুপারম্যান রূপ প্রদান করতে চায়। বলা হয় স্কুল জীবনে মহারানি ভিক্টোরিয়ার সিংহাসন আরোহনের ষোড়শ তম বর্ষে নাগপুরে উৎসবের সাথে মিষ্টি বিলি করা হলে তা প্রত্যাখ্যান করেন তিনি। পাশাপাশি কলকাতায় মেডিকেল কলেজে ভরতি হলে অনুশীলন সমিতির সাথে তার যোগাযোগের কথা বলা হয়।কিন্তু নাগপুরে স্কুল জীবনে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে অংশগ্রহণের ন্যূনতম ঐতিহাসিক প্রমাণ তারা হাজির করতে পারেনি। সেই সময় বালগঙ্গাধর তিলক, চাপেকর ভাইদের নেতৃত্বে মহারাষ্ট্রে স্বাধীনতার আন্দোলন চরম আকার ধারণ করে। বোম্বাই ছাড়িয়ে তার আঁচ এসে পরে নাগপুর,পুনেতেও। এর পরবর্তী সময়ে তিলককে গ্রেপ্তার করে তার বিচার শুরু হলে তা নিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে সংবাদপত্রে তিলকের নামে কুৎসা করার চেষ্টা করে শাসকরা। তার বিরুদ্ধে ব্যাপক ক্ষোভে ফেটে পরে মহারাষ্ট্রের বিপ্লবীরা। কিন্তু এই পর্বে কোথাও হেডগেওয়ারের উপস্থিতির কথা কোনো ঐতিহাসিক তথ্যে উল্লেখ নেই। আরএসএস-ও এই বিষয়ে নিশ্চুপ। কলকাতায় আসার পর অনুশীলন সমিতির ত্রৈলোক্য মহারাজের সাথে তার কিছুটা সখ্য তৈরি হয়। কিন্তু হেডগেওয়ারের মধ্যে বাসা বেঁধে থাকা ধর্মান্ধতার বিষ অনুভব করে তাকে অনুশীলন সমিতি থেকে দূরে সরিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয় অনুশীলন সমিতির বিপ্লবীরা। সমকালীন সময়ে অনুশীলন সমিতি, যুগান্তর গোষ্ঠীর নেতৃত্বে বাংলায় চলছে ব্রিটিশ বিরোধী সশস্ত্র সংগ্রামের আয়োজন। ক্ষুদিরাম বসু, প্রফুল্ল চাকী, কানাইলাল দত্তরা কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছেন ব্রিটিশদের বুকে। কিন্তু বাংলায় বিপ্লবীদের যে নামের তালিকা ব্রিটিশ দপ্তরে ছিল সেখানে কোথাও উল্লেখ নেই হেডগেওয়ারের নাম।
কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পর প্রথম কুড়ি বছর নেতৃত্বের ব্যাটন ছিল প্রধানত নরমপন্থী নেতাদের হাতে। সেই সময় ব্রিটিশের বিভিন্ন নীতির বিরুদ্ধে সংসদে সরব হওয়া এবং নিজেদের অধিবেশনে সেই সংক্রান্ত বিষয়ে আলোচনা করা ছাড়া গণআন্দোলনে গড়ে তোলায় তাদের কোনো ভূমিকা চোখে পড়ে না। কিন্তু এই সময় কংগ্রেস নেতারা ব্রিটিশের বিভিন্ন শোষণমূলক আর্থিক নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। চাকরিতে তারা ভারতীয়দের সুযোগ দেওয়ার জন্য দাবি জানান। অস্ত্র আইন প্রত্যাহারের জন্য তারা সোচ্চার হয়েছিলেন। লবণ কর প্রত্যাহারেরও তারা দাবি জানান। এছাড়া প্রশাসনিক ব্যবস্থার জুড়ি প্রথাকে তারা বিচার ব্যবস্থায় সম্প্রসারণের দাবি করলেও ব্রিটিশরা এ বিষয়ে কর্ণপাত করেনি। কংগ্রেস নেতা দাদাভাই নৌরোজি এই সময় তার ‘ ড্রেন অফ ওয়েলথ ‘তত্ত্বের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কাছে