E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৬১ বর্ষ ১ সংখ্যা / ১১ আগস্ট, ২০২৩ / ২৫ শ্রাবণ, ১৪৩০

পরিবেশ আলোচনা

সংসদে ধ্বনি ভোটে পাস দুই সংশোধনী বিল

দেশের অরণ্য এবং জৈব সম্পদের সম্ভার এখন বহুজাতিকদের জন্য উন্মুক্ত

তপন মিশ্র


জীববৈচিত্রের হটস্পট - সুন্দরবন।

জীববৈচিত্র্যের দিকদিয়ে পৃথিবীর অন্যতম ধনী দেশ ভারত। বৈচিত্র্যময় বাস্তুতান্ত্রিক গঠনের কারণে আমাদের দেশ জীববৈচিত্র্যের দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। এর মধ্যে রয়েছে প্রায় ৪০,০০০ প্রজাতির উদ্ভিদ এবং ৮৫,০০০ প্রজাতির প্রাণী। এই তালিকাটি সম্পূর্ণ নয় কারণ এমন অনেক প্রজাতি আছে যা এখনও বিজ্ঞানের খাতায় লেখা হয়নি। ভারতে বিশ্বব্যাপী উদ্ভিদ সম্পদের প্রায় ১২ শতাংশ রয়েছে। ভারতে ৩,০০০টিরও বেশি ঔষধি প্রজাতি রয়েছে যা বিভিন্ন জনজাতির মানুষ ব্যবহার করেন। এনভিস (এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন সিস্টেম)-এর ডাটাবেস অনুযায়ী ১,০০০-রও বেশি উদ্ভিদ প্রজাতি রয়েছে যেগুলি ব্যবসায়িক ঔষধি গাছ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সরকারের যেন এই সম্পদ রক্ষা করার কোনো দায় নেই।

জীববৈচিত্র্য সংশোধনী আইন

বিশ্বায়নের শুরুর কিছু পরে আমাদের দেশের বায়োডাইভারসিটি অ্যাক্ট (২০০২) তৈরি হয়। এই আইন দেশের জীববৈচিত্র্য সম্পদ রক্ষার ক্ষেত্রে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। দেশজুড়ে আলোচনা এবং পঞ্চায়েত স্তরের জীববৈচিত্র্য নথি তৈরির অভিজ্ঞতাকে একত্রিত করে অনেক আলাপ আলোচনার পর ২০০২ সালে এই আইন তৈরি হয়। এই পরীক্ষা নিরীক্ষা প্রক্রিয়ায় এবং আইন তৈরির প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে দেশের বামপন্থীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। গত ২৫ জুলাই সংসদে, যখন মণিপুরে হিংসা নিয়ে উত্তপ্ত আলোচনা চলছে, তার মধ্যে এই আইনের সংশোধনী (জীববৈচিত্র্য সংশোধনী বিল, ২০২১) নিয়ে কোনো আলোচনার সুযোগ না দিয়ে, ধ্বনি ভোটে পাশ করিয়ে নেওয়া হয়। এই সংশোধনীসমূহ ২০০২-এর আইনকে অত্যন্ত লঘু করেছে এবং আমাদের জৈব সম্পদকে কার্যত বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে।

প্রথমত, এই বিলে আনুষ্ঠানিকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, “কোলাবোরেটিভ রিসার্চ প্রোজেক্টস”-এর নামে রাজ্য বায়োডাইভারসিটি অথরিটি-কে না জানিয়ে দেশের জৈব সম্পদ বাইরে পাচার করা যাবে। এক্ষেত্রে দেশে গবেষণা, পেটেন্টিং এবং বাণিজ্যিক ব্যবহার সহ জৈবিক সম্পদে আরও বিদেশি বিনিয়োগ আনা অন্যতম একটি লক্ষ্য। অন্যদিকে ২০০২-এর আইনের মূল বিষয় ছিল জৈবিক বৈচিত্র্যের সংরক্ষণ এবং টেকসই ব্যবহারের উপর গুরুত্বদান এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের জন্য উপযোগী ব্যবস্থা তৈরি করা। ফলে আইনে নতুন সংশোধনীটি জৈবিক সম্পদ সংরক্ষণের বিরুদ্ধে বাণিজ্যিকীকরণের রাস্তা (Biopiracy) খুলে দিতে ভূমিকা গ্রহণ করবে।

