৫৮ বর্ষ ১৭শ সংখ্যা / ১১ ডিসেম্বর ২০২০ / ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪২৭
ভীমা কোরেগাঁও মামলাঃ দেশে স্বৈরাচার প্রতিষ্ঠার একটি পদক্ষেপ
সিদ্ধার্থ সেনগুপ্ত
মোদীর শাসনে দেশ বিপজ্জনক স্বৈরাচারের দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে, তা ভীমা কোরেগাঁওয়ের সাজানো মামলায় স্পষ্ট প্রমাণিত হয়েছে। ২০১৪ সালে আরএসএস পরিচালিত বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে জনগণের সাংবিধানিক অধিকারগুলি ছিনিয়ে নেওয়া শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালে মোদী সরকার দ্বিতীয়বার ক্ষমতাসীন হবার পর থেকে নাগরিক ও সাংবিধানিক অধিকারের উপর আক্রমণ লাগামহীন হয়ে বেড়ে চলেছে। সিবিআই, ইডি, এনআইএ, নারকোটিক কন্ট্রোল ব্যুরো প্রভৃতি কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলিকে কেন্দ্রীয় সরকার আজ্ঞাবহ করে তুলেছে। সুকৌশলে এই সংস্থাগুলিকে বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং আরএসএস-বিজেপি বিরোধী স্বাধীন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে নির্মমভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে। ভিন্নমতপোষণকারীদের দেশদ্রোহী হিসাবে প্রচারের সাথে সাথে দৈহিক আক্রমণও নামিয়ে আনা এখন প্রতিদিনের ঘটনা। এর জন্য লাভ জিহাদ, শহুরে নকশাল, দেশদ্রোহী, ঘরওয়াপসি ইত্যাদি শব্দবন্ধগুলি আমদানি করেছে মোদী সরকার এবং আরএসএস।
ভীমা কোরেগাঁওর সাজানো মামলায় বুদ্ধিজীবী-কবি-অধ্যাপক-আইনজীবী-মানবাধিকার কর্মীদের বিনা বিচারে আনলফুল অ্যাক্টিভিটি (প্রিভেনশন) অ্যাক্টে (সংক্ষেপে ইউএপিএ) আটক করে রাখা হয়েছে। অশীতিপর বন্দিদের আইনগত সুযোগসুবিধা ও চিকিৎসা থেকেও বঞ্চিত করা হচ্ছে দিনের পর দিন। তাঁদের প্রতি এই আচরণ মনে করিয়ে দিচ্ছে হিটলারের কনসেনট্রেশন ক্যাম্পগুলির কথা। প্রথমেই ভীমা কোরেগাঁও’র ঘটনাটা সংক্ষেপে দেখে নেওয়া যাক।
১৮১৮ সালের ১ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের পুনে জেলায় ভীমা কোরেগাঁও গ্রামে নিম্নবর্ণের মাহার সম্প্রদায়কে নিয়ে গঠিত ব্রিটিশ সেনাবাহিনী পরাজিত করে ব্রাহ্মণ শাসক দ্বিতীয় পেশোয়া বাজীরাওকে। সেইসময় থেকে উচ্চবর্ণের অত্যাচারী শাসকের বিরুদ্ধে নিস্পেষিত ও অত্যাচারিত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষরা প্রতিবছর ওই দিনটিকে বিজয় দিবস হিসাবে পালন করে আসছে।
প্রতি বছরের মতো ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি এই বিজয় উৎসব পালন করতে বিভিন্ন স্থান থেকে দলিত সম্প্রদায়ের মানুষরা ভীমা কোরেগাঁওতে সমবেত হন। তার আগের দিন ৩১ ডিসেম্বর ‘এলগার পরিষদ’ সংস্থার উদ্যোগে আহুত এক আলোচনাসভায় দুইজন আইন বিশেষজ্ঞ, যাঁদের মধ্যে একজন ছিলেন সুপ্রিম কোর্টের প্রাক্তন বিচারপতি, নরেন্দ্র মোদী সরকারের এবং বিজেপি’র হিন্দুত্ব কর্মসূচির তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য পেশ করেছিলেন। পরদিন বিজয় উৎসব পালনের জন্য বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত দলিত সম্প্রদায়ের মানুষদের উপর সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দুত্ববাদীরা আক্রমণ চালালে একজনের মৃত্যু হয়। সেই সময়ে মহারাষ্ট্রে বিজেপি পরিচালিত জোট সরকার শাসনক্ষমতায় আসীন। পুলিশ সঙ্ঘ পরিবারের আক্রমণকারীদের আড়াল করতে আগের দিন এলগার পরিষদ আয়োজিত আলোচনাসভায় বক্তাদের উস্কানিমূলক বক্তব্যকেই দায়ী করে। অর্থাৎ মোদী ও হিন্দত্ববাদীদের সমালোচনা করলেই ষড়যন্ত্রকারী দেশদ্রোহী তকমা লাগিয়ে দেওয়াই এখন আরএসএস’র দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশের এই হীন ভূমিকাকে উপেক্ষা করেই দলিত সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে অনিতা শাওলে হিংসাত্মক ঘটনার জন্য শম্ভাজী ভিড়ে এবং মিলিন্দ একবোটের নামে এফআইআর দায়ের করা হয়। শিবাজীনগর প্রতিষ্ঠানের প্রধান আরএসএস ঘনিষ্ঠ শম্ভাজী ভিড়ে এবং পুর নিগমের প্রাক্তন কাউন্সিলর একবোটে হিন্দু জাগরণ সমিতির সাথে যুক্ত। এর আগেও একবোটে বেশ কয়েকবার সাম্প্রদায়িক উস্কানির অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। দু’জনের বিরুদ্ধে এফআইআর থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র একবোটেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং তিনিও এক মাসের মধ্যেই জামিন পেয়ে যান। মনুবাদে বিশ্বাসী সঙ্ঘ পরিবার দলিতদের এই বিজয় উৎসব কখনোই মেনে নিতে পারেনা। তাই কয়েকদিনের মধ্যে সাজানো ও মিথ্যা মামলার প্রস্তুতি নেওয়া হয় সঙ্ঘ পরিবারের পক্ষ থেকে।
শম্ভাজী ভিড়ের এক অনুগামী তুষার দামগুড়েকে দিয়ে ৮ জানুয়ারি একটি এফআইআর দায়ের করা হয়। ওই সময়ে সঙ্ঘ ঘনিষ্ঠ পুনের ইন্টিগ্রেটেড ন্যাশনাল সিকিউরিটি সংস্থা ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনার মধ্যে শহুরে নকশালদের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করে। রাজ্যের বিজেপি সরকারের নির্দেশে পুলিশও তাদের তদন্তের অভিমুখ পরিবর্তন করে শহুরে নকশাল খোঁজা শুরু করে। আগে থেকেই অবশ্য বিজেপি-আরএসএস এই একই তত্ত্ব প্রচারে পূর্ণোদ্যমে নেমে পড়েছিল। আক্রমণকারীদের আড়াল করতে শহুরে নকশালদের ষড়যন্ত্রের কথা একযোগে প্রচার করতে থাকে কেন্দ্রীয় ও মহারাষ্ট্রের তৎকালীন বিজেপি সরকার এবং সঙ্ঘ পরিবার। ২০১৮ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বলেছিলেন, ‘নকশালবাদীরা শহরে প্রবেশ করে মানুষের মধ্যে প্রভাব বিস্তার করছে’। ‘শহুরে নকশালরা, যাঁরা নিজেদের বুদ্ধিজীবী বলে দাবি করে থাকেন, তাঁরা ছাত্রদের কাঁধে বন্দুক রেখে সুবিধা পেতে চাইছেন’ - এমন কথা ২০১৯ সালে ছাত্রদের উদ্দেশ্য করে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন। তার কিছুদিনের মধ্যেই দেশের মানুষ দেখেছিলেন, রাতের অন্ধকারে কি নৃশংসতার সাথে ফ্যাসিস্ত কায়দায় আক্রান্ত ও রক্তাক্ত হয়েছিল জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দ সহ অসংখ্য ছাত্রছাত্রী।