তুলে ধরেন কীভাবে ব্রিটিশরা বিপুল ধন সম্পদ লুট করে তাদের দেশে তা নিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এই সংক্রান্ত বিষয়ে আরএসএস’র নেতৃত্ব হেডগেওয়ার,গোলওয়ালকার,পরাঞ্জপে, মুঞ্জেদের কোন ভাষ্য পাওয়া যায় না। পরবর্তী সময়েও তারা ব্রিটিশ উপনিবেশিকতাবাদের শোষণ সম্পর্কে খুব বেশি সোচ্চার হননি। ‘উই অর আওয়ার নেশনহুড ডিফাইনড’ গ্রন্থে গোলওয়ালকর লেখেন,‘ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম ব্রিটিশরা এদেশে পা দেওয়ার বহু আগে থেকেই চলছে। তা মূলত মুসলমান শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই।’ অর্থাৎ ব্রিটিশ শোষণের সর্বগ্রাসী মনোভাবের বিরুদ্ধে তাদের কোনো প্রতিক্রিয়া নেই।
আরএসএস’র মতাদর্শ হলো হিন্দুত্ববাদ। তাদের লক্ষ্য ভারতে হিন্দু রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। ভারতের ইনক্লুসিভ জাতীয়তাবাদ তাদের আদর্শ নয়। সূচনা লগ্ন থেকেই ইতালির ফ্যাসিবাদী শক্তির সাথে আরএসএস’র সখ্য ছিল। সংঘ পরিবার এবং হিন্দু মহাসভা উভয়েরই নেতা এবিএস মুঞ্জে ১৯৩১ সালে ইতালিতে গিয়েছিলেন মুসোলিনির সাথে সাক্ষাতের জন্য। সে সময় মগজধোলাইয়ের উদ্দেশ্যে গঠিত যুব সংগঠনের কর্মকাণ্ড এবং সামরিক বাহিনীর কার্যধারা সম্পর্কে সচেতন হন। মুঞ্জে মনে করতেন হিন্দু ভারতেও এমন সংগঠন প্রয়োজন। মতাদর্শগতভাবে আরএসএস ছিল মুসোলিনী, হিটলারের অনুগামী;ব্রিটিশ নথিতে উল্লেখ রয়েছে সে কথা। তবে তাদের এই সামরিক ও স্বৈরাচারী নীতিকে তারা প্রধানত ভারতের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নির্মূলের জন্যই প্রয়োগ করতে চেয়েছিল।
অসহযোগ আন্দোলনের আকস্মিক পরিসমাপ্তির পর ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম এক অন্য পথে বাঁক নেয়। চট্টগ্রামে মাস্টারদা সূর্যসেনের নেতৃত্বে যুব বিদ্রোহ, উত্তর ভারতে ভগৎ সিং, চন্দ্রশেখর আজাদদের অকুতোভয় লড়াই, মহারাষ্ট্র-দাক্ষিণাত্য জুড়ে গড়ে ওঠা শ্রমিক-কৃষক আন্দোলন ব্রিটিশ শাসনের ভিত নাড়িয়ে দেয়। আত্মপ্রকাশ করে নিখিল ভারত ছাত্র ফেডারেশন, সারা ভারত কিষান সভার মতো সংগঠনগুলি। কিন্তু সংঘ পরিবার ছিল এই সময় সমস্ত রকম আন্দোলন সংগ্রামের বৃত্তের বাইরে। দেশ ও বিশ্ব রাজনীতির এক উত্তাল সময়ে ১৯৩৯ সালে আরএসএস’র দ্বিতীয় সরসংঘ চালক মাধব সদাশিব গোলওয়ালকর ‘উই অর আওয়ার নেশার হুড ডিফাইনড ‘গ্রন্থটি প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ’বিদেশি জাতির লোকজনদের ভারতে থাকতে হলে তাদের হিন্দু সংস্কৃতি ও ভাষা গ্রহণ করতে হবে। নিজেদের হিন্দু জাতির অধস্তন হিসেবে মেনে নিতে হবে। তারা কোনো সুযোগ-সুবিধা দাবি করতে পারবে না, এমনকী নাগরিক অধিকারও নয়।’ অর্থাৎ যখন আসমুদ্র হিমাচল পরাধীনতার শৃংখল মুক্তির স্বপ্নে বিভোর,নিজেদের সর্বোচ্চ আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশের জনগণ চাইছে স্বাধীনতা প্রাপ্তি, তখন এক উগ্র ধর্মান্ধতায় নিমজ্জিত ছিল আরএসএস। তাদের এই সংকীর্ণ মনোভাবের মাধ্যমে ব্রিটিশের বিভাজনকে শক্তিশালী করা এবং দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দুর্বল করার কাজই করেছিল তারা। পরবর্তী সময়ে ‘বাঞ্চ অফ থটস’-এ গোলওয়ালকর লেখেন,’ ব্রিটিশ বিরোধিতাকে দেশপ্রেম এবং জাতীয়তাবাদ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছিল যা আমাদের জাতির গঠনে এক নেতিবাচক ভূমিকা রেখেছে। ‘অর্থাৎ তাদের কথায় দেশের মানুষকে শোষণকারী ব্রিটিশের বিরুদ্ধে লড়াই করা দেশাত্মবোধের পরিচায়ক নয়।
আরএসএস প্রতিষ্ঠার দু’বছর আগে ১৯২৩ সালে রত্নগিরি জেলে থাকাকালীন মারাঠা ছদ্মনামে ‘হিন্দুত্ব’ নামক বইটি লেখেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। এই বইতে তিনি হিন্দু ধর্ম এবং হিন্দুত্বকে পৃথক করে দেখান। হিন্দুত্ব যে একটি আদ্যন্ত রাজনৈতিক প্রোপাগান্ডা তা তার এই বইয়ের লেখাতেই প্রমাণিত হয়। ‘ভারতের ৪ হাজার বছরের ইতিহাস হচ্ছে ধারাবাহিকভাবে হিন্দুত্বের ইতিহাস।এই চার হাজার বছর ধরে বিভিন্ন ধরনের হিন্দুরা নিজেদের শাসন করছে অথবা বিদেশিদের দ্বারা শাসিত হয়েছে। কিন্তু এই চার হাজার বছরের ইতিহাস হিন্দুদের ইতিহাস।’সনাতন হিন্দু ধর্ম এবং এই হিন্দুত্ব সম্পূর্ণরূপে আলাদা। হিন্দু ধর্মে গোঁড়ামির কোনো স্থান নেই। তার বৈশিষ্ট্য হলো গ্রহণ মূলক। হিন্দুত্ববাদ হচ্ছে বর্জনমূলক । এই হিন্দুত্বকেই পরবর্তী সময়ে হিন্দু মহাসভা এবং আরএসএস তাদের আদর্শের সাথে সম্পৃক্ত করে। ১৯২৪ সালে সাভারকর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সংঘ প্রতিষ্ঠার আগে হেডগেওয়ার তার সাথে সাক্ষাৎ করেন। বিজেপি’র পূর্বসূরিদের মধ্যে একমাত্র সাভারকর যিনি ব্রিটিশ শাসনে কারাগারে বন্দি হয়েছিলেন। ১৯১০ সালে জোড়া খুনের মামলায় লন্ডনে তিনি গ্রেপ্তার হন। পরবর্তী সময়ে তাকে আন্দামানে নিয়ে আসা হয়। তবে এই জোড়া খুনের ঘটনায় তিনি অত্যন্ত সন্তর্পণে নিজের যুক্ত থাকার সমস্ত প্রমাণ সরিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিলেন। জেলে থাকাকালীন ব্রিটিশ রাজের কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করে তিনি একাধিক চিঠি লিখেছিলেন। তার মধ্যে ১৯১৩ সালের ১৪ নভেম্বরের আবেদন পত্রে তিনি লেখেন, ‘সরকার যদি তার অপরিমিত বদান্যতা ও ক্ষমা মঞ্জুর করে আমাকে মুক্তি দেয় তাহলে আমি শাসনতান্ত্রিক প্রগতি এবং ইংরেজ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পক্ষে একজন কট্টর সমর্থক ছাড়া আর অন্য কিছু হব না। এই