জাপানের নাগোয়া শহরে ২০১০ সালের কনভেনশন অন বায়োলজিক্যাল ডাইভারসিটি দশম সিওপি (কনফারেন্স অব পার্টিজ)-তে এবং পরে ২০২২ সালে কুনমিং-মন্ট্রিল ফ্রেমওয়ার্ক গ্লোবাল বায়োডাইভারসিটি ফ্রেমওয়ার্ক অ্যাক্সেস এবং বেনিফিট শেয়ারিং অর্থাৎ জীববৈচিত্র্য থেকে যে সুবিধা পাওয়া যায় তা এলাকার জনজাতিদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়ার উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। তা ছাড়াও বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য ‘‘আদিবাসী এবং স্থানীয় সম্প্রদায়ের থেকে আগে সম্মতি’’ নেওয়ারও সুপারিশ করা হয়। আমাদের দেশের ২০০২-এর আইনেও এই ব্যবস্থাগুলির উপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল।

ভারতের জীববৈচিত্র্য।

কিন্তু এবারের সংশোধনী বিলে এই ধারাটি সরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং বেশ কয়েক ধরনের সংস্থাকে অনুমতি ছাড়া আমাদের জৈবিক সম্পদ ব্যবহার করায় ছাড় দেওয়া হয়েছে। এটি আক্ষরিক অর্থে পতঞ্জলি এবং কিছু অ্যালোপ্যাথি ফার্মার মতো বাণিজ্যিক শিল্পকে মুনাফা অর্জনের জন্য স্থানীয় জনজাতিদের ক্ষতিপূরণ না দিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদ ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করতে দেওয়ার একটি পরিকল্পনা। এই সংশোধনীর বিরুদ্ধে অনেক সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইতিমধ্যে আওয়াজ তুলেছে। এই সংশোধনীতে স্থানীয় সম্প্রদায়ের জৈবিক সম্পদ ব্যবহারের অনুমতি দানের যে অধিকার ও ক্ষমতা ছিল তা ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা আছে। সংশোধনীর ৮ নম্বর ধারা (১) উপধারায় যা বলা হয়েছে তার সরমর্ম হলোঃ “দেশ বা দেশের বাইরের, কোনো সংস্থা জৈবিক সম্পদের উপর কোনো গবেষণা বা তথ্যের উপর ভিত্তি করে যে কোনো আবিষ্কার, এর সাথে সম্পর্কিত ঐতিহ্যগত জ্ঞান (traditional knowledge) সহ, এই সংক্রান্ত জাতীয় মেধা-সম্পত্তি (intellectual property)-র অধিকারের জন্য সরাসরি জাতীয় জীববৈচিত্র্য কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমোদন গ্রহণ করবে।” অর্থাৎ এখানে পঞ্চায়েত বা পুরসভা স্তরে যে বায়োডাইভারসিটি ম্যানেজমেন্ট কমিটি বা রাজ্য স্তরে স্টেট বায়োডাইভারসিটি বোর্ডের কোনো ভূমিকা নেই। এই ক্ষমতা কেবল ন্যাশনাল বায়োডাইভারসিটি অথরিটি-কে দেওয়া হয়েছে অর্থাৎ সমস্ত ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণের চেষ্টা হয়েছে। জৈবসম্পদের লুঠকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে আইনের এই পরিবর্তন।

অরণ্য সংরক্ষণ সংশোধনী আইন

অরণ্য সংরক্ষণ আইন (১৯৮০)-এর সংশোধনী বিলও একই দিনে (২৫ জুলাই, ২০২৩) ধ্বনি ভোটে লোকসভায় পাস করানো হয়। এই সংশোধনীর আসল উদ্দেশ্য হলো, দেশের বেশ কয়েকটি বনাঞ্চলকে সংরক্ষণের বাইরে আনা। এই সংশোধনীতে অরণ্যের সুপ্রিম কোর্ট নির্ধারিত সংজ্ঞা পরিবর্তন করে বেশ কিছু অরণ্য ব্যক্তি মালিকানার আওতায় ফিরিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

