E-mail: deshhitaishee@gmail.com  | 

Contact: +91 33 2264 8383

৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭

কৃষক প্রতিরোধ এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষিত

গৌতম রায়


নরেন্দ্র মোদী সরকার দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে যে সর্বনাশা পথে দেশকে ঠেলে দিচ্ছে, তার সর্বশেষ সংস্করণ হলো কৃষি আইন সংশোধন। দেশের কৃষিকাঠামোর সার্বিক ব্যবস্থাকে নয়া-উদার অর্থনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে গিয়ে একদিকে ভারতের অর্থনীতির প্রবহমান ধারা-উপধারাকে তিনি জলাঞ্জলি দিচ্ছেন। অপরদিকে ভারতের কৃষিবাজারকে সম্পূর্ণভাবে বিদেশি বহুজাতিক বিশেষকরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদপুষ্ট ব্যবসায়ীদের কাছে খুলে দিতে চাইছেন। এই ব্যবস্থার ভেতর দিয়ে ভারতজুড়ে এখন যে তীব্র সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন ধীরে ধীরে দানা বাঁধছে, এনআরসি ইত্যাদির নাম করে যেভাবে ভারতের বহুত্ববাদী চিন্তা-চেতনায় বিশ্বাসী নাগরিকদের,জন্মসূত্রে সংখ্যালঘু, বিশেষকরে মুসলমান সম্প্রদায়ের নাগরিকদের বিজেপি সরকার ভারতের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করতে চাইছে তার বিরুদ্ধে ভারতজুড়ে একটা দাবানলের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে- সেই সমস্ত পরিস্থিতিকে বিপথে পরিচালিত করে বাজার অর্থনীতির স্বার্থপূরণের ভেতর দিয়ে, নিজেদের নগ্ন অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করার পথে তারা হাঁটতে শুরু করেছে।

আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকারের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে গোটা দেশের কৃষকসমাজ আন্দোলনে মুখরিত। দলমত নির্বিশেষে সমস্ত অবিজেপি রাজনৈতিক দলগুলি কৃষকদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কৃষকসমাজ তাদের অস্তিত্বরক্ষার প্রশ্নে আজ দেশের সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী সরকারের এই অপচেষ্টার বিরুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে লড়াই করছে। সেই লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে গোটা দিল্লি শহর এখন কার্যত অবরুদ্ধ।

কেন্দ্রের বিজেপি সরকার অনেকভাবেই সেই আন্দোলনকে প্রথম অবস্থাতে বিনষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল। এই শীতের রাতে জলকামান দিয়ে আঘাত করে নানারকমভাবে আন্দোলনরত কৃষকদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা তারা করেছিল। সেই চেষ্টার একটি অন্যতম বড়ো পর্যায় ছিল সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা।কিন্তু সেই বিভাজনকে কৃষকসমাজ যে বুদ্ধিমত্তার সাথে মোকাবিলা করেছে, তা ভারতের ইতিহাসে একটি নয়া দিগন্ত আগামীদিনে উন্মোচিত করবে এই ভরসা করা যায়।

এনআরসি বিরোধী আন্দোলনের সময়ে শাহিনবাগে যে ঐক্যবদ্ধ ভারতকে গোটা দুনিয়া দেখেছিল, যেখানে ধর্ম-জাতপাত-রাজনৈতিক রঙ কোনভাবেই কোনো ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া তৈরি করতে পারেনি বিজেপি-আরএসএস’র যাবতীয় প্রচেষ্টা সত্ত্বেও। ঠিক তেমনই পরিস্থিতি দিল্লির কৃষক আন্দোলনকে কেন্দ্র করে তৈরি হয়েছে। বিজেপি, আরএসএস এবং তাদের হাজাররকমের শাখা সংগঠন, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, বজরং দল ইত্যাদি দীর্ঘদিন ধরে গোটা ভারতকে ছিন্নভিন্ন করার লক্ষ্যে ধর্ম-জাতপাতের ভিত্তিতে ভারতের সমাজব্যবস্থাকে টুকরো টুকরো করে দেওয়ার চেষ্টা করছে। সেই চেষ্টার সাফল্য হিসেবে বিভিন্ন রাজ্যে তারা সংসদীয় রাজনীতিতে নিজেদের অস্তিত্ব প্রমাণের দিকে এগিয়েছে, ক্ষমতা দখল করেছে। সেই একইভাবে তারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতা দখল করেছে।

