৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
প্রাথমিক শিক্ষায় রাজ্যের উদাসীনতা বাণিজ্যিকীকরণের পথকেই প্রশস্ত করছে
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ রাজ্যের শিক্ষানুরাগী একাধিক মহলের অনেকগুলি অভিযোগের একটি হলো, মা-মাটি-মানুষের সরকার, বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলিকে মদত দিতেই অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘নয়া শিক্ষানীতি’ যা সরকারি স্কুল সংক্রান্ত পরিকাঠামো পুরোপুরি তুলে দেবার চক্রান্তের রূপরেখা- তা চালু করার পরিকল্পনা নিয়েই নানা বেনিয়ম এবং শিক্ষক নিয়োগজনিত টালবাহানার পথে দীর্ঘদিন ধরেই হাঁটছে মমতা ব্যানার্জির সরকার। এই পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনের প্রতীচী ট্রাস্ট রাজ্যের প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাব্যবস্থার দুর্বলতা সম্পর্কে একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এর পাশাপাশি শিক্ষক-ছাত্র অনুপাত থেকে মিড-ডে মিলের বরাদ্দের ঘাটতি নিয়েও প্রশ্ন তোলা হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছে, সামাজিক ভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের পড়ুয়াদের সংখ্যা কমছে প্রাইমারিতে। এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞদের একাংশের মত, রাজ্যের জনবিন্যাসের দিকে লক্ষ রেখে বাম আমলে যে সুষ্ঠু শিক্ষক নিয়োগের পরিকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল, তা ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। আর রাজ্যে কর্মপ্রার্থী বেকার যুবকযুবতীদের কর্মসংস্থানের জন্য মেধাতালিকা ভিত্তিক যে স্বচ্ছ এবং ধারাবাহিক নিশ্চিত সরকারি শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা চালু হয়েছিল বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে, তা রুদ্ধ করা হচ্ছে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবেই।
তাই পশ্চিমবঙ্গ সরকারের চরম উদাসীনতার শিকার রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ চাকরি প্রার্থীরা। নানা অনিয়ম, হাইকোর্টের নির্দেশ লঙ্ঘন সহ একাধিক দুর্নীতির অভিযোগে বিদ্ধ রাজ্যের শিক্ষাদপ্তর। গত সাত বছর ধরেই কার্যত নিয়োগ বন্ধ করে তৃণমূল সরকার এরাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থাকেই দুর্বল করে তুলে দিতে বদ্ধপরিকর। এর বিরুদ্ধে সংগঠিত প্রতিবাদ জানাতে গেলেই আন্দোলনকারীদের ওপর নেমে আসছে পুলিশি অত্যাচার। সম্প্রতি আবার তার পুনরাবৃত্তি দেখা গেল ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে।
শিক্ষাঙ্গনের সঙ্গে যুক্ত হবু শিক্ষকদের ওপর শুধু নয়, এসএসসি উত্তীর্ণ, প্যারাটিচার, মাদ্রাসা শিক্ষক, আপার প্রাইমারি - সব ধরনের শিক্ষকদের ন্যায্য দাবিদাওয়ার ক্ষেত্রেই বেআইনিভাবে পুলিশি আক্রমণ নামিয়ে আনা এই সরকারের স্বাভাবিক প্রবণতা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এ প্রসঙ্গে রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রতীচী ট্রাস্টের সাম্প্রতিক মুল্যায়নের কয়েকটি বিষয় দেখে নেওয়া দরকার ত্রুটি চিহ্নিতকরণের স্বার্থে। রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষা সংক্রান্ত প্রতীচী ট্রাস্টের মুল্যায়নে উল্লেখ করা হয়েছে, ...The problem is made acute by a shortage of teachers, mainly owing to uneven distribution. According to government data, 4 per cent of the primary schools in West Bengal are run by only one teacher. While the average pupil teacher ratio (PTR) has dramatically improved to 23, there are many schools with an adverse PTR of over 40, while elsewhere it is 12. In other words, at least 20 per cent of the primary schools in the state suffer from teacher shortages, while many other schools have an excess number of teachers. The problem is acute in Malda, Murshidabad and North Dinajpur... .