১৯৭২ সালের স্টকহোম পরিবেশ সম্মেলনের সিদ্ধান্তের কারণে আন্তর্জাতিক চাপ, অরণ্য থেকে খনিজ সম্পদ এবং কাষ্ঠ সম্পদ সংগ্রহের মরিয়া প্রয়াসের জন্য ক্রমহ্রাসমান অরণ্য আচ্ছাদন রোধ করতে ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন সংসদে গ্রহণ করতে হয়। অরণ্য সংরক্ষণের এই আইনের পেছনে অরণ্যবাসীদের নিরন্তর আন্দোলনও এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করে। সারা দেশে সরকারি সহায়তা ব্যতিরেকে যৌথ বন পরিচালনের আন্দোলন আরাবাড়ি ছাড়িয়ে সরকারি সংরক্ষণ ব্যবস্থাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দেয়।

সরকারি হিসাব বলছে, ১৯৫০ থেকে ১৯৮০ সালের মধ্যে, আমাদের দেশে ৪৩ লক্ষ হেক্টর (৪৩,০০০ বর্গ কিলোমিটার) বনভূমি ধ্বংস করা হয়েছে। এর অর্ধেক পরিমাণ ধ্বংস হয়েছে শিল্প, খনি, জলবিদ্যুৎ, পুনর্বাসন ও কৃষির মতো উন্নয়ন প্রকল্পের জন্য এবং বাকি অর্ধেক ধ্বংসের কারণ অরণ্যের বেআইনি দখল। ১৯৮০ সালের অরণ্য সংরক্ষণ আইন এই ধরনের ব্যাপক অরণ্য ধ্বংসের পরিমাণে অভূতপূর্ব হ্রাস ঘটাতে সক্ষম হয়। এবং এই আইন বন উজাড় রোধ করার জন্য প্রবর্তন করা হয়েছিল। ১৯৮০ সালের আগে অরণ্য ধ্বংসের বার্ষিক হার ছিল ১,৪৩,০০০ হেক্টর। আইন প্রবর্তনের পর এই হার কমে দাঁড়ায় বার্ষিক ৪০,০০০ হেক্টর । কেন্দ্রীয় সরকার গঠিত ফরেস্ট অ্যাডভাইজরি কমিটি (এফএসি)-র অনুমোদন ব্যতিরেকে অরণ্য ভূমিকে অন্য কোনভাবে ব্যবহারের উপর এই আইনে নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

পাঠকদের সুবিধার জন্য বলা দরকার যে, অরণ্যের বাইরে বৃক্ষাচ্ছাদন বাদ দিলে বর্তমানে দেশের বনভূমির পরিমাণ প্রায় ২৩ শতাংশ (ফরেস্ট সার্ভে অফ ইন্ডিয়া -২০২১)। ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন এবং ওয়ার্ল্ড রিসোর্স ইনস্টিটিউট যে স্যাটেলাইট সমীক্ষা করে সেই সমীক্ষা অনুযায়ী আমাদের সরকারি হিসাবে দেখানো অরণ্যের পরিমাণ যে অনেক বেশি করে দেখনো হয় তার ইঙ্গিত রয়েছে। তা সত্ত্বেও অরণ্য সৃজনের মধ্যদিয়ে ২০৭০ সালের মধ্যে দেশে ‘নেট জিরো’ নির্গমন (বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে পরিমাণ কার্বনের নির্গমন ঘটবে তা শোষণ করবে অরণ্যভূমি ) এক অলীক লক্ষ্যমাত্রা সরকার ঘোষণা করেছে।

জুলাই মাসে লোকসভায় পাস করা সংশোধনীতে যে বনাঞ্চলগুলি সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে তার মধ্যে রয়েছে -

