E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

উত্তরপ্রদেশঃ বীভৎস পরিণতি

সুভাষিণী আলি


গ্রামের নাম ভদরাস। কানপুর থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে প্রায় ৪ হাজার পরিবারের বাস এই গ্রামে। গ্রামের প্রবেশের মুখেই রয়েছে চামারটোলা। ১৯ নভেম্বর আমি, সারা ভারত গণতান্ত্রিক মহিলা সমিতির রাজ্য সাধারণ সম্পাদিকা সীমা এবং সভানেত্রী নীলম সহ এক প্রতিনিধিদল ওই গ্রামে গিয়েছিলাম।

চামারটোলার একটা ফাঁকা জায়গায় আমাদের চারপাশে গ্রামের বেশিরভাগ পুরুষরা জড়ো হয়েছিল। ওইটাই আবার বাচ্চাদের খেলার জায়গাও বটে। চামারটোলায় থাকে ২৫-৩০ ঘর মানুষ।

আমরা যখন নিজেদের পরিচয় দিলাম তখন ওঁরা সবাই নিশ্চুপ ছিলেন। তাঁরা আগেই জেনেছিলেন, আমাদের ওই গ্রামে আসার উদ্দেশ্য। তবুও ওইখানে থাকা একজন আমাদের চিনিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন, এবং বললেনঃ ‘‘ভয় পাওয়ার কিছু নেই। এরা কমিউনিস্ট। আমাদের অধিকারের জন্য এরা সবসময়ে লড়াই করে’’। এটা কিছুটা সাহস সঞ্চারিত করল ওইখানে সমবেত হওয়া মানুষদের মধ্যে। ১৪ নভেম্বর দেওয়ালির রাত্রিতে কী হয়েছিল তা বলতে শুরু করল তারা।

রামকালি এবং করনের ৬ বছরের মেয়ে ভুরি; চামারটোলাতেই থাকে এই পরিবারটি। অন্যান্যদিনের মতোই দেওয়ালির দিন বিকালে বাড়ির সামনের উঠোনে খেলছিল ভুরি। ৬টার সময়ে যখন অন্ধকার একটু ঘন হয়েছে, তখন ওর মায়ের খেয়াল হয় যে ভুরি নেই। দেওয়ালি উদ্‌যাপনের জন্য বেশিরভাগ গ্রামবাসীর প্রস্তুতি এখবর জানাজানি হবার পর মুহূর্তের মধ্যে স্তব্ধ হয়ে যায়। গ্রামে অন্যান্য বর্ণের এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষরাও দেওয়ালি উদ্‌যাপন বন্ধ রাখেন। কয়েকঘণ্টা পরেই পুলিশকে জানানো হয় ভুরি’র নিখোঁজের বিষয়টি। এটা খুব অবাক করা ব্যাপার ছিল যে, ওইদিন পুলিশ খুব তাড়াতাড়ি গ্রামে আসে। বীরন নাম একটা কমবয়সী ছেলের সাথে করনের বাকবিতণ্ডার কথা জেনে আরও কিছুজনের সাথে ওই দু’জনকে পুলিশ থানায় নিয়ে যায়। উত্তরপ্রদেশের পুলিশের জেরার মুখে বীরন স্বীকার করে যে, সে অনকুলকে সাথে নিয়ে ভুরিকে খুন করেছে। কুরকুরে’র লোভ দেখিয়ে অনকুলই ভুরিকে উঠোন থেকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল।

জেরার মুখে অনকুল পুলিশকে জানায়ঃ তাকে ও বীরনকে তার সন্তানহীন কাকা পরশুরাম ও কাকীমা সুনয়না ১৫০০ টাকা দিয়েছিল। এই টাকা এই কারণে দেওয়া হয়েছিল যে, ওই শিশুকন্যাকে দেওয়ালির রাত্রিতে খুন করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ তাদের দেওয়ার জন্য। গ্রেপ্তার হবার পর পরশুরাম জানায়ঃ কানপুর রেলওয়ে স্টেশনের কাছ থেকে তারা একট বই কিনেছিল। ওই বইতে লেখা ছিল, দেওয়ালির রাত্রিতে একটা শিশুকে হত্যা করে তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ভক্ষণ করলে সন্তানলাভ সম্ভব। ওই বইতে যা লেখা ছিল সেই অনুযায়ী সুনয়না সব করেছে।

নিখোঁজ হবার পরের দিন সকালে এই গ্রাম থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরের একটা খেতে ভুরি’র ক্ষত-বিক্ষত দেহ মেলে। শিশুটির মস্তিষ্কে একটা বড়ো গর্ত দেখা যায়, যার মধ্যদিয়ে মস্তিষ্কের ভিতরের সমস্ত কিছু বার করে আনা হয়েছিল। দেহের বাইরে আনা হয়েছিল অন্যান্য অঙ্গপ্রত্যঙ্গকেও। তার গোপন অঙ্গেও আঘাতে চিহ্ন স্পষ্ট ছিল। পুলিশের বক্তব্য অনুযায়ী, খুন হবার আগে ওই শিশু কন্যাটি বীরন ও অনকুল দ্বারা ধর্ষিত হয়। গ্রামবাসীরা বার বার এ কথাটা আমাদের বলেছিল যে, গ্রেপ্তার হওয়া ওই চারজনের কেউই অপরাধী নয় এবং তাদের অপরাধের কোনো পূর্ব-রেকর্ডও নেই। বিশেষকরে সুনয়না বাচ্চাদের কাছে খুবই জনপ্রিয় এবং সে যখনই সম্ভব হয় বাচ্চাদের মিষ্টি খেতে দিত। এবং যেটা সবচেয়ে আশ্চর্য, ভুরি তার খুব প্রিয় ছিল।

আমাদের সমাজে কুসংস্কারের প্রতি বিশ্বাস এবং তার প্রয়োগ আকছাড় ঘটছে। আমাদের আন্দোলন-সংগ্রাম সবসময়ে জোর দেয় মানুষের মধ্যে বিজ্ঞানমনস্কতাকে জনপ্রিয় করার প্রয়োজনীয়তার উপর। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে গত ছ’বছর কেন্দ্রে বিজেপি’র শাসন এবং বিভিন্ন রাজ্যে তাদের শাসন অবৈজ্ঞানিক চিন্তা-ভাবনা এবং অন্ধবিশ্বাসকে ইন্ধন জুগিয়ে চলছে। যা এ ধরনের করুণ পরিণতিগুলির সংঘটনে অনুঘটকের কাজ করছে।