৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
দ্রুত নিয়োগের দাবিতে উচ্চ-প্রাথমিকের উত্তীর্ণ হবু শিক্ষকদের বিক্ষোভ হটাতে মধ্যরাতে পুলিশি বর্বরতা
৩ ডিসেম্বর বিধাননগরে মধ্যরাতে পুলিশি হেনস্তার শিকার ভাবী শিক্ষকেরা।
নিজস্ব সংবাদদাতাঃ শীতের রাত্রে ৩৬ ঘন্টা খোলা আকাশের নিচে হকের চাকরির দাবিতে অবস্থান করছিলেন রাজ্যের ভাবী শিক্ষকরা। সরকারের ‘দুয়ারে’ এসে নিয়োগের টালবাহানার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাচ্ছিলেন তারা। তাতেই ভীত-সন্ত্রস্ত মমতা ব্যানার্জির রাজ্য প্রশাসন রাতের অন্ধকারে ঝাঁপিয়ে পড়ল শিক্ষিত বেকার যুবক যুবতীদের ওপর। ৩ ডিসেম্বর এ ঘটনা ঘটেছে বিধাননগরে বিকাশ ভবনের অদূরে। মধ্যরাতে বর্বরতার শিকার হলেন এই হবু শিক্ষকরা। কেমন সেই বর্বরতা?
আন্দোলনকারীদের বক্তব্যে রয়েছে সেই বয়ান। তাঁরা বলেছেন, আশেপাশের এলাকার সুলভ শৌচালয়ে তালা লাগিয়ে দিয়েছিল পুলিশ যাতে আন্দোলনকারীরা তা ব্যবহার না করতে পারে। শামিয়ানা টাঙ্গাতে বাধা দেওয়া হয়েছিল। ৩ ডিসেম্বর রাত পৌনে একটা নাগাদ বিক্ষোভরত হবু শিক্ষক-শিক্ষিকাদের চারপাশ থেকে ঘিরে নেয় সশস্ত্র পুলিশ। সঙ্গে জলকামান। প্ররোচিত করতে গালিগালাজ এবং ব্যঙ্গ বিদ্রুপ ছুঁড়ে দেওয়া হতে থাকে আন্দোলনকারীদের প্রতি। কয়েক মিনিট পরেই আন্দোলনকারীদের টানতে টানতে রাস্তায় হিঁচড়ে প্রিজনভ্যানে তোলা হয়। সঙ্গে থাকা ব্যাগ জিনিসপত্র চাদর-কম্বলটুকুও নিতে দেওয়া হয়নি তাদের। সাড়ে পাঁচশ’রও বেশি পুরুষ এবং কুড়িজন মহিলা আন্দোলনকারীকে ধাক্কা দিয়ে, কলার ধরে টানতে টানতে তৃণমূল সরকারের পুলিশ গাড়িতে তোলে। আন্দোলনকারীরা পরে জানান, তাদের জিনিসপত্র রাস্তায় পড়ে ছিল তাও তুলতে দেওয়া হয়নি। পুলিশ তাদের ওপর জলকামান চালানোর হুমকি দিয়েছিল বলে অভিযোগ।
এসএসসি অফিসের সামনে থেকে প্রায় দশটি গাড়িতে আন্দোলনকারীদের জোর করে মধ্যরাতেই তুলে নিয়ে আসা হয় শিয়ালদহ স্টেশনে। পুলিশের গাড়ি থেকে নামেননি আন্দোলনকারীরা। তাঁরা পুলিশকে বলেন আমরা কেউ অপরাধী নই, কেউ শরণার্থী ও নয়, যদি সাহস থাকে গ্রেফতার করুন। তবুও জোর করেই তাঁদের গাড়ি থেকে নামানো হয়। এরপর প্রতিবাদে আন্দোলনকারীরা প্রিজন ভ্যান এর সামনের শুয়ে পড়েন । গাড়ি যেতে দেননি।
খবর পেয়ে যুব নেতৃত্ব চলে আসেন ঘটনাস্থলে। দীর্ঘদিন ধরে এই লড়াইয়ে থাকা সিআইটিইউ নেতা ইন্দ্রজিৎ ঘোষ বলেন, উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়োগের দাবি যদি অন্যায্য হতো তাহলে সরকার সরাসরি জানিয়ে দেওয়ার সাহস দেখাত। সরকার চায় না এই যোগ্য প্রার্থীদের চাকরি হোক... সরকার আদালতে বিষয়টি ঝুলিয়ে রাখত না। ইচ্ছে করে এদের আটকে রাখা হয়েছে। অমানবিক সরকার।
এরপরই নিয়োগের দাবিতে মৌলালির মোড়ে রাত আড়াইটের নিস্তব্ধতা ভেঙে হবু শিক্ষকদের স্লোগান শুরু হয় নিয়োগের দাবিতে। তাদের স্লোগানে সহমর্মী মানুষের সংখ্যা বাড়তে থাকে। পুলিশ সেখানে হাজির হয় এবং গ্রেপ্তারের হুমকি দেয়। শুরু হয় আন্দোলনকারীদের সঙ্গে বচসা। এরপর তাঁরা শিয়ালদহ স্টেশন চত্বরে ফিরে আসেন।