আরএসএস, বিজেপি সহ গোটা রাজনৈতিক হিন্দু সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শিবিরের এই ফ্যাসিবাদী প্রবণতার একটা ভয়ঙ্কর জবাব শুধু নয়, সার্বিক মোকাবিলার ক্ষেত্র হিসেবেই উঠে আসছে কৃষক আন্দোলন। হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের সহযোগিতার প্রশ্নটিই এখানে মূল বিষয়। মানুষ যেভাবে অন্নদাতাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন, মানুষ যেভাবে তাঁদের দৈনন্দিন চাহিদার দিকে লক্ষ রেখে খাবার, জল, ওষুধ, শীতবস্ত্র ইত্যাদি সরবরাহ করছেন, তাতে কোনো ধর্মের বালাই নেই। কোনোরকম উচ্চনিচের ভেদাভেদ নেই। এটা অত্যন্ত ইতিবাচক প্রবণতা যে, বিনোদন জগতের কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব, তাঁরাও অর্থ দিয়ে এবং সহমর্মিতা নিয়ে এঁদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। সামগ্রিকভাবে ভারতের বামপন্থী দলগুলো এ কৃষক আন্দোলনের পাশে আছে। তাছাড়াও প্রকাশ সিং বাদল, আকালি দলের দলের নেতা, যিনি দীর্ঘদিন অটলবিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বাধীন, নীতিহীন সুবিধাবাদী জোট এনডিএ’র সঙ্গে ছিলেন, এবং এনডিএ জামানাতেই পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন, তিনিও কৃষক সম্প্রদায়ের প্রতি যে অন্যায় আচরণ করছে নরেন্দ্র মোদী সরকার, তার প্রতিবাদে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করে ‘পদ্মভূষণ’ ত্যাগ করেছেন।

কৃষকেরা গত ৮ ডিসেম্বর ডাক দেয় ভারত বন্‌ধের। এমন অভূতপূর্ব ভারত বন্‌ধ সাম্প্রতিক অতীতে ভারত আর দেখেনি। দেশজুড়ে কৃষক আন্দোলনের প্রতি যে সহমর্মিতার ধ্বনি উঠেছে, তা হিন্দু সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নানা ধরনের অপকৌশল রুখে দেবার ক্ষেত্রে একটা নতুন ভাবনা চিন্তা, একটা নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে - এ ভরসা করতে পারা যায়।

নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র নেতৃত্বাধীন সরকার কৃষি সংস্কারের নাম করে তিনটি মৌলিক বিষয় ১৪০ কোটি ভারতবাসীর উপর চাপিয়ে দিচ্ছে। তাতে কৃষিপণ্য বিপণনে বিদেশি করপোরেট পুঁজির প্রবেশের রাস্তাটিকে একদম খোলামেলা করে দেওয়া হচ্ছে বিশেষকরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তাঁবেদার বহুজাতিকদের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টার ভেতর দিয়ে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট কিছু বহুজাতিকের সঙ্গে যৌথ প্রচেষ্টার যে কথা বলা হচ্ছে, সেই প্রচেষ্টা যদি আদৌ ফলপ্রসূ হয়, অর্থাৎ বিদেশি বহুজাতিকদের সঙ্গে বিকিকিনির বিষয়টি যদি আদৌ বাস্তবায়িত হয়, তাহলে ভারতের সার্বিক কৃষি-অর্থনীতি একেবারে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের মদতপুষ্ট বহুজাতিকদের করায়ত্ত হয়ে যাবে। আর ভারতের কৃষি অর্থনীতির এই অনিশ্চয়তা সামগ্রিকভাবে ভারতের অর্থনীতির উপর চরম নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করবে। তা ভারতের সামাজিক এবং অবশ্যই রাজনৈতিক ব্যবস্থাতেও প্রভাব ফেলবে আগামীদিনে।