আনুগত্যই হলো এই প্রগতির ক্ষেত্রে সর্বপ্রথম শর্ত। ‘স্বার্থপরতার চূড়ান্ত নিদর্শন দেখিয়ে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে চরম বিশ্বাসঘাতকতার এমন নিদর্শন ইতিহাসে বিরল। কোনো ভিক্ষা আবেদন এর চেয়ে বেশি নীচ, হীন হতে পারে না। যে জেল ছিল যতীন দাস অনশনের মাধ্যমে শাহাদাত বরণের স্থান,যে জেল মানে আন্দামানের মাটি থেকে স্বাধীন অখণ্ড ভারতের স্বপ্ন নিয়ে পরিকল্পনা করার জায়গা, তাই সাভারকরের কাছে পরিণত হয়েছিল প্রভুভক্তি এবং চাটুকারিদার প্রদর্শনের স্থানে।
ব্রিটিশ শাসনের শেষ পর্বে ভারতে আন্দোলন-বিদ্রোহ তীব্রতর হতে থাকে। ১৯৪২ এর ভারত ছাড়ো আন্দোলন ছিল উপনিবেশিকতাবাদের কাছে ডেথ অ্যালার্ট। কিন্তু এই আন্দোলনেও বেইমানি করেছিল সংঘ,হিন্দু মহাসভা এবং তাদের অনুগামীরা। এই সময় কালে বোম্বে স্বরাষ্ট্র দপ্তর মন্তব্য করেছিল, ‘সংঘ নিষ্ঠা সহকারে নিজেদের আইনের মধ্যে বেঁধে রেখেছে এবং ১৯৪২ সালের আগস্টে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়েছে তাতে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে তারা নিজেদের সুনির্দিষ্টভাবে বাইরে রেখেছে। ‘বর্তমানে বাংলায় বিজেপি’র চোখে যিনি সংকট-ত্রাতা সেই শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ছিলেন এই সময় বাংলায় মুসলিম লিগ-হিন্দু মহাসভার কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রী। তিনি বাংলার গভর্নর জন হেরবার্টকে চিঠি লিখে বলেন, ‘বঙ্গের প্রশাসন এমনভাবে পরিচালনা করা উচিত যাতে কংগ্রেসের সর্বোচ্চ প্রয়াসত্ত্বেও বাংলায় আন্দোলন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।’ এই আগস্ট বিদ্রোহের সময়েই উত্তরপ্রদেশের বটেশ্বরে এক বিক্ষোভ কর্মসূচি চলাকালীন পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হন অটল বিহারী বাজপেয়ি। কিন্তু পুলিশের কাছে তিনি আন্দোলনে যুক্ত থাকার কথা অস্বীকার করেন এবং বিশ্বাসঘাতকতা করে বিক্ষোভের নেতৃত্ব লীলাধর বাজপেয়ি সহ আরো অনেককে গ্রেফতার করান। দেশবাসী যখন সম্মুখ সমরে ব্রিটিশের সাথে সেই সময় এই আন্দোলনে পিছন থেকে ছুরি মেরেই মানুষের শক্তিকে পরাজিত করতে চেয়েছিল ধর্মের কারবারিরা।
অজস্র শহিদিবরণ, দেশবাসীর রক্ত ঘাম অশ্রু আত্মত্যাগের বিনিময়ে ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু দেশভাগের প্রাক্কালে ব্রিটিশরা আমাদের দেশকে বিভাজিত করে। র্যা৯ডক্লিফ লাইন কেবল দেশের ভূখণ্ডকে টুকরো করেনি, রক্তস্নাত হয়েছিল দেশবাসীর হৃদয়। এই দেশভাগের পিছনে ছিল দ্বিজাতি তত্ত্বের উদ্রেক, যার প্রধান উদ্গাতা ছিলেন বিনায়ক দামোদর সাভারকর। ১৯৩৭ সালে আমেদাবাদের হিন্দু মহাসভার সর্বভারতীয় সম্মেলনে তিনি বলেছিলেন, ‘ভারতকে আর ঐক্যবদ্ধ সমজাতীয় একটি জাতি হিসেবে মনে করা যায় না।’ এর দু’বছর পর সর্বভারতীয় মুসলিম লিগ সম্মেলনে একই ধরনের বক্তব্য রাখেন মহম্মদ আলী জিন্নাহ। তিনি বলেন, দেশভাগ না হলে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ জন্ম নেবে এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা বিপন্ন হবে। এই বক্তব্যকে সমর্থন করেই সাভারকর আবারও বলেছিলেন, ‘এটা একটা ইতিহাস লব্ধ সত্য যে, হিন্দু ও মুসলিমরা দুটি ভিন্ন জাতি’। নগ্ন ধর্মান্ধতার আবেশে দেশভাগ যাদের মস্তিষ্কপ্রসূত তারাই বিভাজনের সিলমোহর দিয়ে ‘পশ্চিমবঙ্গ দিবস’ পালন করবে এমনটাই কাঙ্খিত।
উগ্র হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলোর সাম্প্রদায়িক আগ্রাসন মুসলিম মৌলবাদী শক্তিগুলোকে সংহত হতে সাহায্য করে। ১৯০৬ সালে গঠিত হওয়া মুসলিম লিগ দেশের স্বাধীনতার জন্য আন্দোলন করেছিল। তার পাশাপাশি তারা মুসলিম সমাজের উন্নয়ন এবং ধর্মের ভিত্তিতে আলাদা মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য তদ্বির করেছিল।উনিশ শতকের শুরুর দিকে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে আন্দোলন,সাইমন কমিশন বিরোধী আন্দোলনগুলোতে মুসলিম লিগ সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু পরবর্তী সময়ে আইন অমান্য আন্দোলন,ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তারা অংশগ্রহণ করেনি। যদিও ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের অধিকাংশই দেশভাগের বিরোধী ছিলেন, কিন্তু দেশভাগের জন্য মুসলিম লিগের একগুয়ে মনোভাবও বৃহৎ অংশে দায়ী। ১৯৩৭ সালে কংগ্রেস মুসলিম লিগ যৌথ সরকার গঠন করলে কংগ্রেসের তরফ থেকে কোনো মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষকে তারা মন্ত্রী হতে দেয়নি, কারণ তাদের দাবি ছিল তারাই একমাত্র মুসলমান সমাজের প্রতিনিধিত্ব করে। সেই সময় কেবল উচ্চবর্ণের শিক্ষিত মানুষেরই ভোটাধিকার সুরক্ষিত ছিল। অভিজাত মুসলমানরা অধিকাংশ মুসলিম লিগের পক্ষে থাকলেও নিম্নবর্গের দরিদ্র মুসলমানরা ছিলেন এই উগ্রতার বিপক্ষে। মুসলিম লিগের নেতৃত্বে মুসলিম ন্যাশনাল গার্ড সংগঠন গড়ে উঠলে অখণ্ডতাবাদী নেতৃত্ব মৌলানা আবুল কালাম আজাদ, সৈফুদ্দিন কিচলু ,মৌলানা আব্দুল মাদানিদের উপর তারা আক্রমণ নামিয়ে আনে। ছদ্ম ধার্মিকতার জিঘাংসাই নামিয়ে আনে দেশভাগের অভিশাপ। সাম্প্রদায়িকতার জুপকাষ্ঠে বলি হয় দেশের অখণ্ডতা।
