E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

সারা দেশের সঙ্গে ধর্মঘটে শামিল পশ্চিমবঙ্গও


কৃষকদের ডাকা ‘ভারত বন্‌ধ’-এ ঘটকপুর মোড়ে পথ অবরোধ।

নিজস্ব সংবাদদাতাঃ কেন্দ্রের কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে ৮ নভেম্বর দেশব্যাপী ধর্মঘটে পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপক সাড়া মিলেছে। গত ২৬ নভেম্বর শ্রমিক সংগঠন ও ফেডারেশনগুলির ডা‍‌কে সাধারণ ধর্মঘটে সারা দেশের সঙ্গে এ রাজ্যেও শ্রমজীবী সাধারণ মানুষ রাজ্য সরকারের দমন-পীড়নকে উপেক্ষা করে সাধারণ ধর্মঘটে অচল করে দিয়েছিল রাজ্য। এর ঠিক বারোদিনের মাথায় আবারও শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধের চেহারা প্রত্যক্ষ করা গেল। ২৬-এর ধর্মঘটে ‘এরাজ্যে ধর্মঘট করা যাবে না’ বলে মুখ্যমন্ত্রীর উদ্ধত হুঙ্কার ও সরকারি ফতোয়া জারি হয়েছিল। এর সঙ্গে ছিল পুলিশের আক্রমণ ও গ্রেপ্তারির ঘটনা। কিন্তু এবারে কৃষক-শ্রমিক সহ সাধারণ মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের মেজাজ দেখে মুখ্যমন্ত্রী আগেই কৃষকদের দাবি ও ধর্মঘটের প্রতি ‘নৈতিক সমর্থনে’র কথা বলে কৌশল অবলম্বন করে ময়দান থেকে দূরে সরে গিয়েছিলেন। এরাজ্যে কৃষকেরা কী অবস্থায় আছেন এবং কৃষক ও খেতমজুর সংগঠনগুলি কেন্দ্রের কৃষি নীতির বিরোধিতার পাশাপাশি রাজ্যের কৃষি ও কৃষকদের বেহাল অবস্থার জন্য রাজ্য সরকারকে দায়ী করে পথে নেমে আন্দোলনে শামিল হয়েছে - এটা আঁচ করেই আগেভাগে নৈতিক সমর্থনের কথা আওড়েছেন। তাই এবারের ধর্মঘটে পুলিশ ও তৃণমূল বাহিনীকে মারমুখী হতে দেখা যায়নি।

সব মিলিয়ে এদিনের ধর্মঘট সর্বাত্মক ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে। রাজ্যের পুলিশ ও তৃণমূলের দুর্বৃত্তদের লেলিয়ে না দিলে যে ধর্মঘট শান্তিপূর্ণ হয়, এবারের ধর্মঘটে তার প্রমাণ মিলেছে। এদিন কলকাতা শহরে কিছু বাস চলাচল করলেও জেলাগুলিতে গণপরিবহণ বন্ধই ছিল। এদিনের ধর্মঘট সফল করার জন্য সারা ভারত কৃষকসভার রাজ্য সম্পাদক অমল হালদার এবং সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউয়ে মিছিলে রয়েছেন বিমান বসু সহ নেতৃবৃন্দ।

এদিনের ধর্মঘটে গ্রাম বাংলায় কৃষকদের মনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভের আঁচ প্রত্যক্ষ করা গেছে। অল্প সময়ের ব্যবধানে এ‍‌দিনের ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া মেলায় উৎসাহিত রাজ্যের কৃষক-খেতমজুর সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এবারে তাঁরা আগামী ১৬ ডিসেম্বরের কৃষক জমায়েতকে সর্বতোভাবে সফল করতে উদ্যোগী হয়েছেন। সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির পশ্চিমবঙ্গ শাখার পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ওইদিন কলকাতার রানি রাসমণি রোডের জমায়েতে ও রাজভবন অভিযানে ৫০ হাজারের বে‍‌শি কৃষক জমায়েত হবেন।

রাজ্যের ১৬টি বামপন্থী ও সহযোগী দল আগেই এই ধর্মঘটকে সফল করতে উদ্যোগ নেবার আহ্বান জানিয়েছিল। এছাড়া ধর্মঘটকে সমর্থন জানিয়েছিল কংগ্রেস দলও। এদিন বামপন্থী ও সহযোগী দলের কর্মীরা সকাল থেকেই পথে নেমে মিছিল, অবরোধ সংগঠিত করেছেন। বিক্ষোভ মিছিল হয়েছে কলকাতায় ও জেলায় জেলায়। বিভিন্ন জায়গায় বামপন্থী ও কংগ্রেসের যৌথ মিছিল হয়েছে।

