E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১১ আগস্ট, ২০২৩ / ২৫ শ্রাবণ, ১৪৩০

১০০ দিনের কাজ থেকে মানুষকে বঞ্চিত করার বিরুদ্ধে লড়াই হবে তীব্র

সুপ্রতীপ রায়


তারকেশ্বরে কেশবচক গ্রাম পঞ্চায়েতে বোর্ড গঠনের পর সিপিআই(এম) কর্মীদের উল্লাস।

পশ্চিমবাংলার শাসকশ্রেণি এখন পঞ্চায়েতের বোর্ড গঠন নিয়ে তৎপর। কারণ মানুষের ভোট লুট করে জয়ের সার্টিফিকেট পেলেও অনেক ক্ষেত্রে তৃণমূলের পক্ষে বোর্ড গঠন অনিশ্চিত। কিন্তু এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারে বিজেপি বা তৃণমূল গ্রামীণ মানুষের স্বার্থবাহী কোনো বিষয় কি প্রচারে এনেছিল? পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রচারপর্বে মূলধারায় মিডিয়াগুলিতে কি গ্রামীণ গরিব মানুষের অর্থনৈতিক ইস্যুগুলি স্থান পেয়েছিল? না। আবাস বা ১০০ দিনের কাজ নিয়ে বিজেপি বা তৃণমূল কার্যত নিশ্চুপ ছিল। মূল সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে গিয়েছিল।

চরম অর্থনৈতিক সংকটে মানুষ। গ্রাম ভারত, গ্রামীণ বাংলার অবস্থা চরম সংকটজনক। ১০০ দিনের কাজ যদি পশ্চিমবাংলায় চালু থাকত তাহলে সংকটাপন্ন মানুষ কিছুটা সুরাহা পেতেন। সারা দেশেও (কেরালা বাদে) ‘রেগা’র হাল ভালো নয়। এই অবস্থার মধ্যে সারা দেশে পাঁচ কোটি রেগা শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছেন। ছাঁটাই হওয়া শ্রমিকের সংখ্যা সর্বোচ্চ। ২০২২-২৩ সালে কেবল মাত্র পশ্চিমবাংলাতেই ৮৩ লক্ষ ৩৬ হাজার নথিভুক্ত পরিবারের নাম বাদ গেছে। এরা আর কাজ পাবেন না। এ বিষয়ে তৃণমূল নিশ্চুপ।

২০২১ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে আমাদের রাজ্যে বন্ধ ১০০ দিনের কাজ। এর ফলে গ্রামীণ গরিব মানুষ কাজের অভাবে চরম আর্থিক সংকটে পড়েছেন। সন্ত্রাস করে পঞ্চায়েত পেলেও ১০০ দিনের কাজের দাবিতে লড়াই আগামীদিনে তীব্র হবে।

দিল্লির সরকার আমাদের রাজ্যে ১০০ দিনের কাজের মজুরি আটকে রেখেছে, বকেয়া মজুরিও পরিশোধ করেনি। যুক্তি, রাজ্য সরকার বেনিয়ম করেছে। রাজ্য সরকার বেনিয়ম করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নিয়ে গরিব মানুষগুলোকে শাস্তি দিচ্ছে কেন? এটা পরিষ্কার হচ্ছে ‘রেগা’ প্রকল্পটিকেই বিজেপি তুলে দিতে চাইছে। ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরই মোদি এই প্রকল্প বন্ধ করে দিতে চেয়েছিলেন। প্রতিবাদের মুখে মোদি পিছু হটেন। মোদ্দা কথা বিজেপি সরকার ‘রেগা’ প্রকল্পের আইনি অধিকার কেড়ে নিতে চাইছে।

২০২৩-২৪ সালের কেন্দ্রীয় বাজেটে ‘রেগা’ প্রকল্পে বাজেট বরাদ্দ করা হয়েছে ৬০,০০০ কোটি টাকা। যা গত বছরে ছিল ৭৩,০০০ কোটি টাকা। ২০২১-২২ সালে এই প্রকল্পে বরাদ্দ ছিল ৯৮,৪৬৮ কোটি টাকা। এটাও স্মরণীয় খাদ্য সুরক্ষা খাতেও বরাদ্দ ধারাবাহিকভাবে কমানো হচ্ছে। খাদ্য শস্য সংগ্রহে ভরতুকির পরিমাণও ক্রমহ্রাসমান। এসব প্রশ্নে সংসদে তৃণমূল নিশ্চুপ থাকে।