ভীমা কোরেগাঁওর পুরোপুরি সাজানো মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়েছে সুধা ভরদ্বাজ, অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপিকা সোমা সেন, আইনজীবী সুরেন্দ্র গাডলিঙ, মহেশ রাউত, অরুণ ফেরেরা, সুধীর ধাওয়ালে, রোনা উইলসন, ভার্নন গঞ্জালভেজ, ভারভারা রাও, দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক হানিবাবু, ভীমা কোরেগাঁও শৌর্য দীন প্রেরণা অভিযানের কর্মী জ্যোতি জগতপ, সাগর গোরখে, রমেশ গাইতোর, সাংবাদিক গৌতম নবলাখা,আনন্দ তেলতুম্বদে সহ মোট ১৬ জনকে। সবাইকেই বিনাবিচারে আটকের আইন ইউএপিএ-তে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৮ অক্টোবর এনআইএ একই আইনে গ্রেপ্তার করেছে রাঁচির আদিবাসীদের অধিকার রক্ষায় নিবেদিত প্রাণ ৮৩ বছরের জেসুইট মিশনারি স্ট্যান স্বামীকে। গ্রেপ্তার হওয়ার ঠিক আগে তিনি এক ভিডিয়ো বার্তায় জানিয়ে গিয়েছেনঃ ‘‘আমি জীবনে কোনোদিন ভীমা কোরেগাঁওয়ে যাইনি। আমাকে মুম্বাই নিয়ে যেতে চাওয়া হচ্ছে। আমি করোনার কারণে যেতে চাই না। আমার সঙ্গে যা ঘটছে তা আলাদা কিছু নয়। যেসব সমাজকর্মী, আইনজীবী, লেখক, সাংবাদিক, ছাত্রনেতা, কবি, বুদ্ধিজীবী সহ অন্যান্যরা যাঁরা আদিবাসী, দলিত ও প্রান্তিকদের অধিকারের পক্ষে দাঁড়িয়েছেন এবং শাসনক্ষমতার বিরুদ্ধে মত প্রকাশ করেছেন, তাঁদেরকেই নিশানা করা হয়েছে।’’ স্ট্যান স্বামীর গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে দু’হাজারের বেশি শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, বিশিষ্ট ব্যক্তি প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আসলে কেন্দ্রীয় সরকার ভিন্ন মতাবলম্বীদের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে মুক্ত চিন্তার পক্ষে থাকা মানুষদের এইভাবে মিথ্যা মামলায় জেলে ঢোকাচ্ছে। এই গ্রেপ্তারের তীব্র প্রতিবাদ করে ঝাড়খণ্ডের মুখ্যমন্ত্রীও চিঠি দিয়েছেন।
পার্কিনসন্স রোগে আক্রান্ত চলাফেরায় অক্ষম স্ট্যান স্বামীর দুবার হার্নিয়া অপারেশনের জন্য তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে জেলবন্দি। নিজের হাতে খাবার মুখে দেওয়া দূরের কথা জলের গ্লাসও মুখে তুলতে পারেন না। স্ট্র ও পেয়ালা ব্যবহারের অনুমতির আবেদনের শুনানি আদালত ধার্য করেছে ২০ দিন পর। তালোজা জেল থেকে এক চিঠিতে স্ট্যান স্বামী তাঁর প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন ও সংহতি জানানোর জন্য দেশবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে এক চিঠিতে লিখেছেনঃ ‘‘দুপুরে ফেরেরা খাইয়ে দেন, স্নান করিয়ে দেন ভার্নন। রাতে আমার ১৩ ফুট বাই ৮ ফুট জেল কুঠুরিতে আরও দুজন সহবন্দি রাতের খাবার খাইয়ে দেন এবং জামাকাপড় ধুয়ে দেন। হাঁটুর যন্ত্রণা বাড়লে মালিশ করে দেন।’’ এই অমানবিক ও অবমাননাকর পরিস্থিতির মধ্যেও স্ট্যান স্বামী ‘মানবতার এক উজ্জল নিদর্শন’ দেখতে পাচ্ছেন। খারাপ স্বাস্থ্যের কারণে তাঁর জামিনের আবেদনকেও খারিজ করে দিয়েছে এনআইএ আদালত। ভীমা কোরেগাঁওয়ের ঘটনার পরপরই বিজেপি সরকারের অভিযোগে বলা হয়েছিল, হিংসাত্মক ঘটনায় মদতের কথা। কিছুদিনের মধ্যেই তা পালটে দিয়ে বলা হলো মাওবাদী সংস্রবের কথা। পরবর্তীকালে তাও পাল্টে দিয়ে অভিযোগ আনা হলো প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের কথা।