এদিন সকাল ১১টা নাগাদ কলকাতার এন্টালি থেকে ধর্মঘটের সমর্থনে মিছিলে অংশ নেন ১৬টি বামপন্থী ও সহযোগী দলের নেতৃবৃন্দ। রাজাবাজার পর্যন্ত এই মিছিল হয় এবং ১ ঘণ্টারও বেশি সময়ের জন্য যান চলাচল অচল হয়ে যায়। মিছিলে অংশ নিয়েছেন বামফ্রন্ট চেয়ারম্যান বিমান বসু, সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, সিপিআই(এমএল) লিবারেশন-এর সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লকের বাংলা কমিটির সম্পাদক নরেন চ্যাটার্জি, সিআইটিইউ’র রাজ্য সম্পাদক অনাদি সাহু, সিপিআই(এম) নেতা কল্লোল মজুমদার সহ বিভিন্ন বামপন্থী দল ও গণসংগঠনের নেতা-কর্মীরা।

পার্ক সার্কাসের কোয়েস্ট মল থেকে গড়িয়াহাট পর্যন্ত মিছিল করেছে কংগ্রেস। মালদহে বিশাল সমাবেশে বক্তব্য রাখেন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরী।

এদিন কেন্দ্রের কৃষি নীতি প্রত্যাহারের দাবিতে বন্‌ধে সর্বাত্মক সাড়া দিয়েছে গ্রাম বাংলা। এদিন জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ হয়েছে। ক্ষোভ আছড়ে পড়েছে রাজ্যের সড়কগুলিতে। স্তব্ধ হয়েছে ট্রেন চলাচল। এখন ধান কাটা ও ধান ঝাড়ার মরসুম। তবুও কাজে নামেননি খেতমজুররা। এদিন কেন্দ্রের কৃষি নীতির প্রতিবাদ জানানোর পাশাপাশি ধানের ন্যূনতম সহায়ক মূল্য না মেলায়, কৃষকদের দুঃসহ জীবনযন্ত্রণার জন্য রাজ্যের বিরুদ্ধেও ক্ষোভ উগড়ে দিয়েছেন কৃষকেরা।

কেন্দ্রের কৃষি আইনের বাতিলের দাবিতে এদিন রাজ্যের জেলাগুলিও স্তব্ধ হয়ে পড়ে। সকাল থেকে বামপন্থী কর্মী, সমর্থকেরা হরতালের সমর্থনে মিছিল, অবরোধ করেছেন। দফায় দফায় রেল ও সড়ক অবরোধ করা হয়েছে। বেসরকারি পরিবহণ প্রায় ছিল না বললেই চলে। গ্রাম থেকে শহর বেশিরভাগ জায়গায় দোকান বাজার বন্ধ ছিল। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এদিন জনজীবন সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে যায়। শিয়ালদহ দক্ষিণ শাখার যাদবপুর, মগরাহাট, দেউলা, মথুরাপুর, দক্ষিণ বারাসত, নুঙ্গি, ঘুটিয়ারিশরিফ সহ বহু রেল স্টেশন অবরোধ করা হয়। ফলতার ফতেপুর, সরিষা, ডায়মন্ডহারবার, কাকদ্বীপ জাতীয় সড়ক বন্ধ ছিল। বেসরকারি পরিবহণ সম্পূর্ণ বন্ধ ছিল। এদিন কাকদ্বীপ সহ বিভিন্ন জায়গায় হরতালের সমর্থনে বামপন্থী ও কংগ্রেসের সমর্থনে মিছিল ও পথ অবরোধ হয়েছে।

উত্তর ২৪ পরগনা জেলাতেও এদিনের ধর্মঘটে ব্যাপক সাড়া পড়ে। মানুষজন রাস্তায় কম চলাচল করেছে। বন্ধ ছিল ব্যাঙ্ক, ডাকঘর, চটকলে কাজ হয়নি। বারাকপুর শিল্পাঞ্চলে হরতালের বিরাট প্রভাব পড়েছে। জেলার ৫টি আদালত ছিল জনশূন্য। খেতমজুররা মাঠে নামেননি। এদিন জেলার ৭টি রেল স্টেশনে অবরোধ হয়েছে। বরানগরের ডানলপ থেকে ধর্মঘটের সমর্থনে সহস্রাধিক মহিলা, কিশোর, ছাত্র, যুব, প্রবীণরা বিটি রোড জুড়ে পথে নামেন। পানিহাটি, খড়দহ, টিটাগড়, বনগাঁ, দমদম সহ বিভিন্ন জায়গায় বামপন্থীদের মিছিল ও সমাবেশ হয়েছে।

পূর্ব মেদিনীপুর জেলা জুড়েও এদিন ধর্মঘটের ব্যাপক প্রভাব লক্ষ করা যায়। এদিন সকাল থেকেই জাতীয় সড়ক ও রাজ্য সড়ক অবরোধের ফলে বন্ধ ছিল। হলদিয়ায় কারখানার গেট খোলা থাকলেও শ্রমিকদের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। জেলার বৃহত্তম বাজার এলাকাগুলির অধিকাংশ দোকানপাট বন্ধ ছিল।

