৫৯ বর্ষ ২৬ সংখ্যা / ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০২২ / ২৮ মাঘ, ১৪২৮
গণভিত্তি সম্পন্ন পার্টি গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে প্রকাশ ২৩তম কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব
নিজস্ব প্রতিনিধিঃ সিপিআই(এম)’র তেইশ তম কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব গত ৪ ফেব্রুয়ারি নয়াদিল্লিতে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ হয়েছে। পার্টির কেন্দ্রীয় দপ্তরে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এই খসড়া প্রস্তাব প্রকাশ করেন পার্টির সাধারণ সম্পাদক সীতারাম ইয়েচুরি। খসড়া প্রস্তাবে বিজেপি-কে বিচ্ছিন্ন ও পরাস্ত করাই মূল রাজনৈতিক কাজ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এর জন্য জরুরি হলো সিপিআই(এম) এবং বাম শক্তির স্বাধীন বিকাশ এবং হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদ, সাম্প্রদায়িকতাবাদ-করপোরেট আঁতাত ও জনগণের জীবনজীবিকার ওপর নয়া-উদারবাদী নীতির আক্রমণের বিরুদ্ধে বাম-গণতান্ত্রিক শক্তির ঐক্যবদ্ধ শ্রেণি ও গণ আন্দোলন গড়ে তোলা।
খসড়া প্রস্তাবে আহ্বান জানিয়ে বলা হয়েছেঃ ‘‘একটি শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে আমাদের প্রত্যয়কে আরও দ্বিগুণ শক্তিশালী করতে হবে! গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে আগুয়ান হোন! সর্বভারতীয় গণভিত্তিসম্পন্ন শক্তিশালী সিপিআই(এম) গড়ে তুলতে আগুয়ান হোন!’’
সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন হান্নান মোল্লা, তপন সেন, বি ভি রাঘভুলু এবং নীলোৎপল বসু।
পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কংগ্রেসের দুমাস আগে রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রকাশ হয়। পার্টির সর্বস্তরে এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করা যাবে, সংশোধনী-সংযোজনী পাঠানো যাবে। পাঠানো নির্বাচিত সংশোধনী-সংযোজনী পার্টি কংগ্রেসে পেশ হবে, আলোচনা হবে এবং চূড়ান্ত হবে। সীতারাম ইয়েচুরি সাংবাদিক সম্মেলনে জানান, কংগ্রেসের রাজনৈতিক প্রস্তাব প্রকাশ থেকে কংগ্রেসে তা গ্রহণ - এই সমস্ত প্রক্রিয়াটাই হলো পার্টির অভ্যন্তরীণ গণতন্ত্রের অংশ।
রাজনৈতিক প্রস্তাবে আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি, জাতীয় পরিস্থিতি, পার্টি লাইন, বর্তমান পরিস্থিতিতে পার্টির কাজ প্রভৃতি বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ২০২১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর হায়দরাবাদে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে রাজনৈতিক প্রস্তাবটি গৃহীত হয়।
পার্টি লাইন
১) প্রায় আট বছরের বিজেপি সরকারের সময়কাল সাম্প্রদায়িকতা এবং করপোরেটের শক্তিশালী আঁতাতের স্বৈরাচারী আক্রমণকেই চিহ্নিত করছে। ২০১৯ সালে ফের ক্ষমতায় আসার পর থেকে ফ্যাসিস্তধর্মী আরএসএস’র হিন্দুরাষ্ট্রের অ্যাজেন্ডা আরও আগ্রাসীভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে। এরসাথে সমানভাবে যুক্ত হয়েছে নয়া-উদার নীতিসমূহের আগ্রাসী অনুসরণ এবং ক্রমবর্ধমানহারে স্বৈরাচারী শাসন। আরএসএস পরিচালিত হিন্দুরাষ্ট্রের এই অ্যাজেন্ডা সাংবিধানিক কাঠামোর মারাত্মক ক্ষয়সাধন এবং ভারত সাধারণতন্ত্রের ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক চরিত্রকে ধ্বংস করছে।
২) সেই কারণেই বিজেপি’কে বিচ্ছিন্ন ও পরাজিত করাই মূল কাজ। এর জন্য দরকার শক্তিশালী জঙ্গি-ধর্মী শ্রেণি ও গণসংগ্রামে জনগণকে সমবেত করতে সিপিআই(এম) ও বাম শক্তিসমূহের স্বাধীন শক্তির বিকাশ।
