E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

কেন্দ্রের সংশোধনী প্রস্তাব খারিজ করলেন কৃষক নেতারা

কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে দেশজুড়ে আরও বৃহত্তর আন্দোলনের ডাক


নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে আন্দোলনকে আরও তীব্র করার পথেই অগ্রসর হলো কৃষক সংগঠনগুলি। ৮ ডিসেম্বর রাতে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহর সঙ্গে বৈঠকের পর সরকারের লিখিতভাবে সংশোধনীর প্রস্তাবকে খারিজ করে কৃষক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ জানিয়ে দেন, কৃষি আইনের বাতিলের দাবিতে আন্দোলন আরও তীব্র হবে।

৯ ডিসেম্বর নেতৃবৃন্দ কেন্দ্রের সংশোধনীর লিখিত প্রস্তাব হাতে পেয়ে কৃষক নেতারা দেখেন তাতে নতুন কিছুই নেই। তিন কৃষি আইন বাতিলের দাবি অস্বীকার করে, মূল প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে কিছু প্রস্তাব পাঠায় কেন্দ্র। তারপর নিজেদের মধ্যে বৈঠক সেরে কৃষক নেতৃবৃন্দ সেই প্রস্তাব সরাসরি খারিজ করে দিয়েছেন। এদিন তাঁরা ঘোষণা করেছেন আগামী কয়েক দিনে রাজধানীকে ঘিরে আরও সড়ক অবরোধ করা হবে। দিল্লি-জয়পুর সড়ক ১২ ডিসেম্বর থেকে অবরোধ করা হবে। ১৪ ডিসেম্বর দেশজুড়ে ব্যাপক আকারে প্রতিবাদ কর্মসূচি হবে। বিভিন্ন রাজ্যে প্রতিবাদ ও রাস্তা অবরোধের কর্মসূচি নেওয়া হবে। জেলাশাসকের অফিসগুলির সামনে ধরনা দেওয়া হবে। জিও এবং আদানিদের পণ্য বয়কট করবেন কৃষকরা। রিলায়েন্সের পেট্রোল পাম্প, মল ইত্যাদিও বয়কট করা হবে।

এদিকে ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সাথে সাক্ষাৎ করে তিন কৃষি আইন এবং বিদ্যুৎ সংশোধনী বিল খারিজের দাবি জানান বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ। এদিন বিরোধী দলগুলির তরফে রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা রাহুল গান্ধী, সিপিআই (এম)’র সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি, সিপিআই’র সাধারণ সম্পাদক ডি রাজা, এনসিপি নেতা শারদ পাওয়ার এবং ডিএমকে নেতা টিকেএস এলানগোভান। এদিন বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপিও তুলে দেন।

কেন্দ্রের প্রস্তাব পাওয়ার পর দিল্লি সীমান্তের সিঙ্ঘুতে বৈঠক করেন কৃষক নেতারা। পরে বৈঠক শেষে তাঁরা জানিয়ে দেন সর্বসম্মতভাবে এই প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন। সারা ভারত কৃষকসভার সাধারণ সম্পাদক হান্নান মোল্লা জানিয়েছেন, সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছে, তা পুরোপুরি হতাশাজনক। গত দশদিন ধরে সরকার যা বলছে, তাই ফের বলা হয়েছে। কোনো নতুন কথা নেই। একটা বাক্যও নেই, যা নতুন। আমরা ভেবেছিলাম স্বররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন ডেকেছেন, তখন নতুন কোনো প্রস্তাব হয়তো আসবে। কিন্তু তা হয়নি। আমরা সর্বসম্মতভাবে সরকারের প্রস্তাব খারিজ করেছি। আর কোনো আলোচনার সম্ভাবনাও থাকছে না। সরকারের আচরণ অত্যন্ত খারাপ। কৃষকনেতা দর্শন পাল বলেন, সরকার কোনো নতুন প্রস্তাব দেয়নি। তাই কৃষকদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া ছাড়া কোনো উপায় নেই।