পশ্চিম মেদিনীপুরে এদিনের হরতালে অভূতপূর্ব সাড়া পড়ে। জেলার গ্রামীণ এলাকার ৩৭টি স্থানে রাস্তার ওপর ধানের বস্তা, ধানের বোঝা ফেলে বিক্ষোভ হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের ৯০ ভাগ এলাকা বন্ধ ছিল। এদিন কৃষকদের দাবি নিয়ে জেলার ১৯টি ব্লক দপ্তর সহ শতাধিক গ্রাম পঞ্চায়েত দপ্তর ঘেরাও করে স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। গ্রামীণ এলাকার ৪৭টি রাইস মিল এবং ৩৫টি হিমঘর ছিল বন্ধ। খড়্গপুর শহরে চারটি রেল ওয়ার্কশপে শ্রমিকরা কাজে যোগ না দিয়ে ধর্মঘটে শামিল হন। পরিবহণ ব্যবস্থা ছিল স্তব্ধ। এদিন বিকেলে ধর্মঘটের আহ্বানে মেদিনীপুর শহরে মিছিল হয়েছে।

ঝাড়গ্রামের জঙ্গলমহল জুড়েই এদিন দোকান, বাজার, হাট বন্ধ ছিল। জেলার ১২টি স্থানে সড়ক অবরোধ সহ ধানের বস্তা, ধান বোঝাই গোরুর গাড়ি, রিকশা রেখে অবরোধ-বিক্ষোভ হয়েছে। বন্ধ ছিল পরিবহণ ব্যবস্থা।

হাওড়া জেলায় এদিন সর্বত্র হরতাল হয়েছে। সকাল থেকেই বামপন্থী কর্মীরা রাস্তায় নেমে হরতালের সমর্থনে মিছিল করেন। জেলার চারটি শিল্পতালুকের মধ্যে জালান কমপ্লেক্স, উলুবেড়িয়া গ্রোথ সেন্টার, ধুলাগড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক ও ধূলাগড় ইন্ডাস্ট্রিয়াল এস্টেটের কারখানায় অল্প কয়েকজন শ্রমিক এলেও বেশিরভাগ কারখানা বন্ধ ছিল। জেলার ১২টি জুটমিলের মধ্যে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে কাজ হয়নি।

হুগলি জেলার গ্রাম-শহর সর্বত্রই ধর্মঘটের সমর্থনে ব্যাপক সাড়া মিলেছে। জেলার বিভিন্ন জায়গায় পথ অবরোধ করা হয়। রিষড়ার ওয়েলিংটন জুট মিল, ডানকুনির আনমোল বিস্কুট কারখানার শ্রমিকরা ধর্মঘটে শামিল হন এবং পথ অবরোধ করেন।

নদীয়া জেলায় ধর্মঘটে নজিরবিহীন সাড়া মিলেছে। ধর্মঘটের সমর্থনে এদিন সকাল থেকেই মিছিল, অবস্থান-বিক্ষোভে শামিল হন বামপন্থী কর্মীরা। বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীরা মোদীর কুশপুত্তলিকা দাহ করেন। এদিনের ধর্মঘটের সমর্থনে কৃষক, খেতমজুর সহ শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মিছিল অবস্থান বিক্ষোভে ছাত্র, যুব, মহিলাদের অংশগ্রহণও ছিল চোখ পড়ার মতো।

এদিনের ধর্মঘটে উত্তরবঙ্গেও ব্যাপক সাড়া পড়ে। দার্জিলিঙ জেলার হাতিঘিষা ও ঘোষপুকুরে চা বাগানের শ্রমিকরা জাতীয় সড়ক অবরুদ্ধ করেন এবং কৃষকদের সঙ্গে রাঙাপানি স্টেশন অবরোধ করেন। জলপাইগুড়ি, আলিপুরদুয়ারের বাগানগুলিতে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ হয়েছে। এদিনের ধর্মঘটে কৃষকদের প্রতি সংহতি জানিয়ে রাজ্যের শ্রমিক শ্রেণিরও ব্যাপক সংখ্যায় অংশগ্রহণ ছিল। কৃষক-খেতমজুরদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ ‍‌‍‌মিলিয়ে এরাজ্যের শ্রমিকরাও মোদী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের বার্তা দিয়েছেন। সর্বনাশা কৃষি আইন, শ্রমকোড বাতিলের দাবি জানিয়েছেন।

এদিন সর্বাত্মক ধর্মঘটের জন্য রাজ্যবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন সারা ভারত কৃষক সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির আহ্বায়ক অমল হালদার ও সাংগঠনিক সম্পাদক কার্তিক পাল। তাঁরা এক বিবৃতিতে বলেছেন, এই ধর্মঘটের পর কেন্দ্রীয় সরকারের উচিত এখনই নয়া কৃষি আইন প্রত্যাহার করা। পশ্চিমবঙ্গে সফল ধর্মঘটের পর আগামী ১৬ ডিসেম্বর কৃষকদের রাজভবন অভিযান ও সমাবেশে কৃষক সহ শ্রমিক, ছাত্র, যুব, খেতমজুর সহ বিভিন্ন গণসংগঠনকে শামিল হবার আবেদন জানান তাঁরা।