সমস্ত বড়ো বড়ো হিমঘর আর রিটেল কর্পোরেটচেইনগুলি কৃষিপণ্যের প্রধান ক্রেতা হিসেবে উঠে আসবে। এই ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে কৃষিক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের বিষয়টি একদম সুনিশ্চিত করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। অর্থাৎ ভারতের কৃষিক্ষেত্রের সামগ্রিক পরিবেশটিকেই বিদেশি বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়ার এটা একটা ভয়ঙ্কররকমের অপচেষ্টা।

যে পর্যায়ে কৃষিক্ষেত্রে কর্পোরেট পুঁজির অনুপ্রবেশ হবে এই কৃষি আইনের নতুন ধারা-উপধারার ফলে, সেই একইহারে কৃষিক্ষেত্রে রাষ্ট্র তার দায়দায়িত্ব কিন্তু কমাতে শুরু করবে। অর্থাৎ কৃষিক্ষেত্র থেকে রাষ্ট্র সম্পূর্ণভাবে হাত তুলে নেওয়ার উপক্রম হিসেবেই কেন্দ্রের বিজেপি সরকার কৃষি আইনটিকে নিয়ে আসছে। প্রথম দফার ইউপিএ সরকারের আমলে ২০০৬ সালের আর্থিক সমীক্ষাতে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল যে, সরকারের দ্বারা অত্যন্ত বেশি পরিমাণে কৃষিপণ্য কেনা বেসরকারি সংস্থাগুলোর ক্ষেত্রে একটা সমস্যা তৈরি করছে। এই কারণেই বেসরকারি সংস্থাগুলো কৃষিবাণিজ্যে পুঁজি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে বিশেষরকমের উৎসাহী হচ্ছে না। ওই সময় থেকেই কিন্তু সরকার গোটা বিষয়টিকে ঘিরে চিন্তাভাবনা শুরু করে। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার আসবার পরে ফসলের দাম সম্পূর্ণভাবে বাজার নিয়ন্ত্রিত করবার যে পর্যায়টি একদম কার্যত আইনসম্মত হতে শুরু করে, সেটি ভারতের কৃষকসমাজের ক্ষেত্রে একটা ভয়ঙ্কর বিপদের সম্ভাবনা ডেকে আনছে।

সরকারের ফসল কেনার প্রক্রিয়াটি কিন্তু নরেন্দ্র মোদী প্রথম দফায় ২০১৪ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ধীরে ধীরে কমিয়ে দিতে শুরু করেছিলেন। উৎপাদন খরচের উপর ৫০ শতাংশ লাভ ধরে ফসলের দাম নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে সরকারের আর কোনো দায় থাকবে না। কারণ, সরকার এবার থেকে ফসলের দাম নির্ধারণ করবে না। ফসলের দাম নির্ধারণ করবে বাজার। এটাই ছিল কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকারের মূলনীতি। আর এই মূলনীতির মধ্যে কিন্তু লুকিয়ে আছে ভারতের কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে, ভারতের কৃষি, ভারতের জমি, ভারতের কৃষককে বিদেশি বহুজাতিকদের হাতে তুলে দেওয়ার ভয়ঙ্কররকমের ষড়যন্ত্রের বিষয়টি।

বহুজাতিক কৃষিপণ্য বিপণনের সঙ্গে যে সমস্ত সংস্থা জড়িত, তারা কিন্তু দীর্ঘদিন ধরেই ভারতের ফসল উৎপাদনজনিত খাদ্যশস্য স্বনির্ভরতাকে নষ্ট করে দিতে উদ্যোগী। অতীতে যদিও রাজনীতিতে বামপন্থীদের সক্রিয়তার দরুন কেন্দ্রীয় সরকার এই ধরনের বিদেশি বহুজাতিকদের প্রচেষ্টাটিকে বাস্তবায়িত করতে পারেনি।

বস্তুত পি ভি নরসিমা রাও প্রধানমন্ত্রী হওয়ার সময়কাল থেকেই কিন্তু বহুজাতিকরা এভাবে আমাদের দেশের খাদ্যশস্যের স্বনির্ভরতাকে নষ্ট করে, বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানির বিষয়টি ভারতের উপরে চাপিয়ে দেওয়ার জন্য চেষ্টা করে চলেছে। এই চেষ্টায় যে একটা সময়ে নরসিমা রাওয়ের অর্থমন্ত্রী হিসেবে ডঃ মনমোহন সিংয়ের কিছুটা প্রশ্রয় ছিল না এ কথা বলা যায়না।