৩) হিন্দুত্ববাদী শক্তির কর্মসূচি এবং সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলির কাজকর্মের বিরুদ্ধে লড়াইকে এগিয়ে নিয়ে যেতেও পার্টি ও বাম শক্তিগুলি শক্তিশালী হওয়া জরুরি। হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তিকে বৃহৎভাবে সমবেত করতেও পার্টি অবশ্যই কাজ করবে।
৪) নয়া-উদার নীতিসমূহের আগ্রাসী অনুসরণ; জাতীয় সম্পদের বেপরোয়া লুট; বৃহদাকারে রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র, খনিজ সম্পদ এবং জন-উপযোগগুলির বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে জনগণের বিস্তৃত অংশকে সমবেত করতে পার্টি অবশ্যই সম্মুখসারিতে থাকবে। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনের মতো শ্রেণি ও গণ আন্দোলনকে তীব্র করার মধ্যদিয়ে করপোরেট-সাম্প্রদায়িকতাবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের সুবৃহৎ অংশকে সমবেত করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী শক্তিগুলির সমাবেশ করার কাজ পার্টি সম্পাদন করবে।
৫) হিন্দুত্ববাদী-করপোরেট শাসনের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সাফল্যের জন্য দরকার হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িক শক্তিগুলি এবং নয়া-উদার নীতিসমূহের বিরুদ্ধে যুগপৎ লড়াই।
৬) পার্টি সংসদে সম্মত ইস্যুগুলিতে ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলগুলির সাথে সহযোগিতা রক্ষা করে চলবে। সংসদের বাইরে সাম্প্রদায়িক নীতিসমূহের বিরুদ্ধে সমস্ত ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির সুবৃহৎ জমায়েত ঘটানোর লক্ষ্যে কাজ করবে। নয়া-উদারবাদের আঘাত, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক অধিকারগুলির বিরুদ্ধে স্বৈরাচারী আক্রমণ, দানবীয় আইনসমূহের দ্বারা বিরুদ্ধাচরণকে দমনপীড়নের বিরুদ্ধে পার্টি ও বাম শক্তিগুলি স্বাধীনভাবে এবং অন্যান্য গণতান্তিক শক্তিগুলির সাথে ইস্যুভত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে লড়াই চালাবে।
৭) শ্রেণি ও গণসংগঠনগুলির ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের জন্য গঠিত যৌথ সংগ্রামের মঞ্চগুলিকে পার্টি সমর্থন করবে। শ্রমিক-কৃষক-খেতমজুরদের ঐক্যবদ্ধ কর্মসূচিকে শক্তিশালী করবে এমন পদক্ষেপসমূহকে পার্টি সমর্থন জানাবে।
৮) বাম ঐক্যকে শক্তিশালী করার প্রচেষ্টা সহ পার্টির স্বাধীন শক্তির বিকাশকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। ঐক্যবদ্ধ বাম প্রচার আন্দোলন এবং সংগ্রামগুলিতে বুর্জোয়া ভূস্বামী শাসকশ্রেণির নীতিসমূহের বিকল্প নীতিসমূহকে অবশ্যই তুলে ধরতে হবে।
৯) গণসংগঠনগুলি এবং সামাজিক আন্দোলনগুলি সহ সমস্ত বাম ও গণতান্ত্রিক শক্তিগুলিকে সমবেত করতে পার্টি ধারাবাহিকভাবে কাজ করে যাবে। বাম ও গণতান্ত্রিক মঞ্চগুলির যৌথ সংগ্রাম ও আন্দোলনে বিকল্প নীতি হিসেবে বাম এবং গণতান্ত্রিক কর্মসূচিকে তুলে ধরতে হবে।
১০) উপরিউক্ত রাজনৈতিক লাইনের ভিত্তিতে সাধারণভাবে এবং নির্বাচনের সময়ে বিজেপি-বিরোধী ভোটকে সর্বোচ্চভাবে এক জায়গায় আনতে যথোপযুক্ত নির্বচনী কৌশল গ্রহণ করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতিতে কাজ
১) ধারাবাহিক শ্রেণি ও গণ সংগ্রামের মধ্যদিয়ে স্বাধীন ভূমিকার বিকাশ, প্রভাব ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতার সম্প্রসারণে পার্টি অগ্রাধিকার দেবে। জনগণের সমস্যা নিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে একটানা স্থানীয় সংগ্রামে পার্টিকে অবশ্যই বিশেষ নজর দিতে হবে।