প্রতীচী ট্রাস্টের সাম্প্রতিক মুল্যায়ন থেকে উদ্ধৃত উপরের অংশটুকু থেকেই স্পষ্ট রাজ্যের প্রাথমিক শিক্ষার পরিস্থিতি। রাজ্য সরকার নিজেই স্বীকার করেছে যে, সরকারি প্রাথমিক স্কুলের ৪ শতাংশে শিক্ষকের সংখ্যা মাত্র একজন, যদিও বাস্তব অভিজ্ঞতা অন্য কথা বলে - তফাতটা অনেক বেশি। আবার ছাত্র-শিক্ষকের অনুপাতের গড় ২৩ (প্রতি শিক্ষক পিছু), যেখানে কোথাও কোথাও তা ১২ থেকে ৪০ পর্যন্ত। রাজ্যের ২০ শতাংশ বিদ্যালয়ে শিক্ষকের অপ্রতুলতা রয়েছে। যেখানে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হলো মালদা, মুর্শিদাবাদ এবং দক্ষিণ দিনাজপুরে। শিক্ষক-ছাত্রের অনুপাতে উন্নতির ক্ষেত্রে সরকারি শিক্ষা থেকে রাজ্যের উল্লেখযোগ্য অংশের মুখ ফেরানোও একটা বড় কারণ বলে অনেকেই মনে করেন।
আবার মিড ডে মিল প্রসঙ্গে ছাত্র-ছাত্রী পিছু খরচের হার এবং প্রকৃত ঘাটতি সম্পর্কে উল্লেখ রয়েছে ওই রিপোর্টে। মিড ডে মিল সম্পর্কে বলা হয়েছে: There have been some important improvements in implementation of the Mid-day Meal programme, but the paucity of funds is still a major cause for concern. While a decent meal would require a conversion cost of at least Rs 7.17 per child per day, the present allocation is only Rs.4.13. There is thus a deficit in conversion cost of Rs. 3.04 per child per day.
উদ্ধৃত তথ্য থেকে এই রাজ্য সরকার যারা মেলা-মোচ্ছবে দেদার খরচ করে তাদের শিক্ষা সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি আরও বেআব্রু হয়েছে। পড়ুয়া পিছু যেখানে প্রয়োজন ন্যূনতম সাত টাকা সতের পয়সা সেখানে রাজ্য সরকার বরাদ্দ করেছে চার টাকা তের পয়সা। ঘাটতিটুকু পূরণ হচ্ছে শিক্ষক সহ এলাকার শুভানুধ্যায়ীদের আর্থিক এবং নানা সহায়তায়। এপ্রসঙ্গে প্রচ্ছন্ন শ্লেষের সুরে রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, এরকম একটি গুরুতর ইস্যুকে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত উদারতার উপর ছেড়ে রাখা ঠিক নয়।
আবার সচেতনতার ক্ষেত্রে ব্যাপক বৈপরীত্য এরাজ্যে। মুখ্যমন্ত্রী সম্প্রতি ঘোষণা করেছেন উচ্চ মাধ্যমিক এবং হাই মাদ্রাসার পড়ুয়াদের বিনামূল্যে অত্যাধুনিক ইন্টারনেট ডিভাইস দেবার কথা। কিন্তু এ রাজ্যের প্রাথমিক স্তরের সামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা অংশের পড়ুয়াদের বাবা-মায়েরা কিভাবে কাস্ট সার্টিফিকেট পাওয়া যায় তা না জানায় ওই পড়ুয়ারা বঞ্চিত হচ্ছে সংরক্ষণের সুযোগ থেকে।
কলকাতা শহরের তপশিলি জাতি, আদিবাসী, ওবিসিভুক্ত পরিবারগুলির অভিভাবকরা অধিকাংশই জানেনই না তাদের সামাজিক অবস্থানের কথা। সংরক্ষণের তালিকাভুক্ত পরিবারগুলির সিংহভাগের নেই কোনো কাস্ট সার্টিফিকেট। প্রতীচী ইনস্টিটিউট এবং টেক মাহিন্দ্রা ফাউন্ডেশন যৌথভাবে কলকাতা শহরের কলকাতা প্রাইমারি স্কুল কাউন্সিল পরিচালিত স্কুলগুলিতে, কলকাতা কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুলগুলিতে ও শিশু শিক্ষা কেন্দ্র স্কুলগুলিতে সমীক্ষা চালিয়ে এই তথ্য তুলে এনেছে।