চুক্তিচাষের ভেতর দিয়ে কৃষককে অর্থকরী ফসল চাষে প্রলোভিত করবার যে পর্যায়টি শুরু হয়েছিল নরসিমা রাওয়ের আমল থেকে, সেই পর্যায় থেকে কিন্তু পরবর্তীকালে অটলবিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন, সেই সাড়ে ছয় বছরে, অনেকখানি প্রসারিত করার দিকে তৎকালীন কেন্দ্রীয় সরকার এগিয়ে ছিল। সেইপথেই কিন্তু আজকে নরেন্দ্র মোদী সরকার এগোচ্ছে। সেই পথকে আরও নগ্ন, আরও বর্বরোচিত করে, ভারতের কৃষি অর্থনীতিতে সম্পূর্ণভাবে বিদেশি বহুজাতিকদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত করার লক্ষ্যেই এই কৃষি আইন।

চুক্তিভিত্তিক যে চাষের কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ এই চাষের মধ্যে যে ভয়ঙ্কররকমের একটা খরচাপাতির ব্যাপার থাকে, আর তার সাথে থাকে একটা দীর্ঘমেয়াদি বহুজাতিকের সঙ্গে কৃষকের সরাসরি সম্পর্ক সেটি কিন্তু কৃষকের সর্বনাশ ডেকে আনার ক্ষেত্রে সব থেকে বড়ো বিপদ। এটি কেবলমাত্র কৃষকের সর্বনাশ ডেকে আনবে না, দেশের মানুষের যে খাদ্যনিরাপত্তার বিষয়, সেটিকে চরমভাবে অনিশ্চিত করে ফেলবে। বিদেশি বহুজাতিকদের লক্ষ্যই হচ্ছে ভারতের খাদ্য নির্ভরতা, উৎপাদন নির্ভরতাকে কার্যত শূন্য করে দিয়ে, ভারতকে খাদ্যের জন্য সম্পূর্ণভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল করে তোলা। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের একটি নতুন পর্যায়ে তাদের উপর নির্ভরশীল করে, অর্থাৎ ভারত আর খাদ্যশস্যের জন্য নিজেরা উৎপাদনের দিকে যাবে না। তারা সম্পূর্ণভাবে চুক্তিভিত্তিক চাষের ভেতর দিয়ে মার্কিন প্রভুদের শরণাপন্ন হয়ে থাকবে। মার্কিন প্রভুদের দাসানুদাস হয়ে থাকবে।

কৃষকসমাজকে সামনে রেখে কৃষি আইনের এই সংশোধনীর ভেতর দিয়ে দেশের কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণভাবে মার্কিন মদতপুষ্ট, নয়া-উদার অর্থনীতির দ্বারা পরিচালিত বহুজাতিকদের হাতে তুলে দিলেও এই ব্যবস্থা কিন্তু কোনো অবস্থাতেই ভারতের কৃষকদের পক্ষে ইতিবাচক হতে পারে না। ভারতের কৃষকদের এই কৃষি আইন কোনো অবস্থাতেই ফসলের ন্যায্য দাম দেবে না। এক্ষেত্রে খোদ মার্কিন মুলুকের অভিজ্ঞতার দিকে আমাদের একটু নজর দেওয়া যেতে পারে। খোদ মার্কিন মুলুকে মুক্তবাজার অর্থনীতি ব্যবস্থা চালু হওয়ার পর থেকে মার্কিন দেশের কৃষকরা ফসলের খুচরা মূল্যের যে ৪০ শতাংশ হারে ন্যায্য দাম পেত, সেটা কমতে কমতে এই মুহূর্তে খুচরো মূল্যের মাত্র ১৫ শতাংশ তারা পায়।