হান্নান মোল্লা জানিয়েছেন, গ্রাম থেকে আরও মানুষ দিল্লির দি‍‌কে আসছেন। তাঁরা রাস্তা ভরিয়ে দেবেন। কৃষকরা টোলপ্লাজা ভরিয়ে দেবেন।

সরকারের তরফে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যেই প্রমাণিত তিন কৃষি আইন নিয়ে কৃষকদের উদ্বেগের কারণ রয়েছে। কৃষকদের উদ্বেগ, নতুন আইনে মান্ডি ব্যবস্থাই দুর্বল হয়ে যাবে। সরকার প্রস্তাব দিয়েছে কৃষিপণ্য বাজার কমিটি বা মান্ডির বাইরে যে ব্যবসায়ীরা কাজ করবে, তাদের রাজ্য সরকার নথিভুক্ত করতে পারে। এপিএমসি-তে যে কর এবং সেস বসানো হয়, রাজ্য সরকার তা এক্ষেত্রেও করতে পারে। এই মর্মে আইনে তা সংশোধনী আনা যেতে পারে।

ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে সরকারের প্রস্তাব, তারা লিখিতভাবে প্রতিশ্রুতি দেবে এই ব্যবস্থা বহাল থাকবে। নতুন আইনে তা বলা নেই, ন্যূনতম সহায়কমূল্য থেকে কেউ কম দামে পণ্য কিনতে পারবে না। এদিন সরকার যে প্রস্তাব দিয়েছে, সেখানেও এই কথা আইনে নথিভুক্ত করতে সরকার রাজি হয়নি।

নতুন আইনে শুধুমাত্র প্যান কার্ড থাকলেই যে কেউ ব্যবসা করতে পারবে। সরকার বলেছে, এই ব্যবসায়ীদের নথিভুক্ত করে স্থানীয় পরিস্থিতি অনুযায়ী বিধি তৈরির অধিকার রাজ্য সরকারকে দেওয়া যেতে পারে। এছাড়া নতুন আইনে কৃষকরা দেওয়ানি আদালতে নিষ্পত্তির জন্য মামলা করতে পারবেন না। শুধু মহকুমা শাসকের স্তরেই নিষ্পত্তি করা যাবে। কেন্দ্র বলেছে, আইনে সংশোধনী এনে দেওয়ানি আদালতে মামলার অধিকার কৃষকদের দিতে তারা রাজি।

বিশেষ করে চুক্তিচাষের ক্ষেত্রে কৃষকের জমি বেহাত হয়ে যাবার যে আশঙ্কা তৈরি হয়েছে, তা নিয়ে সরকারের দাবি নতুন আইনেই বলা রয়েছে, তা করা যাবে না। তবুও কৃষকদের উদ্বেগ কাটাতে সরকারের আইনে লিখে দেওয়া হবে কৃষিজমির ভিত্তিতে কৃষিপণ্যের কোনো ক্রেতা ঋণ নিতে পারবেন না। কৃষকের ঘাড়েও এইরকম কোনো শর্ত চাপানো যাবে না। এখানে সরকারের প্রস্তাবের মধ্যেই যথেষ্ট মারপ্যাঁচ রয়েছে। বলা হয়েছে, চুক্তি চাষের জন্য চিহ্নিত জমিতে কোনো নির্মাণ করা হলে তার জন্য ঋণ পাওয়া যাবে না। চুক্তির মেয়াদ ফুরোলে ওই নির্মাণে চুক্তি-কর্তার কোনো অধিকার থাকবে না।

এদিন কৃষকনেতাদের মধ্যে অনেকেই বলেছেন, শুধু ঋণ নেবার প্রশ্নের মধ্যেই এই ধারাকে সীমায়িত রাখা হয়েছে। আসলে চুক্তি চাষের যেকোনো সময় এমনভাবে শর্ত পরিবর্তন করা হবে যে, কৃষক বাধ্য হয়েই জমি দিয়ে দেবেন। বিরাট পরিমাণ জমি নিয়েই ব্যবসায়ী সংস্থাগুলি চুক্তি চাষে আগ্রহী। সেক্ষেত্রে যত বেশি সম্ভব কৃষকের জমি নিয়ে নেওয়ার দিকেই তাদের লক্ষ্য থাকবে। অর্থনৈতিক শক্তির বিপুল পার্থক্যের জন্য কৃষক কর্পোরেটের সামনে দাঁড়াতেই পারবে না। সরকারের দাবি, চুক্তিচাষের জন্য জমি বাজেয়াপ্ত করার কোনো সুযোগ আইনে নেই। বিদ্যুৎ বিল, ২০২০ বাতিলেরও দাবি তুলেছেন কৃষকরা। কেন্দ্র বলেছে, এই বিল এখনও খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। এই বিলে কৃষকের বিদ্যুৎ বিল দেবার ক্ষেত্রে নিয়ম পরিবর্তন করা হবে না।