২) সমস্ত অংশের জনগণ যারা নয়া-উদারবাদের তীব্র আর্থিক শোষণের শিকার তাদের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ করে সমবেত করতে হবে। সমস্ত স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামের বিকাশ এবং শক্তিশালী করতে সেই সংগ্রামগুলিতে পার্টি সক্রিয়ভাবে হস্তক্ষেপ করবে।
৩) হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে পার্টি সম্মুখসারিতে থাকবে। বিভিন্ন স্তরে ধারাবাহিকভাবে এই সংগ্রাম পরিচালনা করা হবে। হিন্দুত্ববাদী শক্তিগুলির কাজকর্মের মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট নাগরিকবৃন্দ, সংগঠনসমূহ ও সামাজিক আন্দোলনসমূহ সহ গণতান্ত্রিক শক্তিসমূহের সম্ভবপর সর্বোচ্চ ঐক্যবদ্ধ মিত্রতা গড়ে তুলতে হবে।
৪) স্বৈরাচারী পদক্ষেপসমূহের বিরোধিতায় পার্টিকে নেতৃত্বের ভূমিকা নিতে হবে এবং মানবাধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার, নাগরিক স্বাধীনতা, শিল্পীর স্বাধীনতা এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির স্বাধিকার রক্ষায়; হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদী কাজকর্ম এবং সাংবিধানিক বিধানের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক মর্মবস্তুর ধ্বংস সাধনের বিরুদ্ধে যৌথ সংগ্রাম গড়ে তুলতে সমস্ত গণতান্ত্রিক শক্তির সহযোগিতা চাওয়া হবে।
৫) সামাজিক ন্যায়ের জন্য সংগ্রামকে অগ্রসর করতে এবং মহিলা, দলিত ও আদিবাসীদের ইস্যুগুলির পক্ষে সংগ্রামের প্রচেষ্টাগুলিকে পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।
৬) হিন্দুত্ববাদী সাম্প্রদায়িকতাবাদের আগ্রাসী আক্রমণের বিরুদ্ধে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা এবং অধিকারের সুরক্ষাকে শক্তিশালী করতে হবে।
৭) ক্রমবর্ধমান সত্যানুসন্ধান বিরোধিতা, কুসংস্কার, যুক্তিহীনতা, অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মতাদর্শগত/সামাজিক সংগ্রামকে পার্টি শক্তিশালী করবে। জনজীবনে বৈজ্ঞানিক মানসিকতার বিকাশে এবং যুক্তিহীনতা ও ন্যায়হীনতার বিরুদ্ধে যুক্তিবোধ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার কাজকে পার্টি শক্তিশালী করবে।
৮) আমাদের জাতীয় ও অর্থনৈতিক সার্বভৌমত্ব রক্ষায় ভারতীয় জনগণের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সচেতনা বৃদ্ধির লক্ষ্যে পার্টি প্রচার আন্দোলন গড়ে তুলবে। প্রচারে পুঁজিবাদের একমাত্র প্রকৃত বিকল্প হিসেবে সমাজতন্ত্রকে তুলে ধরতে হবে।
৯) মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে মোদি সরকারের আত্মসমর্পণের বিরুদ্ধে জনমতকে পার্টি সংগঠিত করবে। ভারতের স্বাধীন বিদেশ নীতির পুনর্বহালের সংগ্রামকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে।
১০) কেরালার এলডিএফ সরকার রক্ষায় এবং পশ্চিমবঙ্গ ও ত্রিপুরায় ফ্যাসিস্তধর্মী আক্রমণের বিরুদ্ধে পার্টি লড়াই করবে।
উপসংহার
সারাদেশে শক্তিশালী কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলতে এই কাজগুলি সম্পাদন করা জরুরি। কলকাতা সাংগঠনিক প্লেনামের গৃহীত সিদ্ধান্তগুলির নিষ্ঠা সহকারে রূপায়ণের মধ্যদিয়েই একমাত্র সারাদেশে গণভিত্তিসম্পন্ন মার্কসবাদ-লেনিনবাদের ভিত্তিতে পার্টি গড়ে তোলা যাবে। বিশেষ করে জোর দিতে হবে -
১) জনগণের সঙ্গে বন্ধন শক্তিশালী করতে গণলাইন সম্পন্ন বিপ্লবী পার্টিকে শক্তিশালী করতে হবে।
২) জনগণের মধ্যে পার্টির পৌঁছানো এবং প্রভাব বিস্তৃত করতে হবে এবং বাম এবং গণতান্ত্রিক শক্তিগুলির সমাবেশ ঘটাতে হবে।
৩) কলকাতা প্লেনামের নির্দেশিত পথে গুণমানে উন্নত পার্টিসদস্য সহ পার্টি সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে।
৪) তরুণ এবং মহিলাদের পার্টির প্রতি আকৃষ্ঠ করার ওপর জোর দিতে হবে।
৫) মতাদর্শগত লড়াইকে শক্তিশালী করতে হবে।