যদিও কোনো প্রমাণ এখনও পর্যন্ত দেখাতে পারেনি এনআইএ। প্রমাণ বলতে দু’জনের কম্পিউটার থেকে পাওয়া কয়েকটি চিঠি। আন্তর্জাতিক সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের টেকনিক্যাল শাখার পর্যবেক্ষণ হচ্ছে, অন্তত একটি কম্পিউটারে ম্যালওয়্যার ঢোকানো ছিল, যার ফলে দূর থেকেই এই কম্পিউটারটি নিয়ন্ত্রণ করা যেত। সুতরাং অভিযোগের চিঠিটি কম্পিউটারে দূর থেকে ঢোকানো অসম্ভব নয়। ভীমা কোরেগাঁও মামলায় ইউএপিএ আইনে গ্রেপ্তার হওয়া বুদ্ধিজীবীদের একমাত্র অপরাধ তাঁরা আরএসএস’র মতাদর্শের বিরোধিতায় সোচ্চার ছিলন। তাঁরা দলিত ও সমাজের অন্যান্য পিছিয়ে-পড়া অংশের মানুষের অধিকার রক্ষার সপক্ষে কাজ করছিলেন। মোদী সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন।
২০১৮ সালের ২৯ আগস্ট আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ঐতিহাসিক রোমিলা থাপার,প্রভাত পট্টনায়েক সহ পাঁচজন এই গ্রেপ্তারের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছিলেন। ডিভিশন বেঞ্চে ২-১ ভোটে সেই আবেদন খরিজ হয়ে গেলেও ভিন্ন রায়ে বিচারক ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় তাঁর সুচিন্তিত মতামতে উল্লেখ করেছিলেনঃ “ভিন্নমত গণতন্ত্রের এক প্রাণবন্ত প্রতীক। সরকারের বিরোধিতা করা ও অস্ত্রের সাহায্যে সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার মধ্যে সুস্পষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান। বিরোধিতার কণ্ঠকে রাষ্ট্র কর্তৃক স্তব্ধ করার এক প্রয়াস… মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার কারণে এঁদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।” তাঁর আরও পর্যবেক্ষণ ছিল, অভিযুক্তদের বাড়ি সার্চের সময় স্থানীয় সাক্ষীদের না নিয়ে পুনা থেকে সাক্ষী নিয়ে যাওয়া হয়েছিল - যা নিরপেক্ষ তদন্তের পরিপন্থী। যেসব তথ্যপ্রমাণ আদালতের সামনে পুলিশ পেশ করেছে - তার নিরপেক্ষতা নিয়েও ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযুক্ত আইনজীবী সুধা ভরদ্বাজের জনৈক কমরেড প্রকাশকে লেখা চিঠিতে মারাঠি শব্দ ব্যবহার করা হয়েছে - যে ভাষা সুধা ভরদ্বাজ জানেন না। মহারাষ্ট্র পুলিশের তদন্তের নিরপেক্ষতা নিয়েও তিনি সন্দেহের কথা প্রকাশ করেছিলেন। দেশের বিচারব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে দীর্ঘদিন জনমানসে নানারকম বিভ্রান্তি ও সন্দেহ দানা বাঁধছে। ৮০ বছর বয়সী তেলেগু কবি ও লেখক ভারভারা রাওয়ের ২০১৮ থেকে কারা কর্তৃপক্ষ যথাযথ চিকিৎসা দিচ্ছে না বলে দাবি করে তাঁর স্ত্রী পি হেমলতা যে জামিনের আবেদন করেছিলেন, তা নাকচ হয়ে যায় বোম্বে হাইকোর্টে। রিট পিটিশনে ভারভারা রাওয়ের স্ত্রী বলেছিলেন, ভারভারা রাও স্মৃতিশক্তিহীনতায় আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী। এছাড়াও