তৃণমূল আমলে পঞ্চায়েতের কাজে দুর্নীতি মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। গ্রামাঞ্চলে আর্থিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া অংশের পঞ্চায়েতের মাধ্যমে সহায়তা পাওয়ার কথা বেশি। কিন্তু এই অংশই বেশি বঞ্চিত। ‘রেগা’ প্রকল্পে গত কয়েক বছরে লুট চলেছে। গ্রামীণ বেকারত্ব দিনে দিনে বাড়লেও ১০০ দিনের কাজ বন্ধ। শুধু কাজ বন্ধ একথা বললে সবটা বলা হবে না - বিপুল পরিমাণে মজুরি বকেয়া। অনেক লড়াই-সংগ্রামের ফসল ১০০ দিনের কাজ। বাংলায় বছরের পর বছর তাকে ঘিরে বেপরোয়া দুর্নীতি চলেছে। একে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতি বললে ভুল বলা হবে না।

২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকেই বাংলার গ্রাম-শহর, প্রশাসনের সর্বস্তরে দুর্নীতি মুখ্যমন্ত্রীর মদতে বেড়ে চলেছে। নেত্রীর আশীর্বাদধন্য হলেই তিনি অপরাধ করলেও ছাড় পেয়ে যাবেন। মমতা ব্যানার্জির নেতৃত্বে রাজ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে দুর্বৃত্ততন্ত্র।

২০১১ সালের পর থেকে তৃণমূলের আমলে রাজ্যে আর্থিক সংকট ক্রমবর্ধমান। গ্রামের অবস্থা ভয়াবহ। আমাদের রাজ্যে ছোটো চাষির সংখ্যা বিপুল। এদের কাছে ফসলের দাম নেই, এরা প্রাতিষ্ঠানিক ঋণ পান না। মহাজনি ঋণ বা মাইক্রোফিনান্সের জালে এরা জড়িয়ে পড়ছেন। কৃষিজ উপকরণগুলির ভরতুকি কমার ফলে দাম বেড়ে গেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে পঞ্চায়েতের পরিষেবা পেতে গেলে তৃণমূলী লুম্পেনদের কাটমানি দিতে হয়। ১০০ দিনের কাজ করার পর মজুরির একটা অংশ তৃণমূলী দুর্বৃত্তদের দিতে হয়েছে। কোভিড-১৯ এর সংক্রমণকালে লকডাউনের সময় যাঁরা গ্রামে ফিরে এসেছিলেন তাঁদের বড়ো অংশ আর কাজের জায়গায় ফিরে যাননি। কোভিড-১৯-এর সময় অনেকের কাজ চলে গেছে। ১০০ দিনের কাজ চালু থাকলে এই অংশ কিছুটা সহায়তা পেতেন।

‘রেগা’ বিষয়ে আমাদের রাজ্যের চিত্র কী? ২০২১-২২ সালে ৩৬.৪২ কোটি কর্মদিবস তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মজুরি না দিতে পারার জন্য ২০২২-২৩-র ২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কর্মদিবস একেবারে নেমে গিয়েছিল ৩.৪৩ কোটিতে। ২০২২ সালের ২০ জুলাই রাজ্যসভায় কেন্দ্রীয় গ্রাম উন্নয়ন মন্ত্রকের মন্ত্রী জানিয়েছিলেন, ১০০ দিনের প্রকল্পে গোটা দেশে বকেয়া মজুরির পরিমাণ ৩,৯৮৯.৫৮ কোটি টাকা। যার মধ্যে কেবলমাত্র পশ্চিমবাংলার বকেয়া ২,৬০৫.৮২ কোটি টাকা। কিন্তু কেন? কেন্দ্রের যুক্তি - রেগা আইনের ২৭ নং ধারায় উল্লেখিত নির্দেশ সঠিকভাবে না মানার ফলে টাকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়ার পরও সিএজি ২০১১-১২-র পর কোনো অডিট করেনি।

আমাদের রাজ্যে মজুরির হালও খারাপ। ২০২১ সালে রিজার্ভ ব্যাংক প্রকাশিত রিপোর্ট অনুযায়ী এই রাজ্যে গ্রামীণ জনসংখ্যার দৈনিক মজুরির হার মাত্র ২৮৮.৬০ টাকা, যা সর্বভারতীয় হার ৩০৯.৯০ টাকা থেকে কম। কৃষি কাজের সঙ্গে যুক্ত নন এমন শ্রমিকদের মজুরি আমাদের রাজ্যে কম। বাংলায় এই মজুরির হার ৩০৭.৫০ টাকা। যেখানে সর্বভারতীয় হার ৩০৯.১০ টাকা। পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে জব কার্ডধারী শ্রমিকদের নিযুক্ত করা হয়েছে ন্যূনতম মজুরির থেকে অনেক কম মজুরিতে। রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় রাজ্য সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের প্রকল্প শ্রমিকরা ন্যূনতম মজুরি পাচ্ছেন না। এক ভয়ঙ্কর চিত্র পশ্চিমবাংলায়। কী করে এই চিত্র চাপা দেবে শাসক তৃণমূল?

