৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান বাম ও সহযোগী দলের
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর - বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনাকে কলঙ্কময় ঘটনা হিসেবে উল্লেখ করে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াইকে আরও তীব্র করার শপথ নিয়েছে ১৬টি বামপন্থী ও সহযোগী দল। ৬ ডিসেম্বর ২৮ বছর আগের ঐতিহাসিক এই মসজিদ ধ্বংসের জঘন্য ঘটনাকে স্মরণ করে কলকাতার মৌলালি যুব কেন্দ্রে আয়োজিত সভায় সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাধারণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রক্ষার শপথ নিয়েছে বামপন্থী ও সহযোগী দলগুলি।
এদিনের সভায় প্রস্তাব নেওয়া হয়েছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তি দিতে হবে। দেশের সাধারণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্র রক্ষায় বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির ব্যাপক ঐক্য গড়ে তুলতে হবে।
প্রসঙ্গত, ২৮ বছর আগে ৬ ডিসেম্বর প্রকাশ্য দিবালোকে ধুলিসাৎ করা হয়েছিল এই ঐতিহাসিক সৌধটি। বিজেপি এবং সংঘ পরিবার এই কলঙ্কিত ঘটনাটি ঘটাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে করসেবকদের জড়ো করেছিল। ওই বর্বরোচিত ঘটনাটি ঘটার পর এল কে আদবানি, মুরলী মনোহর যোশী, উমা ভারতী, অশোক সিংঘল, বিনয় কাটিয়ারদের পাশবিক উল্লাসের ছবি সংবাদমাধ্যমের দৌলতে প্রত্যক্ষ করেছিলেন গোটা পৃথিবীর মানুষ। যা আজও অনেকেরই স্মৃতিতে অমলিন। কিন্তু ভয়ঙ্কর বিস্ময়ের ব্যাপার মোদীর জমানায় অযোধ্যা মামলায় যে রায় ঘোষণা করা হয়েছে, তাতে বাবরি ধ্বংসের অপরাধীদের ছাড় দেওয়া হয়েছে। অথচ সেই রায়েই বলা হয়েছিল, বাবরি মসজিদ ধ্বংস একটি মারাত্মক ফৌজদারি অপরাধ। তা সত্ত্বেও অপরাধীদের আজও সাজা হয়নি।
মোদীর নেতৃত্বে সাম্প্রদায়িক বিজেপি সরকার দেশের শাসনক্ষমতায় আসার পর থেকে যেভাবে দেশের রাজনীতি-সমাজনীতি-অর্থনীতি-শিক্ষা-সংস্কৃতি প্রতিটি ক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তীব্রতা প্রকট হয়ে উঠেছে, দেশের আইন ও বিচারব্যবস্থাও এই অবস্থা থেকে মুক্ত হতে পারছে না। আজ দেশের সরকার ও শাসকদল মানুষের দৈনন্দিন জীবনযন্ত্রণা, রুটি-রুজির সমস্যা, অর্থনৈতিক সঙ্কট ইত্যাদি থেকে মানুষকে দূরে সরিয়ে রাখতে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতিকেই হাতিয়ার করেছে। এর বিরুদ্ধে সমস্ত বামপন্থী, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করার ডাক দিয়েছে বামপন্থী ও সহযোগী দলগুলি।
৬ ডিসেম্বর মৌলালি যুব কেন্দ্রের সভায় সিপিআই(এম)’র রাজ্য সম্পাদক সূর্য মিশ্র বলেছেন, ১৯৯২ সালের ৬ ডিসেম্বর দিনটি ইতিহাস থেকে মুছে ফেলা যাবে না। কিন্তু এই কলঙ্ককে আমাদের মুছে ফেলতেই হবে। জ্যোতি বসু ওদের অসভ্য বর্বর বলেছিলেন। মসজিদ ধ্বংসের অপরাধীদের শাস্তির জন্য বিচারের মুখে দাঁড় করাতেই হবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী গত ৫ আগস্ট অযোধ্যায় রামমন্দিরের শিলান্যাস করে ওই দিনটিকে ‘স্বাধীনতা দিবস’-এর সাথে তুলনা করেছিলেন। সূর্য মিশ্র এদিন দেশের সংবিধান রক্ষার জন্য দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী যে স্বাধীনতা দিবসের কথা বলছেন তা স্বাধীনতার আগের যুগে ফিরে যাওয়ার কথা বলছেন। আমরা জানি আমাদের দেশের স্বাধীনতার সীমাবদ্ধতা কোথায়। সেই সীমাবদ্ধতা অতিক্রমের জন্য আরও সংগ্রাম দরকার, রুটি-রুজির জন্য সেই সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিত তৈরি হচ্ছে প্রতিদিন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ও তাঁর দল শুধু একটা ধর্মীয় সৌধ ধ্বংস নয়, যুক্তির ধ্বংসসাধনের মধ্য দিয়ে মানুষকে উন্মাদ করে দিয়ে মিথ্যার নির্মাণ করতে চাইছেন। তিনি বলেন, সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় বামপন্থীরা একাই যথেষ্ট নয়। সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক শক্তির কাছে বৃহত্তর ঐক্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছি। এখন একটা দ্বিতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধ দরকার। তিনি বাবরি মসজিদ ধ্বংসের কলঙ্ককে মুছতে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তীব্র সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
সভাপতির ভাষণে বিমান বসু সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শ্রমজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে বিভাজন আনতে ধর্ম-জাতপাতের নামে উসকানি দেওয়া হচ্ছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও ঐক্য রক্ষার জন্য আমাদের শপথ নিতে হবে।
সভার মূল প্রস্তাব পেশ করে তিনি বলেছেন, অযোধ্যা নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট রায় দিয়েছে, কিন্তু বিচার হয়নি। জঘন্য অপরাধ একপ্রকারের বৈধতা পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রী রামমন্দিরের শিলান্যাসের নামে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, শত সহস্র শহিদের স্মৃতিকে অপমান করেছেন। সংবিধান ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে আক্রমণ করে হিন্দুত্বের রাষ্ট্র গঠন করতে চাইছে আরএসএস। এই প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে এদিন বক্তব্য রেখেছেন সিপিআই’র রাজ্য সম্পাদক স্বপন ব্যানার্জি, আরএসপি’র সাধারণ সম্পাদক মনোজ ভট্টাচার্য, ফরওয়ার্ড ব্লক নেতা হাফিজ আলম সইরানি, সিপিআই(এমএল) লিবারেশনের রাজ্য সম্পাদক পার্থ ঘোষ সহ মিহির বাইন (আরসিপিআই), আশিস চক্রবর্তী (এমএফবি), প্রসেনজিৎ সেনগুপ্ত (পিডিএস), ইন্দ্র ঘোষদস্তিদার (সিপিআই-এমএল) সন্তোষ রাণা, বর্ণালি মুখার্জি (সিপিবি), সোমা নন্দী (এলজেডি), নরেন্দ্রকুমার ঘটক (আরজেডি) প্রমুখ। নেতৃবৃন্দ সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী আক্রমণের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম গড়ে তোলার আহ্বান জানান।