৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
কৃষিনীতি বাতিলের দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া
গাজিপুরে দিল্লি-উত্তর প্রদেশ সীমান্তে পুলিশ আটকানোর পর জাতীয় সড়কের উপর অবস্থানে কৃষকরা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের সর্বনাশা কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে কৃষক সংগঠনগুলির ডাকে হরতালে স্তব্ধ হলো গোটা দেশ। ৮ ডিসেম্বর কৃষকদের ডাকে সাড়া দিয়ে শ্রমজীবী মানুষেরাও দেশের বিভিন্ন প্রান্তে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। দেশের ২২টি রাজ্যে কেন্দ্রের কৃষক বিরোধী-কর্পোরেটমুখী তিন কৃষি আইন রুখতে প্রতিরোধী মেজাজে হরতাল পালিত হয়েছে। অনেক রাজ্যে এই হরতাল বন্ধের চেহারা নিয়েছে। যানবাহন চলেনি, দোকান-বাজার ছিল বন্ধ। দেশের জাতীয় সড়কের অর্ধেকের বেশি ছিল অবরুদ্ধ। গ্রাম ভারতে এদিন লক্ষ লক্ষ মানুষ পথে নেমে প্রতিবাদে শামিল হয়েছেন। মিছিল-বিক্ষোভ-অবরোধে স্তব্ধ হয়েছে শহর-শিল্পাঞ্চল।
এদিনের এই ধর্মঘট সফল হওয়ায় সারা ভারত কৃষক সভার পক্ষ থেকে দেশের মানুষকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। সংগঠনের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা বলেছেন, কৃষকেরা তাদের শক্তি দেখিয়ে দিয়েছে। কোনো প্রসাধনী পরিবর্তন নয়, তিন কৃষি আইন প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত লড়াই চলবে।
ধর্মঘটের দিন শুনশান আগরতলার রাজপথ।
কেন্দ্রীয় ট্রেড ইউনিয়নের যুক্ত মঞ্চের তরফে ধর্মঘট সফল করার জন্য শ্রমজীবী মানুষকে অভিনন্দন জানানো হয়েছে। সিআইটিইউ-র পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কর্পোরেটের হাতে কৃষিক্ষেত্রকে তুলে দেবার বিরুদ্ধে এই লড়াইয়ে কৃষকদের পাশে সমস্ত পরিস্থিতিতে থাকবে সিআইটিইউ।
এদিন কেন্দ্রের তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ধর্মঘটে অচল হয়ে যায় পাঞ্জাব ও হরিয়ানা। গ্রামে গ্রামে মিছিল সংগঠিত হয়েছে। এই দুই রাজ্যের বড়ো শহর পুরোপুরি স্তব্ধ হয়ে গেছে। পাঞ্জাবে প্রায় ৫০ হাজার সরকারি কর্মী গণক্যাজুয়াল লিভ নিয়েছিলেন এদিন। হরিয়ানার মধ্যে এবং হরিয়ানা থেকে ভিন রাজ্যে বাস চলাচল বন্ধ ছিল। এই দুই রাজ্যেই সমস্ত পেট্রোল পাম্প বন্ধ করে ধর্মঘটে শামিল হন ডিলাররা। হরিয়ানার বিজেপি পরিচালিত খাট্টার সরকার ধর্মঘটকে বানচাল করতে বিশাল পুলিশ বাহিনী নামিয়েছিল। কিন্তু দমানো যায়নি কৃষকদের। কৃষকরা সড়ক অবরোধ করে, চাক্কা জ্যাম করে অচল করে দেয় রাজ্য। পাঞ্জাবে শাসকদল কংগ্রেস ছাড়াও বিরোধী শিরোমণি আকালি দল, আম আদমি পার্টি সকলেই বন্ধের সমর্থন জানিয়েছিল।
কৃষক ধর্মঘটে কার্যত শুনশান আমেদাবাদ।
উত্তরপ্রদেশে যোগী আদিত্যনাথ সরকার আগে থেকেই দমনপীড়ন নামিয়ে এনেছিল। এদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। গৃহবন্দি করে রাখার চেষ্টা হয়েছে বিরোধী রাজনৈতিক নেতাদের। কিন্তু ধর্মঘট ঠেকানো যায়নি। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে ধর্মঘটে ভালো সাড়া পড়ে। লক্ষ্ণৌয়ে বিধানভবনের সামনে মৌন ধরনায় শামিল হন সমাজবাদী পার্টির বিধায়করা। রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে রাস্তায় যানবাহন ও যাত্রী অন্যদিনের তুলনায় ছিল যথেষ্টই কম। পুলিশি বাধা হটিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে গোরক্ষপুর, আমেথি, কৌশাম্বি, আজমগড়, গাজিপুর, চিত্রকুট, মথুরা, সাহারানপুর, কানপুর প্রভৃতি জায়গায়।