প্রসঙ্গত, সাত বছর পেরিয়ে যাওয়ার পরেও রাজ্য সরকার এখনো পর্যন্ত উচ্চ প্রাথমিকে মেধা তালিকাভুক্ত যুবক-যুবতীদের নিয়োগ করতে পারল না। তার প্রতিবাদে বিধাননগরের এসএসসি অফিসের সামনে ১ ডিসেম্বর ধরনায় বসে ছিলেন তাঁরা। ধরনায় বসার আগেই বিধাননগর থানার পুলিশ ১০০ জন উচ্চ প্রাথমিকে নিয়োগ পরীক্ষায় পাশ করা যুবক-যুবতীদের গ্রেপ্তার করে। তাতে দমে না গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থী মঞ্চের উদ্যোগে তাঁরা বিক্ষোভ বসে ছিলেন। এই ধরনা অবস্থানে গিয়ে সহমর্মিতা জানিয়ে বিধানসভার বাম পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেছেন, সরকার রাজ্যের যুবকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। সকালে মাদ্রাসা শিক্ষকদের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে।... সরকার আছে বলে তো মনে হচ্ছে না, কেন সাত বছরেও হলো না? এই শিক্ষিত বেকার যুবক-যুবতীদের সময় নষ্ট হলো তার জন্য সরকার দায়ী। পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে বসে আছে, শূন্য পদ রয়েছে, তার পরেও সরকার নিয়োগ করছে না? কাদের জন্য সরকার? বামফ্রন্ট সরকার নিয়ম করে প্রতিবছর এসএসসি মাধ্যমে শিক্ষক নিয়োগ করত। সেটা তুলেই দিলো এই সরকার।
আন্দোলনকারীদের বক্তব্য, ২০১৩ সালে এসএসসি’র উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের জন্য আবেদন করেছিলেন প্রার্থীরা। ২০১৫ সালে ১৬ আগস্ট তাঁদের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা হয়। এরপর নানা টালবাহানার পর উচ্চ প্রাথমিকের শিক্ষকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া থমকে রাখা হয়েছে। এ নিয়ে উচ্চ প্রাথমিকের হবু শিক্ষকদের বক্তব্য, ২০১৭ সালে মেধা তালিকা প্রকাশ না করেই ফল ঘোষণা করা হয়। ফল প্রকাশের ঘোষণার আগে এক মামলার প্রেক্ষিতে আদালত স্কুল সার্ভিস কমিশনকে নির্দেশ দিয়েছিল, ‘শিক্ষণ প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের (বিএড) আগে ইন্টারভিউতে ডেকে যদি দেখা যায় যে আসন ফাঁকা রয়েছে তখন প্রশিক্ষণহীনদের ইন্টারভিউতে ডাকতে হবে।’ আদালতের এই নির্দেশ অমান্য করে স্কুল সার্ভিস কমিশন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও প্রশিক্ষণহীন উভয় প্রার্থীদের ইন্টারভিউ নেওয়া শুরু করে। নির্দেশ অমান্য করায় ইন্টারভিউ স্থগিত করে দেয় কলকাতা হাইকোর্ট।
ফের ২০১৮ সালে সার্ভিস কমিশনকে ইন্টারভিউ নেওয়ার নির্দেশ দেয় কোর্ট। এবারেও কতগুলি বাধ্যবাধকতার উল্লেখ করে ইন্টারভিউয়ের অনুমতি দেয় কোর্ট। দ্বিতীয়বারও স্কুল সার্ভিস কমিশন আদালতের বাধ্যবাধকতা অগ্রাহ্য করে উচ্চ প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের ইন্টারভিউ নেওয়ার কাজ করে। কিন্তু ইন্টারভিউয়ের ক্ষেত্রেও একাধিক বেনিয়ম প্রমাণ করে দেয় উচ্চ প্রাথমিকের প্রার্থীরা। কমিশনের বেনিয়মের জেরে বর্তমানে উচ্চ প্রাথমিকের নিয়োগ প্রক্রিয়া স্থগিত হয়ে রয়েছে। এরপর ২০১৯ সালে কোর্ট স্কুল সার্ভিস কমিশনকে এক নির্দেশে প্রভিশনাল মেধা তালিকা প্রকাশ করতে বলে। এরপর ১ বছর ৩ মাস কেটে গিয়েছে। নিয়োগ প্রক্রিয়ার ব্যাপারে কমিশন নিশ্চুপ। বিক্ষোভকারী প্রার্থীদের দাবি, অতি দ্রুত গেজেট বিধি মেনে যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত না করে আপার প্রাইমারির শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। একইভাবে বিষয়ভিত্তিক অনুপাত বজায় রেখে ১৪ হাজার ৩৩০ শূন্যপদে দ্রুত নিয়োগ করতে হবে। বারবার দেখা গিয়েছে, নিয়োগের জটিলতা কাটাতে সরকারকে তেমন উদ্যোগ নিতে দেখা যায়নি। বরং সরকার পক্ষের আইনজীবী উপস্থিত না থেকে জটিলতা বাড়িয়ে দিয়েছে। এখন সরকারকেই এই দায় নিতে হবে, এমনই দাবি আন্দোলনকারী উত্তীর্ণ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের।
তবে পুলিশি বর্বরতায় পিছিয়ে যেতে রাজি নন রাজ্যের ভাবী শিক্ষকরা। তারা আগামী দিনে আরও তীব্র আন্দোলন এর মধ্য দিয়েই নিয়োগের অধিকার আদায় করবেন। এই ঘোষণা করা হয়েছে আপার প্রাইমারি চাকরি প্রার্থী মঞ্চের পক্ষ থেকে।