ভুলে গেলে চলবে না যে, ইয়োরোপ এবং মার্কিন দেশে কৃষিকে বাঁচিয়ে রাখতে সেদেশের সরকারগুলি হাজার হাজার কোটি ডলার ভরতুকি দেয়। আর আমাদের ভারতের সরকার কৃষিক্ষেত্রে ভরতুকি তুলে নেওয়ার জন্য সমস্তরকমের ব্যবস্থা ধীরে ধীরে লাগু করতে শুরু করেছে। বাজারনির্ভর কৃষি অর্থনীতি, ক্ষুদ্র এবং মাঝারি কৃষকদের জন্য একটা ভয়াবহ সঙ্কট ডেকে আনবে। ভারতের কৃষকসমাজ সেটা বুঝেছে বলেই তারা আজ এই ধরনের আন্দোলনের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করেছে। ভারতের সমস্ত অংশের মানুষ এটি অনুভব করেছেন বলেই, এই ধরনের একটি সফল ধর্মঘট তারা করতে সক্ষম হয়েছেন। সমাজের সর্বস্তরের মানুষ তাদের নিজেদের অস্তিত্বরক্ষার লড়াই হিসেবে ধরে নিয়ে ধর্মঘটকে সমর্থন করেছে।

নতুন কৃষি আইনের ফলে সাধারণ মানুষ কর্পোরেটগুলির বদান্যতায় আরও বেশি দাম দিয়ে ফসল কিনতে বাধ্য হবে। নরেন্দ্র মোদী সরকার কৃষি আইন সংশোধনের নাম করে পণ্য নিয়ন্ত্রণ আইনকে তুলে দিয়েছে ইতিমধ্যেই। কৃষিপণ্য সহ নানান খাদ্যবস্তু ঘিরে নানাধরনের ভয়াবহ কালোবাজারি ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। এই আইনের বিষয়টি যত এগোবে, সেই কালোবাজারি যে ভারতের সার্বিক অর্থনীতিকে খেয়ে ফেলবে সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি মতাদর্শগতভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভাবনার বিরুদ্ধে এবং কেন্দ্রীয়করণের পক্ষে নানান ধরনের কথা বলে থাকে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে তারা করে সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানমুখী কাজ। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে, কৃষি আইন সংশোধন ঘিরে নরেন্দ্র মোদী সরকারের এই সংস্কার কর্মসূচি প্রকৃতপক্ষে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তির অবস্থানকে দৃঢ় করবে।

বিকেন্দ্রীকরণের পরিবর্তে কেন্দ্রীকরণের ভেতর দিয়ে সমস্ত কিছু কেন্দ্রের হাতে কুক্ষিগত করবার একটি পদক্ষেপ হলো এই কৃষি আইন সংশোধন। কৃষি যৌথ তালিকারভুক্ত বিষয়। অথচ কৃষিক্ষেত্রে এই ধরনের একটা ব্যাপক সংস্কারের ভেতর দিয়ে ভারতের কৃষিব্যবস্থাকে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত করে দেওয়ার উপক্রম, তাতে রাজ্যের কোনো বক্তব্য রইল না। রাজ্যের কোনো বক্তব্য লিপিবদ্ধকরণের উপক্রমও রইল না। বলাবাহুল্য, এই আইনের প্রয়োগের ক্ষেত্রে রাজ্য তালিকাভুক্ত, যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়ে রাজ্যের কোনো মতবাদ স্থান পাবে না। অর্থাৎ ভারতের যে যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর সার্বিক চরিত্র ভারতের মহান সংবিধান আমাদের উপহার দিয়েছে, সেই চরিত্রকে ধ্বংস করে, একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে ধ্বংস করা, অপরদিকে সংবিধানের ইতিবাচক দিকগুলোকে ধ্বংস করাই হচ্ছে এই কৃষি আইন সংস্কারের ভেতর দিয়ে আরএসএস’র রাজনৈতিক সংগঠন বিজেপি’র অন্যতম প্রধান লক্ষ্য। এর পাশাপাশি একথা অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলতে হয়, কর্পোরেট লবির যে চাহিদা, সেই চাহিদা অনুযায়ী সারাদেশে একটি কেন্দ্রীয় আইন যদি কৃষি সংক্রান্ত ক্ষেত্রে থাকে, তাহলে এই মার্কিন মদতপুষ্ট বহুজাতিকগুলির বাজার দখলের কাজটি অনেক বেশি সহজ হবে।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নরেন্দ্র মোদী সরকারের কৃষি আইন সংশোধনের ভেতর দিয়ে তাদের শ্রেণিচরিত্রের যে নগ্ন বহিঃপ্রকাশ সেই দিকটি নরেন্দ্র মোদী সরকার অত্যন্ত প্রকাশ্যে, কোনো ধরনের রাখঢাক না রেখে নিয়ে আসছে। কর্পোরেট বণিক সংস্থাগুলি কৃষিব্যবসায় এবং কৃষকদের পক্ষে না থেকে বৃহৎ কৃষকদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করছে। খেতমজুর, ভূমিহীন চাষি ইত্যাদিদের দিকে কোনোদিন কোনোরকমভাবে তারা দৃষ্টি দেয় না। কৃষি আইন সংশোধনের ফলে মাঝারি, ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষক সহ বিরাট সংখ্যক কৃষকের অবস্থার একটা ভয়াবহ অবনতি ঘটবে। ফলে দেশে দারিদ্র্য, বেকারি, কর্মহীনতা, অর্থনৈতিক সঙ্কট একটা ভয়াবহ জায়গায় চলে যাবে।