প্রতীচীর রিপোর্টেই উঠে এসেছে শহরের প্রাইমারি স্কুলগুলিতে আদিবাসী ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা মাত্র ০.৪ শতাংশ, তপশিলি জাতিভুক্ত পড়ুয়াদের সংখ্যা মাত্র ১১.৪ শতাংশ, ওবিসি তালিকাভুক্ত ছাত্র-ছাত্রী মাত্র ২.২ শতাংশ, মুসলিম ছাত্রছাত্রীদের সংখ্যা মাত্র ১৭.৫ শতাংশ।
রিপোর্টে উদ্বেগের সঙ্গে জানানো হয়েছে শহরের প্রাইমারি স্কুলগুলির পরিকাঠামোর করুণ দশার কথা। যেমন কলকাতা শহরের ৩০ শতাংশ প্রাইমারি স্কুলের ক্লাসের জন্য উপযুক্ত ক্লাসরুম নেই। ৮৩ শতাংশ প্রাইমারি স্কুলের লাইব্রেরি নেই। ৫৯ শতাংশ স্কুলের বাড়ির বেহাল ভগ্নদশা। কলকাতার প্রাইমারি স্কুলগুলির পরিকাঠামোর অপ্রতুলতার প্রসঙ্গে সরকারের উদাসীনতা শিক্ষামহলে বিস্ময় সৃষ্টি করেছে।
রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শহরের ৪০ শতাংশ প্রাইমারি স্কুলগুলিতে কোনো পাঁচিল নেই। পর্যাপ্ত শৌচাগারের অভাব রয়োছে। কেপিএসসি পরিচালিত স্কুলগুলিতে শৌচাগারগুলির আরও দৈন্যদশা। বিশেষত ছাত্রীদের শৌচাগারের সংখ্যা নগণ্য, যেখানে ৩১ জন ছাত্র পিছু শৌচাগারের সংখ্যা একটি সেখানে ৩৭ জন ছাত্রী পিছু শৌচাগারের সংখ্যা একটি।
কলকাতার প্রাইমারি স্কুলগুলিতে বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন খুদে পড়ুয়াদের সংখ্যা মাত্র ১.৭ শতাংশ। আরো উদ্বেগজনক বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন পড়ুয়াদের জন্য স্পেশাল এডুকেটর স্কুলে আসেন সপ্তাহে মাত্র একদিন। স্কুলের মাস্টারমশাই দিদিমণিদের বছরে অন্তত ৪০ থেকে ৫০ দিন ব্যস্ত থাকতে হয় ভোটের কাজে। স্কুলে পড়ানোর বাইরে তাঁরা নিযুক্ত হন ডিও বা বিএলও হিসাবে। অন্যত্র যুক্ত থাকতে বাধ্য হন বলে স্কুলের পড়ানোর ক্ষেত্রেও শিক্ষকদের সময় কমেছে। স্বাভাবিকভাবেই তার প্রভাব পড়েছে স্কুলের পঠনপাঠনে।
প্রতীচী’র রিপোর্টে উল্লেখযোগ্যভাবে উঠে এসেছে প্রাইমারি স্কুলের পড়ুয়াদের প্রাইভেট টিউশন এর চাহিদা। এ সম্পর্কে অমর্ত্য সেন বলেছেন, এটি কৃত্রিমভাবে নির্মিত প্রয়োজনীয়তা। কলকাতার প্রাইমারি স্কুলের ৭০ শতাংশ ছাত্র-ছাত্রীরাই প্রাইভেট টিউশন পড়তে যায়। কার্যত বেসরকারিকরণের দর্শন খুদেদের মনেও নিরন্তর প্রতিযোগিতার জন্ম দিচ্ছে। ফলে ছোটোরাও মনে করছে, ‘আমার বন্ধু টিউশনি পড়তে যায় আমিও যাব’। প্রাইমারি স্কুলের অভিভাবকদের মধ্যেও প্রবণতা বাড়ছে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে ভর্তি করানোর।
রাজ্যের প্রাথমিক স্তরের স্কুলগুলির সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে রিপোর্টে বলা হয়েছে, স্কুলগুলিকে একটি প্রাণবন্ত সামাজিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার উদ্যোগ এখনো রূপায়িত করা যায়নি।