বিজেপি শাসিত আসামেও হরতালে ব্যাপক সাড়া পড়েছে। এদিন সকাল থেকেই রাজ্যের বিভিন্ন স্থানে বিক্ষোভ-অবরোধে শামিল হন সিপিআই(এম) সহ বামদলগুলি, কংগ্রেস, এআইইউডিএফ সহ ১৪টি বিরোধী রাজনৈতিক দল। দোকানপাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যানবাহন বন্ধ রেখে কৃষকদের দাবিতে সমর্থন জানান সাধারণ মানুষ। রাজ্যের তেলক্ষেত্রগুলিতে কাজ হয়নি। দুরপাল্লার বাস, বাণিজ্যিক যানবাহন চলেনি। গুয়াহাটি, ডিব্রুগড়, জোরহাট, শিবসাগর, লখিমপুর, হোজাইয়ের মতো শহরের রাস্তা ছিল শুনশান। রাজ্যের নানা জায়গায় সিপিআই(এম)’র কর্মী-সমর্থক সহ এসএফআই এবং বিভিন্ন গণসংগঠনের কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কৃষক-বিরোধী তিন আইন বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে হরতালে চেন্নাইয়ে বিক্ষোভ বামপন্থীদের।
বিজেপি পরিচালিত উত্তরাখণ্ডেও দিনভর ধরনা, বিক্ষোভ, অবরোধ, হরতালের ব্যাপক প্রভাব পড়ে। কৃষক সংগঠনগুলির নেতৃত্বে কৃষকেরা দলে দলে রাস্তায় নেমে হরিদ্বার, উধম সিং নগর, পিথোরগড়ের মতো জেলা পুরোপুরি অচল করে দেয়। হরিদ্বারের গ্রামীণ এলাকায় হরতাল ছিল সর্বাত্মক। এদিন সকাল থেকেই হরিদ্বার-দিল্লি হাইওয়ে অবরোধ করে অচল করে দেয় কৃষকেরা।
গুজরাটের মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যেও পুলিশ ও প্রশাসনের বাধা উড়িয়ে বহু জায়গায় হরতাল পালন করেছেন মানুষ। কৃষকদের ‘ভারত বন্ধ’ ঠেকাতে এদিন আহমেদাবাদে প্রচুর পুলিশ নামানো হয়েছিল। ১৪৪ ধারা জারি হয়েছিল। কিন্তু বিক্ষোভ রোখা যায়নি। গ্রামীণ গুজরাটের নানা স্থানে টায়ার জ্বালিয়ে তিনটি জাতীয় সড়ক অবরোধ করা হয়। বিভিন্ন জায়গায় ২০০-র বেশি ধর্মঘটীকে এদিন গ্রেপ্তার করা হয়।
মধ্যপ্রদেশের গোয়ালিয়রে এদিন বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে জলকামান ছোঁড়ে পুলিশ। ভোপাল, মোরেনা সহ কোনো মান্ডিতেই এদিন ফসল বেচতে আসেনি কৃষকরা। ভোপালে ক্ষুব্ধ কৃষকেরা মুখ্যমন্ত্রী শিবরাজ সিং চৌহানের বাসভবনের দিকে এগোতে গেলে পুলিশের বাধায় ব্যাপক উত্তেজনা তৈরি হয়। ইন্দোরে কংগ্রেস নেতা দ্বিগ্বিজয় সিংয়ের নেতৃত্বে দলীয় কর্মীরা বিক্ষোভ দেখান।
হিমাচলপ্রদেশেও কৃষকদের দাবির পক্ষে জোরালো বিক্ষোভ হয়েছে। সিমলার ভিক্টরি টানেলের কাছে সিআইটিইউ’র নেতৃত্বে রাস্তা অবরোধ করে টানা বিক্ষোভ হয়েছে। সংগঠিত-অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা ছাড়াও বামপন্থী দলের কর্মীরা এই বিক্ষোভে অংশ নেন। হামিরপুরে গান্ধিচক এবং জেলা আদালতের বাইরে মিছিল ও ধরনায় অংশ নেন বামপন্থী ও কংগ্রেস দলের কর্মীরা।
অন্ধ্রপ্রদেশে কৃষি আইন প্রত্যাহারের দাবিতে সমস্ত শহরেই সিপিআই(এম) এবং বামপন্থীদের উদ্যোগে মিছিল হয়েছে। বিক্ষোভ হয়েছে বাসস্ট্যান্ড ও রেল স্টেশনে। সংসদে কৃষি বিল সমর্থন করায় শাসকদল ওয়াইএসআর’এর ওপর কৃষকদের ক্ষোভ ছিল চরমে। তাই চাপে পড়ে রাজ্য সরকার সরকারি পরিবহণ বন্ধ রেখেছিল। রাজ্য সরকারের পরামর্শে আগাম ছুটি ঘোষিত হয়েছিল রাজ্যে। রাজ্য সচিবালয়েও বিশেষ কাজ হয়নি।
এদিন বিহারেও হরতালের ব্যাপক সাড়া পড়ে। গোটা রাজ্যেই এদিন জনজীবন ব্যাহত হয়েছে। সিপিআই(এম) সহ বিরোধী দলগুলি একজোট হয়ে রাজ্যের প্রায় সমস্ত জাতীয় সড়ক এবং বড়ো বড়ো রেলস্টেশনে অবরোধ চালায়। পাটনার বুদ্ধ স্মৃতি পার্ক থেকে সিপিআই(এম)’র উদ্যোগে বিশাল মিছিলে অংশ নিয়েছিলেন সর্বস্তরের মানুষ।
কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে এদিন ওডিশায় জনজীবন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে পড়েছিল। এদিন সকাল থেকেই দফায় দফায় রাস্তা এবং রেল স্টেশনগুলি অবরোধ করেন বামপন্থী ও কংগ্রেস সহ বিরোধী দলের কর্মীরা। গত কয়েকদিনের আন্দোলনের তীব্রতা দেখে এদিন সরকারি দপ্তর এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিতে আগাম ছুটি ঘোষণা করেছিল ওডিশা সরকার।
মহারাষ্ট্রে এদিন কৃষিপণ্যের বাজার পুরো বন্ধ ছিল। পুনে, নাসিক, ঔরঙ্গাবাদে পাইকারি সবজি বাজার ছিল সম্পূর্ণ বন্ধ। রাজ্যে সরকারি বাস চলাচল কম করেছে। গ্রামে বন্ধ ছিল সর্বাত্মক। জাতীয় সড়ক ও রেলপথে অবরোধ ও বিক্ষোভে অংশ নেয় বামপন্থী দল, এনসিপি, কংগ্রেস, শিবসেনার কর্মীরা।
তেলেঙ্গানায় এদিন কৃষকদের হরতালে বিক্ষোভ সংগঠিত করে বামপন্থী দল সহ কংগ্রেস এবং টিআরএস। এদিন হরতাল ছিল সর্বাত্মক। রাজ্যের বহু জেলায় সরকারি বেসরকারি অফিস, কলকারখানা বন্ধ ছিল।
ছত্তিশগড়ে হরতালের প্রভাবে বড়ো বড়ো শহর ছিল বন্ধ। বহু শহরে দোকানপাটও খোলেনি। বামপন্থীরা সহ কংগ্রেস বিধায়করা এদিন রাস্তা অবরোধ করেন। পরিবহণ কর্মীরাও এদিন হরতালে শামিল হয়েছিলেন।
কৃষক জমায়েতে অবরুদ্ধ দিল্লি-হরিয়ানা সীমান্ত -
সিঙ্ঘু সীমান্তে জাতীয় সড়কের উপর বারো কিমি লম্বা ট্রাক-ট্রাক্টরের লাইন।
একই সঙ্গে প্রার্থনা করছেন শিখ ও মুসলিম সম্প্রদায়ের কৃষকরা।
কৃষকদের দেশব্যাপী হরতালের ডাকে এদিন প্রত্যাশিতভাবেই কৃষিপণ্যের চলাচল বন্ধ ছিল। মান্ডিগুলোতে কাজ হয়নি। দিল্লির বৃহত্তম সবজিবাজার আজাদপুর ছিল জনশূন্য। পণ্যবাহী ট্রাক চলতে দেখা যায়নি দেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তে। আদিবাসী এলাকায় অসংখ্য মিছিল সংগঠিত হয়েছে। নির্মাণকর্মী, পাথরখাদান সহ অন্যান্য শিল্পের শ্রমিকরাও বিরাট সংখ্যায় অংশ নিয়েছিলেন ধর্মঘটে। দেশের এক হাজারেরও বেশি আদালতে এদিন আইনজীবীরা কাজ করেননি। এদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে মোদী সরকারের কর্পোরেটমুখী নীতির বিরুদ্ধে আওয়াজ উঠেছে।
দেশজোড়া ধর্মঘটে অংশ নেবার জন্য সবচেয়ে বেশি আক্রমণ হয়েছে হরিয়ানা, গুজরাট ও উত্তরপ্রদেশে। দিল্লি-জয়পুর সড়কে গুরগাঁওয়ের বিলাসপুর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে সিপিআই(এম) সাংসদ কে কে রাগেশ, এআইকেএস নেতা পি কৃষ্ণপ্রসাদ, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির সাধারণ সম্পাদিকা মরিয়ম ধাওয়ালে, সারা ভারত খেতমজুর ইউনিয়নের যুগ্ম সম্পাদক বিক্রম সিং, সিআইটিইউ নেত্রী সুরেখা, নির্মাণকর্মীদের সর্বভারতীয় ফেডারেশনের সভাপতি সুখবীরকে। গুজরাটে সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক অরুণ মেহতা, কৃষকসভার সম্পাদক পুরুষোত্তম পারমার সহ একাধিক নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সিপিআই(এম) পলিট ব্যুরো সদস্য সুভাষিণী আলির বাড়ি আগে থেকেই ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়ালের বাড়িও ঘিরে রেখেছিল পুলিশ। এসব সত্ত্বেও দেশব্যাপী ধর্মঘটে বিপুল সাড়া পড়ে। দিল্লির সীমান্তে সিঙ্ঘু, টিকরি, গাজিপুরে অবরোধকারী কৃষকদের উৎসাহ ছিল ব্যাপক। ১৩ দিন অবরোধে অংশ নেওয়া সত্ত্বেও তাদের মধ্যে কোনো ক্লান্তির ছাপ ছিল না।