নরেন্দ্র মোদীর এই কৃষি আইন সংস্কারের ফলে ভারতের কৃষিব্যবস্থার তো কোনো চরিত্রগত পরিবর্তন ঘটবে না। ভারতের কৃষিব্যবস্থাতে যে আধা-সামন্ততান্ত্রিক, আধা-ঔপনিবেশিক ব্যবস্থা বলবৎ আছে, এই কর্পোরেটনির্ভর কৃষিব্যবস্থা তাকে আরও জোরদার করবে। ফিনান্স পুঁজির ভয়াবহতা গত প্রায় তিরিশ বছর ধরে ভারতের অর্থনীতিকে কার্যত গ্রাস করে ফেলেছে। ফলে, ভূমিসংস্কারের পথে যাতে ভারতের শাসককে কখনও কোনোভাবে যেতে না হয়, তার একটা বিধিব্যবস্থা করে রাখার উপক্রম হিসেবেই এই কৃষি আইন সংশোধনের বিষয়টিকে হিন্দু সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী বিজেপি সরকার উপস্থাপিত করেছে।

এই কৃষি আইন সংশোধনের বিষয়টিকে ঘিরে হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তি তাদের সামাজিক প্রযুক্তির ভেতর দিয়ে এই প্রচার চালাচ্ছে যে, যারা এই আইনের বিরোধিতা করছে তারা ফড়েদের পক্ষ অবলম্বন করছে। বস্তুত মধ্যস্বত্বভোগী ফড়েদের দল বিজেপি’র এই ধরনের প্রচারের রাজনৈতিক তাৎপর্যটাও আমাদের একটু ভেবে দেখা দরকার। কারণ, আজকে যে কৃষি আইন সংশোধনের বিষয়টি উপস্থাপিত হয়েছে, এই ধরনের প্রক্রিয়া কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে ক্ষমতায় আসার পর, ২০১৪ সালে পশ্চিমবঙ্গে আইন করে লাগু করবার পথে অনেকখানি এগিয়ে গিয়েছিল।

মমতা মুখে কৃষক আন্দোলনের প্রতি সহমর্মিতা জ্ঞাপন করলেও এই আইন যখন সংসদে অনুমোদিত হয় তার দলের সাংসদরা কিন্তু সংসদে নীরব ভুমিকা রেখে কার্যত এই আইন সংশোধনের বিষয়টিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এইরকম একটি ভয়াবহ সঙ্কটের মুখে ভারতের শুধু অর্থনীতির প্রেক্ষিত নয়, শুধু কৃষিব্যবস্থার প্রেক্ষিত নয় - গোটা নাগরিক সমাজকে, একদিকে নাগরিকত্ব আইন সংশোধনী, অপরদিকে কৃষি আইন ইত্যাদি ভেতর দিয়ে আরএসএস-বিজেপি ভারতের মানুষদের সাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ লড়াই করবার একটা নতুন প্রেক্ষিতে বোধহয় রচনা করে দিচ্ছে।