দেশভাগের পর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে ওঠে ভারত। নিজেদের সংকীর্ণ স্বার্থ পূর্ণ না হওয়ায় দেশের সংবিধান,জাতীয় পতাকা,জাতীয় সংগীতকে কখনোই মান্যতা দেয়নি সংঘ পরিবার। দেশের জাতীয় সংগীত ‘জনগণমন অধিনায়ক’ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রাজা পঞ্চম জর্জের ভারত আগমন উপলক্ষে এই গান লিখেছিলেন। এই আলোচনা সম্পর্কে অবগত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন, ‘ভারত ভাগ্যবিধাতার জয় ঘোষণা করেছি তিনি জনগণের পথচারী। সেই যুগে যুগান্তরের মানব ভাগ্য রথচালক পঞ্চম বা ষষ্ঠ বা কোনো জর্জই হতে পারেন না।‘দীর্ঘদিন ধরেই আরএসএস দাবি করে এসেছিল তিন সংখ্যাটি অশুভ তাই তিন রঙা পতাকা খারাপ মানসিক প্রভাব ফেলবে।পরিবর্তে ২০০২ সাল পর্যন্ত আরএসএস’র হেডকোয়ার্টারে উত্তোলন করা হয় ভাগোয়া ঝান্ডা। দেশের সংবিধানে প্রশ্নে গোলওয়ালকরের বক্তব্য ছিল তা কেবল কিছু পশ্চিম দেশের সংবিধান থেকে তুলে নেওয়া। সাভারকরও মনুসংহিতাকে হিন্দু আইনের ভিত্তি হিসেবে দেশ শাসনের চালিকাশক্তি হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। দেশের সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীতকে যারা কখনো মান্যতা দেয়নি, তারাই আজ দেশপ্রেমের ঠিকাদারি নিয়ে বসে রয়েছে। স্বাধীনতার ৭৬ বছর পেরিয়ে যা চরম পরিহাসের।
রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে ন্যূনতম অবদান নেই সংঘ পরিবারের। আন্দোলন মুখরিত জনতার ব্যারিকেডে বিভাজনের বুলডোজার চালিয়ে ব্রিটিশ শক্তির হাত শক্ত করতে চেয়েছে তারা বারে বারে। পক্ষান্তরে প্রবল শক্তিধর ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বুক চিতিয়ে লড়াই করেছিল এদেশের আমজনতা। তাদেরকে সংগঠিত করেছিল জাতীয় কংগ্রেস। সেই আন্দোলনে শ্রেণি অভিমুখ,বিপ্লবী ধারা সংযোজনায় নতুন প্লাবন এনেছিল কমিউনিস্টরা। স্বাধীনতা সংগ্রাম-সঞ্জাত ভারত নির্মাণের ধারণা সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতা নেই এই লড়াইয়ে অংশগ্রহণ না করা সংঘ পরিবারের। সাভারকরদের বিকৃত হিন্দুত্বের আদর্শে আমাদের দেশকে চালিত করাই তাদের উদ্দেশ্য। করপোরেট-কমিউনাল আঁতাতে মানুষের আজ নাভিশ্বাস উঠছে। বিজেপি’র শাসনে আক্রমণ নেমে আসছে রুটি রুজির উপর, কৃষি-শিল্প-শিক্ষা-স্বাস্থ্যের মতো আমজনতার মৌলিক চাহিদাগুলোর উপর। দেশের মানুষের সমর্থন আদায়ে নিজেদেরকে দেশপ্রেমের সাথে মানানসই করে তুলতে চায় বিজেপি। তাই প্রয়োজন ইতিহাস বিকৃতির। স্বাধীনতার পর সবথেকে কঠিন রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে আমাদের দেশ। মত প্রকাশের স্বাধীনতা যখন শৃংখলে আবদ্ধ তখন মানব মুক্তির লড়ইয়ে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করতে হবে কমিউনিস্টদেরই। সময় এখন লড়াইয়ের ময়দানে অবিচল থাকার। স্বাধীনতা সংগ্রামের আলোকে মনন চিন্তনকে জারিত করতে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে হবে প্রকৃত ইতিহাস। বিশ্বাসঘাতকদের দ্বেষের হাত থেকে দেশ রক্ষাই হোক ৭৭তম স্বাধীনতা দিবসের শপথ।