১। দেশের আন্তর্জাতিক সীমানা থেকে দেশের ভিতর ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে অরণ্যভূমি এই সংরক্ষণের আওতার বাইরে রাখা হয়েছে। এই ছাড়ের আওতায় পড়বে সম্পূর্ণ উত্তর-পুর্ব ভারত, হিমালয়ের বিভিন্ন অংশের বনাঞ্চল এবং সুন্দরবন। উত্তর-পুর্ব ভারত এবং হিমালয়ের বনাঞ্চল বিশ্বের দুটি গুরুত্বপূর্ণ জীববৈচিত্র্য হটস্পট। সারা পৃথিবীতে ৩৬টি জীববৈচিত্র্যের হটস্পট চিহ্নিত করা হয়েছে। এর মধ্যে ভারতে চারটি জীববৈচিত্র্যের হটস্পট রয়েছে। এই হটস্পটগুলি চিহ্নিত হয়েছে উচ্চ প্রজাতি বৈচিত্র্য, এন্ডেমিক প্রজাতির সংখ্যা এবং এগুলির ক্ষয় হয়ে যাওয়ার প্রবণতা ইত্যাদির উপর ভিত্তি করে। সুন্দরবন পৃথিবীর বৃহত্তম বাদাবন। অর্থাৎ এই তিনটি অঞ্চলের বনাঞ্চল পরিবেশ রক্ষার দিক দিয়ে অত্যন্ত সংবেদনশীল। এখানে বেসরকারি এবং সরকারি যৌথ উদ্যোগে নির্মাণ কাজ করা যাবে।

২। একইভাবে নিরাপত্তার নামে দেশের যেকোনো প্রান্তে ৫ থেকে ১০ হেক্টর পর্যন্ত বনভূমি অধিগ্রহণ করে অরণ্য ধ্বংস করার ক্ষমতা সরকার এই সংশোধনীতে যুক্ত করেছে। এখানে বলা আছে যে, বাম-চরমপন্থীদের শায়েস্তা করতে এই ব্যবস্থা সরকার যেকোনো সময়ে নিতে পারে।

এই সংশোধনী বিলের দ্বিচারিতা হলো - জলবায়ু পরিবর্তন প্রশমিত করার জন্য অরণ্য-ভিত্তিক কার্বন সিঙ্ক (অরণ্যে কার্বন ভাণ্ডার) তৈরি করার কথাও বলা হয়েছে। এই কারণে ক্ষতিপূরণমূলক বনায়ন (compensatory afforestation)-এর ব্যবস্থার কথাও বলা হয়েছে। দ্বিচারিতা হলো এখানেই, কেন না, কখনোই প্রাকৃতিক অরণ্যের কার্বন শোষণের ক্ষমতা বৃক্ষরোপণের মধ্য দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা যায় না। প্রাকৃতিক অরণ্যের অনেক ধরনের বাস্তুতান্ত্রিক উপযোগিতা রয়েছে। এগুলিকে অস্বীকার করে কেবল কার্বন শোষণের উপর গুরুত্ব দেওয়া নির্বোধের কর্ম।

এই সংশোধনীর মধ্যদিয়ে যে সমস্ত অরণ্য সংরক্ষণের আওতার বাইরে চলে যাবে সেগুলিতে অরণ্য অধিকার আইন (২০০৬)-এর হাল কী হবে সে বিষয়ে সরকার নীরব। ভারত সরকারের পরিবেশ ও অরণ্য মন্ত্রণালয় বলেছে যে, সংশোধনীটি পেশ করার আগে আদিবাসী মন্ত্রণালয় -এর কাছে পাঠানো হয়। কিন্তু কেন? যদি অরণ্যই না থাকে তবে আদিবাসী-বনবাসীদের অরণ্য অধিকার খর্ব হতে বাধ্য।

আমাদের দেশের অরণ্য ও অন্যান্য জৈবিক সম্পদ বহুজাতিকদের সামনে উন্মুক্ত করার অর্থ হলো, আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের অবাধ লুট। এর সঙ্গে যুক্ত আছে জৈবিক সম্পদের সাথে সম্পর্কিত জ্ঞান বা মেধা সম্পত্তির লুট। সম্প্রতি জাতিসংঘ স্পষ্টভাবে বলেছে যে, জীববৈচিত্র্যের লুণ্ঠন আমাদের মূল্যবান জেনেটিক বৈচিত্র্যের সামনে এক চ্যালেঞ্জ এবং এই চ্যালেঞ্জর মোকাবিলা না করতে পারলে আমাদের খাদ্য ও স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তা বিপন্ন হবে।