ইউরিনারি সমস্যাতেও ভুগছেন। এই মুহূর্তে তাঁকে সরিয়ে না নিলে জেলের মধ্যেই মৃত্যু হতে পারে। এই দাবি না মেনে আদালত বলেছিল, জেলের বাইরে তাঁর চিকিৎসা নয়। টেলি মেডিসিন দেওয়া সম্ভব না হলে চিকিৎসকেরা তালোজা জেলে গিয়ে তাঁকে দেখে আসতে পারবেন। অবশেষে গত ১৭ নভেম্বর আদালত ভারভারা রাওকে ১৫ দিনের জন্য নানাবতী হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠাতে রাজি হয়। এর আগে স্বাস্থ্যের কারণে ভারভারা রাওয়ের ৪টি জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়েছিল আদালত।
কিছুদিন আগে মোদী সরকারের ক্রীড়নক সাংবাদিক অর্ণব গোস্বামী আত্মহত্যায় প্ররোচনা দেওয়ার অভিযোগে ফৌজদারি মামলায় গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। তিন স্তর আদালত - সেশন কোর্ট, হাইকোর্ট ঘুরে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেতে অর্ণব গোস্বামীর লেগেছিল মাত্র ৭ দিন। গোস্বামী জেলের অভ্যন্তরে মোবাইল ফোন নিয়ে যেতে পেরেছিলেন, অথচ চলচ্ছক্তিহীন হাতে ধরে খাবার গ্রহণ করতে অসমর্থ ভারভারা রাও ও স্ট্যান স্বামীকে কম্বল, স্ট্র, প্লেট ইত্যাদি দেবার আবেদন করা সত্ত্বেও দিচ্ছে না জেল কর্তৃপক্ষ।
ভীমা কোরেগাঁওয়ের এই সাজানো মামলা দেখে বোঝা যাচ্ছে - কীভাবে দেশে ভিন্ন মতাবলম্বী ও সরকার বিরোধীদের বিরুদ্ধে ফ্যাসিস্ত কায়দায় আক্রমণ চলেছে। ইতিমধ্যে মহারাষ্ট্রে বিজেপি সরকার পরিবর্তন হয়ে নতুন সরকার গঠিত হওয়ার পর ভীমা কোরেগাঁও মামলা পুনঃমূল্যায়নের ঘোষণার সাথে সাথেই আগের বিজেপি সরকারের মিথ্যা মামলা সাজাবার ষড়যন্ত্র যাতে ফাঁস না হয়ে যায়, তারজন্য মোদী সরকার এনআইএ’র হাতে মামলা দিয়ে দেয়। ভিন্ন মতাবলম্বী এবং অবিজেপি রাজ্য সরকারগুলির বিরুদ্ধে মোদী সরকার কেন্দ্রীয় তদন্ত সংস্থাগুলিকে ফ্যাসিস্ত কায়দায় ব্যবহার করার চেষ্টা করছে তার একটি উদাহরণ হলো কেরালার ঘটনা। গত জুলাই মাসে কেরালার তিরুবনন্তপুরম বিমানবন্দরে সংযুক্ত আমিরশাহির কূটনৈতিক ব্যাগে ৩০ কেজি সোনা পাচারের ঘটনায় তদন্তের নির্দেশ দিলে তাকে স্বাগত জানিয়েছিল রাজ্যের বাম-গণতান্ত্রিক সরকার। ইউএপিএ’র অধীনে এই মামলাটিতে এখন বামনেতাদের জড়ানোর পরিকল্পনা করছে মোদী সরকার।
ঠিক একইভাবে, দিল্লি দাঙ্গায় প্রকৃত দায়ী বিজেপি নেতা-মন্ত্রীদের কেশাগ্র স্পর্শ না করে বিনাবিচারে দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন বিরোধী আন্দোলনকারী ছাত্রনেতা ও প্রতিবাদী নাগরিকদের। অতিরিক্ত চার্জশিটে নাম রাখা হয়েছে বামপন্থী নেতা সীতারাম ইয়েচুরি, বৃন্দা কারাত, কবিতা কৃষ্ণন, অ্যানি রাজা, অর্থনীতিবিদ জয়তী ঘোষ, যোগেন্দ্র যাদব, তথ্যচিত্র নির্মাতা রাহুল রায়, কংগ্রেস নেতা ও প্রাক্তন বিদেশমন্ত্রী সলমন খুরশিদ প্রমুখের।
বিভিন্ন গণতান্ত্রিক মহল থেকে মোদী সরকারের এই অপচেষ্টার তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। কিন্তু চার্জশিট সংশোধিত হয়েছে বলে এখনও জানা নেই। স্বৈরাচারের প্রমাণ আর কি হতে পারে!