আমাদের রাজ্যের গ্রামীণ মানুষের একটা বড়ো অংশ এখনও চাষের সঙ্গে যুক্ত। যদিও কৃষি সংকটের কারণে কৃষিজীবী মানুষের সংখ্যা কমছে। কৃষি সংকটের কারণে অনেকে চাষের কাজ ছেড়ে দিচ্ছেন। এই মানুষগুলিকে বাঁচাবার জন্য ১০০ দিনের কাজ চালু থাকলে কিছুটা আর্থিক সমস্যা মিটত। রাজ্যে কৃষি সংকট ও কৃষক বিপদে থাকলেও বিজ্ঞাপন-প্রিয় মুখ্যমন্ত্রীর মিথ্যা ভাষণের শেষ নেই। যেমন ২০২১ সালে কৃষ্ণনগরের প্রশাসনিক বৈঠকে তিনি বলেছিলেন, ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পের অনুদানের অর্থ বাড়িয়ে দ্বিগুণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি খেত মজুরদেরও অনুদানের ব্যবস্থা করেছেন। কিন্তু প্রকৃত চিত্র হলো ‘কৃষক বন্ধু’ প্রকল্পে এক একরের বেশি জমি যাদের আছে তারাই কিস্তিতে ৫০০০ টাকা অনুদান পেয়েছেন। আবার জমি চাষ না করেও কেবলমাত্র জমির মালিক, তাই কাগজের জোরে অনুদানের টাকা পাচ্ছেন। লিজ চাষি, পাট্টাহীন গরিব কৃষক এই সুযোগ পান না।

প্রান্তিক কৃষকরা প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্তদের শস্য বিমা সহ বিভিন্ন সরকারি সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এই অংশের জন্য ১০০ দিনের কাজ সহায়তা দিতে পারে - কিন্তু তাও বন্ধ।

রাজ্যে গ্রামীণ জীবনে সংকট বেড়ে চলেছে। বাড়ছে কাজের সংকট। গ্রামীণ অসংগঠিত শ্রমিকদের মজুরি সংকোচন ঘটে চলেছে। তৃণমূলের জমানায় কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য পাচ্ছেন না। এবছর রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে আলু ও পেঁয়াজ চাষিরা বিক্ষোভে শামিল হয়েছিলেন। চাষিরা অভাবী বিক্রয়ে বাধ্য হচ্ছেন। কৃষক আত্মহত্যা বাড়ছে। কৃষি সমবায়গুলিতে দুর্নীতি রমরমিয়ে চলছে। দালাল, ফড়েদের মৃগয়াক্ষেত্র পশ্চিমবাংলা। গ্রামীণ গরিবদের জীবন জীবিকা সংকটে।

কৃষি সংকটের কারণে গ্রামীণ পরিবারের আয়ের বড়ো অংশই আসে অকৃষি ক্ষেত্র থেকে। প্রান্তিক কৃষক, গরিব কৃষকের পরিমাণ বাড়ছে। প্রান্তিক কৃষক পরিবারগুলির জমির পরিমাণ খুব কম। এদের পারিবারিক মাসিক আয়ের ৮৬ শতাংশ আসে অকৃষি উৎস থেকে। মাঝারি পরিমাণ জমির মালিক যারা তাদের পারিবারিক আয়ের ৬৩ শতাংশ আসছে অকৃষি উৎস থেকে। কৃষি কাজ থেকে আয় কমার কারণে গ্রামীণ পরিবারগুলি অকৃষি কাজের দিকে ঝুঁকছেন। সংকট ভয়াবহ।

গ্রাম বাংলার বিপুল পরিমাণ মানুষ কাজের জন্য অন্য রাজ্যে পাড়ি দিয়েছেন। পশ্চিমবাংলায় গ্রামীণ বেকারত্বের সংখ্যা বাড়ছে। এনএসও ২০১৯-র রিপোর্ট থেকে জানা যাচ্ছে, গ্রামীণ বেকারির পরিমাণ বাড়ছে। বিদেশে বিশেষ করে আরব দেশগুলিতে যে সমস্ত রাজ্য থেকে পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজের সন্ধানে পাড়ি দেয় তার প্রথম পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে পশ্চিমবাংলা আছে।

গ্রাম বাংলার গভীর সংকটের ফলে আয় বৃদ্ধির সম্ভাবনা নেই। রাজ্যে শিল্পক্ষেত্রে বিপর্যয় নামিয়ে এনেছে তৃণমূল। এই বিপর্যয় থেকে বেরিয়ে আসার কোনো সম্ভাবনা নেই। বরং রাজ্য সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কারণে শিল্পক্ষেত্রে সংকট আরও বাড়বে। ফলে গ্রামীণ মানুষ শিল্পক্ষেত্রেও কাজ করার সুযোগ পাবেন না।

তাহলে ভবিষ্যৎ কী? কিছুটা সমস্যার নিরসন হতে পারে কীভাবে? ১০০ দিনের কাজ চালু করার দাবিতে লড়াই তীব্র হবেই। মানুষকে বাঁচতে হবে। গরিব মানুষের শ্রেণির দাবিতে লড়াইকে চিরদিন স্তব্ধ করে রাখা যাবে না।