তিন আইনের মধ্যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য আইন নিয়েও সরকার একেবারে নীরব। এই আইনের কোনো ধারায় সংশোধনী আনার কোনো প্রস্তাব নেই। এমনভাবে এই আইন সংশোধন করা হয়েছে, যেখানে বিপুল পরিমাণ মজুতদারি এবং কালোবাজারির সুযোগ থেকে গেছে।

এদিন সারা ভারত কৃষক সংঘর্ষ সমিতির পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, কৃষকদের ডাকে হরতালে সারা দেশের মানুষ সাড়া দিয়েছেন। এই আন্দোলনকে মজবুত করার লক্ষ্যে সমস্ত সংগঠন ও রাজনৈতিক দলগুলিকেও সক্রিয় হতে আহ্বান জানানো হয়েছে।

এদিকে বিরোধী দলগুলির পক্ষে ৯ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির কাছে যে স্মারকলিপি তুলে দেওয়া হয়েছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘‘ভারতীয় সংবিধানের রক্ষক হিসাবে আপনি আপনার সরকারকে একগুঁয়ে মনোভাব ছাড়তে বলুন। ভারতের ‘অন্নদাতা’দের উত্থাপিত দাবিগুলি এখনই মেনে নিতে বলুন।’’ স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, ‘‘পুরোপুরি অগণতান্ত্রিক কায়দায় নির্ধারিত আলোচনা আটকে, ভারতের খাদ্য নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করে আমাদের কৃষি ও কৃষককে ধ্বংস করে ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (এমএসপি) বিলোপের পথ তৈরি করে ভারতের কৃষিক্ষেত্র ও বাজারকে বহুজাতিক ও দেশীয় কর্পোরেটদের মরজির ওপর সঁপে দিয়ে নতুন কৃষি আইনগুলি পাশ করানো হয়েছে।’’

বলা হয়েছে, ‘‘এসব সর্বনাশা আইন প্রত্যাহারের দাবিতে কৃষকরা টানা ১৩দিন রাস্তায় বসে আছেন। ৮ ডিসেম্বর তাঁদের ‘ভারত বন্‌ধ’ কর্মসূচিতে দেশজোড়া সাড়া মিলেছে। বিভিন্ন রাজ্যের শাসকদল কৃষকদের ঐতিহাসিক আন্দোলনকে সমর্থন করছে।’’

এদিন সীতারাম ইয়েচুরি বলেছেন, দেশজুড়ে কৃষকদের প্রবল বিরোধিতার জন্য কৃষি আইন ও বিদ্যুৎ বিল এখনই প্রত্যাহার করা উচিত। রাহুল গান্ধী বলেছেন, রাষ্ট্রপতিকে আমরা বলেছি, সংসদে যেভাবে কৃষি আইনগুলি পাশ করানো হয়েছে, তা কৃষকদের পক্ষে অত্যন্ত অসম্মানজনক। তাই তাঁরা এই শীতের মধ্যেও লড়াই চালাচ্ছেন।

শারদ পাওয়ার বলেছেন, এই আইন পাশের আগে কৃষকদের মতামত নেওয়া হয়নি। সংসদের সিলেক্ট কমিটিতে আলোচনা হয়নি। সংসদে বিরোধীদের উত্থাপিত একটি প্রস্তাবও না মেনে তাড়াহুড়ো করে এই আইন পাশ করানো হয়েছে। তাই এই আইন বাতিল করতে নির্দেশ দিন রাষ্ট্রপতি।